বলেছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। কারণ ওটি শরৎ সর্দারের হাতের জিনিস। সুরকার-পাকড়াশী-মেলোডি-জি রিথ... সব ছেড়ে এখন শিল্পীরা গিটার কিংবা কি-বোর্ডেই স্বচ্ছন্দ। বাঙালি বাড়িতে, আসরে-বাসরে-কনে দেখায় অপরিহার্য এই বাদ্যযন্ত্র কি এখন আরশোলার বাসা?
রাত এগারোটার পর ডালহৌসিতে কোনও শব্দ থাকে না। শেষ ট্রামগুলো পৌনে এগারোটায় বেরিয়ে যায়, যেগুলো ফেরার গুমটিতে ফিরে আসে। তখন তাঁর লালবাজারের দোকান-সংলগ্ন বাড়ির ছাদে উঠে যেতেন শরৎ সর্দার মশাই। হারমোনিয়ামের টিউনিং হবে। কলকাতার একমাত্র জায়গা, যেখানে বাড়তি কোনও শব্দ নেই। সেইখানে বসে, নিবিষ্ট চিত্তে সুরপঞ্চম ধরে টিউনিং করতেন হারমোনিয়ামের আদি স্থপতি শরৎ সর্দার।
সে কালে হারমোনিয়ামের প্রতি এই যত্ন, ভাব-ভালবাসা এখন সোনার পাথরবাটি। আজকালকার গাইয়েরা এ যন্ত্র বড় একটা হাতে নেন না। সে জায়গা নিয়েছে কি-বোর্ড আর গিটার। বাবু রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে এ রকম দু’টি ছিল। একটি তিনি সব সময় বাজাতেন। আর একটি তাকের উপর তোলা, চাদরে মোড়া, একটু ছোট। প্রথমটিতে উনি যাত্রার মানুষজনকে গান শেখাতেন সারা দুপুর। খাতা দেখার বালাই ছিল না, সবই কণ্ঠস্থ। শেষ হলেই ফাংশন যাওয়ার তাড়া। ‘গাত্রহরিদ্রা থেকে সাধভক্ষণ— সবের গানই আমার কাছে আছে,’ শরীর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন কণ্ঠশিল্পের এই খলিফা। সবাই সরে যেতে চেপে ধরতাম। এক দিন বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের গান শোনান না! হারমোনিয়াম বাজিয়ে উনি একদম অচেনা সুরে গাইলেন ‘ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে’। বললাম, “এ সুর পেলেন কোথায়?” চমৎকার হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন আর বলছেন, “শৈলজাবাবু একই কথা বলেছিল আকাশবাণীতে। ‘মহিলামহল’-এ গাওয়ার সুযোগ দিয়েছে, আমি গেয়ে দিলাম, যেমন ইন্দুমা-র (ইন্দুবালা) কাছে শিখেছি। তাতে হারমোনিয়ামের দেদার কালোয়াতি ছিল। শৈলজাবাবু বললেন, ‘আমি স্টুডিয়োয় ঢুকে গান বন্ধ করে দিইনি একমাত্র তুমি গাইছ বলে। এ সুর তো গুরুদেবের সুর নয়!’ উত্তরে বলি, এই নাক মলছি, কান মলছি, আর গাইব না।”
এক সময় আমায় নামিয়ে আনতে বললেন তাকের উপর তোলা চাদরে মোড়া সেই হারমোনিয়াম। বললেন, “এই যে হারমোনিয়াম দেখছ, এ কোনও দিন টিউন করিনি। করলেই এর জাত চলে যাবে। এ শরৎবাবুর টিউন করা।”
যে শৈলজারঞ্জন মজুমদার, রামকুমারের কালোয়াতি রবীন্দ্রসঙ্গীতে রেগে গেলেন, তিনি কিন্তু আদপেই চাইতেন না রবীন্দ্রনাথের গানে হারমোনিয়াম বাজুক। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলকাতাপর্বের যে সূচনা, সেখানে আদি প্রতিষ্ঠান গীতবিতান, দক্ষিণী-র শিক্ষকরা হারমোনিয়াম বাজানোর অনুমতি পেলেও, শৈলজাবাবুর অনুসারীরা কেউই হারমোনিয়ামে গান শেখাননি। শিখিয়েছেন এস্রাজের সঙ্গে। প্রফুল্লকুমার দাস— যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকারও বটে— দোর্দণ্ডপ্রতাপে হারমোনিয়াম ছাড়াই ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষা দিচ্ছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের গলা কিন্তু বিজ্ঞানের নিয়মেই সুরে বেজেছে। শিক্ষাদানে, অন্তত রবীন্দ্রনাথের গানে এস্রাজ তাই এগিয়ে, যদিও আসরে এস্রাজের জায়গা হারমোনিয়ামের আগে নয়।
আসরে-বাসরে অপ্রতিরোধ্য সে হারমোনিয়াম। আচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় হারমোনিয়াম নিতেন একদম শরীরের উপরে। মেগাফোনে প্রকাশিত সিঙ্গল রিড হারমোনিয়ামে বাজানো দু’-তিনটি মিনিটপাঁচেকের পিস-সহ ‘জাগো আলোক লগনে’ সে দিন যেমন অপার্থিব আবহ তৈরি করেছিল, আজও তাই। কোনও মূল্যের বিনিময়েই সেই রেকর্ডিং আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। বাংলা গানে বাঙালির বল-ভরসা সবই ছিল ওই হারমোনিয়াম। আড়াই, তিন, সাড়ে তিন, চার অক্টেভে লুকোনো কাঞ্জিলাল, জীবনলাল, জুপিটার আর বিদেশি কতশত রিড! পুরনো বাড়ির সিজ়নড দরজা-জানলার কাঠে তৈরি তার শরীর। মোটামুটি মাঝারি একটি হারমোনিয়াম, তাতে ‘হে সখা, মম হৃদয়ে রহো’, ‘শুকনো পাতার নূপুর’, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’ কিংবা ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ আর বিলাবল-ভূপালি দিয়ে চর্চা শুরু। কতশত বাংলা ছবিতেই না রয়েছে, বরপক্ষকে গান শোনাচ্ছে বিবাহযোগ্যা মেয়েটি। সত্যজিৎ রায়ের ‘সমাপ্তি’ ছবিতে অপর্ণা সেনের দুষ্টুমি, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এ রবি ঘোষের বুলবুলভাজা বিক্রি, ‘বসন্ত বিলাপ’-এ মহিলামহলে হোলির গানের কথা তো মনে আসবেই। অনুষ্ঠান মঞ্চে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় মণীন্দ্র নট্টর সঙ্গে আর যা নিতেন, তা হল একটি হারমোনিয়াম। সেই হারমোনিয়ামই তার ‘বাগিচায় বুলবুলি’ আর ‘ফুলশাখা’-কে দৃশ্যমান করত। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়েই ‘কাজল নদীর জলে’ সোনার বরন কন্যাকে প্রদীপ ভাসাতে দেখেছেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নির্মলেন্দু হারমোনিয়াম হাতেই ‘সুহাগ চাঁদ বদনী’-তে হাসিয়েছেন, চোখের পাতা ভারী করেছেন ‘সাগর কুলের নাইয়া’ শুনিয়ে। পুত্র উৎপলেন্দু চৌধুরীও ওই হারমোনিয়াম প্রবল বেগে বাজাচ্ছেন এবং দিনে তিন-চারটে ফাংশনের ধকল নিতে পারছে না কণ্ঠ। শব্দযন্ত্রীকে ইশারায় বলছেন হারমোনিয়াম আর গলার আওয়াজ বাড়াতে। নিরুপায় শব্দযন্ত্রী নতমুখ। সবিনয়ে স্টেজের সামনে এসে সে জানায়, “রুণুদা, আপনার মুখ আর হারমোনিয়াম দিয়া খালি হাওয়াই বাইরাইতেছে।”
লন্ডনে নিশীথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত আর আটপৌরে আধুনিক গানগুলোর সঙ্গে বেজেছিল শুধু হারমোনিয়ামই। সে সঙ্কলনের মতোই বিক্রির সমস্ত রেকর্ড ভেঙেছে দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, মঞ্চে খুব ঘনিষ্ঠ আসরে যে গানগুলো তুলে রেখেছিলেন আলো কুণ্ডু মশাই, সেখানেও সঙ্গী এক ও একমাত্র হারমোনিয়াম। হারমোনিয়াম নিয়ে আস্ত একটা ছবিই বানিয়ে ফেললেন তপন সিংহ, যেখানে ‘ময়নামতীর পথের ধারে’, ‘মন বলে আমি মনের কথা জানি না’, ‘সে ভালবাসিলে জীবন মম’ কিংবা ‘আহা ছল করে জল আনতে আমি যমুনাতে যাই’— এই সব গানের আবহ তৈরি দিয়েছিল মণ্টু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারমোনিয়ামের ম্যাজিক। তাঁকে এক ঝলক দেখাও গিয়েছিল এই ছবিতে। এই সব স্মৃতি নিয়ে হারমোনিয়ামের দোকানগুলোয় এক বার ঘুরে আসা যাক।
দেদার বিকোচ্ছে হরেক মানের হারমোনিয়াম। কুলীন দোকান পাকড়াশী-মেলোডির মতো লালবাজারে শরৎ সর্দারের উত্তরসূরি মনোজ সর্দারের দোকানে রেডিমেড জিনিস হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু মনের মতো হারমোনিয়ামের রং বা টিউনিং পেতে গেলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। সুচিত্রা মিত্রর হারমোনিয়াম দেখে আমরা জি রিথকে চিনেছিলাম। একটা বড় জি, তার পাশে ছোট হরফে রিথ। মানে বুঝতাম না, কিন্তু হারমোনিয়াম দেখলেই চিনতে পারতাম, এ সুচিত্রাদির। মাস কয়েক আগে ফেসবুকে জনৈক সুচিত্রা-অনুরাগী শুধু হারমোনিয়ামটির ছবি দিয়ে বলেছিলেন এটি কে বাজাতেন? অন্তত একশো জন বলে দিয়েছিলেন সঠিক উত্তর। জি রিথ-এর কর্ণধার গোবিন্দবাবু পরে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর শ্রুতিনন্দনের ছাত্রছাত্রীদের হারমোনিয়ামগুলির দেখভাল করেছেন, পুরনো হারমোনিয়ামের বদলে নতুন হারমোনিয়াম করে দিয়েছেন। কিন্তু, শিল্পীমাত্রই যে হারমোনিয়ামের খোঁজে এখন থাকেন, সেটি হচ্ছে সুরকার কোম্পানির হারমোনিয়াম। টালিগঞ্জে মুদিয়ালির দুর্গোৎসবের মতোই কম আকর্ষক নয় রজনী সেন রোডের সুরকারের দোকানটি। সেখানে গেলে মালিকপক্ষ খুব একটা কথা বলেন না। কারণ, তাঁরা জানেন যে হারমোনিয়াম কেনার জন্য কেউ এসেছেন। সেই ক্রেতা শুনে হতাশই হন যে, এক বছরের আগে নতুন হারমোনিয়াম পাওয়া যাবে না। সময়মাফিক হারমোনিয়াম ডেলিভারিতে অনিশ্চয়তা আনে ক্রমশ পাল্টে যাওয়া বর্ষা-বসন্তর হামলা তথা ঝক্কি। এই ব্র্যান্ডের হারমোনিয়ামটি এখন মহার্ঘ তার সুরের সংগঠন এবং তৈরির কৃৎকৌশলে।
এক সময় দরকার হত ছোট হারমোনিয়াম। ছোট হারমোনিয়াম নিয়ে অনুপ ঘোষাল বা উৎপলেন্দু চৌধুরীরা বিদেশে যান। অনুপদার হারমোনিয়াম দেখার মতো। যেন ব্রিফকেস। চাবি সাজানোর কারুকার্যে দু’অক্টেভ কি তার চেয়েও ছোট সে হারমোনিয়ামে দরকার মতো সবই ছিল। দেখাদেখি উৎপলেন্দু চৌধুরীও তার ইউরোপ বা আমেরিকা সফরের সময় ওই ধরনের হারমোনিয়াম বানিয়ে নিয়ে যেতেন হ্যান্ড লাগেজ করে। আজকাল পুরনো হারমোনিয়াম পড়েই থাকে, পরবর্তী প্রজন্ম বড় একটা ছুঁয়েও দেখবে না। কলকাতায় বাড়িতে কোনও সেমি বা হাফগায়কের আগমন ঘটলে, কিংবা পাত্রপক্ষ কনে দেখতে এলে একটি হারমোনিয়াম ঠিক জোগাড় হয়ে যেত। খাওয়াদাওয়ার পরেই গান। একরত্তি কন্যে মৃদু গলায় সলাজ গাইছে ‘তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে’। উল্টো ছবিও আছে। গৃহকর্তার জানার কথা নয় অব্যবহারে হারমোনিয়ামটি কী অবস্থায়, তাই বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে দু’-চারটি লালচে আরশোলা সেখান থেকে বেরিয়ে পাত্রপক্ষের দিকে ধেয়ে এল।
হারমোনিয়াম যে শরীরের অংশও হয়ে যায়, মান্না দে-কে দেখে তেমনই মনে হত তাঁর শান্তি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িতে। ঘরের মধ্যেই আসীন পাথরপ্রতিমায় কৃষ্ণচন্দ্র দে, আর তার সামনে বসে মান্না দে হয় গান শোনাচ্ছেন বা গান তুলছেন, রেওয়াজে আছেন। হারমোনিয়ামটি শুধু তাঁর বাদ্যযন্ত্র নয়, তিনি হাত রাখছেন, খাতা রাখছেন, হয়তো মুড়ির বাটি, চশমাটাও। এ দৃশ্য তো চোখের সামনে দেখা। যেমন দেখেছি অখিলবন্ধু ঘোষকে। সুর আর হারমোনিয়াম যেন পোষা পাখি। যেমন বলছেন, তেমনই বলছে। যাত্রায় যাঁরা হারমোনিয়াম হাতে গান-মাস্টার, তাঁদের হাতেই গোটা প্রযোজনার রাশ। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যে কিংবদন্তি সন্তোষ সেনগুপ্ত, সুচিত্রা মিত্রদের সে ভূমিকাতেই দেখা যেত। অভিনেতা স্বপন কুমার বলতেন, “যে গ্রামে যাত্রা হবে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আগে দেখে জেনে নেওয়া দরকার থানাটা কোন দিকে। নায়কের গলা যদি বসে যায়, গান যদি ভাল না হয়, পালা যদি সুবিধের না হয়, তা হলে তো সবই গেল! মানুষজন অ্যাটাক করলে, থানার ও দিক পানে দৌড়তে হবে।” অনেক সময় পালা মনের মতো না হলে ক্ষিপ্ত দর্শকরা তবলা-হারমোনিয়াম কেড়ে রেখে দিত। নৃত্যনাট্যের বিখ্যাত শিল্পী অসিত চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা, “গান যেই খারাপ হল, পাড়াপড়শি আগে এসে হারমোনিয়ামটা নিয়ে চলে যায়। কোন মারধোর নেই, আক্রমণ নেই। কিছু ক্ষণ পরে সেই হারমোনিয়ামটি ফেরত এল। সেটি পুকুরে চুবিয়ে আনা হয়েছে!”
আমাদের সময়কার আচার্য জয়ন্ত বসুকে পেয়ে গেলাম। তিনি যখন গান করেন, তখন অর্ধেকটা গলায় ধরেন, বাকিটা তাঁর হারমোনিয়াম বলে দেয়। জাদুকরের হাত তাঁর। বেলোয় বাতাসের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে হারমোনিয়ামের রিডের ওপরে তাঁর অঙ্গুলিচালনা ঐশ্বরিক। উনি যেন হারমোনিয়ামে রিড বাজাচ্ছেন না, পাঁজরের হাড়গুলোকেই রিড করে নিয়েছেন। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসছে মধুর মর্মগ্রাহী বাণী। শুধু হারমোনিয়ামে তেমনই সাধনা আমরা দেখেছি পণ্ডিত জ্যোতি গোহ, আসফাক আলি খাঁ বা দেবাশিস ঘোষের বাজনায়। এখন যেমন স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্তর গানের সঙ্গে-সঙ্গেই মন কেড়ে নেয় তাঁর হারমোনিয়াম-বাদন। আমরা দেখেছি গৌতম ঘোষকে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক অদ্ভুত একটা কাজ করে দেখাতেন। যেমন দেখেছিলেন সলিল চৌধুরীর কাছে, অবিকল তেমনই। একটি হারমোনিয়ামে পঞ্চম মানে ‘পা’ রিডটি ছিল না, ফুস করে আওয়াজ হত। গৌতম বিলম্বিত থেকে অতি দ্রুত গতিতে ‘সা-রে-গা-মা-ফুস’, ‘রে-গা-মা-ফুস-ধা’, ‘গা-মা-ফুস-ধা-নি’, ‘মা-ফুস-ধা-নি-সা’— অনর্গল, অতি ক্যারিশমায় দেখাতে পারতেন সুরহীন ফুস-সহ। আর দেখেছিলাম সাধারণ হারমোনিয়াম নিয়ে স্টেজের মাঝখানে গিরিধারীলাল, ঝুররা মহারাজ, রামলখন পাণ্ডেকে বসে থাকতে। আশির দশকে মাইহার ব্যান্ড যখন কলকাতায় এল, সেই মাইহার ব্যান্ডের হারমোনিয়াম বাদক ওঁরা। আমরা আধুনিক অর্কেস্ট্রায় এক জন কন্ডাক্টরকে দেখি, যার সামনে পাতার পরে পাতা স্বরলিপি। এখানে ওই হারমোনিয়ামই বাবা আলাউদ্দিন-কৃত পিসগুলো কন্ট্রোল করত। লিখিত স্বরলিপি নেই, শুধু আছে মস্তিষ্ক-ভরা সুর। হারমোনিয়াম বাদক একটা কিছু স্বরমালিকা আরম্ভ করলেন এবং সেই ভাবে চোখ বুজে তাঁর হারমোনিয়ামের সঙ্গে বাকি যন্ত্রগুলি ওঠা-নামা করতে লাগল। মাইহার ব্যান্ডের সদস্যরা বাবা আলাউদ্দিনের হাতে মানুষ। তাঁর সন্তানসম। মাইহার রাজার কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে কিছু অন্ন-বস্ত্র-খাদ্য জোগাড় করে নিয়েছিলেন এই সুরতাপস। মাইহার ব্যান্ডের প্রজন্মর পর প্রজন্ম কোনও নোটেশন ছাড়া শুধু একটি হারমোনিয়ামের ভিত ধরে অবিস্মরণীয় মার্গসঙ্গীত উপহার দিয়ে চলেছে আপামর শ্রোতাদের।
মনে পড়ে যায়, ঋষিতুল্য শিল্পী সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের কথা, তাঁর কাজই ছিল কবিপক্ষে রবীন্দ্রসদনে যে শিল্পী হারমোনিয়াম হাতে তুলে নেবেন না, তাঁর সঙ্গে হারমোনিয়াম সঙ্গত। তাতেই কী অনাবিল তৃপ্তি মানুষটির মুখে! সিঙ্গল রিড হারমোনিয়াম বাজিয়ে সাধক ভীষ্মদেবের খেদোক্তি ‘যদি মনে পড়ে সেদিনের কথা, আমারে ভুলিও প্রিয়’ মনে আসে। হারমোনিয়ামেই সে গানের বৈভব সুরের সখ্যে গড়ে তুলেছিল সমাধিস্থল। অথচ, শাস্ত্রীয় আসর আর শিক্ষার গোড়ার সহায়ক যন্ত্র ছাড়া হারমোনিয়াম সে অর্থে তেমন জায়গাই পেল না, এ প্রজন্ম তাকে তুলে রাখল বাতিল যন্ত্রপাতির তাকে— এ অসম্মান তার প্রাপ্য ছিল কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy