ছবি: কুনাল বর্মণ
পাড়া ও পড়শিদের গালগল্প, উপকথা, রূপকথা আর রূপোকথা। কিন্তু ঈশ্বরীতলার নয়, বরং মজে যাওয়া আদিগঙ্গার ধারে কলিতীর্থ কালীঘাট আর দিনরাত বলো হরি হরি বোল-এ মুখরিত কেওড়াতলার গত শতকের শেষ কয়েক দশকের কাহিনিকল্প। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বার বার বলেই দিয়েছেন যে পাড়ার ইতিহাসের প্রামাণিকতার দায় তার কাঁধে নেই, ইতিহাস পাড়ার ধারেকাছে তিনি নেই। বইটার নাম তো ‘বুনো স্ট্রবেরি’, একেবারে সুইডিশ ছবির লেবেল। গত সপ্তাহে এক উদ্ভট খেয়ালে কালীঘাটের বাজার ঢুঁড়েও আমি স্ট্রবেরি পেলাম না, বুনো তো দূরের কথা। বহুজাতিক কোম্পানির প্যাকেটের স্ট্রবেরি লেক মার্কেটে উঁকিঝুঁকি দেয়, গোলকায়নের সর্বজনীন প্রসারেও দেখলাম যে স্ট্রবেরির প্যাকেটটি ফেংশুইয়ের মতোই আজও কালীঘাটে ঢোকেনি। তবে আপাতভাবে ভূগোল আর ইতিহাসকে থোড়াই কেয়ার করেন সঞ্জয়, সেটা এই পাড়াকাহিনির শিরোনামে পরিষ্কার।
অন্য পক্ষে এই একই কেওড়াতলা আর কালীঘাট নিয়ে পাড়াপড়শির আর একটি গল্পকথা ফেঁদেছেন কল্লোল, কালপর্বটা প্রায় সঞ্জয়ের বলা কাহিনির সমান্তরাল, কিন্তু দৃষ্টিকোণ আলাদা, অন্য ধরনের কুস্তোকুস্তি। তবে ওঁর বইয়ের নামেতেও বাংলা বায়োস্কোপের নামের ছায়া আছে, মিশেল আছে উত্তর-আধুনিকতার। নামটি, ‘তক্কোগুলি, চরিতাবলী ও আখ্যানসমূহ’। দুটো বইয়ের বিন্যাসেই সিনেমার নানা চালু রীতির প্রয়োগ দেখি। ইংরেজি শব্দগুলি সহজবোধ্য, যেমন ‘স্ন্যাপ-শট’, ‘ফ্ল্যাশ-ব্যাক’ বা ‘ডিপ-ফোকাস’। ফ্ল্যাশ-ব্যাক শব্দটি দু’এক বার সঞ্জয়ের লেখাতে উঁকিঝুঁকি মেরেছে। কালানুক্রমিক ধারাবাহিকতাতেও সঞ্জয় বা কল্লোলের বড় একটা আগ্রহ নেই। ‘ক্ষণদর্শন’ নির্ভর উপস্থাপনা, লেখক দুজনেই যেন মেজাজে কম-বেশি বৌদ্ধ। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে কালীঘাট ও কেওড়াতলার নামে এলাকা দু’টির মাহাত্ম্য আছে। বরাবর প্রশ্ন ওঠে, কালীঘাট না কলকাতা, কোনটার মধ্যে কোনটা? উত্তর নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে চুলোচুলি চলে, নিষ্পত্তি হওয়া দুষ্কর। ঐতিহ্যের অবয়ব ওই সব বিবৃতিতে তৈরি হয়, শাঁসে জলে ভরপুর হয়ে বিবৃতিগুলি পুনর্মুদ্রিত হয়। কালীঘাট-কেওড়াতলার ঐতিহ্য নিয়ে রচনাগুলির মধ্যে চটজলদি কয়েকটা নামও মনে আসে। যেমন, সূর্য্যকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘কালীক্ষেত্র দীপিকা’ ও উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কালীঘাট ইতিবৃত্ত’ আর অধুনালুপ্ত ‘কৌশিকী’ পত্রিকায় প্রকাশিত কেওড়াতলা শ্মশান নিয়ে ইন্দ্রজিৎ চৌধুরীর তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধ। এই সবই পাথুরে ফলক ও দলিল নির্ভর নিশ্ছিদ্র প্রামাণিক ইতিহাস। এ হেন ধ্রুপদী ঢঙের রচনার বিপরীতে আছে সঞ্জয় ও কল্লোলের ইদানীন্তন প্রাকৃতজন কথা। এখনই তো লেখার মোক্ষম সময়, পাড়া ও বেপাড়া সবই ‘মল’-এ একাকার হচ্ছে, এমনকী গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজে ঢোলগোবিন্দ হয়ে মধ্য-কলকাতার এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চষে ফেলেও ছেলেবেলার পরিচিত গোমেশ লেনটার কোনও হদিসই করতে পারেননি। ঢোক গিলে দুঃখটা মেনে নিলেন, উৎসে ফেরা শক্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় আদৌ ফেরা যায় কি? হয়তো বা চেষ্টাটাই সার। স্মৃতিপথে কোনও এক ফেলে দেওয়া আমির টুকরো পাওয়াটাই লাভ।
পাড়া শব্দটার গায়েই তো একটু গ্রাম গ্রাম গন্ধ লেগে থাকে, লব্জটা ‘পল্লী’ বা ‘পাটক’-এর অপভ্রংশ আর অভিধানে ‘গ্রামার্ধকং পল্লীসংজ্ঞম্’ এই বলে একটি সংজ্ঞার্থও দেওয়া আছে। তবে বর্ধিষ্ণুতার আমলে কলিকাতা কমলালয় তো খোপে খোপে পাড়াময় ছিল, জমকালো বাবু শহরে গাজনের শোভাযাত্রা হুতোম সে দিন পাড়াগুলির নামাক্ষেই বিবৃত করেছিলেন। এই অনতি সে কালে, গত শতকের চারের দশকেও, দা’ঠাকুরের লেখা লোকপ্রিয় শহুরে ভুলের শব্দবাজির গান তো আড়ে বহরে বেড়ে যাওয়া কলকাতার পাড়ার ফর্দ মাত্র, ‘নাইকো হাতী, নাইকো বাগান, হাতীবাগান বলে/ বাদুড়বাগানেতে দেখি বাদুড় নাহি ঝোলে!/ নেবুতলায় গিয়ে দেখি নেবু নাহি মিলে/ বৌবাজারের নামটা কেন শুধু শুধু দিলেন।’
ঐতিহ্যবুভুক্ষুদের কাছে এই সব পাড়ার খাঁই বেশ বেশি, কালের হিসেবে কলিকাতা শহর একটু অর্বাচীন বলেই হয়তো বুভুক্ষাটা বেশি। শুদ্দুরের শহর কলকাতায় কায়েত ও নবশাখরাই তো পাড়া জাঁকিয়ে তুলেছিল, প্রত্যেকটি বাঙালি পাড়ার ইতিবৃত্ত যেন উঠতি পরিবার ও দেশজ সমাজের কথা ও কীর্তি, শেঠ-বসাক থেকে সুবর্ণবণিক ও কৈবর্তদের বোলবোলাও-এর ইতিকথা। এই সব পাড়ার রত্নভূষণ ছিল, যেমন পটলডাঙার বসুমল্লিক ও হাটখোলার দত্ত, শোভাবাজারের রাজবাড়ি আর জানবাজারের রানি মা। ইতিকথায় পাড়া ও পোষ্টা, এলাকা ও সমাজ, দলাদলি আর হাঙ্গামা মিলেমিশে যায়। রাধারমণ মিত্র ও তারাপদ সাঁতরার মতো চরণিকরা এবং যোগেশচন্দ্র বাগল ও থানকপ্পন নায়ারের মতো নথিখোর গবেষকরা ফলক ও বাড়ির নিশানা ও নানা প্রতিষ্ঠানের সালতামামি পাড়ায় পাড়ায় খুঁজে বের করেছেন। তাঁদের চেষ্টায় জেনেছি যে খানিকটা সাহেবি বশংবদ হয়ে, খানিকটা সামাজিক মানমর্যাদার প্রত্যাশায় ও জনহিতৈষণার তাগিদে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই সব পাড়াতেই নানা বিদ্যাচর্চা, সমাজ-সুধার ও দেশোদ্ধারের ভিত গড়ে তুলেছিলেন, একেবারে হেরিটেজের পত্তনী বন্দোবস্ত। ‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো’।
সমাজশাস্ত্রীদের তাবৎ ছকে কলকাতার প্রচলিত পাড়াকাহিনি আদৌ বাতিলযোগ্য নয়, তবে একটু একমেটে, একমুখী ও একঘেয়ে। এই একঘেয়েমির বিরুদ্ধেই সঞ্জয়ের লেখা, পাড়াভাবনার মুখকে একটু ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাঁর বড় হয়ে ওঠা কালীঘাট-কেওড়াতলার ভূগোলে একটি বড়লোকও নেই, খানদানি বনেদিপনাও নেই। পাড়ার বাসিন্দার কাছে ওই বড়লোকরা সব থাকে বাংলা ছায়াছবিতে। ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র বা বসন্ত চৌধুরীরা রুপোলি পর্দায় বড়লোকি সাজুগুজু করে হাজিরা দিতেন। চার পাশে হলও ছিল, সস্তার রূপায়ণ বা কালিকা, একটু ভদ্রস্থ দামের উজ্জ্বলা, বসুশ্রী। বাস্তবিক আসলি বড়লোকের বাড়ি সেই প্রতাপাদিত্য রোডে, ‘বাড়ি ছিল ফোয়ারাশুদ্ধ, হল ঘরের দেয়ালটা আয়না মোড়া।’ মালিক মারওয়াড়ি, মাইকার ব্যবসায়ী। কোনও হিংসে নয়, খালি পাড়ার লোকেরা বমকে যেত ভদ্রলোকের ব্রেকফাস্টের কম্বিনেশনে। ‘তিনি নাকি রোজ প্রাতরাশে ডালপুরি, রাজহাঁসের ডিমের ‘‘মামলেট’’, পোলাও ও চন্দ্রপুলি খান’। গত শতকের পঞ্চাশের বছরগুলি ছিল সঞ্জয়ের শৈশব। তখনই জ্ঞানের নাড়ি টনটনে, খাদ্য আর খিদে বিচার এক-আধটু বুঝতে শিখেছেন। কালীঘাটি বাঙালরা সকালে খেত ‘ভাত, নয় চা’, আর ঘটিরা দু’একটা লুচি আর সুজির চিনি-ঘ্যাঁট খেত, নাম মোহনভোগ। তবে ঘটি বা বাঙাল যাই হোক, ‘মামলেট খাওয়া বড়লোকেরা জগুবাবুর বাজার নয়তো লেক মার্কেট যায়। কালীঘাট যায় বাস্তুহারা, কালীঘাট বা ক্ষীরোদ ঘোষের বাজারে’। থাকবন্দি সমাজে সব স্মৃতি-আচরণ এক হতে পারে না, কড়ির টানে ধরা পড়ে বাজারের টান, আর পেটের টানে প্রাণের টান; রোজকার এই টানাটানির পাল্লাতে ধরা পড়ত এ পাড়া আর সে পাড়ার বিভাজনটা।
সঞ্জয়ের মতে এ হেন কালীঘাটের ইতিহাস লেখা যায় না। বনেদি পরিবার নেই, সে রকম কোনও ‘হ্যাপেনিং’ ১৯৫০ বা ’৬০-এ সঞ্জয়ের পাড়ায় ঘটেনি। ‘কালীঘাটে টেরাকোটা নেই, গম্ভীরা নেই, স্ট্যাচু নেই।’ পাড়ার সঞ্জয়ের চোখে, ‘আমাদের কালীঘাট অনেকটা পেঁয়াজের মতো। যতই খোসা ছাড়াও, খোসার আড়ালে খোসা, তার পরেও খোসা, শাঁসটুকু আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’ একেবারে খাওয়ার পরে রাঁধা, আর রাঁধার পরে খাওয়া, এই তো পাড়াপড়শির জীবন। সঞ্জয়ের জবানিতে, মাসিক ও সাপ্তাহিক দৈনন্দিনতার খতিয়ান, ‘এ পাড়ায় শীতের শেষে লোকে বড়ির ঝোল খায়। লেপতোষক রোদে দেয়, লুঙ্গি পরে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গান শোনে।’ বা ‘আকাশবাণীতে অনুরোধের আসর মানেই রবিবারের দুপুর শেষ হয়ে এল— চা বসাই, কয়লার উনুন; ছাইয়ের গাদায় ঘুমিয়ে আছে বেড়াল ছানা।’
সারবান কথা নেই, স্মরণ-গল্পগুলি তুচ্ছ ও অপাঙ্ক্তেয়, এই বলে পাড়ার ইতিবৃত্ত না লেখার যতই পাঁয়তারা কষুন না কেন সঞ্জয়, কথাবলির বাঁধুনির খাতিরেই পাড়ার দাঁড়াটা ঠিক রাখতে হয়। উত্তরে কালী-কলকাত্তাওয়ালি আর দক্ষিণে কেওড়াতলা, ঐতিহাসিক হিসেবে একটু নবীন কিন্তু প্রসরে নামডাকে জাঁকালো। গা ঘেঁষে চলেছে টালির নালা, থুড়ি আদি গঙ্গা, এলাকাটাই তো ‘গাঙ্গেয়’। একেবারে সে কাল থেকে এই তো সে দিনের আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আদি গঙ্গার উপরে কাঠের সাঁকো ছিল, অপর পারে চেতলা স্কুল। একটু আগে চোখ মেলা আমি, প্রায় সমকালে ময়দান দাপানো পিন্টু শূর বা অনুজ সঞ্জয়, সবারই কৈশোরের বুড়ি, ‘সেন্ট চেতলা’। মাঝে মাঝে ওখানকার গুটিকয়েক প্রোডাক্ট প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে গিয়ে হিন্দু, হেয়ার বা সেন্ট জেভিয়ার্সের সোনাপানাদের সঙ্গে একটু ঠুসোঠুসি করত। সত্তরের দশকে পাকা ব্রিজ হয়ে পাড়ার রাস্তা জুড়ে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হলেও সাঁকোটা অনেক দিন ছিল, পা চালিয়েই এ পার-ও পার করতে অভ্যস্ত ছিল গঙ্গাপারের লোকেরা। গঙ্গা ভরসা, তাই প্রেমেন্দ্র মিত্র খাস হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা হয়েও তেমন খাতির পাননি, মানে পাড়ার লব্জে আসেননি। দিনেশ দাস আদি গঙ্গার জলে মানুষ, পাড়ারই জ্ঞাতি কবি, ইস্কুলের চ্যাংড়াদের মুখে মুখে ফিরত ‘বাংলার কবি চণ্ডীদাস, চেতলার কবি দিনেশ দাস’। গঙ্গার এ পার-ও পার, ভূগোলের রেখাতেও, গরমিল নেই এবং ছড়াটায় সমসাময়িক ও ঐতিহ্য ভারসাম্য বজায় রাখছে।
কালীঘাট কেওড়াতলার কালচারটা সৃজনশীল, উপকথাই হোক আর ইতিহাসই হোক, সৃষ্টিশীলতার ভূমিক্ষেত্রের নকশা খেয়াল রেখেই সঞ্জয় নানা পটচিত্র দেখান, পাড়াপড়শির গুপ্তকথা সামনে আসে। রোচনা-কাজলের পূর্বরাগ, একেবারে পাড়ার ছেলে ও মেয়ের আদত ছাঁচ, ‘কাজল বি-কম পাশ করে বংশকৌলীন্যের মর্যাদা রাখতে দেহচর্চা করে। রোচনা বক্ষদ্বয় খাতার অন্তরালে রেখে পিইউ পাশ করেছে। এ বার যোগমায়া দেবী কলেজে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিএ পড়বে।’ শ্রেয়াংসি বহু বিঘ্নানি, পুরুষালি ‘দৃষ্টি পট’ ও মেয়েলি ‘সাহস বিস্তৃত বক্ষপট’-এর মিল অত সহজে হয় না। মিলোতে গেলে মাঝে মাঝে দিগ্ভ্রান্তের অ্যা়ডভেঞ্চার করতে হয়। আর ওই পৌষ-ফাগুনের পালার মধ্যে পাড়ার মার্ক্সবাদী ইউনিটে নকশালি বজ্রনির্ঘোষী প্রশ্ন ওঠে, ‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ মানে কী?’ ঘড়ি একটু দেখেই নেতা শ্যামাদা জবাব দেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটাই অসামাজিক, তার আবার সামাজিকতা কী?’ রাজনীতির তাত্ত্বিক ঝগড়ায় উত্তাল কলকাতার সব তত্ত্বই কালীঘাটি ইউনিটের লোকাল কর্তা শ্যামা গুহ-র উচ্চারণে ‘ভোকাস’ ওঙ্কারধ্বনির মধ্যে
ডুবে যেত।
পাড়ার প্রণয় ও বঙ্গীয় পলিটিক্স-এর স্থানীয় খুঁচখাঁচের মধ্যে পাড়াপড়শির জীবন সেই ষাট-সত্তর দশকের পর্বে বাঁধা গতেই চলে, ‘খাটের তলায় পেতলের স্টোভ। নিশুতি রাতে বাচ্চা ট্যাঁ ট্যাঁ শুরু করলে, তবু উপায় নেই, স্পিরিট ল্যাম্প বার করে দুধ জ্বাল দেয় কানাই মিত্তিরের সিরিঙ্গি বউ।’ দৈনন্দিনতার ক্লান্তি আচ্ছন্ন করে ফেলে নিম্নবিত্তের গতানুগতিক রাতকে, ‘চিলেকোঠায় সে-বাড়ির মেজো ছেলে ভোলা বাতি জ্বেলেই কেশব নাগের বীজগণিতে মাথা রেখেছে— ঘুমে ন্যাতা— তার স্বপ্নের জীবনে কোনও লগটেবিল নেই।’ রাতভোর কী করেই বা স্বপ্নসম্ভব হবে?
ঠিক এখানেই পড়শি হিসেবে তক্কো জুড়েছেন কল্লোল। সত্তরের দশকের শেষে, জরুরি অবস্থার অবসানে, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কেওড়াতলার কিছু উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে, পাড়ার নানা সঙ্গে ও অনুষঙ্গে, নানা অকাজের কাণ্ডকারখানায়, যাচাই করতে বসেছিলেন তাঁদের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নপ্রকল্পকে। কালীঘাটের দক্ষিণঘেঁষা উপ-এলাকা, কাঠের সাঁকো ও পাকা ব্রিজটার মোড়ে দাগানো এক উপকেন্দ্র, কেওড়াতলা-শীতলাতলা হিউম রোড লাগোয়া বাস্তুহারা বাজার। পাড়াপড়শির ঝামেলা মেটানো, বন্দিমুক্তির জন্য গলা ফাটানোর মধ্যে পিপিএফ গণসংগঠন বানানো ও ১৯৮৫-তে পুরসভার ইলেকশনে এই হেরো আখ্যানে কেওড়াতলা তার মাহাত্ম্য ছাড়েনি। ছিল নারাণদা, আমি গোবিন্দদা বলেই ছেলেবেলা থেকে তাকে ডাকতাম, চ্যাম্পিয়ন আচার বানাত আর বাড়ি বাড়ি বিক্রি করত। হাজার আমন্ত্রণ পেয়েও পাড়ার কোনও দোকানে সেই মাল রাখেনি, কারণ বেশি বিক্রি মানে বেশি লাভ, আর বেশি লাভ মানেই তো ‘ক্যাপিটালিস্ট রোডার’। দাদা ও সবের ধারেকাছে নেই, দুরুস্ত জবাব, ‘ওয়ান্স আ কম্যুনিস্ট, অলওয়েজ আ কম্যুনিস্ট।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঘুরতে ঘুরতে এক বার কেওড়াতলার ঠেকে এসেছিলেন, পাড়ার ছেলেরা ভাল চাটের ঘুগনি দেয়, শক্তিও কৃতজ্ঞতার দায়ে পড়ে আবৃত্তি করলেন ‘অবনী বাড়ি আছ?’ ছেলেরা শ্রদ্ধায় হতবাক, কেবল কেওড়াতলা মোড়ের এক নম্বর বাড়িটার বাসিন্দা, পিপিএফ-এর একনিষ্ঠ সমর্থক বকেয়া ধরা গলায় বলেছিল, ‘এত বার ডাকলেন, হারামি সাড়াই দিল না।’
বন্দিমুক্তির টানে, হাজরার গণমঞ্চের কোরাসে গলা মেলাবার আহ্বানে ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী রামচন্দ্রন ও আমাদের জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনে লোক সরবরাহের তাগিদে কেওড়াতলা আড়াআড়ি বাড়ছিল, আবার ভাটার টানে ভূগোলটা কমেও আসত। দু-এক দিন পাড়াপড়শিদের কেউ কেউ অতিথি-অভ্যাগতদের সুবাদে ডেবরা ও উত্তরবঙ্গকে ছুঁত। হিউম রোডে দেবাশিসের বাড়িতে আসতেন কানু সান্যাল, নিতাই দাস, ভবদেব মণ্ডল আর গুণধর মুর্মু, শোনা হত স্বপ্নভঙ্গের গল্প, গ্রামেগঞ্জে ভুল চেনা ও ভুল কাটাবার রকমফের। ’৭৭-এ মাও মারা গেলেন। সন্ধের রেডিয়োতে খবর এল, গুরুদ্বার পার্কের উল্টো দিকে ফুটপাতে কয়েকটা ছেলে ক্যারম খেলছিল, নিত্যদিনের কাজ। ছেলেরা কেন জানি না গেয়ে উঠল মৃদু অথচ স্পষ্ট উচ্চারণে, ‘জাগো, জাগো, সর্বহারা’। সকলের চোখে জল। পরের দু’দিনের মধ্যেই আর্টিস্ট অরুণ আর সন্তুর হাতযশে আর অধ্যাপিকা শিপ্রা সরকারের আনুকূল্যে নামানো হয়েছিল চিন বিপ্লবের মাউন্ট এগজ়িবিশন, পার্কের উলটো দিকের বড় দেওয়ালে রাত জেগে কাজ টানার জন্য গ্যাবলাদার বউও অক্লান্ত চা সরবরাহ করেছিলেন। পাড়ার ছেলেদের কাজ। সেই দু’দিনের দিনচর্যায় চিনের বিপ্লবী মাও, এক প্রায় হারানো ভাবনায় আমাদের চেয়ারম্যান, পাড়ার স্বজন হয়ে গিয়েছিলেন। মনে আছে যে, এগজ়িবিশন দেখতে লোকের বেশ ভিড় হয়েছিল, অন্য পাড়া ধারও নিয়েছিল। কেওড়াতলা-কালীঘাটের দিনচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল লং মার্চের সাগা। খাড়া-বড়ি-থোড় ও থোড়-বড়ি-খাড়ার মধ্যে অন্য এক কাল ও ভূগোলকে ছুঁতে পাওয়ার ক্ষণিক ঈপ্সা।
তবে পথেঘাটের পলিটিক্সটা পাড়ার বাসিন্দারা তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে ঠিক করত, নানা অভিনব কায়দায় রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে মোকাবিলা করত। রাসবিহারী মোড়ে বাসভাড়া বৃদ্ধির জন্য জমায়েত, পুলিশ সুজাতকে এক লাঠির বাড়ি দিয়েছে। বাবুদার ভাগ্নি শিখু, পোস্টারের আঠা বানানোর মূল কারিগর, পুলিশটার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে লাগাল এক কামড়। এক রাতের জন্য অন্যদের সঙ্গে শিখুর হাজতবাস, পাড়ায় হেলদোল নেই। পাকা ব্রিজটার মোড়ে, চেতলা আর কেওড়াতলা, দুই পক্ষীয় মস্তানের বোমাবাজি। পুলিশ পোস্টিং যথারীতি জরদ্গব, বাজার-জীবন ওষ্ঠাগত। পরের দিন ব্রিজের মুখে জনসমাবেশ, রাস্তা জুড়ে পুলিশ মোতায়েন। আনকোরা বক্তা গৌরী উঠে সাবলীল বক্তৃতার ঝোঁকে বলে গেল যে গোলমালের সময় পুলিশ ‘বোকা পাঁঠা’র মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ভিড় জুড়ে ‘হাসির হররা’, হাজির ওসি পার্বতীবাবু মুখ চুন করে থানায় ফিরে গেলেন। পুলিশরা হতভম্ব। ক্ষমতার এই রকম বেইজ্জত কেওড়াতলাতে সে দিন সম্ভব ছিল।
কেওড়াতলা কালীঘাটের প্রান্তবাসী ঝালদার মাঠ। হতদরিদ্র মানুষের বাস। বাবুদের বাড়িতে গতর খাটায়, ওদের কাছে ছিঁচকে ছিনতাইবাজরাও আশ্রয় পায়। ফ্রি কোচিং স্কুলের সুবাদে সাফসুতরো ভদ্রলোক ছেলেমেয়েদের এ বসতিতে যাতায়াত। অতবড় এলাকায় সিএমডিএ প্রতিশ্রুতি মতো তখনও একটি সাধারণ শৌচাগার বানিয়ে দেয়নি, চিঠিচাপাটিতে সুরাহা হয়নি। বস্তিতে যেন একটু কংশালি গন্ধ আছে। এক জন বস্তি বৃদ্ধ গোপাল মণ্ডলের পরামর্শে ও নেতৃত্বে জনা তিরিশেক মহিলা বাসিন্দাকে নিয়ে কোচিংয়ের মাস্টাররা রানিকুঠিতে পুরমন্ত্রী প্রশান্ত শূরের বাড়িতে অভিযোগ জানাতে হাজির হয়েছিল, মন্ত্রী মহাশয় দেখা করতে নারাজ। ব্যস শুরু হল উদারা, মুদারা, তারায় মহিলা নিঃসৃত কণ্ঠে নানা অদ্ভুত সম্পর্কের ছড়বেছড় শব্দের বোমায় ‘বম্বার্ড দ্য হেডকোয়ার্টার্স’। কয়েক মিনিটের মধ্যে মন্ত্রী মহাশয় দেখা করলেন। দাবিও
আদায় হল।
এ সব খুচরো তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার, মহাভারতীয় সঞ্জয়ের হিসাবে ‘হ্যাপেনিং’ নয়। কেওড়াতলায় এক বার কিন্তু ‘হ্যাপেনিং’ ঘটেছিল। একটা শব্দমাত্র উল্লেখ করেও সঞ্জয় চেপে গিয়েছেন। কেওড়াতলার বাসিন্দাদের একটা চিরকেলে সুবিধা আছে। বঙ্গীয় মহাত্মা ও মহীয়সীদের অন্তত এক বার করে দেখতে পায়, বেশির ভাগকে শেষ মিছিলে কেওড়াতলাতেই আনতে হয়। যেমন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায় ও প্রমোদ দাশগুপ্ত, ঋত্বিক ঘটক বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কাতার দিয়ে লোক দাঁড়াত, চোখ মোছামুছি, মাঝে মাঝে স্লোগান, ভক্তদের ঠেলাঠেলি। প্রশাসনের সঙ্গে কোনও এক অলিখিত চুক্তিতে শ্মশানে ভিড় ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব থাকত তৎকালীন শ্মশানদাদার হাতে। ১৯৯২-এর এপ্রিল মাস, বঙ্গীয় নবজাগরণের মহান উত্তরসাধক সত্যজিৎ রায়ের মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কেওড়াতলায় আনা হয়েছে, ভিড়ে ভিড়ে একাকার। কী খেয়ালে দু-এক জন ভুঁড়ো পুলিশ আধিকারিক আগ বাড়িয়ে মালা চড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আর যায় কোথা! মালা হাতে অগ্রণী শ্মশান-স্বপন অকুতোভয়ে আধিকারিকের ভুঁড়িতে খোঁচা দিয়ে লাইন ঠিক করার চেষ্টা করল, দুরুস্ত খেজুরে গল্পবাজ সফি সাহেবের সঙ্গে জাপটাজাপটি। ‘সাহাদা-সাহাদা’ করে স্বপন শ্মশান মাত করল। তার বক্তব্য সাফসুতরো। পোষ্টা পুলিশ কমিশনার বি কে সাহা স্বয়ং তাকে আগে মালা চড়ানো ও ভিড় সামলাবার দায়িত্ব দিয়েছেন, সে বশংবদ নির্দেশ চালকমাত্র। কেওড়াতলার হ্যাপেনিংটা পরের দিন সব কাগজে শিরোনাম হয়। শব পোড়া ও মড়া দাহের বাঙালি কালচারের ক্যালেন্ডারে চিরমর্যাদার স্থান পায়।
সঞ্জয় ও কল্লোলের পাড়া-কাহিনির লেখন পড়তে পড়তে কখন আমিও সাপেক্ষ হয়ে পড়েছি। পুনঃকথনে কেওড়াতলার দীর্ঘ সময়কালীন বাসিন্দারূপে আমিও তর্ক জুড়েছি, ফুটও কেটেছি। পাড়া-জীবনের কেন্দ্র তো লগ্নতা, আমার পাড়া ও পাড়ার আমির মিশ্রণে তৈরি হয় পাড়াজীবনের নির্মাণ স্মরণের বস্তুজগৎ ও মনোজগৎ। পরিবেশ ও প্রতিবেশের আদানপ্রদানে তৈরি হয় পাড়াজীবনের অবয়ব, সময় ও স্মরণের মাখামাখিতে বস্তুজগৎ ও মনোজগতের প্রলেপ তৈরি হয়, নির্মিত অবয়বে আস্তরণ পড়ে। গোলকায়নের তাগিদ ও কৃৎকৌশলে যে কোনও সময় আমার পাড়াটি হাজির হয় মাল্টিমিডিয়ার পরিবেশনে, ঐতিহ্যবুভুক্ষা ও রক্ষার প্রদর্শনীতে, লোকায়নের রকমারি আর্কাইভস ও এথনিক্স-এর মোড়কে। প্রযোজকের বয়ানে আমার পাড়ার ইতিবৃত্ত ঐতিহ্যের কার্যকারণে আবদ্ধ, প্রগতির নিশ্চয়তা ও আধুনিকতার গতিতে অবসিত। পরিবর্তিত পাড়ার বিবর্ধনের ইতিকথায় নাচার পাড়ার গাল্পিক আমিটা হয়ে পড়ি অপাঙ্ক্তেয় ও অদৃশ্য।
অথচ ক্ষণদর্শনে বা চকিত সংলাপে প্রান্তিক পাড়ার পিছিয়ে থাকা গাল্পিক আমিটা মাঝে মাঝে বর্তমানের এগিয়ে থাকা আমিটার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই ভুবনে ‘আমি’ সত্তাটি নির্বাসিত না অভিবাসী, কর্পোরেটের নাটবল্টু না এক বেখাপ্পা ক্ষুব্ধ মানুষ? গোলকায়নের প্রদর্শনীতে আমার পাড়াটি ফেরিওয়ালার ডাক সমেত অনুকৃত হতে পারে, একেবারে যেন সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্র অনুসারী লোকায়নের একটি ভাণ, ভাষাটা অবশ্যই গ্লোবাল ইংরেজি। কিন্তু ভাণটিতে পাড়ার আমির চেনাজানা গলার ঝালঘুগনি ও ভাগীরথী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গুটকে কচুরিটা থাকবে না।
পরিবেশ ও প্রতিবেশের সেই লগ্নতা তো ছিন্ন। তাই কবেকার পাড়ার গাল্পিক আমিটার সঙ্গে আজকের গোলকায়িত আমিটার চাগিয়ে তোলা ভাবনার চকিত সংলাপ কোনও এলিয়ে পড়া মেদুরতা নয়, বরং আত্মস্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy