Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Tripura

এক টাকার টিকিটে দুর্গাপুজোর লটারি

কারণ, বিজয়ীর নামে হবে দুর্গাপুজোর সঙ্কল্প। চালচিত্রে কালি দিয়ে আঁকিবুকি করলেন রবি ঠাকুরের দিদি। দশভুজা দুর্গা দেখে মূর্ছা গেলেন ত্রিপুরার রানি। সে কালের দুর্গাপুজোয় মিশে আছে নানা গল্পের টুকরো। রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন এই মাণিক্য রাজারা সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। তাই পুজোর দিনে রাজপ্রাসাদে বসত সঙ্গীতসভা।

রাজবাড়ির পুজোর প্রতিমা।

রাজবাড়ির পুজোর প্রতিমা।

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ২৩:০৫
Share: Save:

কুড়ুল দিয়ে কাটতে হত কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গাদেবীর বৈকালিক ভোগ— দোলে গুড়ের পাক। প্রকাণ্ড কড়াইয়ে দোলে গুড় জ্বাল দিয়ে বোরার মধ্যে ঢালা হল। দশ-বারোটা বোরা জ্বাল-দেওয়া গুড়ে বোঝাই হত। পুজো শেষ হলে লোহার মতো শক্ত সেই ভোগ কুড়ুল দিয়ে কেটে রাজবাড়ির কর্মচারীদের বাড়িতে প্রসাদ পাঠানোই ছিল নিয়ম।

কৃষ্ণনগরের মহারাজা গিরিশচন্দ্র নিয়ম করেছিলেন, প্রত্যেক কর্মচারীকে নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো করতে হবে। গাভীর বাঁটের প্রথম দুধ, গাছের প্রথম ফল দেবীকে উৎসর্গ করতে হবে। ‘শেক্সপীয়র বিদ্যা-বিশারদ’ কৃষ্ণনাগরিক উমেশচন্দ্র দত্তগুপ্তের জেঠামশাই রাজবাড়ির কর্মচারী ছিলেন। এক বার কন্যাদায়ের কারণে বাড়িতে পুজোর আয়োজন বন্ধ রাখলেন। খবর গেল গিরিশচন্দ্রের কানে। সব শুনে বললেন, “কী! আমার কর্মচারী দুর্গোৎসব করবে না! যা দরকার আমার তোষাখানা থেকে যাবে। পূজার সমস্ত খরচ আমার।”

খুব সুপুরুষ ছিলেন মহারাজা। দীর্ঘদেহী। দোগাছিয়ার তাঁতিরা তাঁর জন্য আলাদা করে তেরো হাত কাপড় বুনত। কর্মচারীদের বাড়িতে পুজো দেখতে তিনি নিজে আসতেন।

রাজবাড়ির পুজোর প্রতিমা গড়ত শান্তিপুরের পাঁচ-ছ’জন কারিগর। প্রতিমা গড়া শেষ হলে মহারাজা হাত জোড় করে কারিগরদের বলতেন, “তোমরা যদি অনুমতি করো, তা হলে আমি মাকে পাটে বসাতে পারি।” তারা বলত, “আপনি বসান।”

পটুয়াদের আঁকা দুর্গাঠাকুরের চালচিত্র দোয়াতের কালির পোঁচে চিত্রবিচিত্র করে দিয়েছিলেন বালিকা সুকুমারী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যম কন্যা সুকুমারী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে এগারো বছরের বড় ছিলেন। বাড়ির ছেলেমেয়েদের পাঠশালা বসত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঠাকুরদালানে। ওখানে প্রতিমাও তৈরি হত। এক বার পুজোর তিন দিন আগে পটুয়ারা চালচিত্র আঁকা শেষ করে ঢাকা দিয়ে চলে গেছে, বালিকা সুকুমারীর হঠাৎ কী খেয়াল হল, চালচিত্রের কাপড় খুলে ফেলে দোয়াতের কালি দিয়ে আঁকাআঁকি শুরু করে দিলেন: “এতদিনকার সযত্ন সম্পাদিত চিত্রকর্ম সমস্ত এক দণ্ডে পণ্ড হইয়া গেল। বাড়িতে এক মহা হুলস্থুলু পড়িয়া গেল। তখন পটুয়াদিগকে ডাকাইয়া যেমন-তেমন করিয়া আবার চালখানি চিত্রিত করানো হইল।”

গৃহস্থের দরজায় কার্তিক ঠাকুর ফেলার মতো সে কালে বাড়ির উঠোনে দুর্গামূর্তি রেখে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটত। এক বার এই ঘটনায় মারামারি বেধে গিয়েছিল বেলঘরিয়া গ্রামে। ১৮২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। আমোদ দেখবে বলে আগের দিন রাতে গ্রামের ছেলেরা নিজেদের বারোয়ারি পুজোর মূর্তিটাই রেখে এল এক গৃহস্থের উঠোনে। ভোরবেলায় সদর দরজা খুলে প্রতিমা দেখে গৃহস্থ ভদ্রলোক অগ্নিশর্মা। দা এনে প্রতিমা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললেন। পাশের পুকুরে ডুবিয়ে বাঁশ আর কাঠ চাপা দিয়ে দিলেন। ছেলের দল মজা দেখতে এসে দেখে ঠাকুর নেই! ফেরত চাইতে গেলে লোকটির সঙ্গে তাদের হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।

সে বারেই কলকাতার চাঁদনি চকের গোলমালের জেরে রীতিমতো ফৌজদারি মামলা চলেছিল। সপ্তমী পুজোর সকালে। গঙ্গায় নবপত্রিকা স্নান করিয়ে বাজনা বাজিয়ে কোনও পুজোর শোভাযাত্রা ফিরছিল। এক দল দুষ্কৃতী হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে মারামারি শুরু করে। ঢাক-ঢোল ভেঙে দেয়, নবপত্রিকার কলাগাছ কেটে ফেলে। পুলিশ এসে অবস্থা সামাল দেয়। বহু লোককে থানায় চালান করে। কোর্টে কারও তিন মাস, কারও পাঁচ মাস কারাবাসের শাস্তি হয়।

পরের বছরও বারোয়ারি মণ্ডপে মারামারি লেগেছিল জয়নগর-শ্যামপুকুর এলাকায়। সমাজচ্যুত এক তাঁতিকে সমাজে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন এক ব্রাহ্মণ। এমন গোলমাল হয় যে, দু’পক্ষই লেঠেল ভাড়া করে আনে। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকায় ১৮২১-এর ২২ সেপ্টেম্বর লেখা হয়েছিল, “পূজার দিবস ঠাকুরাণীর সম্মুখে খণ্ড প্রলয়ের মত অতিশয় মারামারি হইয়াছিল তাহাতে অন্য বলিদান ও রক্তপাতের অপেক্ষা প্রায় রহে নাই… বারএয়ারী পূজাতে বারএয়ারী মারামারি এক্ষণে প্রসিদ্ধি হইয়াছে।”

পুজো আর লটারিকে একাকার করে দিয়েছিলেন জনৈক ব্যবসায়ী। কলকাতার পশ্চিমে শিবপুর গ্রামের সেই ব্যক্তি পুজোর সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে লটারি খেলার ডাক দেন। টিকিটের দাম এক টাকা। মোট আড়াইশো টিকিট। যে জিতবে, সে কী পুরস্কার পাবে? সেটা অবশ্য খুবই অভিনব— বিজয়ী ব্যক্তির নামে সঙ্কল্প হয়ে ওই দুর্গাপূজা করা হবে। সংবাদপত্রে এই খবরের শিরোনামে লেখা হয় ‘সূর্ত্তির দুর্গোৎসব’। ১৮২২-এর ঘটনা। তখন লটারি খেলা ‘সূর্ত্তি’ নামেই জনপ্রিয় ছিল।

“কি ঝাড়ন ঝেড়েছ বাবা একাত্তরের ঝড়ে,/ চালচুলো সব গেল উড়ে/ বাবা, ঝড়ের কি গুঁতো,/উড়ে গেল মুতো,/ গরুগুলো হয়ে গেল বেঁড়ে।”— কবিতাটির রচয়িতা ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ‘একাত্তরের ঝড়ে’ বলতে ১২৭১ বঙ্গাব্দের কথা বলা হয়েছে। ইংরেজির ১৮৬৪ সাল। আশ্বিন মাসে দেবীপক্ষের পঞ্চমী পুজোর দিন বেলা দশটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত একটানা ঝড়-বৃষ্টিতে সে বারের পুজো পণ্ড হয়ে যায়। কবি ঈশানচন্দ্রের এই কবিতায় ঝড়ের দাপটে মুথা (মুতো) ঘাস উড়ে যাওয়া কিংবা গরুর লেজ খসে যাওয়ার বিবরণ অতিরঞ্জিত হতে পারে, কিন্তু এই ‘অতিকথন’ বুঝিয়ে দেয় ঝড়বৃষ্টির দাপট কেমন ছিল!

দুর্গাপুজো উপলক্ষে শোভাবাজার রাজবাড়িতে ১৮৬৭ সালে পিটার নামে এক সাহেব জিমন্যাস্টিক্স দেখিয়েছিলেন। পুজোর পর লোকের মুখে মুখে ফিরেছিল পিটার সাহেবের কসরতের কথা। অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতার বেশ কিছু তরুণ জিমন্যাস্টিক্স আয়ত্ত করার ইচ্ছেয় ব্যায়ামাগার খুলে ফেলেন।

দুর্গার দশ হাত দেখে ভয়ে মূর্ছা গিয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজবংশের কিশোরী রাজরানি সুদক্ষিণা দেবী। রানি নাকি এই ‘দশ হাত’ সহ্যই করতে পারতেন না। মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য নির্দেশ দিলেন পরের বার থেকে দুর্গার দু’হাতই শুধু থাকবে। পণ্ডিতদের পরামর্শ মতো বাকি আটটি হাত ছোট ছোট করে যুক্ত করা হল, যা মূর্তির পোশাকে-অলঙ্কারে ঢাকা পড়ে যেত। ১৮৩০ সাল থেকে ত্রিপুরা রাজবাড়ির দুর্গামূর্তির বৈশিষ্ট্য এটাই।

রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন এই মাণিক্য রাজারা সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। তাই পুজোর দিনে রাজপ্রাসাদে বসত সঙ্গীতসভা। পাশের কুমিল্লা জেলা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসতেন দুই ভাই— উস্তাদ আফতাবউদ্দিন ও আলাউদ্দিন খাঁ। ষষ্ঠীর দিন থেকে মুন্না খাঁ-এর সুরমূর্ছনা ছাড়া পুজো এসেছে বলে মনেই হত না। আশি-নব্বই বছর আগে রাজধানী আগরতলায় জামা-কাপড়ের দোকান ছিল একটিই। ‘দশ দরজার দোকান’ নামে বিখ্যাত বস্ত্র প্রতিষ্ঠানটি ছিল সবার পুজোর পোশাকের একমাত্র ভরসা। দোকানের মালিক ছিলেন হাজি রহিম বক্স। রহিমসাহেব মুর্শিদাবাদ থেকে আগরতলায় গেছিলেন জীবিকার টানে। মাণিক্যরাজা তাঁকে থাকার জমি দিয়েছিলেন। শহরের প্রথম মসজিদটিও তাঁর তৈরি। তখন হাজি রহিম বক্সের বা সুর-সাধক খাঁ-সাহেবদের ‘ধর্ম’ নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। সনাতন দুর্গোৎসব এ সব নিয়ে ভাবেওনি কোনও দিন।

কৃতজ্ঞতা: রামেশ্বর ভট্টাচার্য, সুভাষ দাস, মণীশ চক্রবর্তী

অন্য বিষয়গুলি:

Tripura History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy