পুরাণ, ইতিহাস আর স্বপ্নাদেশের মতো লোককাহিনির কত যেমালা গাঁথা রয়েছে আমাদের গ্রামবাংলায়, তার সীমা-পরিসীমা নেই। একটা সময় ছিল, যখন ধনী জমিদার কিংবা সম্পন্ন মানুষ, ডাকাত বা লুণ্ঠনকারী শত্রু-সৈন্যর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, মূল্যবান অলঙ্কার, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, ধাতুনির্মিত বাসনপত্র, এমনকি গৃহদেবতাকেও জলাশয়ের নীচে লুকিয়ে রেখে দিতেন। অষ্টধাতু-নির্মিত বা রত্নখচিত এমন নানা দেবদেবীর বিগ্রহ নানা জলাশয় থেকে পাওয়াও গেছে।
কিন্তু যে দেবীর কথা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরতে চলেছি, সেই দেবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভিন্ন কাহিনি। দেশে-বিদেশে দেবীপক্ষে মণ্ডপে মণ্ডপে যখন দুর্গাপ্রতিমা পূজিতা হন, তখন কিন্তু আর এক দুর্গাপ্রতিমা থাকেন জলের তলায়। তাঁর দর্শন মেলে না শারদোৎসবে, অকালবোধনের দিনগুলিতে।
দেবীমাহাত্ম্যের অন্তরালবর্তী পৌরাণিক কাহিনিতে দেখি, দেবী ভদ্রকালী এক রাতে স্বপ্নাদেশ দিলেন পুরাকালীন রাজা হরিদত্তকে, প্রতিদিন তাঁর নামে একটি নরবলি উৎসর্গ করা না হলে, তাঁর রাজ্য ধ্বংস হবে। ভয়ঙ্কর এমন আদেশের কথা শুনে প্রজারা প্রাণভয়ে সে রাজ্য ছেড়ে দেশান্তরি হল। এ দিকে প্রজাবৎসল হরিদত্ত পড়লেন উভয়সঙ্কটে— এক দিকে দেবীর আদেশ, অন্য দিকে তা পালন করতে গিয়ে রাজ্যকে প্রজাশূন্য হতে দেওয়া।
আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে প্রথম সাত দিন দেবীর সামনে বলি দিতে হল একে একে রাজার সাত সন্তানকে। বাকি ছিলেন রাজার পুরোহিত আর তাঁর একমাত্র পুত্র, কিন্তু সপ্তম দিনের সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সেই পুরোহিতও সপরিবার পালিয়ে গেলেন। দুর্যোগের সেই রাতে পথে এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, ঝড়জলের মধ্যে কেন তাঁদের ঘর ছেড়ে বেরোতে হল। পুরোহিত সজল চোখে তাঁকে সব কিছু জানালে, করুণা হল বৃদ্ধার। তিনি এ বার আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন, তিনিই দেবী মহামায়া। এর পর তিনি ব্রাহ্মণকে বললেন, অতি প্রিয় সাত সন্তানকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই রাজা তাঁর ভক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আর নরবলির দরকার নেই, পুরোহিত নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে রাজাকে দেবীর আদেশের কথা জানিয়ে দিতে পারেন।
দেবীর নির্দেশমতো পুরোহিত ঘরে ফিরে রাজাকে সব কথা জানালেন, মায়ের দয়াতেই রাজার সাত ছেলে আবার তাদের জীবন ফিরে পেল। রাজা মহামায়ার অভয়বাণীর কথা প্রচার করে দিতে প্রজারা সব রাজ্যে ফিরে এল। দেবীরই আদেশেই ভদ্রকালীর মূর্তির বদলে প্রতিষ্ঠিত হল দেবী দশভুজার মূর্তি। দেবীমূর্তির এই রূপান্তরের কাহিনি বর্ণিত আছে ক্রিয়াকাণ্ডবারিধিতে।
পরবর্তী কালে আবার সেই দেবীকেই পাওয়া গেল জলদুর্গা রূপে। সেখানেও এক কাহিনি। রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ অনুসারে, মহীরাবণ পৃথিবীজাত এক অসুর বা রাক্ষস। তাকে রাবণ লঙ্কায় এনে মন্দোদরীর হাতে প্রতিপালনের জন্য দেন। পরে রাবণ তাঁর পুত্র ইন্দ্রজিতের সহায়তায় পাতালরাজ বলিকে পরাজিত করে পাতালের কাঞ্চনা নগরী অধিকার করেন এবং মহীরাবণকে তার রাজা করেন। মহীরাবণ রাবণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে স্মরণ করলেই তিনি উপস্থিত হবেন। ভদ্রকালী বা দেবী মহামায়ার সেবক মহীরাবণ, রাবণেরই আদেশে রাম ও লক্ষ্মণকে বলি দেওয়ার পরিকল্পনা করে, ছলনা করে পাতালে নিয়ে যায়। পরে মহাবীর হনুমান, পাতালে গিয়ে মহীরাবণ বধ করে রাম-লক্ষ্মণকে উদ্ধার করেন। তখন তিনি পাতালবাসিনী ভদ্রকালীকেও মাথায় করে এনে তাঁকে ক্ষীরগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পণ্ডিত রঘুনন্দন গোস্বামীর লেখায় পাওয়া যায়, ‘পাতাল হইতে হনু গমন করিল/ ক্ষীরগ্রামে আসি তথাদেবীরে স্থাপিল॥’
ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম কারণ, এই সতীপীঠে দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন, ‘ক্ষীরগ্রামে ডানি পা’র অঙ্গুষ্ঠ বৈভব/ যুগাদ্যা দেবতা ক্ষীরখণ্ডক ভৈরব॥’ দেবী যোগাদ্যার ভৈরবের নাম ক্ষীরখণ্ডক। সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম ক্ষীরগ্রাম।
পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত শাক্তপীঠ এই ক্ষীরগ্রামেই প্রতিষ্ঠিত যোগাদ্যা দেবী নামে খ্যাত মা দুর্গার প্রস্তরবিগ্রহ। বর্ধমান স্টেশন থেকে কাটোয়াগামী ট্রেনে চেপে নামতে হয় কৈচর হল্ট স্টেশনে। সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পাওয়া যায় টোটো। তাতে করে যেতে হয় ক্ষীরগ্রাম। দেবী সারা বছরই থাকেন ক্ষীরদিঘির জলের তলায়। বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটি তারিখে গভীর রাতে দেবীর মূর্তিটি জল থেকে তুলে এনে অল্প সময়ের জন্য মন্দিরে রাখা হয়। একমাত্র বৈশাখী সংক্রান্তিতে দেবী সূর্যের মুখ দেখেন। সে দিন দেবীদর্শনের জন্য দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে সমবেত হন ক্ষীরগ্রামে।
দেবীপূজার অঙ্গ, একটি অনুষ্ঠান বেশ কৌতূহল জাগায়। মাঘ মাসের প্রতি নিশীথে দেবীর বৃত্তিধারী ঢাকী (যাঁরা সারা বছর মন্দিরে ঢাক বাজান) চোখে সাত ভাঁজ কাপড় বেঁধে এক পা মন্দিরের ভিতরে, অন্য পা বাইরে রেখে বিশেষ একটি তাল বাজাতে থাকেন। ‘নিশিধম্বল’ কিংবা ‘নিশিঢম্বল’ নামের এই অনুষ্ঠানটি কোনও কোনও আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতীতে প্রচলিত ছিল। মন্দিরের চত্বরে এই দিন ঢাকী ভিন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকতে পারেন না।
কথিত আছে, মহীরাবণের আরাধ্যা দেবী মহাকালী পরে মহিষমর্দিনীরূপে যোগাদ্যা হন। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে ক্ষীরগ্রাম-সহ বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদারি লাভের পর, আনুমানিক ১৯৩০ সালে যোগাদ্যা দেবীর মন্দির তৈরি করে দেন। কীর্তিচন্দ্র ছিলেন উগ্রক্ষত্রিয়। পরবর্তী কালে দেবীর প্রতি গভীর ভক্তি ও বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে রাঢ়ের উগ্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায় অধ্যুষিত বাঁকুড়া, হুগলি ও অন্যান্য জেলার গ্রামাঞ্চলেও। যে কোনও প্রাচীন পরিবারের সঙ্গে দেবীর নিত্যসেবা, পূজাবিধি ও আনুষ্ঠানিক আচারকে ঘিরেই ক্ষীরগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে।
এক কালে যোগাদ্যা দেবীর খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে নদিয়া, পাটুলি-সহ নানা জায়গার ভূস্বামীরা প্রতি বৈশাখী সংক্রান্তিতে ষোড়শোপচারে দেবীর যে পুজো ও বলিদানের ব্যবস্থা করতেন, তার কিছু আজও অবশিষ্ট আছে। কীর্তিচাঁদ-বংশের নামে এখনও দেবীপূজার সঙ্কল্প হয়।
ক্ষীরগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী যোগাদ্যা দেবীকে কেন্দ্র করে এক কালে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মিলন ঘটেছিল। একটি অনুষ্ঠান এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। অনুষ্ঠানটির নাম ‘গুয়া ডাকা’। প্রতি মাসের সংক্রান্তিতে ক্ষীরগ্রামের বিশিষ্ট মানুষ ও ভক্তরা দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হলে পান-সুপুরি দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানান মালাকার গোষ্ঠীর এক জন। প্রথমেই স্বাগত জানানো হয় ডোম সম্প্রদায়ের প্রাক্তন প্রধান ‘ফোপনা মশাই’-কে। পরে এরুয়ার, নাসিগ্রাম, কুসুমগ্রাম, কুড়মুন ও কালিগ্রামের উগ্রক্ষত্রিয় বা আগুরিদের উদ্দেশে গুয়া ডাকা হয়। শেষে মাঝিগ্রামের আগুরিদের প্রতি গুয়া ডাকার সময় ‘মাঝ’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র সজোরে ঢাক বাজিয়ে দেওয়া হয়, যাতে বাকি কথাগুলি কেউ শুনতে না পায়। এমন আচরণের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা কিছু আছে কি না, তা জানা না গেলেও প্রথাটি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
অনুমান করা যেতে পারে, অতীতে উগ্রক্ষত্রিয়রাই ওই অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী হিসেবে সমাজে সম্মান ও সম্ভ্রমের পরিসর অর্জন করেছিলেন। এঁরাই দেবী এবং দেবীর পরিজনদের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।
‘যোগাদ্যা’ নামটি প্রথম লক্ষিত হয় পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে সতীপীঠের সূত্রে। ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যা আসলে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের দেবী, পরে নাকি তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতে ব্রাহ্মণরা দেবীর দখল নিয়ে নেন। এই লোকশ্রুতি অনুসারেই বুঝি এখনও যোগাদ্যা দেবীর মহাপূজার আগের রাতে মূল মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয় ‘ডোম-চুয়ারি’ খেলা। এই খেলায় প্রথমে শূদ্র, পরে ক্ষত্রিয় এবং শেষে ডোম সম্প্রদায়ের মানুষরা ব্রাহ্মণদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেন। ব্রাহ্মণরা জয়ী হলে ডোমদের মধ্যে থেকে এক জন নিজের বুকে বেল-কাঁটা বিঁধিয়ে দেবীর উদ্দেশে শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত দিলে মহাপূজার প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া হয়।
১৫ বৈশাখ বিকেল থেকে উৎসব পর্যন্ত ঢাকের বদলে মন্দিরে মাদল বাজে। বৈশাখের ২৮ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত দেবীর ভোগ রান্না হয় না। কারণ, কথিত আছে, দেবীকে পাতাল থেকে মাথায় করে আনতে হনুমানের ওই ক’দিন সময় লেগেছিল। চৈত্র সংক্রান্তিতে হোমযজ্ঞ দিয়ে শুরু করে এক মাস ধরে চলে লগ্ন উৎসব, ক্ষীরকলস সিঞ্চন, ময়ূরনাচ, বীরদর্পে মাটি কাঁপানো, মালাকারের বিয়ে, উলগ পুজো, ডোম-চুয়ারি খেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠান। শেষে মহাপূজার দিন, গ্রামের সমৃদ্ধি হবে— এই বিশ্বাসে, পরম্পরা মেনে অতিথি সেবার রীতি এখনও বিদ্যমান। ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মায়ের মাসব্যাপী মেলায় ওই অঞ্চলের বত্রিশটি সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনোৎসব ভারী দৃষ্টিনন্দন।
বৈশাখী সংক্রান্তিতে মহাপূজার শেষে ভোররাতে দেবীর প্রস্তরমূর্তিটি জলাশয়ের গভীরে রেখে দেওয়া হয়। এর তিন দিন পরেই আবার সেটিকে তুলে এনে মন্দিরে বসিয়ে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান হয়।
বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ছাড়া দেবী জলের তলায় থাকলেও মন্দিরে তাঁর নিত্যপূজা হয়। যোগাদ্যা দেবীর নিত্যসেবায় কিন্তু আমিষ ভোগ দিতে হয়। আবার কালীপুজোর রাতে তাঁর মহাভোগই মা কালীকে নিবেদন করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হল, ক্ষীরগ্রামের সতীপীঠে কিন্তু কালীপ্রতিমা রাখা হয় না। অথচ ‘রত্নবেদী’-তে কালীর মন্ত্রেই দেবী যোগাদ্যার পুজো হয়। তন্ত্রচূড়ামণি মতে, যেখানে এই দেবী থাকেন, সেখানে আর কোনও দেবীমূর্তি রেখে তাঁর পুজো করা বিধেয় নয়। তাই সাধারণ দুর্গাপুজোর বিধিও এই গ্রামে নেই।
ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যার সঙ্গে গবেষকরা উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলায় পাওয়া গুহাচিত্রের মহিষাসুরমর্দিনীর বেশ কিছুটা মিল দেখে, এই দেবীমূর্তিটি সুপ্রাচীন মাতৃকাদেবীর সমকালীন বলে মনে করেন। মাতৃকা অর্থাৎ মা, এবং তিনিই বুঝি আদি মাতা, পৌরাণিক দেবী। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুসারে, রক্তবীজ ধংস করতেই দেবীর আবির্ভাব। পুরাণান্তরে, অন্ধকাসুর নিধনকালে শিবানুচরী বেশে দেবী মাতৃকার আবির্ভাব। এই মাতৃকার সংখ্যা আবার পুরাণভেদে শতাধিক। চৌষট্টি যোগিনীর মধ্যেও মাতৃকার নামগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সময়কালের মাতৃকাদেবীর বেশ কয়েকটি মূর্তি উদ্ধার করা গিয়েছিল। দেবীর প্রস্তরমূর্তির প্রথম সন্ধান মিলেছিল উত্তরপ্রদেশে, পরে অখণ্ড ভারতবর্ষের নানা জনপদে এমনই মূর্তির দেখা মেলে। তবে জলদুর্গারূপে দেবীর অধিষ্ঠান বাংলার এই ক্ষীরগ্রাম ছাড়া অন্যত্র বুঝি বিরল। ক্ষীরগ্রামে বর্তমানে পূজিত শিল্পসুষমামণ্ডিত দেবীপ্রতিমাটি দাঁইহাটের বিখ্যাত শিল্পী নবীন ভাস্করের তৈরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy