Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Mirza Ghalib

‘এই বিপন্ন সময়েও আত্মজীবনী লিখে চলেছেন মির্জা গালিব’

সিপাহি বিদ্রোহ শেষ। বিধ্বস্ত দিল্লি। এক দিকে প্রতিশোধলিপ্সু ব্রিটিশ সেনা, অন্য দিকে শহর জুড়ে মহামারি। পথে ঘাটে, যমুনা নদীতে অজস্র বেওয়ারিশ লাশ। এই বিপন্ন সময়েও আত্মজীবনী লিখে চলেছেন মির্জা গালিব। অগ্নি রায় সিপাহি বিদ্রোহ শেষ। বিধ্বস্ত দিল্লি। এক দিকে প্রতিশোধলিপ্সু ব্রিটিশ সেনা, অন্য দিকে শহর জুড়ে মহামারি। পথে ঘাটে, যমুনা নদীতে অজস্র বেওয়ারিশ লাশ। এই বিপন্ন সময়েও আত্মজীবনী লিখে চলেছেন মির্জা গালিব।

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২০ ০০:২৪
Share: Save:

এক

রঁগো মে দৌড়নে ফিরনে কে হাম নঁহী কায়েল

যব আঁখি সে নহ্ টপকা তো ফির লহু ক্যা হ্যায় ?

কোথায় সেই রক্তবর্ণ প্রাচীর, যা মমতায় ঘিরে রাখত শহরকে? কোথায় সেই চাঁদে পাওয়া জামা মসজিদ, যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে প্রজাপতির মতো উড়ত হাজার গজলের পঙ্‌ক্তি? যমুনার পাড়ে আকাশের দিকে মুখ তোলা সেই সব মিনার? নৌকোয় ভেসে যাওয়া আনন্দনগরীর সুবাতাস? জোছনার শরাবে মাত হয়ে থাকা দিল্লি?

বাল্লিমারান-এর গলির শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে এখন ভেসে আসে হত্যার তাণ্ডবনাদ শুধু। কাশ্মীরি গেটের কাছে ব্রিটিশ রেসিডেন্টের বিশাল আবাস, এখন যুদ্ধঘাঁটি। প্রখর সূর্য ফোস্কা ফেলছে দিল্লির এমনিতেই পুড়ে যাওয়া ত্বকে। পেটের অসুখ আর ম্যালেরিয়া ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে মহামারির আকার নিয়েছে প্রায়। মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিদিন। ঘরে ঘরে মৃত্যুর ছোবল। ব্রিটিশরা একের পর এক যুদ্ধ জিততে শুরু করেছে। সিপাহিদের পতন অদৃশ্য কালিতে লেখা হয়ে গিয়েছে লাল কেল্লার ওই দেওয়ালে।

প্রস্তরবৎ মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব। দোয়াতে কলম চুবিয়ে হলদেটে কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছেন মাঝে মধ্যে। আসলে ঠিক আঁকিবুঁকিও নয়। কয়েকটি বাক্য বার বার লিখছেন আর কেটে দিচ্ছেন। ‘আমার শহরের নাম দিল্লি। আমার মহল্লার নাম বাল্লিমারান…’ ব্যস, আর এগোচ্ছে না কলম। কেটে দিচ্ছেন, কালি উপচে পড়ছে। পাতাটির চেহারাও যেন হয়ে উঠছে আজকের দিনের দিল্লির মতো— ভাবলেন গালিব। এখানে এক ধ্বংসযজ্ঞ, মহামারি চলছে— যে গোলকধাঁধায় প্রবেশ আছে, কিন্তু নির্গমনের পথ নেই। সমস্ত মুশায়রা আজ যেন মৃত।

রুখু বাতাসে মিশে যায় গালিবের প্রশ্বাস। কলম চলতে থাকে…..

দুই

নহ গিলে নাগমা হু নহ পরদাএশাজ

ম্যয় হু অপনি শিকসত কী আওয়াজ

‘মৃত্যুর শহর। প্রিয় দিল্লি হে আমার, তুমি এখন শুধুই মৃত্যুর শহর।’

নিজের মনে বিড়বিড় করছেন গালিব। উমরাও বেগম রাগ করে উঠে চলে গিয়েছেন কিছু ক্ষণ আগে। ঘরে পিন পতনের নীরবতা। একটা টিকটিকি বা পতঙ্গেরও দেখা নেই। বাইরে থেকে নৈমিত্তিক কাকের ডাকও তো ভেসে আসছে না। দিল্লির অনেক মানুষের মতো ওরাও কি তা হলে পালাল শহর ছেড়ে? বিড়বিড় করতে করতে টেবিলে এসে ঝুঁকে বসলেন গালিব। দাস্তাম্বু অর্থাৎ দিনলিপি লিখছিলেন যে খাতায়, সেটি টেনে নিলেন। সাদা পৃষ্ঠায় কালির আঁচড় পড়তে থাকল, যেন তাঁর ভিতরের বেড়ে যাওয়া ধুকপুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই।

হিন্দন নদীর ধারে ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে সিপাহিদের লড়াই ক্রমশ রক্তাক্ত হচ্ছে। কয়েকদিন আগেই ঘোড়সওয়ার ব্রিটিশ সেনারা দিল্লির একাংশ তছনছ করে দিয়েছে। নৌকো জোড়া লাগিয়ে যমুনার উপর সেতু গড়েছে। বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের প্রিয় নদী, নিভৃত কক্ষে বসে তিনি যার শোভা দেখতেন, তা এখন শোণিতে লাল হওয়ার অপেক্ষায়।

দরজায় করাঘাত শুনে উঠলেন গালিব। তাঁর পরম সুহৃদ হাকিম আহসানউল্লা উদ্‌ভ্রান্ত, আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে। তিনি বাদশার চিকিৎসকও বটে। একটু দম নিয়ে হাকিম জানালেন, বাদশাই দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন তাঁকে। গালিবের হাল-হকিকত জানতে। মেরঠ থেকে আসা ব্রিটিশ সেনারা কেল্লার কাছে পৌঁছেছে। শোনা যাচ্ছে, পথে-ঘাটে মুসলমান দেখলেই কচুকাটা করছে। বাদশা বলেছেন, গালিব যেন খুব সাবধানে থাকেন। রাতে তো নয়ই, দিনমানেও যেন নিজের গলি থেকে বেরিয়ে জামা মসজিদ, চাঁদনি চৌকের দিকে না যান। বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর প্রিয় কবির জীবন নিয়ে সবিশেষ চিন্তিত।

হা আল্লা! গালিব ভাবেন, এই মারণসময়ে স্বয়ং বাদশার জীবন কে রক্ষা করবে? কে বাঁচাবে তাঁর সাধের দিল্লিকে? আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পায়ে ফিরে যান হাকিম আহসানউল্লা। দরজার ফাঁক দিয়ে হট্টগোল, মারণচিৎকার, হত্যাযজ্ঞের কিছু শব্দ কানে আসে। না কি তা মনের ভুল? এই মহল্লায় তো এখনও গড়িয়ে আসেনি হিংসা। তিনি যা দেখছেন তা কি বাস্তবের দিল্লি, না কি এ সব তাঁর সদা আতঙ্কিত মনের বিকারগ্রস্ত ভ্রম? ফের এসে বসেন গালিব। তবে এ বার আর কলম স্পর্শ করেন না। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন চেয়ারে। প্রস্তরবৎ।

হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকেন উমরাও বেগম। আতঙ্কে তাঁরও চেহারা বদলে গিয়েছে। চোখের দৃষ্টি অচেনা। গালিব জানেন, ত্রাস তাঁর কণ্ঠস্বরও কী ভাবে বদলে দেয়। উমরাও কিছুটা বেখাপ্পা ভাবেই ঘরের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন, “আল্লা মেহেরবান!” পরিবেশ কিছুটা লঘু করার জন্যই গালিব বলেন, “বিবি, চিন্তা কোরো না। আমি খাঁটি মুসলমান তো নই! ব্রিটিশরা সেটা বুঝবে। অর্ধেক মুসলমানকে তারা মারবে না।” উমরাওকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে গালিব বলেন, “আমি মদ্য পান করি ঠিকই, কিন্তু শূকরের মাংস তো ছুঁই না!”

“হায় আল্লা! এমন কথা কি কোনও খাঁটি মুসলমান বলতে পারে?”

“না বিবি, পারে না। আর সে কারণেই তো বললাম আমি নিরাপদ! যাও তুমি, এ সব বাজে চিন্তা না করে গোস্ত আর মোগলাই পরোটা বানিয়ে

নিয়ে এসো। আর কাল্লু মিঞাকে দেখতে পেলে পাঠিয়ে দাও।”

উমরাও চলে গেলে জানলার সামনে এসে দাঁড়ান গালিব। নৌকার বানানো সেতু পেরিয়ে অশ্বারোহীরা দরিয়াগঞ্জের কাছে রাজঘাটের পথে শহরে ঢুকেছে। অন্য দিকে কিছুটা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে, কিছুটা সিপাহিদের ভয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কতিপয় দিল্লিবাসীও। বাদশার সেনাদের একটা অংশও রয়েছে তাদের সঙ্গে।

দেওয়াল টপকে গালিবের বাড়ি ঢোকে শাহজাদা চিশতি। বাদশাহের দরবারে সে চাকরি করে। হাঁপাতে হাঁপাতে খবর দেয়, তাদের প্রিয় ডাক্তার চমন লালু সিপাহিদের হাতে মারা গিয়েছে। খ্রিস্টান ধর্ম নেওয়ার কারণে এই প্রথম বলি। অস্থির গালিব কাল্লু মিঞাকে ডেকে পাঠান। ঘরে তাঁর মদের সঞ্চয় প্রায় শেষ। কাল্লুকে বলেন, পরিস্থিতি বুঝে রাতে গা ঢাকা দিয়ে মহেশ দাসের কাছে যেতে। শস্তায় যদি দিশি শরাব মেলে।

তিন

পিলা দে ওকসে সাকী, জো হমসে নফরৎ হ্যায়

পেয়ালা গর নহীঁ দেতা নহ্ দে শরাব তো দে

অথচ দিশি মদে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারতেন না গালিব। বিলেত থেকে ‘পুরনো টম’ নামের আগুন আসত, যার দাম প্রতি ডজন চব্বিশ তঙ্কা। সিপাহি বিদ্রোহের আগুনে সেই তরল আগুনের দাম লাফ দিয়ে বাড়ল অনেকটাই। ষাট তঙ্কা প্রতি ডজন। এক চিঠিতে গালিব লিখলেন, ‘অনেকদিনের অভ্যেস, রাতে ফরাসি ছাড়া কিছুই চলে না। ঘুম আসতে চায় না। যদি সাহসি ও দিলদরিয়া মহেশ দাস এই বিপদে ফরাসিরঙের দিশি মদ না পাঠাত, তা হলে বাঁচা-ই বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াত এই বিপদের দিনে।’

বিদ্রোহের আগুনে দিল্লির স্বাভাবিক সওদাগরি, দোকানপাট, বেচা কেনা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। জোড়াতালি দিয়ে ডাল-রুটি আর গোস্তের ব্যবস্থা করতেই প্রাণ যায়। কিন্তু মদ ছাড়া কেমন করে কাটাবেন গালিব দিনের পর দিন? পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, কেউ কি তা জানে? আর এই মদের কারণেই মহাজনেরা তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ পর্যন্ত করেছে। যদিও রামপুর লোহারু থেকে তিনি নিয়মিত ওয়াজিফা (বৃত্তি) পেতেন এক সময়, কিন্তু ওই মদের কারণেই তাঁর জেব প্রায়শই থাকত ইঁদুর বাদে ফাঁকা! সিপাহি বিদ্রোহের বহু বছর আগেই নাকি তাঁর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল, চল্লিশ হাজার টাকা। ম্যাকফারসন সাহেব, যাঁর কাছ থেকে গালিব মদ নিতেন, মামলা করে জিতে যান। ফলে গালিব হাজতে। নবাব আমনুদ্দীন সে যাত্রা চারশো টাকা জামিনে তাঁকে ছাড়িয়েছিলেন। হাজত থেকে বেরিয়ে গালিব কোরবান আলি সালিফকে লিখলেন বিষাদমধুর অপূর্ব চিঠি—

‘‘এখানে ভগবানের থেকেও আর কোনও আশা নেই তো মানুষ। নিজেই যখন নিজের দর্শক হয়ে গিয়েছি। দুঃখ আর অপমানে খুশি হই। নিজেকে পর ভেবে নিয়েছি। দুঃখ হলে বলি নাও গালিব, আর একটা জুতো পড়ল!’’

অর্থের একটা টানাটানি লেগে থাকতই। তবুও হাসি-আনন্দ-অপমান-দুঃখ মেলানো মেশানো হুরি-পরিদের মতো দিন ছিল সে সব। আর ছিল বসন্তের হাওয়ার মতো উড়িয়ে নেওয়া রাত। সুর্মা আর আতরের গন্ধবিধুর মহল্লা থেকে ভেসে আসত এস্রাজের ধ্বনি, গজলের গুঞ্জন। দরবারির আলাপে ভোর হয়ে যেত আসর। মুশায়রায় জমে উঠত

কবির লড়াই।

তৃষ্ণার্ত গলা-ঠোঁট-বুক ভিজিয়ে নেন গালিব তরল আগুন— ‘সাকী গরী কী শরম করো আজ বরনা হাম / হর সব পিয়া হিঁ করতে হেঁ ম্যাঁয় জিস কদর মিলেঁ।’ কাল্লু মিঞা তাঁর দীর্ঘ দিনের সুখদুঃখের সাকী, পাশে বসে ঢেলে দেয় সুরা।

“তুমি কী স্বপ্ন দেখো কাল্লু মিঞা?”

“এই তো হুজুর দু’দিন আগেই দেখলাম, আমি যেন খুব ছোট। বাপ-মায়ের সঙ্গে যমুনা নদীর উপর দিয়ে যাচ্ছি একটা খুবসরত বজরায় চড়ে। নিজেকে মনে হচ্ছিল বাদশাহ। মোহরের থলি দিয়ে গোটা নদীটা কিনে নিতে পারি”— স্বপ্ন-জড়ানো গলায় বলে কাল্লু।

ঝুম হয়ে বসে থাকেন গালিব। ওই যমুনার কালো জল এসে ভিজিয়ে দেয় তাঁর পোশাক ও পদতল। শরীর জুড়ে খেলা করে ভালবাসার নদী। দিশি শরাব আস্তে আস্তে দখল নেয় স্নায়ুর। শৈশবের স্বপ্ন দেখবে বলে এই অস্থির সময়ে ফের ঘুমিয়ে পড়েছে কাল্লু মিঞা। পায়ে পায়ে বাল্লিমারানের গলিতে এসে দাঁড়ান গালিব। এই মহল্লাটি এখনও পাটিয়ালার মহারাজের অধীনে। গা ছমছমিয়ে ওঠে তাঁর বাইরে এসে। চর্তুদিকে কেমন আঁশটে গন্ধ যেন। অথচ এই শহরটিই তাঁর কবিতার প্রাণ। আজ যেন প্রাণহীন খন্ডহর। আর বেশি না ভেবে হাঁটতে শুরু করেন গালিব। ধীরে ধীরে গতি বাড়ে তাঁর। কিছুটা নেশার কারণে, কিছুটা উৎকণ্ঠায়।

চার

নহি গিলে নাগমা হুঁ নহ পরদাএশাজ

ম্যয় হুঁ অপনি শিকসত কি আওয়াজ

অনেক বার কড়া নাড়ার পর চাঁদনি মহল্লায় মিত্র মেহমুদ খান দরজা ফাঁক করেন। এই অবেলায় সুরামত্ত গালিবকে দেখে খুব খুশি তিনি হননি। তবুও কিছু কিছু খবর কানে আসে। শোনেন, কী ভাবে সিপাহিরা ঘোড়ার চাবুক কষে লালকেল্লার ভিতরে দিওয়ানি খাসের বাগানে গিয়ে উত্তেজিত এক সমাবেশ করেছিল। বাদশাহের দোয়া দাবি করে সাফল্যের জন্য। তরোয়াল উঁচিয়েই তারা সমর্থন আদায় করে নেয়। শোনেন, কী ভাবে সিপাহিদের ঘোড়াগুলো তছনছ করেছে বাগানের ঘাস-লতা-ফুল। লুঠপাট করেছে অলঙ্কার, হরণ করেছে অল্পবয়সি নারীদের— এমন কথাও ভেসে বেড়াচ্ছে শহরের বাতাসে।

জোর কদমে হাঁটেন গালিব। রাস্তায় মানুষের লাশ পড়ে আছে। সিপাহিদের, স্থানীয় মুসলমানদের, ইংরেজ রমণীদেরও। আর এক ইয়ার দোস্ত হুসেন আলির ঘর অন্ধকার দেখে ঢুকে পড়েন ভিতরে। আর তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে ওঠেন। মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে তাঁর বহু কালের বন্ধু। খোলা মুখ হাঁ করা। চার পাশে কিছু মাছি ভনভন করছে, আর কেউ নেই কোথাও। অথচ এই হুসেন আলির ঘরে কালকেও ছিল পাঁচ পাঁচ জন ফুটফুটে মেয়ে। দৌড়ে বেরিয়ে আসেন গালিব, ছুটতে থাকেন। যেন নিজের কাছ থেকে, তাঁর প্রিয় শহরের থেকেও। অনেক ক্ষণ বাড়ি না ফেরায় উমরাও বেগম বাইরে এসে দেখেন বাড়ির রোয়াকে হেলান দিয়ে বসে আছেন গালিব। চোখ বোজা। ওই ভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। শ্রান্তিতে মাথা নুয়ে এসেছে।

নিঃসাড় এক ঘুমে গোটা রাত কাটার পর ভোরবেলা তাঁর ভাই মির্জা ইউসুফের দারোয়ান আসে মৃত্যু সংবাদ নিয়ে। তাঁর চেয়ে দু’বছরের ছোট ভাই। পাখির ডিম খোঁজা, সাঁতার দেওয়া, ঘুড়ি ওড়ানোর আবাল্যসঙ্গী। মাথা প্রকৃতিস্থ ছিল না বলে স্নেহ হয়তো একটু বেশিই ছিল ওর প্রতি গালিবের। শহরে ছড়িয়ে যাওয়া মহামারির প্রকোপেই সম্ভবত পাঁচ দিন জ্বরে বেহুঁশ ছিলেন ইউসুফ। কাউকে খবর দেওয়াও সম্ভব হয়নি এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। দারোয়ান জানায়, দাওয়া কিনতেও বেরোতে পারেনি সে, খবর দিতে আসা দূরস্থান।

শোকের অবকাশ নেই গালিবের। এখন কবরস্থানে খোঁড়ার লোক নেই। পালকি চলছে না শহরে। কাফনের কাপড় নেই। চার জন মুসলমান এক সঙ্গে হাঁটতেও পারবে না প্রাণের ভয়ে। গভীর রাতে বাড়ির বিছানার চাদরে মুড়ে দাফনের কাপড় করা হল। দু’-এক জন সহৃদয় প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির কাছের মসজিদের অন্ধকারে দাফন করে ফিরে এসে ভেঙে পড়লেন গালিব। পর পর সাতটি সন্তানের মৃত্যুশোকের উপর এত দিনের চাপা দেওয়া পাথর যেন সরে গেল। তবে কান্না নয়, চিৎকার করে নিজের পুরনো শের বলতে থাকেন তিনি— ‘‘লাজিম থা কে দেখো মেরা রাস্তা কোয়ী দিন অওর / তনহা গ্যায়ে হো অব রহো তনহা কোয়ী

দিন অওর…’’

পাঁচ

কহুঁ কিসসে ম্যায় কে ক্যা হ্যায় সবে

গম বুরী বলা হ্যায়

মুঝে ক্যা বুরা থা মরনা অগর একবার হোতা

শরীরের গাছ থেকে পাতা ঝরার শব্দ পান গালিব। নিজের হাতের তালুতে দেখতে পান বয়সের আঁকিবুঁকি বাড়ছে। বাজার অগ্নিমূল্য। গত দু’বছরে শহর বার বার আক্রান্ত হল। সিপাহি বিদ্রোহ, ইংরেজদের পুর্নদখল, কলেরা, অজানা জ্বর, দুর্ভিক্ষ। নিজের জরাজীর্ণ হয়ে আসা ঘরে বসে প্রিয় সখা, প্রিয় কবি, দিল্লীশ্বর বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গে নিজের মনেই কথা বলেন বিড়বিড় করে। এ জন্মে আর বোধহয় তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না গালিবের। লালকেল্লায় নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে তাঁকে এখন চলে যেতে হয়েছে রেঙ্গুনের এক খুপরি কক্ষে। শুনেছেন, বাদশার কোনও কলম নেই, দোয়াতভরা কালি নেই। এ-ও কানে এসেছে, তিনি এখন কাঠকয়লা দিয়ে দেওয়ালে লেখেন তাঁর বিষণ্ণ শেরগুলি। কোন দিন হয়তো তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে।

গজল নিয়ে দুই কবির যে ছিল কত খুনসুটি! কেউ কারও শ্রেষ্ঠত্ব সহজে মানতে চাইতেন না, চলত ছদ্মঝগড়া! আবার এই বাদশাই তো যখন তখন তাঁকে ডেকে পাঠাতেন। তাঁর লেখা গজলকে একটু মেজেঘষে দিতে। আবার কখনও বা সকালে দরবার সেরে বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হত। নির্দেশ থাকত, যত ক্ষণ না গালিব পৌঁছাচ্ছেন, আকাশে উড়বে না চাঁদিয়াল।

চিন্তার বুদ্বুদ ফেটে যায় মুহুর্মুহু কামানের আওয়াজে। দিল্লিতে চলছে বিজয়োল্লাস। খবর পান বিদ্রোহীদের অবরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে লখনউ দখল করে নিয়েছে ব্রিটিশ সেনা। প্রায় এক মাস যুদ্ধের পর। আর দিল্লির জামা মসজিদের চার পাশ দোকান, উদ্যান, বৃক্ষ সব উড়িয়ে গিয়ে নেড়া করে দেওয়া হয়েছে জায়গাটি। শহর জুড়ে শুধু কোদালের শব্দ। এই শহরে নাকি উন্নয়ন হবে। নতুন করে গড়া হবে দিল্লি। না কি উন্নয়নের নামে ধুলোয় মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে সাবেক ইতিহাস? কুয়ো সংস্কারের জন্য জল নেই। ছোট বড় বাজার ধূলিসাৎ। বন্ধুদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি এখন খন্ডহরবৎ। মড়কে আক্রান্ত মুশায়রাগুলি।

তাঁর শিষ্যপম কবি মির মেহেদি মজরুকে শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে আলওয়ার। তাঁকে গালিব লেখেন, ‘‘কী বা আর বলার আছে তোমায়। দিল্লির সেই পাঁচটি চিহ্ন আজ কোথায়? কেল্লা, চাঁদনি চৌক, গিরিন্দা বাজার, জামা মসজিদ, প্রতি সপ্তাহে যমুনার ধারে ফুলওয়ালাদের মেলা। এগুলিই যখন আর নেই তখন কোথায় রয়েছে শহর বলো?’’

কাশিম-জান গলি খয়রাতির ফাটক ফাতাউল্লা বেগের ফাটক পর্যন্ত এক মহাকায় শকুন এসে ডানা মেলে বসে। তার ডানায় ভর করে অন্ধকার নামতে থাকে দিল্লি শহরে।

তথ্যসূত্র: গালিবের গজল থেকে (আবু সঈদ আইয়ুব), যমুনা নদীর মুশায়রা (সেলিনা হোসেন), মির্জা গালিব, আ বায়োগ্রাফিকাল সিনারিও (গুলজার), গালিবের কবিতা (অনুবাদ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আয়ান রশীদ) এম্পায়ার অব দ্য মুঘল— ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার (আলেক্স রাদারফোর্ড)

অন্য বিষয়গুলি:

Mirza Ghalib Mirza Ghalib Autobiography Malaria Epidemic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy