তিন পুত্রের সঙ্গে চার্লস হার্ডলেস
এমন বাঙালি বিরল বললেই চলে যে ব্যোমকেশ কি ফেলুদার গল্প ভালবাসেন না। কিন্তু গল্পের গোয়েন্দাদের নিয়ে আমাদের ঠিক যতটা আগ্রহ, দুর্ভাগ্য যে ঐতিহাসিক গোয়েন্দাদের নিয়ে আমাদের প্রায় ততটাই ঔদাসীন্য। প্রাক্-আধুনিক যুগে সঠিক অর্থে না ছিল গোয়েন্দা গল্প, না ছিল গোয়েন্দা। বড়জোর রাজার কিছু চর নাগরিকদের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকত।
প্রাক্-আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং গরজ দুই-ই ছিল অপরিসর। রাজা কী করে মসনদে কায়েম থাকবেন এবং মোটামুটি সুষ্ঠু ভাবে কর আদায় করতে পারবেন— মূলত এই চিন্তায়ই মশগুল থাকত প্রাক্-আধুনিক কোটাল-বাহিনী। তাই কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-ই হোক কিংবা বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, আমরা বার বার দেখা পাই নাগরিকদের মধ্যে মিশে থাকা রাজার গুপ্তচরদের। কিন্তু গোয়েন্দারা এ জগতে গরহাজির।
এই গুপ্তচররা নানা ভেকধারী, কিন্তু তাঁদের মগজাস্ত্র যে বিশেষ প্রখর ছিল তেমন কোনও আভাস আমরা পাই না। বরং সেই জগতে বুদ্ধিমত্তার প্রতীক হলেন চোর চক্রবর্তীরা। সম্প্রতি ঐতিহাসিক প্রবীর মুখোপাধ্যায় এক মনোগ্রাহী প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কেমন করে আধুনিকতার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে চোরের ভাবনাটির আমূল চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে যায়। অনেকটা গোপাল ভাঁড় বা বীরবলের গল্পের নায়কদের মতো বুদ্ধিমত্তার প্রতিমূর্তি থেকে চোর ধীরে ধীরে উনিশ শতকে হয়ে ওঠে ছিঁচকে, লোভী এবং প্রান্তিক একটি চরিত্র। এরই পাশাপাশি উঠে আসে বুদ্ধিমত্তার মতুন প্রতিমূর্তি, মগজাস্ত্র চালক, আধুনিক গোয়েন্দা।
ঐতিহাসিক: হার্ডলেস প্রবর্তিত গোয়েন্দাগিরি সংক্রান্ত সাময়িকপত্র।
ব্যোমকেশ বা ফেলুদা পারতপক্ষে লুকিয়ে কাজ করেন না। দু’-এক বার তাঁদের ভেক ধারণ করতে হলেও, তাঁদের মূল অস্ত্র হল বুদ্ধি। যুক্তি এবং বিজ্ঞানের দ্বারা শানানো সেই ক্ষুরধার বুদ্ধির জোরে তাঁরা সম্মুখসমরে নানা অসামাজিক ব্যক্তিদের প্রতিহত করেন। তাঁদের প্রতিপক্ষ কেবল চোর নয়। জালিয়াত থেকে ডাকাত, সন্ত্রাসবাদী থেকে খুনি— নানা ধরনের দুশমনদের মোকাবিলা করতে হয় তাঁদের। দুশমনদের কুশীলবের এই অধিক ব্যাপ্তির মধ্যেই আমরা দেখতে পাই আধুনিক রাষ্ট্রশক্তির নতুন বর্ধিত পরিসর। আধুনিক রাষ্ট্রশক্তির দায়ভার আগেকার চেয়ে অনেক বেশি। সে শক্তি শুধু কর আদায় করে আর রাজাকে মসনদে আসীন রেখেই ক্ষান্ত হয় না। সে নাগরিক জীবন এবং সম্পত্তি রক্ষার নতুন দায়ও বহন করে। আধুনিক রাষ্ট্রের সার্থকতা সাধিত হয় নাগরিক জনজীবন এবং সার্বিক আর্থিক উন্নতির ব্যবস্থাপক রূপে। তাই তো তাকে জালিয়াত বা খুনি ধরার জন্য নতুন করে তোড়জোড় করতে হয়। এবং সেই নতুন ব্যবস্থার উপস্থাপক হিসেবেই আবির্ভাব আধুনিক গোয়েন্দার।
আঠেরো শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি চার জন গোয়েন্দা, কলকাতায় গোয়েন্দাগিরির ইতিহাসে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশিষ্ট বন্ধু, মট সাহেব। তাঁর স্মৃতি আজ বহন করে চলেছে উত্তর কলকাতার মট লেন। এর পর উনিশ শতকের মাঝামাঝি এলেন রিড সাহেব। ইনিই কলকাতায় সিআইডি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ দু’জন ছিলেন বাঙালি। আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু। ইতিহাসবিদ ছন্দক সেনগুপ্তের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি কেমন করে উনিশ শতকের শেষের দিকে পুলিশ কমিশনার এডওয়ার্ড হেনরির নির্দেশে আঙুলের ছাপের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করার এক নতুন ব্যবস্থার উত্থাপন করেন এই দু’জন। তবে মনে রাখতে হবে যে, এঁরা চার জনই ছিলেন সরকারি গোয়েন্দা। ঠিক সাহিত্যের বিখ্যাত গোয়েন্দাদের মতো স্বাধীন সত্যান্বেষী নন।
আধুনিকতার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে, রাষ্ট্রশক্তির নিরপেক্ষতার ধারণাটিও দৃঢ় হয়ে ওঠে। তখনই রাষ্ট্রের সম্যক পরিধির বাইরে গিয়ে স্বাধীন গোয়েন্দাদের আবির্ভাব হয়। এই স্বাধীন গোয়েন্দারা যদিও তাঁদের কাজের মাধ্যমে রাষ্ট্রশক্তির পরিপূরক, তবু তাঁরা রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র। নাগরিক জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে তাঁরা রাষ্ট্রের পাশাপাশি কাজ করেন। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন, কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবে এবং নিজেদের বুদ্ধির জোরে। এ দেশে সরকারি থেকে বেসরকারি গোয়েন্দাবৃত্তির এই ইতিহাসের জনক, চার্লস হার্ডলেস নামে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গোয়েন্দা।
হার্ডলেসের জীবন কোনও উপন্যাসের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। তাঁর জন্ম ১৮৬৬ সালে, হাওড়ার এক হতদরিদ্র পরিবারে। পরিবারটি এতই দরিদ্র ছিল যে তাঁর এক কাকা, জন হার্ডলেস, রোজ রোজ নিজের সন্তানদের অনাহারে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হন। মেধাবী ছাত্র চার্লস এই দারিদ্রের হাত থেকে মুক্তি পান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য বিশেষ আবাসিক স্কুল, লা মার্টিনিয়ারে বৃত্তি পেয়ে। স্কুল শেষ করে তিনি চাকরি পান জিপিও-তে ডাক বিভাগে। আর এখানেই অপ্রত্যাশিত ভাবে শুরু হয় তাঁর গোয়েন্দাগিরি।
সময়টা তখন উনিশ শতকের শেষ দশক। দেশে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হয়েছে এবং কলকাতাকে কেন্দ্র করে সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে চলেছে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যের এক মহাযজ্ঞ। সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেকটাই নির্ভরশীল ডাকযোগে পাঠানো টাকাকড়ি, দলিল-দস্তাবেজ, মালপত্র ইত্যাদির উপর। সেই কারণেই তখন ডাকবিভাগের ভিতরে চুরির বহরও ছিল বেশ বড়সড়। মানি অর্ডারের টাকা থেকে শুরু করে বড় পার্সেল-সহ অনেক কিছুই লোপাট হয়ে যেত। খেসারত দিতে হত ডাক বিভাগকে। তাতে প্রতি বছর ডাক বিভাগের অনেক টাকা লোকসান হত।
এ সব চুরিতে প্রায় বেশির ভাগ সময়েই হাত থাকত ডাক বা রেল বিভাগের কর্মচারীদের। তবে তাদের ধরা ছিল অসাধ্য, কারণ তারা অবশ্যই নিজের নাম সই করে জিনিসটি নিত না। তবে ডাক বিভাগের কেরানি থাকাকালীন চার্লস হার্ডলেস লক্ষ করেন যে, অনেকগুলো চুরি-সংক্রান্ত যে সব কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে কয়েক জন বিভাগীয় কর্মচারীর হাতের লেখার একটা মিল আছে। তিনি ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। হাতের লেখা দেখে কি সত্যি একটি মানুষকে চেনা যায়? একটি মানুষের হাতের লেখা কি সব সময় এক রকম হয়? এ সব নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে পড়াশোনা শুরু করেন।
নিজের চেষ্টায় এবং খরচে তিনি হাতের লেখা সংক্রান্ত নানা বই কিনে পড়েন। অবশেষে তিনি তাঁর সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে দু’-একটি চুরি ধরে ফেলেন। এতে স্বাভাবিক ভাবেই ডাক বিভাগের বড়বাবুরা খুব খুশি হন। চার্লসকে এ বার চুরি ধরার জন্য কিছু অবসর সময় ও সুবিধেও দেওয়া হয়। তাঁর অনুরোধে ডাক বিভাগ তাঁকে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে নানা ধরনের হাতের লেখা জোগাড় করে দিতে থাকে। চার্লস অবসর সময়ে তাঁর চর্চা চালিয়ে যান এবং উত্তরোত্তর আরও বেশি চুরি ধরে ফেলতে সক্ষম হন।
ক্রমশ তাঁর নাম ডাক পোস্টাপিসের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ডাক আসতে থাকে খোদ লালবাজার থেকে। ডাক বিভাগের মামুলি কেরানিকে তাই প্রায়ই বিশেষ অনুমতি দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুলিশকে সাহায্য করতে। অবশেষে লর্ড কার্জন যখন এ দেশের বড়লাট হয়ে আসেন, তখন কলকাতা পুলিশ তাঁর কাছে দরবার করে যে, হার্ডলেসকে ডাক বিভাগ থেকে সরিয়ে পাকাপাকি ভাবে পুলিশে চাকরি দেওয়া হোক।
কার্জন তাঁর কাজের নমুনা দেখতে চান। তত দিনে হার্ডলেস প্রায় দশ বছর ধরে পুলিশকে সাহায্য করছেন। ফলে তাঁর অনুসন্ধান করা অনেক কেসই ছিল পুলিশের ফাইলে। সেই ফিরিস্তি দেখে খুশি হয়ে ১৯০৫ সালে কার্জন লন্ডনে চিঠি পাঠান হার্ডলেসের জন্য পুলিশ বিভাগে একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করার অনুমতি চেয়ে। কার্জনের চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি যে, হার্ডলেসকে এর মধ্যেই দু’বার অস্থায়ী ভাবে পুলিশ বিভাগে চাকরি দেওয়া হয়েছিল এবং দু’বারই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে বেশ কিছু মামলার সমাধান করেছিলেন।
লন্ডনে ভারত সরকারের জন্য ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী সিঞ্জন ব্রোডেরিক কিন্তু কার্জনের আবেদন খারিজ করে দিলেন। তাঁর মতে হাতের লেখা বিশারদরা তেমন নির্ভরযোগ্য নন। এবং এমন এক জনকে পুলিশে চাকরি দিয়ে বৃথা অর্থ নষ্ট হবে। কলকাতা পুলিশের লোকেরা কিন্তু হাল ছাড়লেন না। তাঁরা আবারও হার্ডলেসকে আরও এক বছরের জন্য অস্থায়ী ভাবে চাকরিতে বহাল রাখলেন।
পরের বছর, মানে ১৯০৬ সালে, পুলিশ কর্তাদের সুপারিশে ফের কার্জন লিখলেন লন্ডনে। এ বার তিনি জানালেন যে, মাত্র এই গত এক বছরে হার্ডলেস ৬৮টি মামলার সমাধান করেছেন। তাঁকে ছাড়া পুলিশ বিভাগ একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়বে। এ বার লন্ডনের আধিকারিকরা দ্বিরুক্তি করলেন না। হার্ডলেসের জন্য তৈরি হল কলকাতা পুলিশে নতুন একটি পদ, গভর্নমেন্ট ইনভেস্টিগেটর অব কোয়েশ্চেনেবল ডকুমেন্টস, অর্থাৎ সরকারি জাল দস্তাবেজ অনুসন্ধানকারী। যে হার্ডলেস চাকরি-জীবন শুরু করেছিলেন ডাক বিভাগে মাত্র ৫০ টাকা মাইনের কেরানি হিসেবে, তাঁর এখন জুটল লালবাজারে নিজের আপিস আর ৫০০ টাকা বেতন।ইতিমধ্যে বঙ্গভঙ্গ হয়েছে এবং তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মাথাচাড়া দিয়েছে সন্ত্রাসবাদী জাতীয়তাবাদ। শহরে গ্রামে নানা জায়গায় তখন গজিয়ে উঠছে বেশ কিছু গুপ্ত সমিতি।
স্বদেশি ভাবাপন্ন যুবকরা বোমা বানাতে আর গুলি চালাতে শিখছে। এই বাজারে চাকরি পেয়ে হার্ডলেসের উপর ভার পড়ল বেশ অনেকগুলো বড় স্বদেশি মামলার, যার মধ্যে অন্যতম ছিল আলিপুর বোমা মামলা, যাতে জড়িত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। একটি মামুলি ইস্তাহারের হাতের লেখা বিশ্লেষণ করে হার্ডলেসই দলটির এক সদস্যকে চিনতে পারেন এবং তার মাধ্যমেই বাকিদের হদিস পায় পুলিশ।
এই সব কেসে তাঁর কাজ দেখে জাতীয়তাবাদীরা হার্ডলেসকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। এমনকি একটি মামলায় বাদীদের পক্ষের কৌঁসুলি, মি. নর্টন, তাঁকে আদালতে দাঁড়িয়ে ‘সরকারের চেয়ারের পায়ায় বাঁধা কুত্তা’ বলে বিদ্রুপ করেন। হার্ডলেস কিন্তু মোটেই সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন না। তিনি চিরকালই বলতেন যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পিতৃভূমি বিলেত, মাতৃভূমি কিন্তু ভারত। ইংরেজ এক দিন এ দেশ ছেড়ে যাবে। কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা এখানেই থাকবে। তবে উগ্র জাতীয়তাবাদ তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর ধারণা ছিল এই চরমপন্থা অবলম্বন করলে নানা ঝঞ্ঝাট দেখা দেবে এবং দেশ অচল হবে। তিনি তাই নরমপন্থী জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নেতা ফ্রাঙ্ক অ্যান্টনির সহকর্মী হিসেবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নরমপন্থী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানা কর্মকাণ্ডের আয়োজনও করেছিলেন।
তদন্তরত: কিং কোঠি প্যালেসে হার্ডলেস (চেয়ারে বসে) ও আলোকচিত্রী রাজা দীনদয়াল (একেবারে ডান দিকে)
সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন, এ সব রাজনীতির প্রশ্ন বিশেষ ওঠেনি। আর পাঁচ জন পুলিশ অফিসারের মতো তিনিও সরকারবিরোধী শক্তিকে দমনের প্রয়াস করেছিলেন। সেখানে ব্যক্তিগত রাজনীতির জায়গা ছিল না। তবে সরকারি চাকরিতে যে হার্ডলেসের মন বসছিল না, তা কিছুটা হলেও এই সব মামলার কারণেই। তাই চাকরি ছাড়ার প্রথম সুযোগেই তিনি ইস্তফা দিয়ে দেন।
সুযোগটি অপ্রত্যাশিত ভাবে তাঁর হাতে এসে যায় ১৯১২ সালে। ১৯১১ সালে হায়দরাবাদের নিজাম মাহবুব আলি খানের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর জায়গায় প্রয়াত নিজামের দ্বিতীয় পুত্র মির ওসমান আলি খান সিংহাসনে বসলেন। কিন্তু দরবারের কিছু প্রতিপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি নতুন নিজামকে সিংহাসনে দেখে খুশি হলেন না। তাঁরা গোপনে চক্রান্ত চালাতে লাগলেন কী করে নতুন নিজামকে মসনদচ্যুত করা যায়। ভাগ্যক্রমে তাঁদের একটি গোপন চিঠি ওসমান আলির হাতে পড়ে গেল। তবে সে চিঠি কে লিখেছে তা তিনি বুঝতে পারলেন না।
এ দিকে দ্রুত এই দুরভিসন্ধির অবসান না ঘটাতে পারলে যে তাঁর রাজত্ব থাকবে না, তা তিনি বুঝতে পারলেন। তখন তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে এক জন সুদক্ষ গোয়েন্দার খোঁজ চেয়ে চিঠি লিখলেন। ইংরেজ সরকার অবস্থার গুরুত্ব বুঝে কয়েক দিনের জন্য হার্ডলেসকে হায়দরাবাদ পাঠাল।
হার্ডলেস তঁর বড় ছেলে চার্লস এডওয়ার্ডকে সঙ্গে করে আস্তানা গাড়লেন হায়দ্রাবাদের কিং কোঠি প্যালেসে। সেখানে তাঁর আলাপ হল বিখ্যাত আলোকচিত্রী, রাজা দীনদয়ালের সঙ্গে। সেই আলাপের মধ্যে দিয়েই হার্ডলেস হাতের লেখা বিশ্লেষণের একটা নতুন উপায় বার করে ফেললেন। যে কোনও লেখার একটা ছবি তুলে, তাকে বিবর্ধিত করে লেখার মধ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভেদাভেদ ধরার এই নতুন রীতি ব্যবহার করে হার্ডলেস নিজামের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের চিনে ফেললেন। নিজাম তৎক্ষণাৎ ষড়যন্ত্রকারীদের তাঁর রাজ্য থেকে চিরদিনের মতো নির্বাসিত করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হার্ডলেসকে উত্তরপ্রদেশে চুনার জেলায় একটি প্রাসাদোপম বাড়ি আর কিছু জমি কিনে দিলেন। হার্ডলেসও তৎক্ষণাৎ সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিলেন।
কলকাতার পাট চুকিয়ে এ বার হার্ডলেস তাঁর বিশাল পরিবার নিয়ে চলে গেলেন চুনারে ‘দ্য স্যাংচুয়ারি’ নামক সুন্দর একটি বাড়িতে। এই সময় থেকেই তিনি স্বাধীন ভাবে গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন। তাঁর বাড়ির একতলায় তিনি গড়ে তুললেন একটি প্রয়োগশালা ও একটি গ্রন্থাগার। এর পাশাপাশি শুরু করলেন গোয়েন্দাগিরি সংক্রান্ত একটি সাময়িকপত্র প্রকাশনা। সাময়িকপত্রটি অবশ্য বেশি দিন চলেনি। তবে সেটা বন্ধ হয় যাওয়ার পর হতোদ্যম না হয়ে কিছু দিনের মধ্যেই আবার নবকলেবরে তা প্রকাশ করেন হার্ডলেস। এই দ্বিতীয় বারের উদ্যোগ বেশ কিছু দিন চলেছিল। হার্ডলেসের প্রয়াস ছিল ‘ডকুমেন্ট ইনভেস্টিগেশন’ নামক এই পত্রিকাটির মধ্য দিয়ে গোয়েন্দাদের কাজে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের ব্যবহার বাড়িয়ে তোলা। পত্রিকাটির যে ক’টি সংখ্যা আজ পাওয়া যায়, প্রায় প্রত্যেকটিতেই বিভিন্ন রকমের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের দ্বারা গোয়েন্দাগিরির কাজের কথা আলোচনা করা হয়েছে।
তবে এই সবেরই ঊর্ধ্বে ছিল হার্ডলেসের গোয়েন্দা-শিক্ষা ভাবনা। তিনি মনে করতেন যে ভারতবর্ষে সকল জাতিরই একটি না একটি পৈতৃক ব্যবসা আছে। ব্রাহ্মণরা পূজাপাঠ করেন, বৈদ্যরা চিকিৎসা করেন ইত্যাদি। কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা যে হেতু নতুন জাতি, তাঁদের এ রকম কোনও পৈতৃক ব্যবসা নেই। তাই তাঁদের উচিত নতুন কোনও একটি বৃত্তিকে আপন কাজ হিসেবে গ্রহণ করা। অতএব তিনি একটি গোয়েন্দা পাঠশালা গঠন করেন, যাতে তিনি কেবল দুঃস্থ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেদের শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই গোয়েন্দা পাঠশালাটিও বেশি দিন চলেনি, কিন্তু এর মাধ্যমে চার্লস হার্ডলেস তাঁর তিন পুত্রকে সফল গোয়েন্দা করে তোলেন।
১৯৩০-এর দশকে আমরা একটি মামলার দলিল থেকে জানতে পারি যে, হার্ডলেসের মেজো ছেলে একাই তত দিনে মাসিক প্রায় ৩০০০ টাকা আয় করছেন। তাঁর তিন পুত্র, চার্লস এডওয়ার্ড, ফিলিপ এবং হ্যারল্ড, সকলেই সাফল্যের সঙ্গে গোয়েন্দাগিরি করেন এবং এই সংক্রান্ত বইও লেখেন। এঁদের মধ্যে চার্লস এডওয়ার্ড বাবার মতো হাতের লেখা বিশ্লেষণের পাশাপাশি আবার রাসায়নিক পদ্ধতিতে কাগজ ও কালির পরীক্ষার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। মেজো ছেলে ফিলিপও নানা ধরনের রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কনিষ্ঠ পুত্র হ্যারল্ড মন দেন বন্দুকের গুলি, বারুদ এবং গুলি-সংক্রান্ত আঘাতের বৈশিষ্ট্যের উপর।
যদিও চার্লস হার্ডলেস ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই মারা যান, তাঁর ছেলেরা কিন্তু স্বাধীনতার পরও থেকে যান চুনারে এবং ইলাহাবাদে। তবে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সামাজিক অবস্থার সার্বিক অবনতি হতে থাকে। হার্ডলেস বংশও এই অবক্ষয়ের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সত্তর-আশির দশকে তাঁদের পসার পড়ে যায়। অবশেষে আশির দশকে চার্লস হার্ডলেসের একমাত্র জীবিত কন্যা ‘দ্য স্যাংচুয়ারি’-তেই খুন হয় যান। তত দিনে অবশ্য হার্ডলেসের অনেক উত্তরসূরিই ধীরে ধীরে দেশ ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করেছেন বিলেতে বা অস্ট্রেলিয়ায়।
এ দিকে আধুনিক গোয়েন্দাদের ইতিহাসও তো আমাদের দেশে ম্লান হয়ে আসছে। যে দেশে এক দিন আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ বা হাতের লেখা বিশ্লেষণের মতো যুগান্তকারী সব নতুন ধরনের অপরাধবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল, সেখানে এখন অপরাধবিজ্ঞান বলতে পড়ে আছে বাকি দুনিয়ায় বহু কাল আগে অবৈজ্ঞানিক বলে খারিজ হয়ে যাওয়া ‘নারকো-অ্যানালিসিস’ বা স্রেফ ‘থার্ড ডিগ্রির’ পিটুনি। গোয়েন্দা গল্পেও তাই আসছে পরিবর্তন। ‘সি এস আই’ বা ‘বোন্স’ এর মতো সব বিদেশি গল্পের গোয়েন্দারা যখন আগের চাইতে চেয়ে ঢের বেশি সময় কাটাচ্ছেন জেনেটিক্স, ফরেনসিক অস্টিয়োলজির প্রয়োগশালায় নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনে অনুসন্ধান চালিয়ে, আমাদের গল্পের গোয়েন্দারা হয়ে উঠছেন মূলত ‘অ্যাকশন হিরো’।
গোয়েন্দাদের এই পরিবর্তনের ইতিহাসও ওই সত্তরের দশকের শেষেই শুরু। তাই অধ্যাপক পরিমল ঘোষ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, যতই আমরা ফেলুদার ভক্ত হই না কেন, ফেলুদা তো মূলত ছোটদের বই। যেখানে ব্যোমকেশ বক্সী প্রাপ্তবয়স্কদের সাহিত্যিক খোরাক, সেখানে ফেলুদা অপ্রাপ্তবয়স্কদের রোমাঞ্চের ইন্ধন। ব্যোমকেশের গল্পে আমরা দেখতে পাই প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালিদের গোয়েন্দার বুদ্ধির উপর ভরসা, কিন্তু ফেলু মিত্তিরের সময় তা বিরল। স্রেফ বুদ্ধি খাটিয়ে যে দুষ্টের দমন করা যায়, এই বিশ্বাস তত দিনে একমাত্র কিশোর মানসেই ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের গোয়েন্দা বলতে তো তখন জনপ্রিয় স্বপনকুমারের লেখার দীপক চ্যাটার্জি, যার বুদ্ধির চেয়ে ভরসা বেশি পেশিশক্তি আর গুপ্তচরদের উপর। এই পরিবর্তন যুক্তিবাদের উপর আস্থা হারানোর চিহ্ন, না কি রাষ্ট্রশক্তির নতুন পেশিবহুল রূপের প্রতীক— তা ঠিক মতো ঠাহর করা কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy