তখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। পাক হানাদার-বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হল ‘অভিযোগ’ নামক এক দুঃসাহসী পুস্তিকা। যিনি প্রকাশ করলেন, তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই পুস্তিকার এক জায়গায় লিখলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিশ্চিত বিজয়ের লক্ষ্যে ধাবমান। এই সংগ্রাম গোটা বাঙালী জাতির সর্বাঙ্গীণ সংগ্রাম। বাংলাদেশের মানুষের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি কোনো কিছুই এ সংগ্রাম থেকে আলাদা নয়। বাংলার জনগণ এই কঠিন কঠোর সংগ্রামে বিজয় অর্জন করার জন্য তুলনাহীন আত্মত্যাগ করেছেন, করে যাচ্ছেন এবং করবেন।’ এই প্রতিবাদী মানুষটিই ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, দক্ষ সম্পাদক ও বলিষ্ঠ সংগঠক।
নির্ভীক কলমে ধারালো প্রতিবাদ করেই থেমে থাকেননি তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের মৌলিক অধিকার আদায় করা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য তিনি একটি সমিতি গঠন করেছিলেন। আবার ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় গড়ে তুলেছিলেন ‘দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’। শুধু লেখালিখির মধ্য দিয়েই নয়, প্রয়োজনে সরাসরি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাজ করতেও কখনও দ্বিধা ছিল না তাঁর।
১৯১৮ সালের ১৯ মার্চ (মতান্তরে ৩১ মার্চ) এখনকার বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সিকান্দারের জন্ম। মঈনউদ্দীন হাশেম ও জোবেদা খানমের জ্যেষ্ঠ পুত্র সিকান্দারের শৈশব-কৈশোর কাটে গ্রামেই। পরবর্তী পড়াশোনা কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে। বি এ পড়া শেষ করতে পারেননি। বাইশ বছর বয়সে লেখাপড়ার ইতি টেনে ১৯৪১ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তবে তাঁর মতো স্বাধীনচেতা মানুষের পক্ষে একটা চাকরির মধ্যে বেশি দিন আটকে থাকা সম্ভব হয়নি। ১৯৪২ সালে চাকরি ছেড়ে ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় কাজ শুরু করলেন। পাশাপাশি শুরু করলেন নারকেল তেলের ব্যবসা। চলল না। পূর্ণ সময় ব্যবসা করবেন বলে ‘দৈনিক নবযুগ’ ছেড়ে একটার পর একটা ব্যবসা ধরলেন, কিন্তু প্রতি বারই ব্যর্থ হলেন। ১৯৫০ সালে ঢাকার রেডিয়ো পাকিস্তান-এ স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে চাকরি নেন। সেখানেও থিতু হতে পারেননি। বছরচারেক যেতে না যেতেই ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সহযোগী সম্পাদক হয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন আবার। আবার মাথা চাড়া দিল ব্যবসার ঝোঁক। এ বারও ব্যর্থ হলেন। বহু টাকা লোকসান হল। তার পর ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হলেন। আর কলেজে পড়ার সময় যে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন, তাতেই মন দিলেন গভীর ভাবে। ক্রমশ তিনি এক জন প্রতিষ্ঠিত কবি হয়ে ওঠেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘প্রসন্ন প্রহর’, ‘বৈরী বৃষ্টিতে’, ‘বৃশ্চিক লগ্ন’, ‘বাংলা ছাড়ো’ প্রভৃতি। নাটক রচনাতেও
তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মোট ন’টি নাটক লিখেছিলেন তিনি। তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে ‘সিরাজদ্দৌলা’ ও ‘মহাকবি আলাওল’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
অন্যের পত্রপত্রিকায় সম্পাদনা কিংবা সাংবাদিকতার চাকরি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কোথাও যেন স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ ও কঠিন সত্য অকপটে বলায় সমস্যা হচ্ছিল সিকান্দারের। সেই উদ্দেশ্যেই শুরু হল নিজস্ব পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ। বিশিষ্ট কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পাদিত ‘কনটেম্পোরারি’ নামক ইংরেজি পত্রিকার নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি নিজের পত্রিকার নাম রাখেন ‘সমকাল’। ১৯৫৭ সালের অগস্টে তাঁর সম্পাদনায় এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ। বন্ধুস্থানীয় কবি আল মাহমুদ এই পত্রিকার শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রুফ দেখার কাজ করতেন।
সম্পাদক হিসেবে সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন আপসহীন। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র প্রশস্ত করার জন্য গতানুগতিক ভাবনা একেবারেই ঝেড়ে ফেললেন। আঞ্চলিকতা, অতীতনির্ভরতা, সঙ্কীর্ণতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দিলেন না। মধ্যপ্রাচ্যের মুখাপেক্ষী হতেও অস্বীকার করলেন। সব রকম সাম্প্রদায়িকতা দিলেন জলাঞ্জলি। ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিকতার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ‘সমকাল’-এর সম্পাদক। এবং প্রশ্নাতীত ভাবে সফলও হয়েছিলেন। সিকান্দার আবু জাফর পত্রিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে যে কোনও বাধাকে অনায়াসে তুচ্ছ করতে পারতেন। কাউকে পরোয়া করতেন না। তাঁর এই দুঃসাহসই ছিল ‘সমকাল’-এর জীবনীশক্তি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও জাফর দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ‘সমকাল’-কে মাধ্যম করে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, “‘সমকাল’ সেকালে আমাদের সাহিত্যের ব্যাপারে নিজেদের মনের সমস্ত সন্দেহ ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালী যেমন নিজের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছিল, তেমনি অর্জন করেছিল নিজের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব।”
বহু নবীন ও প্রবীণ লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়েছে সমকালে। তাঁদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আবুল হোসেন, আল মাহমুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হকের মতো বহু লেখক পরবর্তী কালে প্রথিতযশা হয়েছেন। শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ ‘সমকাল’-এ প্রকাশিত হয়েছে। আবুল ফজলের দুঃসাহসী দু’টি প্রবন্ধ— ‘মানবতন্ত্র’ এবং ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সিকান্দার আবু জাফর জানতেন যে, এই প্রবন্ধ দু’টি প্রকাশিত হলে সমাজে সাংঘাতিক আলোড়ন হবে। সমাজের রক্ষণশীলতার ধ্বজাধারীরা মোটেই ছেড়ে কথা বলবে না। তবু তিনি প্রকাশ করেছিলেন। কারণ লেখকের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার প্রসারকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। প্রবন্ধ দু’টি প্রকাশিত হবার পর পত্রিকার দু’টি সংখ্যা বাজেয়াপ্ত হল। সিকান্দারের উপর নেমে এল নানা বিদ্রুপ-বিষোদ্গার। তবু নিজের মতাদর্শের সঙ্গে কখনও একচুল আপস করেননি, কারও স্তাবকতা করেননি, অচলায়তনের দ্বারে আঘাত করতে ভয় পাননি। তাঁর ঋজু মেরুদণ্ডই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy