Advertisement
২৮ নভেম্বর ২০২৪
দেড়শো বছর ধরে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, স্যর আশুতোষ থেকে শুরু করে প্রেমেন্দ্র মিত্র, নজরুল প্রমুখ বহু বিশিষ্ট জনের মন কেড়েছে এই মালভূমির রূপ।
travel

Travel: বাঙালির হাওয়াবদলের চিরনতুন মধুপুর

মহর্ষির নাতনি সরলা দেবীর বিয়ের অনুষ্ঠান এখানেই হয়েছিল। কলকাতা থেকে সরে এসে এখানেই উঠেছিলেন নটী বিনোদিনী।

স্মৃতিসাক্ষ্য: মধুপুরের মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি ‘টেগোর কট’। ডান দিকে, কবির বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি।

স্মৃতিসাক্ষ্য: মধুপুরের মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি ‘টেগোর কট’। ডান দিকে, কবির বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি।

অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৩৭
Share: Save:

ইচ্ছে হলেই যাওয়া যায়। বিস্তর আয়োজনের প্রয়োজন নেই। মন চাইলেই কিস্তিমাৎ। চলে যাও পশ্চিমে। ‘পশ্চিম’ মানে পাশ্চাত্য নয়। বাংলার পশ্চিম। বাঙালির বাপ-ঠাকুরদার ঘর-গেরস্থালি। সেকালে যখন বাঙালির পেটের রোগে ভেল্কি দেখাতে নানা অ্যালোপ্যাথি বড়ি আসেনি, তখন ডাক্তারদের ভরসা ছিল পশ্চিম। কথায় কথায় তাদের নিদান ‘হাওয়া বদল’। এই ডিসেম্বরে সেখানে এখন বাতাসের ঘরে ফেরার দিন। দিক বদল করে পুবের হাওয়া বইছে পশ্চিম থেকে। পশ্চিমের সেই বরফিলি হাওয়ায় এখন হ্যামলিনের বাঁশির সুর। পাতকুয়োর পাথরচোঁয়া জলে গার্হস্থ্য আন্তরিকতা।

দেড়শো বছর ধরে এটাই দস্তুর। নতুন কিছু নয়। চিরকালই এখানে বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড কিংবা সিসার সূচক ঘাড় গুঁজে থাকে। নগরপীড়িত ফুসফুস এখানে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। জলই যে জীবন, পশ্চিম ছাড়া এ কথা প্রমাণ করবে কে! শুধুই কি মালভূমির দিগন্তবিস্তারী রূপ দেখিয়ে পশ্চিম মনোহরণ করেছিল বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু, স্যর আশুতোষ থেকে শুরু করে প্রেমেন্দ্র মিত্র, নজরুল, বিষ্ণু দে প্রমুখ সাবেক থেকে হাল আমলের কেষ্টবিষ্টুদের! তবে হ্যাঁ, বঙ্গজনের মর্জির বদল হয়েছে ঢের। যা ছিল বচ্ছরকার ভ্রমণ, তাই এখন হপ্তা শেষের ছটাক ভ্রমণ— যাকে বলে হাওয়া বদলেরও চরিত্র বদল হয়েছে।

তবে তা নিয়ে এখানে কথা নয়, কথা সেই পুরনোর, মানে পশ্চিমি পুরাণের। একা রবীন্দ্রনাথ-ই এসেছেন বার বার। হাজারিবাগ-কর্মাটাঁড়-মধুপুর-গিরিডি-দেওঘর-রিখিয়া... কোথায় না এসেছেন। থেকেছেন দিনের পর দিন। আরাম পেতে, ব্যারাম সারাতে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সাঁওতাল পরগনাকে নিয়ে পুরোদস্তুর মজে গিয়েছেন। শুধু তিনি নন, জোড়াসাঁকোর ও পাথুরিয়াঘাটার বৃহত্তর ঠাকুর পরিবারও সাঁওতাল পরগনায় এসে বাসা বেঁধেছেন। তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের এখানে নিজস্ব বাসস্থান ছিল না। তা না থাকলেও তাঁরা এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি স্নেহময়ী সৌদামিনী দেবীও মধুপুরের মায়ায় মজে লিখেছেন, “স্থান মধুপুর। শরৎকাল, বর্ষার পর শুভ্র স্বচ্ছ মেঘ, রাত্রে জ্যোৎস্নার ফুটফুটে আলো। শেফালি ফুলে গাছতলা ছেয়ে গেছে, মধুর গন্ধে মন মাতিয়ে তুলেছে, প্রাকৃতিক শোভা দেখে যেন আর আশ মেটে না… ।”

বড়দিদির ছোটভাই রবীন্দ্রনাথের চিঠিতেও পশ্চিম-প্রীতির ঝলক যেন অনেকটা একই রকম। ভাইঝি ইন্দিরাকে তিনি লিখছেন কর্মাটাঁড় থেকে (৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩), “গোলাপ ফুলে বাগান একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। একটা শিরীষ ফুলের গাছ আগাগোড়া ফুলে ভরে আছে, একেবারে যেন নরম মিষ্টি আদরের মত, চোখের ঘুমের মত।”

তবে কিনা এই ভাল লাগা কারও ক্ষেত্রেই মায়াঞ্জনের চিরন্তন আলেখ্য রচনা করেনি। দুঃখ-দ্বন্দ্বের অভিঘাত ঠাকুর পরিবারেও এসে লেগেছে। আর আশ্চর্যের বিষয় এই, সেক্ষেত্রেও সাঁওতাল পরগনার ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর নয়।

স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যুর পরপরই অসুস্থ হন রবীন্দ্র-কন্যা রাণী। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ বন্ধুবর প্রিয়নাথ সেনকে লিখছেন (১৯০৩), “আজকাল পশ্চিমে প্লেগের দৌরাত্ম্য— সাঁওতাল পরগনা ছোটনাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যে বাড়ি খুঁজচি— এখনো পাইনি — যাই হোক শীঘ্রই কোথাও যেতে হবে।” কিন্তু ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি’ গ্রন্থে ইন্দিরা দেবী জানিয়েছেন, “ক্রমশ যখন রাণীর অসুখ ধরা পড়ল তখন শুনেছি নাটোরের মহারাজা তাকে নিয়ে মধুপুরে যান। অমলা দাসের পরিচর্যা আর হাওয়া বদলের গুনে তার বেশ উপকার হয়েছিল।”

শোনা কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। রাণীকে নিয়ে কেউই মধুপুরে আসেননি। অন্তত রবীন্দ্রনাথের তেমন পরিকল্পনাও ছিল না। তবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন বিখ্যাত গায়িকা অমলা দাশ তখন মধুপুরে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ‘টেগোর কট’-এ ছিলেন। মধুপুর রেল স্টেশনের কাছে বাগান ঘেরা বিলিতি ক্যাসল ‘টেগোর কট’ ঘিরে ঠাকুর পরিবারের অনেক স্মৃতি।

শেষ পর্যন্ত, অসুস্থ কন্যা রাণী বা রেণুকাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাজারিবাগ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিপূর্বে তিনি হাজারিবাগ গিয়েছিলেন (১৮৮৫) এক বার। তাঁর সেই পুরনো হাজারিবাগ-প্রীতির সঙ্গে যোগ হয়েছিল, সেখানে বসবাসের উপযুক্ত বাসাবাড়ির সুলভতা। কারণ, তাঁর সেবারের সঙ্গী দলটি ছিল বেশ বড়। তাঁর অসুস্থ কন্যা রেণুকার সঙ্গে ছিল কন্যা মীরা ও পুত্র শমীন্দ্রনাথ। তাঁদের দেখাশোনার জন্য ছিলেন পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবী, শ্যালক নগেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী নলিনীবালা। এ ছাড়া দেখাশোনার জন্য চাকরেরা। সব মিলিয়ে দলটি ছিল বৃহৎ।

সেকালে হাজারিবাগ যাওয়া খুব সহজ ছিল না। রেলপথে মধুপুরে এসে ট্রেন বদলাতে হত গিরিডির জন্য। গিরিডি পৌঁছে ডাকগাড়ির মতো ঠেলাগাড়ি ‘পুশপুশ’-এ করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাজারিবাগ। মানসিক উদ্বেগের সঙ্গে পথক্লেশে নাজেহাল রবীন্দ্রনাথ হাজারিবাগ থেকে আলমোড়া পৌঁছে বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লিখেছেন, “আমার ঝড় তুফানের মধ্যে তোমার বইখানি মারা গেছে। যখন রেণুকা ও দলবল নিয়ে হাজারীবাগের পথে চলেছিলাম তখনই বোধ হচ্ছে মধুপুর স্টেশনের ভোজনাগারে বা স্নানাগারে কিংবা আর কোথাও সেখানি হারিয়েছে। পথক্লেশ নিবারণের জন্য সেই একখানি মাত্র বই আমার সম্বল ছিল। বালক বালিকা দাস দাসী সিন্দুক বাক্স পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নানা পথ দিয়ে বিচিত্র যানবাহনযোগে যাওয়া যে কি দুঃখ এবার তা পেট ভরে বুঝে নিয়েছি।… তাই তো তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি “কোথা এই যাত্রা হবে শেষ?” (৩০ মে ১৯০৩ শনিবার )।”

হাজারিবাগে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের বাগান বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সে বাড়ি অন্ধকার মনে হওয়ায় হাজারিবাগের সরকারি উকিল রায়বাহাদুর গিরীন্দ্রকুমার গুপ্তর বাড়িতে উঠে যান। হাজারিবাগে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহযোগী স্বজনসহ দাসদাসিরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন। রেণুকার শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। এই বেহাল পরিস্থিতিতেও কবির কবিতা রচনা থেমে থাকেনি। হাজারিবাগেই শুরু করেছেন ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস। মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখা চিঠিতে তাঁর মানসিক অবস্থা, হাজারিবাগের প্রকৃতির রূপ প্রকাশ পেয়েছে, (২৫ মার্চ, ১৯০৩) “পর্শু আমার জ্বর ছেড়েছে— কাল থেকে আমি গুটি তিনেক কবিতা লিখে ফেলেছি। … এখানে এখন পরিপূর্ণ বসন্ত। আমার পূর্বদিকে জানলা খোলা,— সম্মুখে তরঙ্গায়িত চষা মাঠ দিক্প্রান্তে নীল পাহাড়ে গিয়ে মিলেছে। এখানকার বার্তা কলকাতার সেই রথঘর্ঘরিত গলির মধ্যে কেমন করে গিয়ে পৌঁছবে?… এখানকার আকাশ ও বাতাসের খানিকটা দিয়ে যদি কবিতা ক’টা মোড়ক করে বুকপোষ্ট করে দিতে পারতুম তাহলে কতকটা ঠিক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছত।...”

সাঁওতাল পরগনা কবির চোখে কী মায়াঞ্জন বুলিয়েছিল কে জানে। বারবার তিনি ফিরে এসেছেন কখনও গিরিডি, কখনও দেওঘর, কখনও বা রিখিয়ায়। শুধু তাই নয়, বড় মেয়ে বেলার জন্য সাঁওতাল পরগনায় কয়েক একর জমি কিনে একই সঙ্গে চাষবাস ও গো-পালনের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

অসুস্থ রাণীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন হাজারিবাগে, তখন কবির স্ত্রী মৃণালিনীর প্রিয় বান্ধবী অমলা দাশ মধুপুরে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি ‘টেগোর কট’-এ। মৃণালিনী দেবীর অসুস্থতার সংবাদে তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে তাঁর প্রাণের হাহাকার ভরা ক’টি চিঠি সেই সময়কার ঘটনাবলির সাক্ষ্য দেয়। রেণুকার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে ইন্দিরা দেবী লিখেছেন, “রবি কাকা একবার বলেছিলেন, আমরা বোলপুর যদি যেতুম তাহলে মীরাকে ও শমীকে আমার সঙ্গে দিতেন। আমি অবিশ্যি কিছু বলতে পারিনি, (এখানে) আমার নিজের বাড়ি হলে রাণীকে জোর করে নিয়ে আসতুম। এখানে (মধুপুরে) যে রকম খোলা মাঠের হাওয়া আমার নিশ্চয় বিশ্বাস এ রকম কোন জায়গায় এলে খুব অল্প সময়ে ওর শুধরে যায় … (মধুপুর, ৪ ডিসেম্বর, ১৯০২, বৃহস্পতিবার)।”

উনিশ-বিশ শতকের কোনও না কোনও সময়ে ঠাকুর পরিবারের প্রায় সকলেই এসেছিলেন সাঁওতাল পরগনায়। ব্যতিক্রম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি আসেননি কখনও। তবে তাঁর পুত্ররা সকলেই এসেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা দেবীর বিবাহ হয়েছিল দেওঘরে। ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে সরলা দেবী লিখছেন, “মা-রা তখন শরীর শোধরাবার জন্য বৈদ্যনাথে আছেন। আমার গন্তব্য হল সেইখানে, কলকাতায় নয়।… বৈদ্যনাথ পৌঁছাবার আগেই দিদি ষড়যন্ত্র করে বিয়ের সব আয়োজন একেবারে পাকা করিয়েছিল…। স্টেশনে দেখি আমি ‘কনে’ হয়ে এসেছি।… কনে পক্ষ হয়ে এলেন রাঁচি থেকে নতুন মামা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ), মেজমামা ও মেজমামি (সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনী), বোলপুর থেকে রবি মামা ও বড় মামা (রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রনাথ), মধুপুর থেকে বড় মাসিমা (সৌদামিনী দেবী) কৃতী ও সুকেশী, কলিকাতা থেকে ইন্দিরা প্রমথ ও সুরেন (ইন্দিরা দেবী, প্রমথ চৌধুরী ও সুরেন্দ্রনাথ)।”

এই বিবাহ অনুষ্ঠান ছাড়া কবি ও দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে মধুপুরের একটা বিশেষ যোগাযোগ ছিল। মধুপুরের পশ্চিম প্রান্তে সপাহা অঞ্চলে পাতঞ্জল যোগদর্শন-মার্গচারী অধ্যাত্ম প্রতিষ্ঠান কাপিল মঠ। এ মঠটি প্রাচীন। এখানকার প্রথম আশ্রমাচার্য শ্রীমৎ স্বামী হরিহরানন্দ আরণ্য। তিনি ছিলেন সর্বশাস্ত্র বিশারদ, সংস্কৃতজ্ঞ। তিনি একাধিক শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে অন্যতম ‘পুরুষ বা আত্মা’ গ্রন্থটি। হরিহরানন্দজি এই গ্রন্থ সম্পর্কে দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে চেয়ে তাঁকে বইটি পাঠিয়েছেন। গ্রন্থটি পাঠ করে দ্বিজেন্দ্রনাথও জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মতামত—

বোলপুর ২৬ বৈশাখ (সাল উল্লেখ নেই)

শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীমৎ স্বামী হরিহরানন্দ আরণ্য সমীপেষু

নমস্কার পুর্বক নিবেদন,

আপনার বিরচিত ‘পুরুষ বা আত্মা’ সম্বন্ধীয় আলোচনা গর্ভ পুস্তকখানি প্রাপ্ত হইলাম। আত্মা সম্বন্ধে যুক্তিতর্ক যাহা আপনি প্রদর্শন করিয়াছেন— তাহার উপরে আমার কোন কথা বলিবার নাই— কেননা যুক্তিতর্কের প্রণালী পদ্ধতি আবহমান কাল হইতে এইরূপ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। মূল কথা— ভগবানের দর্শন লাভ করিয়া জীবের যাহাতে শান্তি এবং আনন্দ হয়, তাহাই মনুষ্যের প্রয়োজন হইয়াছে। তাহা দেশকালপাত্র এবং সাধনকে অপেক্ষা করে— সমস্তেরই মূল ভগবৎ কৃপা।

ভবদীয়

শ্রী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু দ্বিজেন্দ্রনাথ নয়, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও কাপিল মঠের যোগাযোগ ছিল। স্বামী হরিহরানন্দের ‘ধম্মপদং’ গ্রন্থের সুন্দর আলোচনা করেছিলেন তিনি।

শুধুই কি হাওয়া বদল! তার আড়ালে কত কর্মকাণ্ড! যেন আশা-নিরাশায় দোলায়িত এক মানব প্রবাহ। মধুপুরের পশ্চিম থেকে পূর্বে ছড়িয়ে আছে সেই ইতিহাস। প্রেমে-অপ্রেমে ভরপুর হৃদয়ধ্বনি। মনের খেলার মাতামাতি। নির্জন এই মালভূমি প্রান্তরে এখনও তার ফিসফাস। তার কেন্দ্রে নট-সম্রাজ্ঞী বিনোদিনী।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে কর্মহীন। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা তখন গড়তে চাইছেন একটা নতুন রঙ্গমঞ্চ। সেই উদ্দেশ্যে যোগ দিলেন গুর্মুখ রায় মুসাদ্দির ৬৮ বিডন স্ট্রিটের থিয়েটারে। গুর্মুখ রায়ও তখন চাইছিলেন ‘বি-থিয়েটার’ নামে একটা থিয়েটার গড়তে। ‘বি’ অর্থাৎ বিনোদিনী। গুর্মুখের প্রস্তাবে বেঁকে বসলেন গিরিশচন্দ্র প্রমুখ নাট্য-ব্যক্তিত্বেরা। কারণ, পতিতার নামে থিয়েটার হলে রক্ষণশীল বাঙালি নাটক দেখতে আসবেন না, বন্ধ হবে সকলের রোজগার। তাই বিনোদিনীকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে থিয়েটারের নাম রাখা হল ‘স্টার থিয়েটার’। বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হল বিনোদিনীর কাছেও। সেই সময় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলকাতা থেকে, শোনা যায়, মধুপুরেই পাঠানো হয় তাঁকে।

অসামান্য রূপ-লাবণ্য এবং অভিনয়দক্ষতা থাকলেও বিনোদিনী তখন থিয়েটার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। বয়স মাত্র চব্বিশ। তবু আর অভিনয় নয়, এবার তিনি চান থিতু হতে। চান ঘর-বর-সংসার। এর মধ্যে এক জনকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তিনিও হয়ে গেলেন নিরুদ্দেশ। তাঁর রূপের আগুনে তখন ঝলসে যাচ্ছেন কলকাতার বহু বিশিষ্ট। তারই মধ্যে তাঁর কাছে এগিয়ে এলেন গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি। অল্প বয়স, কিন্তু অগাধ সম্পত্তির মালিক। হোড়মিলার জাহাজ কোম্পানির বেনিয়ান। মধুপুরের পানিয়া খোলা অঞ্চলে তত দিনে গড়ে উঠেছে ‘হোড়মিলার হাউস’। মধুপুর রেলস্টেশন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ‘টেগোর কট’। সে বাড়ির বিশাল বাগানের উত্তর প্রান্তে ‘হোড়মিলার হাউস’। কলকাতা থেকে দূরে থাকতে গুর্মুখের হাত ধরে, শোনা যায়, এখানেই এসেছিলেন বিনোদিনী।

দর্শকের মতে যিনি ছিলেন কলকাতার রঙ্গমঞ্চের ফুল, সেদিন ফুটে উঠেছিলেন পশ্চিমের মালভূমিতে, এই মধুপুরে।

অন্য বিষয়গুলি:

travel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy