Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

আড়াই হাজারের মা

নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদি শিশুদের বাঁচিয়েছিলেন তিনি। কখনও আলুর বস্তায় ভরে, কখনও বা কফিনে লুকিয়ে। পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়আর এই সময়ই ইরিনার কাজ বহু গুণ বেড়ে গেল। কাজ মানে যে পরিবারগুলো লুকিয়ে বেঁচে আছে, তাদের জন্য জাল নথি বানানো।

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

নাৎসি-দের সাঁজোয়া গাড়িগুলো যখন পোল্যান্ড দখল করতে ঢুকল, ইরিনা সেন্ডলার তখন ওয়ারশ’-তে, ‘পোলিশ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট’-এর হয়ে কাজ করছেন। সেটা ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এক বছরও কাটল না, তাঁর চোখের সামনেই প্রায় পাঁচ লক্ষ ইহুদি আটক হলেন ওয়ারশ’ শহরের ‘ঘেটো’তে। শুরু হল তাঁদের নতুন নরক-জীবন।

আর এই সময়ই ইরিনার কাজ বহু গুণ বেড়ে গেল। কাজ মানে যে পরিবারগুলো লুকিয়ে বেঁচে আছে, তাদের জন্য জাল নথি বানানো। ১৯৩৯-১৯৪২ সালের মধ্যে ইরিনা ও তাঁর জনাকয়েক বন্ধু প্রায় ৩০০০ জাল কাগজ বানান, যার সাহায্যে ইহুদিরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারেন।

কিন্তু বিপন্ন মানুষের সংখ্যা যেখানে কয়েক লক্ষ, সেখানে এইটুকু সাহায্য! মন ভরছিল না তাঁর। সুযোগ এল ১৯৪২ সাল নাগাদ। তৈরি হল এক গোপন সংস্থা ‘জ়েগোটা’, নাৎসি চোখ এড়িয়ে ইহুদিদের সাহায্য করতেন যার সদস্যেরা। তত দিনে প্রায় তিন লক্ষ ইহুদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রেব্লিংকা-র কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। এই পরিস্থিতিতে জ়েগোটা-সদস্যেরা ইরিনাকে তাঁদের শিশু বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানালেন। ইরিনা তৎক্ষণাৎ রাজি।

প্রাণ বাজি রেখে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বভাব ইরিনার মধ্যে বোনা হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলাতেই। পোল্যান্ডেরই অন্য এক শহরে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন তিনি। এক বার টাইফাস জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় সেখানে। বড়লোকেরা যখন শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল, ইরিনার চিকিৎসক বাবা ঝাঁপিয়ে পড়েন গরিব ইহুদিদের বাঁচিয়ে তুলতে। বড় ছোঁয়াচে এই রোগ। অল্প দিনের মধ্যে ইরিনার বাবাও মারা যান এই টাইফাসেই। ইরিনা তখন সাত। এর পর মায়ের সঙ্গে তিনি আসেন ওয়ারশ’-তে। ওয়ারশ’ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দেখলেন, সেখানে এক অদ্ভুত বিভেদের খেলা। ইহুদি আর অ-ইহুদিরা এক সঙ্গে বসতে পারে না, ক্লাসের বাইরে ঘুরতে পারে না। যেন এক অদৃশ্য হাত সমানে পাঁচিল গেঁথে চলেছে উভয়ের মধ্যে। প্রতিবাদ করলেন ইরিনা, সাসপেন্ডও হলেন নিয়ম ভাঙার অপরাধে।

পড়া শেষ করে তিনি যুক্ত হলেন সমাজসেবামূলক কাজে। সে কাজ করতে করতেই বাধল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জীবনও বাঁক নিল এক নতুন দিকে, যার শুরুটা হয়েছিল রাস্তার শিশুদের নিয়ে। ঘেটো-র রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অনাথ শিশুদের লুকিয়ে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিতেন ইরিনা ও তাঁর সঙ্গীরা। তাঁর সমাজকর্মীর পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঘেটোয় অবাধ যাতায়াতের ছাড়পত্র জোগাড় করেন ইরিনা। ছদ্মনাম নিলেন ‘জ়োলান্টা’। নাৎসিরা ভাবত, তিনি অসুস্থ ইহুদিদের দেখাশোনা করেন। আড়ালে কিন্তু চলত শিশুদের সেই নরক থেকে বার করার প্রস্তুতি। এ কাজে তাঁর সঙ্গী ছিল মাত্র জনাদশেক। ঘেটোর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কোর্টহাউস আর ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে দিয়েই চলত শিশুদের পাচার করার কাজ। একটু বড়দের শিখিয়ে দেওয়া হত ক্যাথলিক প্রার্থনামন্ত্র, যাতে কোনও সন্দেহ না জাগে। আর চার্চের ভিতরে তাদের গা থেকে খুলে নেওয়া হত হলুদ তারা— তাদের ইহুদি পরিচয়।

আর যারা এতটুকু, বুলি ফোটেনি মুখে, তাদের পোরা হত পিঠের ব্যাগে, আলুর বস্তায়, যন্ত্রপাতি রাখার ব্যাগে, সুটকেসে, আবার কখনও অ্যাম্বুল্যান্সেও। কফিনেও নাকি ঠাঁই পেয়েছিল কয়েক জন। পরের দিকে, তাঁরা শিশুদের মা-বাবার কাছে দরবার করতেন সন্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। মা-বাবাদের সেই সংশয়, আশঙ্কামাখা চাহনির কথা আমৃত্যু ভুলতে পারেননি ইরিনা। বার বারই তাঁরা আকুল হয়ে জানতে চাইতেন, সত্যিই তাঁদের সন্তানরা নিরাপদে থাকবে তো! কেউ ছাড়তে চাইতেন না সন্তানের হাত। আবার কেউ শুধু মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে কোলের শিশুটিকে তুলে দিতেন তাঁদের হাতে। যদি বেঁচে যায়, এই আশায়। ভরসা দিতেন ইরিনারা। যুদ্ধ-শেষেই তো বাচ্চারা আবার ফিরে আসবে পরিবারের কাছে। সেই কথা অবশ্য রাখতে পারেননি তিনি। যুদ্ধ-শেষে দেখা যায়, যে ২৫০০ শিশুকে তাঁরা উদ্ধার করেছিলেন, যুদ্ধ তাদের প্রায় সকলকেই অনাথ করেছে।

২৫০০! অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। ঘেটো থেকে বের করে শিশুদের পাঠানো হত জ়েগোটার সদস্যদের পোলিশ খ্রিস্টান বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়দের কাছে। নিয়মিত শেখানো হত খ্রিস্টান প্রার্থনা ও মূল্যবোধ, যাতে গেস্টাপো বাহিনীর জেরার মুখে তাদের ইহুদি পরিচয় বেরিয়ে না আসে। কয়েক জনকে পাঠানো হয় ওয়ারশ’র অনাথ আশ্রমে, রোমান ক্যাথলিক কনভেন্ট আর স্কুলে। ইরিনা চেয়েছিলেন, একটি শিশুর জীবনও যাতে বিপন্ন না হয়, যুদ্ধ-শেষে মা-বাবার হাতে যেন ফেরত আসে তাঁদের সন্তান। তাই উদ্ধার করা শিশুদের নাম-ঠিকানা, নতুন পরিচয় চিরকুটে লিখে কাচের বয়ামে ভরে বন্ধুর বাগানে আপেল গাছের নীচে পুঁতে রেখেছিলেন তিনি। শেষরক্ষা হয়নি যদিও। ১৯৪৩ সাল নাগাদ ধরা পড়েন ইরিনা। প্রচণ্ড অত্যাচারে হাড় ভাঙে শরীরের, কিন্তু মুখ ফোটেনি এক বারও। অক্ষত থেকে যায় বয়ামগুলো। নাৎসি পতনের পর মাটি খুঁড়ে সেগুলো উদ্ধার হয়।

কিন্তু ২৫০০ শিশুকে দ্বিতীয় জন্ম দেওয়া ইরিনা সেন্ডলার প্রচারবৃত্তে আসেন ঢের পরে। কেমন করে গেস্টাপোদের ওই কড়া নজরদারি এড়িয়ে ২৫০০ শিশুকে বার করে আনতেন তাঁরা? হাসিমুখ, ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখের অধিকারী ওই চার ফুট এগারো ইঞ্চির ছোট্টখাট্টো চেহারাটা কেমন করে পিঠের বস্তায় শিশুদের পুরে গেস্টাপোদের সামনে দিয়ে নির্ভীক পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসত, ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও? তাও এক বার নয়, বার বার? জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে যখন তাঁর কৃতিত্ব সারা পৃথিবী জানল, তখন সেই অসীম সাহসের উৎস ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি— মা-বাবা শিখিয়েছিলেন, কোনও মানুষ যখন ডুবতে বসে, তখন তাকে সাহায্য করতেই হবে, সে তার ধর্ম, রাষ্ট্র যা-ই হোক না কেন।

ছোট্ট কথা। অতি সাধারণ, কিন্তু অমূল্য। এই সহজ কথাটুকু কেন যে মনে রাখতে চায় না আধুনিক পৃথিবী!

অন্য বিষয়গুলি:

Irena Sendler World War Nazi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy