ঐতিহাসিক: বোলপুর স্টেশনের স্মৃতিস্তম্ভ
কিছু বোঝার আগেই বর্ধমানের দিক থেকে একটা ট্রেন এসে থামল, বেরিয়ে এল কিছু ব্রিটিশ পুলিশ, যাদের সাজপোশাক সাধারণ পুলিশের মতো নয়। এসেই জমায়েত আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালাতে শুরু করল। তত ক্ষণে বোলপুর স্টেশন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। উত্তেজিত জনতা ভেঙে ফেলেছেন স্টেশনের অফিসের দরজা-জানলা, কেটে ফেলেছেন টেলিফোন-টেলিগ্রাফের তার, আর স্টেশনে রাখা কয়েকশো বস্তা সরকারি চালের অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে। গুলির শব্দে আন্দোলনকারীরা তির-ধনুক ও ইট-পাথর নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন এই অন্য রকম পুলিশ বাহিনীকে। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই কয়েক জন গুলিবিদ্ধ হলে এই অসম লড়াই শেষ হয়। আহত সঙ্গীদের নিয়ে আন্দোলনকারীরা পালিয়ে যান।
পরে সরকারি প্রতিবেদনে লেখা হয়, ১৯৪২ সালের ২৯ অগস্ট বিকেলে তির-ধনুক, লোহার রড প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার উত্তেজিত মানুষ রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্বে বোলপুর স্টেশন আক্রমণ করেন। তাঁদের হাত থেকে স্টেশন রক্ষা করার জন্য ২০টি গুলি চালানো হয়, মারা যান দু’জন আক্রমণকারী। চার জন পুলিশ-সহ মোট ১৩ জন আহত হন।
বহু যুগ পর সমকালীন স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের স্মৃতিচারণায় পুলিশি তাণ্ডবে নিহত তারাপদ গুঁই (মোদক), জটা মুর্মু (মাঝি), কৃষ্ণকান্ত হাটি ও গণেশ সরেনের মতো আন্দোলনকারীদের নাম পাওয়া গেলেও, সমসাময়িক সরকারি নথি থেকে সে দিনের কোনও শহিদের নাম এত দিন জানা যায়নি। এই কারণেই কয়েক বছর আগে বোলপুর রেল স্টেশনে ব্রিটিশ শাসকের গুলিতে নিহত এই শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা হলেও এই স্মারকে কোনও নাম ছিল না। স্টেশনে প্রবেশের বাঁ দিকের বাগানে এই স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে— ১৯৪২ এর ২৯ অগস্ট বোলপুর রেল স্টেশনে ব্রিটিশ শাসকের গুলিতে যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের স্মরণে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরভূম জেলায় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে শহিদ হওয়ার এই একটিই ঘটনা, কিন্তু সরকারি নথিতে এই শহিদদের নাম উল্লেখ না থাকায় তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অন্ধকারে।
২৯ অগস্ট বোলপুর শহরে স্টেশনের পূর্ব দিকে কালী-বারোয়ারি তলায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে একটি সভা ডেকেছিল। ঠিক ছিল ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের পরবর্তী কার্যক্রম সে দিন ঘোষণা করা হবে। ৮ অগস্ট বোম্বাইয়ে গাঁধীজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করেছিল ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের কর্মসূচি, আর পর দিন থেকে সারা দেশ ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ ধ্বনিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করতে পথে নেমে পড়েছিল। বীরভূমে এই আন্দোলনের সূচনা ১৩ অগস্ট মুরারই গঞ্জে জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক লালবিহারী সিংহের সভার মাধ্যমে। আর ১৬ অগস্ট দুবরাজপুরে তাঁরই নেতৃত্বে এক সভায় বীরভূম জেলাকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বোলপুরে অগস্ট আন্দোলনের সূচনা ১৭ অগস্ট। লালবিহারী সিংহের নেতৃত্বে শহর পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। সোশ্যালিস্ট পার্টি, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট লিগ হিসেবেই তখনও পরিচিত), ফরওয়ার্ড ব্লক, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে বোলপুরের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যুক্ত হয়।
অন্যতম আন্দোলনকারী শান্তি সরকার তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন, ২০ তারিখ নাগাদ বোলপুরের বাজার-হাট ও গ্রামাঞ্চলের সাধারণ জনগণের মধ্যে আন্দোলনের চেহারাকে আরও জঙ্গি করে তোলার দাবি উঠতে শুরু করে। বাংলার তমলুক-সহ ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে গাঁধীবাদী পথ থেকে সরে এসে আন্দোলনকারীদের স্বাধীন সরকার গঠনের সংবাদ তাদের অনুপ্রাণিত করছিল। বোলপুরের বামপন্থী নেতা ও কর্মীরা জনগণের এই দাবিকে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে কার্যকর করে তোলার জন্য হংসেশ্বর রায়, ধূর্জটিদাস চক্রবর্তী প্রমুখ স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি শুরু করেছিলেন। ফলে ২৭ তারিখ থেকে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্বন্ধে এই কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ সেন, বালেশ্বর ভকত, শান্তি সরকার প্রমুখ বামপন্থীরা আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করেন। তখন থেকেই প্রচার শুরু হয়েছিল যে, আগামী ২৯ তারিখ ভবিষ্যৎ জঙ্গি আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করা হবে।
ফলে ২৯ তারিখ ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্য অসংখ্য মানুষ দুপুর দুটো থেকে কালী-বারোয়ারি তলার এই সভায় অংশগ্রহণ করতে বোলপুরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী, জনজাতি শ্রমজীবী মানুষ, মুটে-মজুর, রিকশাওয়ালা, দোকানদার-সহ সমস্ত ধরনের মানুষজন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিছিলে অংশগ্রহণ করে সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন। প্রধান নেতারা তখনও উপস্থিত না হওয়ায় এই জনসমুদ্র অনেকাংশে ছিল অনিয়ন্ত্রিত। ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘এ দেশ তোমাদের নয়, আমাদের’, ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’, ‘বাইরে চাল চালান বন্ধ হোক’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল বোলপুর। বিকেলের দিকে শ্রীনিকেতনের দিক থেকে আসা একটা বিশাল মিছিল হঠাৎই কালী-বারোয়ারি তলার দিকে না গিয়ে বোলপুর স্টেশন আক্রমণ করে। স্টেশনে উপস্থিত রেলের পুলিশরা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে সাহায্যের জন্য ওপরতলায় আবেদন করে। আর তার পরই ট্রেনে করে সেই ‘অন্য ধরনের’ পুলিশদের আগমন ও গুলি চালানোর ঘটনা।
১৯৩৯ থেকে বিশ্বযুদ্ধের ফলে চালের দাম প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৩৬ সাল থেকে শস্যহানির ফলে বীরভূমের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৪২-এর অগস্টে জেলার অন্নসমস্যা তীব্রতর হয়ে পড়ে। স্টেশন আক্রমণের দু’দিন পর (৩১ অগস্ট) ‘বীরভূম বার্ত্তা’ সংবাদপত্র উল্লেখ করেছিল— ‘সাধারণ মোটা চাউল এখানে একরূপ পাওয়াই যায় না। সামান্য যাহা পাওয়া যায় তাহাও আবার ৭/৮ টাকা মণ দরে বিক্রয় হইতেছে। মোটা ভাতের সমস্যা আজিকার দিনে যে আকার ধারণ করিতেছে তাহা স্বভাবতই ভয়াবহ।’ চণ্ডীচরণ সরকার, শান্তি সরকার প্রমুখ বামকর্মীরা ‘চালের দাম দু’আনা সের রাখতে হবে’ এবং ‘ধানের গোলা সিল করা বন্ধ করো’— এই দাবিতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষদের সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতেও ব্রিটিশ সরকার বীরভূম থেকে যথেচ্ছ ধান-চাল সংগ্রহ করে বোলপুর স্টেশনে জমা করতে থাকে। ২১ অগস্ট থেকে প্রধানত তাদের উদ্যোগেই শান্তি সরকার প্রমুখ বামপন্থী স্বেচ্ছাসেবক বোলপুর স্টেশনের জমা করা কয়েকশো বস্তা ধান-চাল পাহারা দেওয়া শুরু করেন। পরে নিশাপতি মাঝির নেতৃত্বে কংগ্রেসের কিছু কর্মীও তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
এই উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতেই ২৯ তারিখের সভা ডাকা হয়। কমিউনিস্ট লিগ দলের মনোরঞ্জন দত্ত, রামপদ দত্ত, চণ্ডীপদ সরকার, সুমিত্রানন্দন সিংহ প্রমুখ স্থানীয় নেতারা এই সভাকে কাজে লাগিয়ে গরিব মানুষের হাতে খাবার তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এই দলের প্রভাবিত এলাকাগুলোয় প্রধানত সাঁওতাল-সহ অনগ্রসর মানুষজন বসবাস করতেন, যাদের অবস্থা ধান-চালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। এঁদের সমবেত করে স্টেশনে জমা করে রাখা চাল দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন এই কমিউনিস্ট কর্মীরা। কিন্তু সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে ধান অধিকারের পরিকল্পনা তাঁদের কর্মীদের ছিল না।
কিন্তু সরকারপক্ষ এই আক্রমণের জন্য গোপনে প্রস্তুত হয়েছিল। তাই বাহিনী নিয়ে স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন হাওড়ার রেল পুলিশের সুপারিনটেন্ডেন্ট ও বোলপুরের কাছের কোনও স্টেশনে রেলগাড়িতে অপেক্ষা করছিল রেলওয়ে অক্সিলিয়ারি ফোর্স। জনতা স্টেশন আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে সুপারিনটেন্ডেন্টের নির্দেশে রেল পুলিশ গুলি ছোড়ে, ফলে জনতা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। আর তখনই তাদের সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিয়ে বোলপুর স্টেশনে উপস্থিত হয়ে রেলওয়ে অক্সিলিয়ারি ফোর্সও গুলি চালায়। একাধিক আন্দোলনকারী আহত হন এবং নেতৃত্বহীন জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
পুলিশ বিভাগের প্রতিবেদনে দু’জন ব্যক্তির মৃত্যুর তথ্য স্বীকার করা হলেও সরকারি নথিপত্রে তাঁদের নাম কোথাও নেই। অন্য দিকে সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিশ্চিত করে লিখে যাননি শহিদদের পরিচয়। ফলে মৃত ব্যক্তিদের নাম নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনাবশ্যক ধোঁয়াশা। কিন্তু পরাধীন বাংলার ব্যবস্থাপক সভার বিবরণী থেকে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে এই দুই শহিদের পরিচয়। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বোলপুর অঞ্চল থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস দলের সদস্য নিশাপতি মাঝির প্রশ্নের উত্তরে সরকারপক্ষ জানিয়েছিল যে, ২৯ অগস্ট গুলিতে আহতদের উপস্থিত জনতা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে চলে যান এবং পরবর্তী সময়ে মাত্র দু’জন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এই দু’জন ছিলেন, তারাপদ মোদক ও নেপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নিশাপতি মাঝি ও সরকারপক্ষের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ২৫ বছরের তারাপদ ছিলেন বোলপুরের কাছের কালিকাপুর গ্রামনিবাসী, আর নেপাল ছিলেন বর্ধমান জেলার দাঁইহাট নিবাসী ২৮ বছরের যুবক। এই দু’জনের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী জনতার সেই অংশ, যাঁদের ভূমিকা ইতিহাস মনে রাখে না। এখন সময় এসেছে বিস্মৃতির ধুলো সরিয়ে তাঁদের প্রাপ্য শহিদের মর্যাদাটুকু দেওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy