Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ছবির আকাশে ছাত্রদের অবাধে উড়তে শেখাতেন তিনি। আদ্যন্ত ভারতীয় স্টাইলে এঁকেছিলেন একের পর এক মাস্টারপিস।
Abanindranath Tagore

ধ্যানে নয়, চোখ খুলে দেখতে শেখো

সেখানেই যোগী আর শিল্পীর তফাত। বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখা গল্পও ছবির মতো জীবন্ত। আগামী শনিবার তাঁর ১৫০ বছর পূর্তি।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২১ ১০:২২
Share: Save:

একটি ছবি মাস্টারমশাইকে দেখাতে এনেছে ছাত্রটি। দেবী উমা। ছবি জুড়ে একটু-একটু গেরুয়া রঙের আভাস। তা দেখে মাস্টারমশাইয়ের পরামর্শ, ‘ছবিতে একটু রঙ দিলে না?... উমাকে একটু সাজিয়ে দাও। কপালে একটু চন্দন-টন্দন পরাও, অন্তত একটি জবাফুল।’ ছাত্র ফিরে গেল। কিন্তু শিক্ষকের রাতভর ঘুম আসে না। ভাবেন, প্রিয় ছাত্রটি হয়তো তপস্বিনী উমার পাথরের মতো দৃঢ়, রংহীন এক রূপই দেখেছিলেন। রংহীন সে রূপে কেন থাকবে চন্দন, ফুল!

পুব আকাশে আলো ফুটতেই শিক্ষক মোটর নিয়ে ছোটেন ছাত্রের কাছে। শঙ্কা, রাতেই বুঝি ছবিতে রং চাপিয়ে ফেলেছে ছাত্রটি। তবে তখন ছাত্রটি প্যালেটে রং গুলে ভাবনাচিন্তা করছে। আচম্বিতে শিক্ষকের কড়া নাড়া। বললেন, ‘থামো থামো, কি ভুলই আমি করতে যাচ্ছিলুম, তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না।’— ছবিটি ‘উমার তপস্যা’। ছাত্র, নন্দলাল বসু। শিক্ষক, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অবনীন্দ্রনাথ এমনই। কল্পনার আকাশে হংসবলাকার মতো তাঁর ওড়াউড়ি। নিজে ওড়েন, অন্যকেও উড়তে শেখান, তবে তা তাদের মতো করে— সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অসিতকুমার হালদার, শৈলেন্দ্রনাথ দে, মুকুল দে, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী... সেই আকাশের এক-একটি উজ্জ্বল দিগন্তের নাম।

তবে ওড়া শেখানোর আগে শিক্ষক পরখ করে নেন, শিক্ষার্থীর মনে আদৌ রঙের ছোঁয়া আছে কি না। নন্দলালকে যেমন পরখ করেন গণেশের ছবি আঁকতে বলে। আবার এক শিল্পী যখন নাড়া বাঁধতে এসে দুর্গার ছবি মেলে ধরেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী ভাবে আঁকলে?’ শিক্ষার্থীর উত্তর, ‘ধ্যানে ব’সে একটা রূপ ঠিক ক’রে নিয়েছিলুম।’
শুনে মাস্টারমশাইয়ের জবাব: ‘ধ্যানে দেখলে চলবে না, চোখ খুলে দেখতে শেখো, তবেই ছবি আঁকতে পারবে। যোগীর আর শিল্পীর ধ্যানে এইখানে তফাৎ।’

শিল্পগুরু: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (মূল ছবি)। ঘড়ির কাঁটার চলনের দিকে, তাঁর আঁকা বিখ্যাত চিত্রগুলি— ফাল্গুনীতে রবীন্দ্রনাথ, ভারতমাতা এবং দীপদাত্রী।

শিল্পগুরু: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (মূল ছবি)। ঘড়ির কাঁটার চলনের দিকে, তাঁর আঁকা বিখ্যাত চিত্রগুলি— ফাল্গুনীতে রবীন্দ্রনাথ, ভারতমাতা এবং দীপদাত্রী।

লাল মাছ, পাখির খাঁচা

এই তফাতটা আসলে ছোট থেকেই অবন বুঝতে পারেন, নিছক ছেলেবেলার দুষ্টুমিতে আর চারপাশটা নিংড়ে দেখার মধ্যে। তাঁর জন্ম, ১৮৭১-এর ৭ অগস্ট, বাংলা ১২৭৮-এর ২৩ শ্রাবণ, জন্মাষ্টমীর দিন, বেলা ১২টা ১১ মিনিটে। বাবা, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা, সৌদামিনী দেবী।

অবন বা ছোটপিসিমার ‘অবা’ তখন একরত্তি। তার দায়িত্ব আঁধার-কালো পদ্মদাসীর। বৃদ্ধাবস্থাতেও অবনের স্মৃতি জুড়ে এই মানবী। তেতলার উত্তর-পূর্ব কোণের ছোট্ট ঘরে রাত নামে। দেখেন, অদূরে পিদিমের আলোয় রুপোর ঝিনুক আর বাটি নিয়ে দুধ জুড়োচ্ছেন তিনি। দুধ জুড়োনোর ছন্দে হাত ওঠে-নামে। শিশুমনে নাড়া দেয়, দুধের ধারা পড়ার শব্দ। দুধ খাওয়া সারা হলে, আঁধারের মধ্যে যেন মিশে থাকেন পদ্মদাসী। তাঁর স্পর্শে, ছড়ায়, দত্যি-দানোর গল্পে ঘুম নামে একরত্তি ছেলেটার চোখে।

কিন্তু সকাল হলেই ফের দুষ্টুমি। পদ্মদাসী চিৎকার জোড়েন, ‘ছেলে কোথা গো...’ লাল শালুর লেপ, তার গায়ে লেপ্টে থাকা পাতলা ওয়াড়। তার ভিতরে ছেলে তখন ঘুমে কাদা। বেশ কাটে দিনগুলো। এক দিন কী হল, ছেলে মানুষ করার বকশিস ‘সোনার বিছেহার’ আর এক ফর্সা দাসীর সঙ্গে অশান্তির খেসারত হিসেবে কপালে ‘রক্তের টিপ’ পরে চলে যান পদ্মদাসী। ছেলেটার মন কেমন করে। ভাবে, ওই বুঝি এল... দেশ থেকে খেলনা নিয়ে।

‘বোম্বেটে’ ছেলের খেলার উপকরণ অবশ্যি বড় কম নয়। দোতলার বারান্দায় জল-ভর্তি টবে খেলা করে লাল মাছের দল। ছেলেটি ভাবে, লাল মাছ তো লাল জলেই থাকা উচিত। অমনি তাতে লাল রং গুলে দেয় সে! রং দেখলেই কি ছেলেটার মন কেমন করে? বাবামশাইয়ের পাখির ভারী শখ... লাল, নীল নানা রঙের পাখি। তাদের খাঁচা তৈরির জন্য আসে চিনে-মিস্ত্রিরা। খাঁচা তো নয়, যেন প্যাগোডা! কী মনে হল, এক দিন দুপুরে মিস্ত্রিরা খেতে গেলে হাতুড়ি, বাটালি হাতে কাঠে ঘা দিতে গেল অবন। ফল, বাটালির খোঁচায় বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ডগা কেটে রক্তারক্তি!

একটু বড় হলে রামলাল নামে এক জনের তত্ত্বাবধানে এল অবন। ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাওয়া শেখা আর ‘ইয়েস, নো, বেরি ওয়েল, টেক্ না টেক্’— এমন ইংরেজির তালিম ওঁর কাছেই। এই রামলালের সঙ্গেই এক দিন অলিগলি পেরিয়ে, দালানের ইতিউতি দেখতে-দেখতে অবন ঠাকুরঘরে। চটি খুলে নেন রামলাল। ধুপ-ধুনোর গন্ধ-ধোঁয়ায় মিলমিশ ঠাকুরঘর। দেওয়ালে সাদা পঙ্খের প্রলেপ, মুছে যাওয়া বসুধারার ছোপ, সিঁদুর মাখানো ঘট... এ সবই যেন দেখে সে। মাঝে কে যেন মেঝেয় বড় করে লিখে দিলেন ‘ক’। খড়ি হাতে ধরে তার উপরেই দাগা বুলোনো, হাতেখড়ি।

বিদ্যাশিক্ষার তালিমের আয়োজনও হল বেশ। ভর্তি হওয়া নর্মাল স্কুলে। কিন্তু ওই ‘রবিকা’র মতোই ইস্কুল ভাল লাগে না। বরং আগ্রহ, সামনের এক বাড়ির বাগানের ভালুকটার দিকে। ও ব্যাটা কেমন করে দাঁড়ায়, চলে-ফেরে, শুয়ে থাকে— এ সবই দেখে ছোট্ট অবন। আর এক বার স্কুলের বড় দাদাদের সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের বচসায় যোগ দেয়।

তবে এ সব বেশি দিন চলে না। ‘মা দুর্গার অসুর’-এর মতো চেহারার লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত নামে মাস্টার এক দিন ক্লাসে এক খাবারের নাম বললেন ‘পাডিং’। খুদে অবন সটান বলে, ‘না, ওটা পুডিং’। রোজ বাড়িতে খায় যে ওটা সে! কিন্তু মাস্টার শুনলে তো। ছুটির পরে এক ঘণ্টা ‘কনফাইনমেন্ট’-এর নিদান, বেত্রাঘাত সব সইলেও ‘পাডিং’ মুখে রোচে না অবনের। স্কুলের পাঠে আপাতত দাঁড়ি। বাড়িতেই যদু ঘোষালের কাছে পড়াশোনা। শেখা ফার্সিও।

তবে পড়া বাদে অন্য সময় মস্ত বাড়িটার রূপ-রস-গন্ধ নিতে যেন একা-একা ঘুরে বেড়ায় অবন। ছোটপিসিমার ঘরে ঝোলানো দেবদেবীর পট, তেলরঙের ছবিগুলো কী সুন্দর। ছোট পিসেমশাইয়ের দেওয়া হাঁসের ছবি কপি করাও চলে। কখনও বা বৈঠকখানার ঘরে দাদাদের ডেস্কে উঁকি দেয়, কী থাকে ওতে। কখনও বা বাবামশাইয়ের টেবিলে ইতিউতি রাখা রংগুলো অবাক চেয়ে দেখে। ওই রং দিয়ে কিংবা হলুদ গুলেই ধীরে-ধীরে যেন শিল্পীটি তৈরি হতে থাকে।

মস্ত বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কোন্নগরে অবনদের ‘দু-থাক ঢালুর উপরে সাদা ছোট্ট’ বাগানবাড়ি। কলসি কাঁখে মেয়েদের গা ধুতে যাওয়া, রাখালদের গরু নিয়ে ফেরা, নদীর বুকে ভেসে চলা নৌকো— এ সব দেখতে দেখতে সেখানে যায় অবন। ওখানে দুপুরগুলো কাটে কুলগাছ থেকে রেশমের গুটি কুড়িয়ে। কখনও বা প্রজাপতির পায়ে সুতো বেঁধে উড়িয়ে দিয়ে। সব থেকে টানে ওই মেঘের আঁচল পাতা গঙ্গার রূপ। গঙ্গায় তখন কেউ যেন তখন ‘কালো-সাদা কাপড়’ বিছিয়ে দেয়। আর রাতে চাঁদের আলোয়, কাঁঠালতলার দিকে চেয়ে থাকে। জোনাক আলোর খুদে মশাল জ্বেলে আসে বরযাত্রীরা— কাঠবেড়ালির বিয়ের আসর বসে! এ সবের মাঝে চলে পড়াশোনাও। এখানেই কী করে যেন এক দিন অবন শিখে নিল বাংলাদেশের কুঁড়েঘর আঁকা।

তবে শেষমেশ মায়ের ইচ্ছেয় সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানে বেশ কয়েকটা বছর কাটাতে হল তাকে। পরে বছরখানেক সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তবে সংস্কৃত কলেজের দিনগুলোয় আঁকা-আঁকি, কবিতা, গোলদিঘির পাড়ে সবুজ ঘাস, বাগানের ফুল, জানলা, এ সবেই যেন বেশি আগ্রহ তাঁর। বন্ধু অনুকূলের কাছে শিখে নেওয়া লক্ষ্মী-সরস্বতী আঁকার কৌশল। এই কলেজের শেষ বছরেই বিয়ে, সুহাসিনী দেবীর সঙ্গে। কালক্রমে দম্পতির চার মেয়ে, তিন ছেলে।

খুলি আঁকতে গিয়ে ১০৬ ডিগ্রি জ্বর

ছোট থেকেই ‘শিল্পীর ধ্যান’টি বেশ রপ্ত করলেন অবনীন্দ্রনাথ। সেই ধ্যান নিয়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ কাব্য-চিত্রণ। ছাপা হল ‘সাধনা’য়। মেজো-মা জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহ ও ব্যবস্থায় ইটালিয়ান শিল্পী ওলিন্তো গিলার্দির কাছে মূলত প্যাস্টেলের কাজ, প্রতিকৃতি আঁকার পাঠ নেওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সূত্রে আলাপ রবি বর্মার সঙ্গে। ‘ছোকরা’র স্কেচ দেখে বেশ বাহবাও দিলেন তিনি। তেলরং, জলরংয়ের কাজ শেখা সি এল পামার-এর কাছে। কিন্তু পামার-এর কাছে শারীরবিদ্যার পাঠ নিতে গিয়ে মড়ার মাথা আঁকতে গেলেন, জ্বর এসে গেল— ১০৬ ডিগ্রি!

সবই হচ্ছে, কিন্তু নিজের পথটা যেন অধরা। এমন সময়ে প্রপিতামহ দ্বারকানাথের বইঘর থেকে পাওয়া মোগল যুগের প্রাচীন চিত্রের পুঁথি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথের বন্ধু মিসেস মার্টিনডেলের পাঠানো নকশা করা আইরিশ মেলোডিজ়-এর বই, ভগ্নিপতি শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া পার্সিয়ান ছবির বই আর রবিকার দেওয়া রবি বর্মার আঁকা কয়েকটা ছবি যেন পথ দেখাল।

কিন্তু আঁকবেন কী! ভরসা সেই রবিকা। বৈষ্ণব পদাবলি পড়তে বললেন। ‘পৌখলী রজনী পবন বহে মন্দ...’ অবলম্বনে আঁকলেন ‘শুক্লাভিসার’। কিন্তু এ যেন মেমসাহেব রাধাকে শাড়ি পরিয়ে শীতের রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে! বুঝলেন, দেশি রীতিনীতি না শিখলেই নয়। ছবির ফ্রেমে সোনা লাগানো শিখলেন রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির কারিগরের থেকে। শিখেছেন জাপানি আঙ্গিকও।

মোটা দাগে অবন ঠাকুরের ছবি-জীবনকে ছ’টি পর্বে ভাগ করেন অনেকে— ১৮৯০-পূর্ববর্তী সময়, ১৮৯০-১৮৯৫, ১৮৯৫-১৯০০, ১৯০০-১৯১১, ১৯১১-১৯২০, ১৯২০-৩০। এর পরে দীর্ঘ বিরতি, তখন অবনীন্দ্রনাথ ব্যস্ত যাত্রাপালা লিখতে, ‘কাটুম-কাটাম’ বানাতে। তবে ১৯৩৮-৩৯ সালে আচমকা চার মাসে প্রায় ৮০টি পট আঁকলেন তিনি। অবন ঠাকুরের ছবিগুলিকে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মুঙ্গের, কৃষ্ণলীলা, তাজ, মুক্তাঙ্কন, মুসৌরি, দেওঘর, ওমর খৈয়াম-সহ মোট ২১টি পর্যায়ে ভাগ করেন। এই গোটা ছবি আঁকার পর্বে বাড়ির লোকজন এবং শিল্পীরা বাদে দু’জনের বিশেষ ভূমিকা—

১৯০০ সালের শীত। সপরিবার অবনীন্দ্রনাথ গেলেন ‘চেঞ্জে’, ইলাহাবাদে। সেখানে এক তলার বারান্দায় বসে নীরবে গড়গড়ায় টান দেন। আর সন্ধ্যা হলে ছেলেমেয়েদের কাছে বসিয়ে গল্প শোনান।

সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছেলে অলোকেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, এখানে প্রায়ই আসেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকা বার করবেন।

তখন বেশির ভাগ পত্রিকা অবন ঠাকুরের ছবি সম্পর্কে বলে, ‘কে মশায় আপনার ঐ লম্বা আঙুল, পটলচেরা চোখ ভারতীয় কলার ছবি ছাপবে?’ রামানন্দবাবু কিন্তু ছাপবেন জানালেন। কিন্তু পত্রিকার নামটি কী হয়, তা নিয়ে তিনি চিন্তায়। অবনীন্দ্রনাথই সমাধান করলেন, ‘আপনি নিজে প্রবাসে থাকেন, অতএব আপনার পত্রিকার ‘প্রবাসী’ নাম দিন।’

অন্য জন, ভগিনী নিবেদিতা। আমেরিকান কনসালের বাড়িতে, কাকুজো ওকাকুরার সংবর্ধনা সভায় তাঁর সঙ্গে পরিচয়। ‘সাদা পাথরে গড়া তপস্বিনী’ নিবেদিতার সঙ্গে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সম্পর্ক অবনীন্দ্রনাথের। শিল্পতাত্ত্বিক নিবেদিতা অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ ছবিটি সম্পর্কে লিখলেন, ‘প্রবাসী’তে (ভাদ্র, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ): ‘এই ছবিখানি ভারতীয় চিত্র-শিল্পে এক নবযুগের প্রারম্ভ সূচনা করিবে বোধ হয়।...’

ঘটনাচক্রে, অবনীন্দ্রনাথকে আমরা ভারত-শিল্পের পুনরুদ্ধার, ‘বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট’-এর প্রধান শিল্পী হিসেবে সঙ্গত কারণেই দেখি। তবে পাশাপাশি, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, অবনীন্দ্রনাথের ছবির সবচেয়ে ‘বড় সম্পদ, তাঁর স্টাইল...’ তবে এ বিষয়টি খানিক যেন উপেক্ষিত। কারণ, ‘ভারতমাতা’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘শাজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষা’, ‘আলমগীর’, ‘শেষ বোঝা’ প্রভৃতি ছবিগুলিতে যে ‘ভাব’ রয়েছে, তার আবেশেই যে ডুব দেন সকলে। তাঁর প্রতিটি ছবিতেই যে লেগে অনুভূতির স্পর্শ। প্লেগে অবনীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে শোভার মৃত্যু হয়েছে। ‘শাজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষা’য় তাঁর ‘বুকের ব্যথা সব উজাড় ক’রে ঢেলে’ দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ।

যাবতীয় শিল্প-কীর্তির মাঝেই ১৯১৩-য় লন্ডনে প্রদর্শনী, ইংরেজ সরকারের থেকে সিআইই উপাধি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট-সহ নানা সম্মান প্রাপ্তি। বিশ্বভারতীর আচার্য, আর্নেস্ট হ্যাভেলের জোরাজুরিতে আর্ট স্কুলের সহ-অধ্যক্ষ, ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টস-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন, এমন নানা কাজ করতে হয়েছে অবনীন্দ্রনাথকে। তবে ঘরকুনো এই মানুষটি কোনও দিন বিলেত যাননি। কিন্তু জাপান, ইং‌ল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, নরওয়ে, পোল্যান্ড থেকে তাঁর কাছে বার বার এসেছেন শিল্পীরা।

আসলে সম্মান, অর্থ, এ সবে তেমন আগ্রহ ছিল না। সে বার লর্ড কারমাইকেল অবনীন্দ্রনাথ-সহ কয়েকজন ভারতীয় শিল্পীর ছবি বিলেতে জাহাজে করে বিলেতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভূমধ্যসাগরে সে জাহাজ ডুবে গেল। শিল্পীর মন্তব্য, ‘আমি দেখছি জলদেবীরা আমাদের ছবিগুলো বরুণালয়ে টাঙিয়ে আনন্দ করছেন।’ তবে, শিল্পীর পুঁজি তাঁর আত্মসম্মানে। অবনীন্দ্রনাথের ‘শেষ বোঝা’ ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজ়িয়াম কিনতে চাইলেও তিনি দেন না। তাঁর মনে হল, ‘ভারতীয় ছবি’ বলেই, কম মূল্য দিচ্ছেন মিউজ়িয়াম কর্তৃপক্ষ।

নাটকে বোরখাধারী এফেক্ট

আঁকার পাশাপাশি, সরকারি আর্ট স্কুলে ভারতীয় শিল্পের আর্ট গ্যালারি তৈরি, বঙ্গীয় গৃহশিল্পের পত্তনের তোড়জোড় এবং অভিনয়, যে কোনও ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ অবনীন্দ্রনাথ। শিল্পীর সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পতাত্ত্বিক সত্তাটিও বাঙালির বিশেষ আদরের। এই অবনীন্দ্রনাথের পরিচয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ডাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রানি বাগেশ্বরী অধ্যাপক হিসেবে দেওয়া প্রায় ত্রিশটি বক্তৃতা, ‘ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ’-সহ নানা ক্ষেত্রে।

অবনীন্দ্রনাথের জীবনের এই সব সূত্রেই যেন লেগে আছেন তাঁর রবিকা। ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’য় তিনকড়ি বলে, ‘...আমিও কারো জন্যে ভাবি নি, আমার জন্যেও কেউ ভাবে নি...’। তিনকড়ির ভূমিকায় অভিনয় করেন অবন। ওই সংলাপটিই যেন অবনেরও ‘সত্যিকারের রূপ’। ভাইপোর সে রূপটিকে একমাত্র চিনেছিলেন তাঁর রবিকা। কাকার ‘বিসর্জন’, ‘ফাল্গুনী’, ‘ডাকঘর’, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’-সহ নানা নাটকে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয়ও করেন ভাইপো।

অভিনয়ের আঙিনায় ঘটে নানা ঘটনা। এক নাটকের মহলা চলছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ, দু’জনেই পার্ট ভুলে যাচ্ছেন। উপায় বার করলেন অবনীন্দ্রনাথ। শুনে আঁতকে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ।

নাটক শুরু। অবনীন্দ্রনাথের পরিকল্পনা মতো, মঞ্চে দেখা গেল, ‘এফেক্ট’ হিসেবে বোরখা পরা কয়েকজন ঘোরাঘুরি করছেন। অভিনেতা কাকা-ভাইপো তাঁদের আশপাশ দিয়ে যাচ্ছেন। আসলে, ওই ‘এফেক্ট’ দেওয়ার জন্য যাঁদের নামানো হল, তাঁরা ছিলেন প্রম্পটার!

মাঝেসাঝে দু’জনেই পরস্পরকে ভারী ফ্যাসাদেও ফেলেন। অবন ঠাকুরের গড়গড়া আর বার্মা চুরুটের শখ। জোড়াসাঁকোর ঘরে সে দিন রবীন্দ্রনাথ খুব মগ্ন হয়ে কী যেন লিখছেন। আচমকা টোকা: ‘রবিকা, ভাল চুরুট পেয়েছি, খাবে? টেনেই দেখো না একটা। বেশ লিখতে পারবে।’ কাকাবাবুও বেশ দু’-এক টান দিলেন। মুহূর্তে মুখ-চোখ লাল। কাশতে-কাশতে বললেন, ‘এই তোমার ভাল চুরুটের নমুনা?’

আবার এক দিন রবীন্দ্রনাথ একটি গান লিখে সুর বসিয়েছেন। তা বাজানোর জন্য ডাক পাঠালেন অবনীন্দ্রনাথকে। কানাইলাল ঢেরীর কাছে এসরাজ, রাধিকা গোঁসাইয়ের কাছে গান শেখা অবনীন্দ্রনাথ দিব্যি বাজিয়ে দিলেন। কিন্তু পরের দিন আর পারেন না, ভুলে গিয়েছেন। দেখেশুনে খুড়োর কাছে জিজ্ঞাসা, ‘আমি তো তোমার গান গাইতে পারি না, তোমার সুর আমার গলায় আসে না, কিন্তু আমার সুরে তোমার গান গাই, তাতে তোমার আপত্তি আছে?’ আপত্তি জানাননি রবীন্দ্রনাথ।

এ ভাবেই দু’জনের পৃথক সুর মিলেছে এক গানে। রবীন্দ্রনাথ তখন রোগশয্যায়। খুব ইচ্ছে, ভাইপোর সে বারের জন্মদিন ঘটা করে পালন হোক। রবীন্দ্রনাথের দূত হয়ে নন্দলাল এসে তা বলতেই তেড়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথ। এ সবে ঘোর আপত্তি তাঁর। রানী চন্দের কাছে সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বেশ কড়া গলায় বললেন, ‘তোমার এতে আপত্তির মানে কী? দেশের লোক যদি চায় কিছু করতে— তোমার তো তাতে হাত নেই কোনো।’ মাথা চুলকে, কাকাকে প্রণাম করে এ বার দে দৌড় ভাইপোর। রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘পাগলা বেগতিক দেখে পালালো।’ কিন্তু প্লেগের সময় জনসেবা, স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে চাঁদা সংগ্রহ বা রাখিবন্ধন উৎসব— রবি ঠাকুরকে দেখে পালাননি, সঙ্গে থেকেছেন অবনীন্দ্রনাথ।

এ হেন অবন ঠাকুরকে গল্প লেখার ‘বাতিকটা’ ধরালেন রবীন্দ্রনাথই। পাওয়া গেল, ‘শকুন্তলা’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূতপত্‌রীর দেশ’, ‘নালক’, ‘রাজ কাহিনী’ আরও কত কী...। রয়েছে ‘বাংলার ব্রত’, ‘কথিকা’, ‘আপন কথা’র মতো লেখালিখিও। কখনও বা ‘ঘরোয়া’র বিবরণ শুনে খোদ রবিকারও ‘মনের মধ্যে মরা গাঙে বান ডেকে’ ওঠে। কিশোর মনেও বান আনে ‘খুদ্দুর যাত্রা’, ‘এসপার ওসপার’-এর মতো যাত্রাপালাগুলি। সাহিত্যিক হিসেবে অবন ঠাকুরের কৃতিত্ব কী, তা নিয়ে দিস্তে-দিস্তে আলোচনার পরিসর আছে। তবে প্রমথনাথ বিশীর একটি কথা যেন সব কথার সার: ‘বাংলা গদ্যে গীতিস্পন্দের প্রধান দৃষ্টান্তস্থল অবনীন্দ্রনাথের গদ্য।’ ছবি হোক বা গদ্য, অবনীন্দ্রনাথ অনন্য তাঁর ‘স্টাইল’, ‘ভঙ্গি’র কারণেই।

মণিমুক্তো: ছোটদের জন্য তাঁর কলম ছিল প্রাণবন্ত। তাঁর লেখা কালজয়ী বইগুলি, ঘড়ির কাঁটার চলনের দিকে, নালক, রাজ কাহিনী ও শকুন্তলা।  আজও সব বয়সের মানুষের কাছেই সমান আকর্ষক

মণিমুক্তো: ছোটদের জন্য তাঁর কলম ছিল প্রাণবন্ত। তাঁর লেখা কালজয়ী বইগুলি, ঘড়ির কাঁটার চলনের দিকে, নালক, রাজ কাহিনী ও শকুন্তলা। আজও সব বয়সের মানুষের কাছেই সমান আকর্ষক

সমুখে শান্তিপারাবার

একটা সময়ের পর সব কিছুরই তার যেন দ্রুত ছিঁড়ে যাওয়া শুরু হল। মেয়ের মৃত্যু আগেই দেখা। এ বার দাদা গগনেন্দ্রনাথের প্রয়াণ, ১৯৩৮-এ। সব কিছু যেন শেষ করে দিল, অবনীন্দ্রনাথের ইংরেজি জন্মদিনের তারিখটাই, ৭ অগস্ট। ১৯৪১। সব কিছুর গ্রন্থি বাঁধা যাঁর কাছে, সেই রবিকা আর নেই। পাঁচ নম্বর বাড়ির উত্তরের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে প্রবীণ শিল্পী দেখেন, জন-অরণ্য। পড়ে রইল খাবার পরে পান খাওয়া। আঁকলেন সে জন-অরণ্য, আর তার মাথায় এগিয়ে চলা রবি ঠাকুর। নীচে লিখলেন, ‘সমুখে শান্তিপারাবার,/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’

মা প্রায়ই তাঁর এই খেয়ালি ছেলেটিকে বলতেন, ‘রবির সঙ্গে আছিস, বড় নিশ্চিন্ত আমি।’— ওই দিনটায় সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টাই যেন কেউ কেড়ে নিল অবনের থেকে। তার মধ্যেও নানা দায়-দায়িত্ব সামলেছেন।

ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসে ১৯৫১-র ডিসেম্বর। ক্রমশ বুঝতে পারছেন, শরীরটা আর চলে না। বেশ কয়েকটা বছর ধরেই ঘুম হয় না রাতে, শুধু ফেলে আসা পুরনো-কথা মনে পড়ে। ৫ ডিসেম্বর রাতে প্রয়াত হলেন শিল্পগুরু। যেতে-যেতেও রেখে গেলেন এক টুকরো রং-পেনসিল, আঁকার কাগজ। মজলিশি ঢঙে যেন জানতে চাইলেন— ‘কিছু না! কিছু না! এই ছবিটা কেমন বলো দেখি।’

তথ্যঋণ: ‘অবনীন্দ্র রচনাবলী’, ‘অবনীন্দ্রনাথ স্মৃতি’ (সম্পাদনা: বিশ্বনাথ দে), ‘বাংলার চিত্রকলা’: অশোক ভট্টাচার্য, ‘অবনীন্দ্রনাথ’: মনোজিৎ বসু, ‘অবনীন্দ্রনাথ’: অনির্বাণ রায়, ‘পেন্টিংস অব অবনীন্দ্রনাথ টেগোর’:
আর শিব কুমার।

অন্য বিষয়গুলি:

Abanindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy