Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

কানপুর, দিল্লি থেকে কলকাতা উড়ে আসে ওরা

শিকারি পাখির আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েও গন্তব্যে ফিরে এসে জেতানোর চেষ্টা করে মালিককে। কলকাতার ‘পায়রা দৌড়’-এর ঐতিহ্য এখনও জীবিত। অনিরুদ্ধ সরকারশিকারি পাখির আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েও গন্তব্যে ফিরে এসে জেতানোর চেষ্টা করে মালিককে। কলকাতার ‘পায়রা দৌড়’-এর ঐতিহ্য এখনও জীবিত।

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৬
Share: Save:

ডিসেম্বর থেকে মার্চ, শীতের মরশুমে কলকাতায় আজও মাঝেমধ্যে শোনা যায় অভিনব ‘পায়রা রেস’-এর কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রানি রাসমণির বাড়িতে বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল বেশ কয়েকটি ‘হোমার পায়রা’। হোমার পায়রা হল বিশেষ প্রশিক্ষিত পায়রা। এদের ব্যবহার করা হত ডাক বিভাগের কাজে, এমনকী যুদ্ধক্ষেত্রেও। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হোমার পায়রাদের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক কারণেই হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার রানির বাড়ির পায়রাগুলিকে বাজেয়াপ্ত করে নেয়। যুদ্ধ শেষ হলে অল্প কিছু পায়রা ফিরিয়ে দিয়েছিল তারা রাসমণির বাড়িতে।

গত শতকের গোড়ার দিকে রানি রাসমণির বাড়ি সহ কলকাতার বেশ কয়েকটি জমিদার বাড়ির সদস্যরা মিলে হোমার পায়রা নিয়ে শুরু করেন প্রথম পায়রা রেস বা পায়রা দৌড়। এই দৌড় কিন্তু ঘোড়দৌড়ের মতো নয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রা কোনও মাঠে নয়, উড়ে যায় এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে। আবার ফিরে আসে নিজের জায়গায়। যেখান থেকে দৌড় শুরু হয়, সেখানে।

কলকাতায় এই পায়রা দৌড়ের জনপ্রিয়তা জন্ম দেয় ‘ক্যালকাটা রেসিং পিজিয়ন ক্লাব’-এর। বাঙালি জমিদারদের দেখাদেখি পায়রা দৌড় শুরু করেন কলকাতার চিনেরা। তাঁরা গড়ে তোলেন ‘পিজিয়ন রেসিং ক্লাব’। বাঙালি জমিদার বনাম চিনাদের পায়রা দৌড় বেশ জমে ওঠে। বাঙালি ও চিনাদের দেখাদেখি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং ব্রিটিশরাও পায়রা দৌড়ে অংশ নিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার পায়রা দৌড়ের পরম্পরা।

সেই সব জমিদাররা এখন ইতিহাস, যাঁরা শখ পূরণের জন্য পয়সার হিসেবের তোয়াক্কা না করে পায়রা পুষতেন, ওড়াতেন, এমনকী পায়রার বিয়েও দিতেন! তবে মার্বেল প্যালেসের মল্লিকবাড়িতে এখনও দেখা মেলে দুষ্প্রাপ্য পায়রা এবং তাদের জন্য বানানো বর্মি সেগুন কাঠের তৈরি খাঁচা। মল্লিকবাড়িতে এমন রাজকীয় কায়দায় পায়রা পোষার তারিফ করে গিয়েছেন বারাণসীর মহারাজও। এখন সে সব অতীত। কলকাতায় হাতে-গোনা খান তিরিশেক বনেদি পরিবার শুধু এই পায়রা দৌড়ের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

কলকাতায় এখন দু’ধরনের পায়রা দৌড় হয়। স্বল্প দূরত্বের দৌড় আর লম্বা দূরত্বের দৌড়। ‘ইয়ং বার্ড’ অর্থাৎ এক বছরের কমবয়সি পায়রাদের দিয়ে করানো হয় স্বল্প দূরত্বের দৌড়। আর এক বছরের বেশি বয়সি পায়রাদের বলা হয় ‘ওল্ড বার্ড’। এদের প্রস্তুত করা হয় লম্বা দূরত্বের দৌড়ের জন্য। স্বল্প দূরত্বের দৌড় হয় কলকাতা থেকে আসানসোল, গয়া, হাজারিবাগ অবধি। আর লম্বা দূরত্বের দৌড় হয় রাঁচি, কানপুর, ইলাহাবাদ, মুঘলসরাই এমনকী
দিল্লি পর্যন্তও!

পায়রার দৌড়ের আগে বন দফতর এবং পশুপালন দফতরেরও ছাড়পত্র নিতে হয়। এই ছাড়পত্র বললেই মেলে না। অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এমনও হয়েছে, ঠিক সময়ে ছাড়পত্র না মেলায় বানচাল হয়ে গিয়েছে পায়রা দৌড়।

দৌড়ের জন্য একমাত্র রেসিং হোমার পায়রাদেরই ট্রেনিং দেওয়া হয়। রেসিং হোমার পায়রা জন্মানোর সাত দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট ক্লাব থেকে মেটালের রিং পরিয়ে দেওয়া হয় সদ্যোজাতের পায়ে। বয়স দু’মাস হলে ওই রিং পায়রার পায়ে এমনভাবে বসে যায়, যা আর সহজে খোলা যায় না। তার পর শুরু হয় তালিম। সে বেশ কঠিন কাজ। ‘শিক্ষার্থী’র পাশাপাশি শুরু হয় প্রশিক্ষকেরও ধৈর্যের পরীক্ষা।

পায়রাকে প্রথমে চেনানো হয় তার নিজের বাসস্থান। তার পর ধীরে ধীরে তার আশপাশের কিছু জায়গা। হোমার পায়রা এক বার জায়গা চিনে গেলে সহজে ভুলে যায় না। এদের স্মৃতিশক্তি প্রখর। যেখানেই পাঠানো হোক, ঠিক ফিরে আসে বাসস্থানে। জায়গা চেনার এই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ হলে পায়রাকে নিয়ে যাওয়া হয় দৌড় দেখাতে।

প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ক্লাবে প্রতিযোগীরা তাঁদের পায়রাগুলি নিয়ে আসেন। সেখানে পায়রার নাম, বংশ, রিং নম্বর ইত্যাদি নথিভুক্ত করে একটি বাক্সে পায়রাগুলিকে রেখে সিল করে দেওয়া হয়। বাক্সগুলি চলে যায় বিভিন্ন রাজ্যের নির্দিষ্ট ক্লাবে। প্রতিযোগিতার দিন স্টপওয়াচ হাতে উপস্থিত হন বিচারক। নিয়ম মেনে পায়রাগুলি ওড়ে দিল্লি, ইলাহাবাদ বা রাঁচি থেকে এবং দৌড় শেষ হয় গন্তব্য শহরে ফিরে এলে। যার পায়রা যত কম সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারে, সে বিজয়ী বলে ঘোষিত হয়। মেলে পুরস্কার। ভাল হোমার পায়রা চার ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার উড়তে পারে। রাজধানী এক্সপ্রেসের গতিকেও টেক্কা দেয় তারা!

দৌড় হয় এক থেকে এগারো পায়রা অবধি। ‘এক পায়রা’র প্রতিযোগীরা দৌড়ে দেন একটি পায়রা। ‘দু-পায়রা’ দুটো, এমন করে সর্বোচ্চ ‘এগারো পায়রা’, মানে প্রতিযোগী দৌড়ের জন্য এগারোটি পায়রা দেন। যদিও এগারো পায়রার দৌড় কলকাতার বুকে এখন আর হয় না। দৌড়ের পায়রাদের নাম রাখা হয় তাদের গতির সঙ্গে মিলিয়ে। যেমন, এফ-টেন, মিগ-টোয়েন্টিওয়ান, লাকি থার্টিন, ফার্স্ট ফরোয়ার্ড, স্টপার ইত্যাদি।

সব সময় পায়রা যে দৌড় শেষ করে যথাস্থানে ফিরে আসে এমনটা নয়। দিনের বেলায় ওড়ার সময় ভয় থাকে চিল বা বাজের মতো শিকারি পাখির, আর রাতে পেঁচার। ক্ষতবিক্ষত পায়রাও ফিরে এসেছে দৌড় সম্পূর্ণ করে, এমনও হয়েছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও সে জেতানোর চেষ্টা করে তার মালিককে।

‘ক্যালকাটা রেসিং পিজিয়ন ক্লাব’ থেকেই পরে আশির দশকে তৈরি হয় ‘ক্যালকাটা রেসিং পিজিয়ন অর্গানাইজেশন’। এই দুটি ক্লাবই কলকাতায় পায়রা রেসের ঐতিহ্যকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। চিনাদের ক্লাবটিতে এখন অবশ্য বাঙালির আধিপত্য। এক সময় কলকাতার ক্লাবগুলি থেকে উড়ত হাজারখানেক পায়রা, এখন যার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দেড়শোয়। এখন বরং চেন্নাই, বেঙ্গালুরু কিংবা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন পায়রা দৌড়ের ক্লাবগুলি আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কলকাতার ক্লাবগুলি সরকারি সাহায্যের অভাবে ধুঁকছে। নেই উপযুক্ত পরিকাঠামো, পায়রা তালিম দেওয়ার অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকও। আর্থিক সমস্যাও একটা বড় সমস্যা। খাবার, ওষুধ, প্রশিক্ষণ— সব মিলিয়ে দৌড়ের পায়রা-পিছু বছরে খরচ পাঁচ হাজার টাকা!

এত সমস্যার পরেও আজও কলকাতায় পায়রা দৌড়ের জন্য প্রতিযোগীরা লক্ষাধিক টাকা খরচ করে পায়রা পোষেন, নেশা ও ভালবাসার টানে। এঁদের অধিকাংশের আক্ষেপ, আগামী প্রজন্মের কাছে পায়রা দৌড় হয়তো গল্পকথাই হয়ে থাকবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Pigeon pigeon race
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE