Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Cats in Ray Family

রায় পরিবারের কলমে প্রাণ পেয়েছিল যে সব বিড়াল

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মজন্তালী সরকার থেকে সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’-র স্বপ্নবিড়াল। সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র প্রফেসর শঙ্কুর ‘নিউটন’ কিংবা ব্রাউন সাহেবের ‘সাইমন’।

সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৭
Share: Save:

বিড়াল বা মার্জারকুলের ইতিহাস নিদেনপক্ষে সাড়ে ন’হাজার বছরের পুরনো বলেই ধরা যায়, অন্তত পণ্ডিতেরা তাই বলেন। প্রাচীন সভ্যতার তথ্যতালাশ বলে, পৃথিবীর বুকে এই আপাতনিরীহ অথচ সুচতুর, গোঁফখেজুরে চতুষ্পদ প্রাণীটির বিচরণ বহুকালের। মিশরীয় সভ্যতায় সামাজিক এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের অঙ্গ বেড়াল। পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে তার পরিচিতি। কখনও সে দেবীর বাহন, কখনও এক আহ্লাদি পোষ্য অথবা ঘোর অমঙ্গলের প্রতীক। পৃথিবীর নানা সাহিত্যের মাঝে সে নিজেকে বেশ নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছে। কবি এলিয়ট মার্জারকুলের নামকরণ নিয়ে পদ্য করেছেন; লুইস ক্যারল গপ্পো বলেছেন চেশায়ার ক্যাট-এর, যে থেকে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেও তার আকর্ণ হাসিখানা ভেসে থাকে হাওয়ায়! আর লন্ডনে রানিমার সাক্ষাৎপ্রার্থী পুষিবেড়াল তো নার্সারি রাইমের পাতা ছেড়ে কল্পনার অলিন্দ পেরিয়ে এক লাফে প্রবেশ করেছে শিশুমনের আঙিনায়— সেও প্রায় দুই শতাব্দী আগে।

মা ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে বিড়ালের অনুপ্রবেশ লৌকিক ধর্মবিশ্বাসে। ফলে গণেশের বাহন ইঁদুরের মতোই বেয়াদপি চালচলনেও সে ছাড় পেয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে কমলাকান্তের দুধের বাটিতে চুমুক দিয়ে ‘ক্ষুদ্র মার্জার’-এর আবির্ভাব। আসলে বেড়াল শ্রেণির ওই ধাত, পরস্বাপহরণকারী ও পরশ্রীকাতর এবং অবশ্যই ভেকধারী। ভাজা মাছখানা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু আদপে ‘কেহ মরে বিল ছেঁচে কেহ খায় কই’— এই হ’ল তার মনের কথা।

মার্জারশ্রেণির সঙ্গে মনুষ্যসমাজের এই পারস্পরিক আদানপ্রদান, উপেন্দ্রকিশোর থেকে শুরু করে সত্যজিৎ অবধি সৃষ্ট মার্জারদের সকলেরই এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। খানিক কল্পনা, খানিক বাস্তব এবং বেশ খানিক ননসেন্স হিউমার-এর মিশেলে বর্ণিল সেই সব চরিত্র!

প্রথমেই ঘুর ঘুর করে গৃহস্থের সেই ‘দুষ্টু বেড়াল’। সে খালি ভাবে টুনটুনি পাখির ছানা খাব। যে বেগুনগাছে পাখি বাসা বেঁধেছে তার নীচে দাঁড়িয়ে বলে, “কি করছিস লা টুনটুনি?” পাখি তাকে সমঝে চলে, বলে, “প্রণাম হই, মহারানী।” তার পর যেদিন টুনটুনির ছানারা ডানা মেলে উড়তে পারল, সে দিন বিড়াল এসে ডাক দিতেই সে পা উঁচিয়ে তাকে বলল, “দূর হ’ লক্ষ্মীছাড়ি বিড়ালনী!” বলেই ফুড়ুত করে উড়ে পালায়। দুষ্টু বেড়াল রেগেমেগে গাছে উঠে তাকে ধরতেও পারে না, উল্টে বেগুনকাঁটার খোঁচা খেয়ে নাকাল হয়ে ঘরে ফেরে।

এর পরেই উঁকি দেয় আর এক চতুর বিড়াল, যাকে আমরা চিনি মজন্তালী সরকার নামে। ছিল সে জেলেদের বাড়ির হাড় জিরজিরে, ঠ্যাঙার বাড়ি খাওয়া প্রাণী। গয়লাবাড়ির দুধ, ছানা, ক্ষীর খাওয়া মোটাসোটা জাতভাই ছিল তার ঈর্ষার কারণ। কৌশলে তাকে জেলে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে আনে সে। সেখানে আসতেই জেলেরা ভাবল গোয়ালাদের দইদুধখেকো চোর বিড়ালটা এসেছে, মাছ খেয়ে শেষ করবে! মার বেটাকে! মার খেয়ে মরেই গেল সেই বিড়াল। এ বার ধূর্ত বিড়াল গোয়ালা বাড়িতে আরামে দিন কাটায়, খায়দায় আর বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর নাম জিজ্ঞেস করলে বলে— মজন্তালী সরকার! উপেন্দ্রকিশোরের কলমের খোঁচায় এক দিন অবিশ্যি তারও প্রাণ গেল। শেষ হল তার অসদুপায়ে জীবনযাপন।

‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’— এই বাক্যটি বাংলা ভাষায় একটা উপমার জায়গা করে নিয়েছে। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘হ য ব র ল’ বইটি, তারও আগে বেরিয়েছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায়। সেই বিড়াল অবিশ্যি স্বপ্নে দেখা এক অদ্ভুতুড়ে চরিত্র। সে ফ্যাচফেচিয়ে হাসে, আর হেঁয়ালি করে। মনে হয় আমাদের চার পাশের মনুষ্য সমাজের এক অদ্ভুত শ্রেণির প্রতিনিধি সে, যাদের কোনও আইডেন্টিটি নেই, নেই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসও! এই উদ্ভট মার্জার চরিত্রের সূত্র হয়তো বা ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর চেশায়ার ক্যাট, যার কথা আগেই বলেছি!

লীলা মজুমদারের জীবনে মেকুরকুলের সংখ্যা বেশ ভারী। শিলং বাড়ির মেহমান অবশ্যই ছাই রঙের হুলো, ‘ছাই বেড়াল’, যার সঙ্গে পরিচয় কোনও এক ঘোরতর শীতের রাতে, লেপের নিশ্চিন্ত আয়েশে। ক্রমশ ছাইবেড়াল ধরাকে সরাজ্ঞান করে। রসুইখানায় ঢুকে দুধের সর, শিকেয় তোলা ভাজা মাছ খেয়েদেয়ে সরে পড়ে সে। নেংটি ইঁদুর দিয়ে জলখাবার তো আছেই। পাশের বাড়ির সাহেবের দুই বিলিতি বেড়ালকে এক দিন তাড়া করল এক দিন সেই হুলো। ভয় পেয়ে তারা তো সরল গাছের মগডালে চড়ে পড়েছে, আর নামতে পারে না। অবশেষে সাহেবের বেয়ারা এসে মই লাগিয়ে, গাছে চড়ে, বিড়াল নামাল।

কলকাতায় এসে তাঁর পরিচয় ‘ফুলি’ বিড়ালিনীর সঙ্গে। শাশুড়িমার আদরের পোষ্য, সাদা-সোনালি ডোরাকাটা, প্রায় কুকুরছানার মতো বড়, তবে স্বভাবচরিত্রে অত্যন্ত সাধু। মাছ না খেয়ে মাছ পাহারা দেয় সে। ও দিকে চৌরঙ্গী বাড়িতে তখন হুলস্থুল। নেংটি ইঁদুরের অত্যাচারে প্রাণান্তকর পরিস্থিতি। বাড়িময় ছানাপোনা কিলবিল করে তাদের। এমনকি জিমি-ব্রাউনির মতো জোড়া সারমেয়কেও তাদের থোড়াই কেয়ার। মেজদি পুণ্যলতার বাড়ি থেকে আনা হল ছাই আর কালো ডোরাকাটা হুলো। তাঁর কথায় ‘ওই হলো কলিকালের শুরু। জিমি ব্রাউনির পাশে শুয়ে হুলো রোদ পোয়াত। আমরা বলতাম— আহা! ও বড় ভালো।’ কালক্রমে সে গড়ে তুলেছিল সাত-আট জন বাছাই করা হুলোর এক বাহিনী। লীলাদেবীর শান্তিনিকেতন বাসকালে আলাপ হয়েছিল এক ‘দিদি বিড়াল’-এর সঙ্গে। তাঁর প্রতিবেশী এক কবির বাড়ি আলো করে থাকত সাত-আট জনের এই মার্জার পরিবার। সবচেয়ে গলাবাজ ছিল ওই দিদি বিড়াল। কিন্তু এক বার কলকাতা থেকে দীর্ঘ দিন বাদে গিয়ে দেখেন কবির বাড়ি ফাঁকা— সঙ্গে মার্জার পরিবারও বেপাত্তা। ভারী মন খারাপ হয় তাঁর দিদি বিড়ালের জন্য। রাতে আঁধারে সে বাড়ি থেকে যেন ভেসে আসে তার ডাক। কেয়ারটেকার সুধাদা এসে রসুইখানার দরজা খুলতেই বিকট ই-হি-আঁ-ও আওয়াজ দিয়ে মাটি ছুঁয়ে নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল দিদি বিড়াল। আসলে সেও ছিল অভ্যেসের দাস। রাতে রসুইখানার লাগোয়া শিশুগাছ বেয়ে ছাদের কাছে খুদে জানালা দিয়ে ঢুকে আসত সে ভিতরে। দরজা খুলতেই বেরিয়ে যেত সকালবেলা। দরজায় তালা পড়ায় হয়েছিল যত বিপদ।

সুবিমল রায়ের ‘স্বদেশলাল’কে মনে আছে? সে বানিয়েছিল বিড়ালের হারমোনিয়াম! বাড়ির আর পাড়ার বিড়ালগুলোর উপর অনেক পরীক্ষা চালিয়ে সে জেনে নিয়েছিল তাদের গলার স্বর হারমোনিয়ামের কোন পর্দার সঙ্গে মেলে! সেই অনুযায়ী তাদের পর পর বসিয়ে তাদের ল্যাজে চাপ দিলেই সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি সুর শোনা যেত তাদের ম্যাও ম্যাও থেকে! এর জন্য তাকে কতই না আঁচড় কামড় খেতে হয়েছে। এর শেষ পরিণতিও ছিল সাঙ্ঘাতিক। কারিগরের বানানো কাঠের হারমোনিয়ামের খাঁজে খাঁজে লেজ গোঁজা বিড়ালরা একদিন বিদ্রোহ করে বসল। স্বদেশলাল সে দিন নাকে খত দিয়ে বললে, ‘আমার বিড়াল শিষ্যেরা আমাকে আজ ক্ষমা করুক আর শান্তিতে থাকুক!’

রায়বাড়ির অপর দুই কন্যা সুখলতা ও পুণ্যলতার হাতেও তৈরি হয়েছে মার্জার-চরিত। টুনুরা গেছে পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে। মনের ভুলে টুনুর মায়ের আদরের মেনি আটকে আছে ভাঁড়ার ঘরের ভিতরে। সারাদিন সে কান্নাকাটি করে, জানান দেয় বন্দিদশার। টুনুর বন্ধু বুড়ো, যে থাকে খোলার ঘরে আর যার সঙ্গে টুনুর মেশা বারণ, সেই এসে খাবার দিয়ে তাকে বাঁচায়। টুনুর মা বুঝতে পারে ভুল। বুড়ো-টুনু বন্ধু হয়ে যায়। পুণ্যলতার উমরী-ঝুমরী ছিল দুই বনবিড়ালের ছানা। ভালমন্দ খেয়েও তাদের চুরি করা স্বভাব। ছোট জালের আলমারিতে থাকে দুধ। এক জন ঝাঁকালে দুধ চলকে পড়ে, অপর জন চেটে খায়। কিন্তু মেকুর চরিত্র চাতুর্যের পরাকাষ্ঠা। মায়া কাটাতে সময় লাগে না তাদের। দু’জনেই এক দিন হাওয়া হয়ে যায় শহর ছাড়িয়ে শালবনে। নিন্দুকেরা বলে ‘বনের বেড়াল ঘরে এসে দুধু ভাতু খায়, খেতে খেতে আড় নয়নে বনের পানে চায়।’

এ বার বিড়ালের মতোই লাফ দিয়ে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে এসে পৌঁছনো যাক গিরিডির সেই বাড়িতে। ‘নিউটন’ নামে দেশি আটপৌরে এক বিড়ালের বাস এখানে। বাড়ির মালিকের নাম প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। ভারী আদুরে এই জীবটি প্রফেসরের ছায়াসঙ্গী, কখনও তাঁর কাঁধে বসে আদুরে ভঙ্গিতে গালে গাল ঘষে সে; কখনও বা বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়ায় রোবট বিধুশেখরের কাছ থেকে খানিক দূরে। প্রফেসর তার জন্য উদ্ভাবন করেন ‘ফিশ পিল’। কিন্তু সত্যজিতের লেখনীতে ভর করে নিউটন বিজ্ঞানীর যতটা কাছাকাছি ছিল প্রথম দিকে, পরে ক্রমশ যেন এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। প্রথম দিকের গল্পে ডায়েরির পাতায় এসেছে নিউটন বারংবার, অথচ পরের দিকে সে যেন হারিয়ে গেছে অন্তরালে, শঙ্কুর দেশ-বিদেশ ভ্রমণই কি তার একমাত্র কারণ?

এ বার নিশুতি এক রাতের অন্ধকারে উঁকি দেওয়া যাক ‘এভারগ্রিন লজ’-এর অন্দরমহলে। ব্যাঙ্গালোর শহরের ফ্রেজার টাউনে প্রায় পঞ্চাশ বছর পুরনো একতলা এই কটেজের ভিতরে তিন জন মানুষ বসে তাস খেলছে! এ বাড়ির একদা মালিক ব্রাউন সাহেবের ডায়েরির এক বিস্ময়কর তথ্য তাদেরকে টেনে এনেছে এই বাড়ির ভিতরে। বহু বছর আগে এক ২ নভেম্বরের ঘটনাক্রম লেখা হয়েছিল লাল কালিতে। এর আগের সেপ্টেম্বর মাসে এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়েছে সাইমনের। মৃত সাইমনের জন্য এক ধরনের মনোকষ্ট আর শূন্যতা নিয়ে বেঁচে আছেন সাহেব। কিন্তু সেই নভেম্বর সন্ধ্যায় তিনি দেখতে পান তার আদরের সাইমনকে— ফায়ার প্লেসের পাশে—হাইব্যাকড চেয়ারটিতে বসে আছে সে। অন্ধকার ঘরে একজোড়া স্নেহ মাখানো চোখ তার দিকে চেয়ে থাকে। কে এই সাইমন? সত্যিই কি ফিরে আসবে
সে আবার, দেখা দেবে এই তিন জন অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষকে?

অবশেষে সে আসে। বাইরের প্যাসেজ পেরিয়ে প্রবেশ করে ঘরের ভিতরে। মৃদুমন্দ পদক্ষেপে এগিয়ে যায় ফায়ারপ্লেসের পাশে লাল মখমলে মোড়া হাইব্যাকড চেয়ারের দিকে। সাইমন আসলে ছিল ব্রাউন সাহেবের আদরের পোষা বিড়াল— যার অপঘাত মৃত্যু হয়েছিল বহু বছর আগে।

এই ভাবেই রায়বাড়ির গল্পকারদের হাতে সৃষ্ট বিড়ালেরা বাংলা সাহিত্যের অলিগলিতে বিচরণ করে এসেছে। লেখকের লেখনী নৈপুণ্যে সেই সব মার্জার চরিত হয়ে উঠেছে রসেবশে অনন্য— ‘যারা বেড়াল পোষে বা বেড়ালরা যাদের পোষে’ তাদের সবার কাছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy