সুরেলা: চোরবাগানের শীল পরিবারের নাটমন্দিরে নববর্ষের গানের আসর। ছবি সৌজন্য: বিমানবিহারী শীল
সে ছিল এক অন্য নববর্ষ! ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বড়বাড়ির নহবতখানা থেকে ভৈরবীর মিঠে সুর ছড়িয়ে পড়ত ঘুমে আচ্ছন্ন চারপাশে। লখনউয়ের তালিম হুসেন সে দিন অন্য মেজাজে জুঁই, বেল আর চামেলির সুবাস ছড়িয়ে দিতেন তাঁর সানাইয়ের জাদুতে। তাঁর সঙ্গে নাগাড়ায় তাল মেলাতে গলদঘর্ম হতেন বৃদ্ধ চুন্নু মিঞা। পাড়াপড়শি অনেকে ব্যঙ্গ করতেন, এ সব বড় লোকেদের আদিখ্যেতা! তবু, বাবুবিলাসের সেই দিনগুলিতে বছরের প্রথম দিনটায় পুজোপার্বণ, খানাপিনা থেকে নাচঘরের মেহফিলে থাকত নতুন নতুন চমক। উৎসবের অঙ্গ হিসেবে বেশি ইনাম দিয়ে দেশের সেরা উস্তাদ বা বাইজিকে এনে আসর মাতানোই ছিল বাবু-কালচারের ঐতিহ্য। আতরের গন্ধ, গোলাপজলের মৃদু সুবাস, আর গানের মাঝে ‘কেয়াবাত’ তৈরি করত মায়াবী জগৎ।
সে দিনের নহবতখানা আজ স্মৃতি। আভিজাত্যের গন্ধ-মাখা সেই বর্ষবরণের স্মৃতি আজও উসকে দেয় স্মৃতিমেদুর বাঙালিকে। বঙ্গাব্দের উৎস প্রসঙ্গেও বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত। কারও মতে, বাংলায় নববর্ষ উৎসবের প্রচলন হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। কেউ বলেন সুলতান হুসেন শাহ এর প্রচলন করেন। আবার অন্য একটি মত অনুসারে, তিব্বতি শাসক স্রং সন গাম্পো-র নাম থেকেই বাংলা সনের উৎপত্তি। রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের স্রষ্টা ও প্রবর্তক, এমনও মত অনেকের। আবার অনেকে মনে করেন বাংলায় নববর্ষ উৎসব শুরু হয় অনেক পরে, মূলত ইংরেজ আমলে। ইংরেজি নববর্ষের অনুকরণে বাংলায় বর্ষবরণের উৎসব শুরু হয়েছিল।
নববর্ষের দিনে বনেদি পরিবারে গানের জলসা আজ বিরল। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারে টিকে আছে প্রাচীন রীতি-রেওয়াজ। যেমন, নববর্ষের ভোরে আজও গানের আসর বসে চোরবাগান শীল পরিবারে। বছরের প্রথম দিনটা শুরু হয় গৃহদেবতা দামোদরজিউয়ের পুজো দিয়ে। আজও বাড়ির সধবা ও দীক্ষিত মহিলারা পাঁচ রকম ফল, পান-সুপুরি ও পৈতে নিয়ে গৃহদেবতা দামোদরজিউকে দর্শন করে থাকেন। বাড়ির ছোট-বড় সকলে নিয়ম করে দেবতার চক্র দর্শনে যান।
শোভাবাজার রাজপরিবারে পয়লা বৈশাখে গৃহদেবতা গোবিন্দজিউয়ের সেবায়েতদের পালা পরিবর্তনের দিন। এক বছর অন্তর সেবায়েতদের পালা পরিবর্তন হয়। আগে বৈশাখের প্রথম দিনে গানের আসর বসত, এখন আর সে সব হয় না। তবে পুজোর সাবেক রেওয়াজ আজও অটুট। কিছু বনেদি পরিবারে চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত গৃহদেবতাকে ঝারায় বসানো হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত দেবতার গায়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। দেওয়া হয় বিশেষ বৈকালিক ভোগ। এতে থাকে বেল, তরমুজ, খরমুজের পানা বা শরবত। থাকে বিভিন্ন রকমের ফল। ঠাকুরঘরের জানালায় আজও লাগানো হয় খসখসের পর্দা।
সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে। তবে নববর্ষের ভোরে মন্দিরে মন্দিরে লক্ষ্মী-গণেশের নতুন মূর্তি আর খেরোর খাতা নিয়ে অপেক্ষমাণ মানুষ এখনও একেবারে অদৃশ্য হয়নি। নববর্ষের দিনে দোকানে দোকানে গণেশ পুজোর প্রচলন হয় অনেক পরে। আগে বেশির ভাগ দোকানে গণেশ পুজো হত অক্ষয়তৃতীয়ায়। পরে অবশ্য বৈশাখের প্রথম দিনেই দোকানে দোকানে এই পুজোর চল বাড়তে থাকে। তবে পঞ্জিকামতে আজ সকাল ৭টা ৫২ মিনিটে অমাবস্যা শুরু। ছাড়বে আগামী কাল সকালে। ফলে অনেকের মতে, হালখাতা বা গণেশ পুজো আগামী বুধবার, অক্ষয়তৃতীয়ায় করলে ভাল।
উত্তর কলকাতার প্রবীণ বাসিন্দাদের মুখে আজও শোনা যায় অতীতের নববর্ষের স্মৃতি। দোকানে ঢুকতেই ছেটানো হত গোলাপজল। কিছু কিছু দোকানে খাওয়ানো হত সরবত, ঘিয়ে ভাজা কচুরি আর ছোলার ডাল। সঙ্গে মাটির সরায় দরবেশ, পান্তুয়া।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ থেকে কুস্তি, বিয়ের পদ্যে ঠাঁই সবার
নববর্ষের সন্ধে গড়াতে উত্তরের পাড়ায় পাড়ায় রকে ভিড় জমাতেন মানুষজন। বৈশাখী সন্ধ্যায় আড্ডা জমে উঠত চায়ের কাপে চামচ দিয়ে চিনি মেশানোর টুংটাঙে। অন্য দিকে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ত শহরের নিষিদ্ধ পল্লিতে। সস্তা আতরের কড়া গন্ধ, বেলফুলের মালা আর কুলফি-মালাইওয়ালাদের ডাক অলিগলি হয়ে রাজপথে এসে মিশত।
এখন জামাইষষ্ঠী কিংবা ভাইফোঁটার মতোই নববর্ষ উদ্যাপনও যেন ক্ষণিকের বাঙালিয়ানার কৃত্রিম মোড়কে ঢাকা পড়েছে। ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা ঢাকাই জামদানি, বালুচরির সাজে অভিজাত রেস্তরাঁয় বাঙালিখানার প্যাকেজ বুঁদ হওয়া এখন অনেক সহজ। বাঙালির নববর্ষ আজ শুধুই যেন প্যাকেজবন্দি এক পার্বণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy