২০১৬ কান চলচ্চিত্রোৎসব। রেড কার্পেটে জুলিয়া রবার্টস। পিছনে জোডি ফস্টার হাসছেন। ছবি: গেটি ইমেজেস।
এই প্রথম এলাম কান চলচ্চিত্র উৎসবে। একটা শর্ট ফিল্মে অভিনয়ের সুবাদে। ছবিটা শর্ট ফিল্ম কর্নারে স্ক্রিনিংয়ের জন্য মনোনীত হয়েছে। দেখলাম, ফেস্টিভাল-বিল্ডিংয়ের সেই বিখ্যাত লাল কার্পেটের বাইরে প্রচুর অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে। তাদের পরনে ডিজাইনার টাক্সেডো আর ঝলমলে গাউন। কিন্তু, হাতে উঁচিয়ে রেখেছে একটা করে প্ল্যাকার্ড। কোনও প্রতিবাদ করছে কি? সিনেমায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এখানেও কোনও বিতর্ক চলছে? কাছে গিয়ে দেখি, ও হরি! সে সব কিছু নয়। এরা সকলেই, যেনতেনপ্রকারেণ, যে কোনও একটা স্ক্রিনিংয়ের একটা এক্সট্রা পাস চায়। তা হলেই ওই রেড কার্পেটে হাঁটতে পাবে যে! কোন সিনেমা, কেমন সিনেমা— কিচ্ছু যায়-আসে না। ওদের জীবন-বৃত্তের কেন্দ্র, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, বৃত্তফল সবই ওই লাল কার্পেট।
শুধু ওদের কেন, কান উৎসবের চুম্বক আজকাল এই রেড কার্পেট। জুলিয়া রবার্টস খালি পায়ে হাঁটলেন (গত বছর হাই-হিল না-পরার জন্য কয়েক জনকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতিবাদে), ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন বেগুনি লিপস্টিক পরে হাঁটলেন, এই নিয়েই শুধু কথা চলছে। যেন তারকাদের পোশাক, অলংকার, হাঁটার ধরন, দাঁড়াবার পোজ, এইগুলোই একটা ফেস্টিভালের মূল ব্যাপার! ষোলোশো সংস্থা থেকে চার হাজারেরও বেশি সাংবাদিক এসেছেন ইভেন্ট কভার করতে। প্রায় সব্বাই শুধু পাখির বাসার মতো গাউন আর বো-বাঁধা টাক্সেডোর রিভিউ কষতে ব্যস্ত! আরে, এটা তো পৃথিবীর যে কোনও ফেস্টিভাল নয়! লোকে বলে, এটাই বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত, শ্রেষ্ঠ ফিল্মোৎসব। অস্কার নয়, এখানে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন পাম’ পাওয়াই গোটা পৃথিবী জুড়ে ফিল্ম-করিয়ে’দের সবচেয়ে মূল্যবান স্বপ্ন! অবশ্য, ভুল বললাম বোধহয়। বাক্যটায় পাস্ট টেন্স ব্যবহার করা উচিত ছিল। কান-ও এখন হলিউডের দিকে যেমন পড়িমরি করে ঝুঁকেছে, তাতে অস্কারের পাল্লাই হয়তো ভারী হবে!
১৯৬০-এ ‘লা দোলচে ভিতা’ ছবির জন্য পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি আর অভিনেতা মার্চেল্লো মাস্ত্রোইয়ান্নি যে লাল কার্পেটে হাঁটছেন, সেটাতেই ১৭ বছর পর হাঁটছেন এক অস্ট্রিয়ান বডিবিল্ডার! আর্নল্ড শোয়ারজেনেগার। ভারোত্তোলকদের নিয়ে তৈরি, জর্জ বাটলারের প্রায় দু’লাখ ডলার দামের ডকুমেন্টারি ‘পাম্পিং আয়রন’-এর প্রোমোশনে। আর ১৯৯২-এ এলেন মাইকেল ডগলাস আর শ্যারন স্টোন। ‘বেসিক ইন্সটিংক্ট’ সিনেমাটার আনসেন্সর্ড ভার্সন দেখানোর জন্য! ছবিটা খারাপ তা মোটেই বলছি না, কিন্তু কান-এ তার মূল পাবলিসিটি হয়ে দাঁড়াল: যে ৭০ সেকেন্ড কেটে দেওয়া হয়েছে সঙ্গমদৃশ্য থেকে, তা এখানে দেখানো হবে! মার-মার-কাট-কাট ভিড়!
শিল্পগুণ থেকে গ্ল্যামারগুণের দিকে (না কি গ্ল্যামারদোষ?) সরে যাওয়া এখন পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত উৎসবেরই বৈশিষ্ট্য। কান-ও প্রথম থেকেই বিরাট তারকাদের ঘোরাফেরা ও লীলাখেলার জায়গা, সেই ১৯৫৪-তেই, সপ্তম কান ফিল্ম ফেস্টিভালে, সিমন সিলভা-কে যখন বলা হল বিখ্যাত মার্কিন নায়ক রবার্ট মিচাম-এর সঙ্গে পোজ দিন, উনি তক্ষুনি জামা খুলে ফেলে টপলেস পোজ দিলেন, ছবি তোলার জন্যে রিপোর্টারদের মধ্যে এমন হুড়োহুড়ি পড়ল যে অনেকে আহত হলেন, দুই ক্যামেরাম্যানের হাত-পা ভেঙে গেল! তার আগের বছরেই ব্রিজিত বার্দো-র বিকিনি-আবৃত শরীর এবং খোলা বন্য চুল সবাইকে ধাঁ করে দিয়েছে। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাইরের ব্যাপার। উৎসবটা আবর্তিত হত ছবিদের ঘিরেই। এখন ওই কেন্দ্রটা বদলে গিয়েছে। সবাই ছোঁকছোঁক করছে এই গসিপ-সম্ভাবনাগুলোর আশেপাশে, ছবি যেন হলেও হয়, না হলেও হয়। কান-এর এই সবার রঙে রং মেলানোর দৌড়টা একটু অবাক করে দেয়।
যে কান-এ ‘পথের পাঁচালী’ পেয়েছিল ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’, যা থেকে তার বিশ্বজয় শুরু, যে কান সম্মান জানিয়েছিল শাহজি এন করুণ-এর ‘পিরাভি’-কে, সেখানে আজকাল ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন কারা? ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন, সোনম কপূর। তাঁরা অবশ্য প্রধানত যান গয়না বা প্রসাধন কোম্পানির মুখ হিসেবে, অভিনেত্রী হিসেবে নন, কিন্তু প্রধান প্রশ্ন তো সেটাই: প্রসাধন কোম্পানির মডেল একটা চলচ্চিত্রোৎসবে শামিল হচ্ছেন কেন? সেই উৎসবই বা কোন দাঁড়িপাল্লায় নিজের মর্যাদাকে ওজন করছে, যে, এই তারকাদের নিয়ে নাচানাচি অনুমোদন করছে? শুধু অনুমোদন কেন, প্রশ্রয় দিচ্ছে, এঁদের নিয়ে বাড়াবাড়িটাই প্রোমোট করছে!
ঘুরেফিরে দেখলাম, দুরন্ত কিছু ইউরোপীয় ছবির স্ক্রিনিংয়ে লোকই নেই। কারও আগ্রহই নেই এই সব সিনেমায়। ইউরোপের বাইরে থেকেও ছবি এসেছিল কিছু। তাদের মান সাংঘাতিক রকমের ভাল। কিন্তু ওই যে! গ্ল্যামারের ঘটা নেই। কারণ স্টার নেই। তাই দর্শকও নেই। সব খাঁ-খাঁ!
পুরো উৎসবটা যে ভাবে সাজানো হয়েছে, তাতে উদ্দেশ্য পরিষ্কার। গ্ল্যামারের পুজো। দারোয়ানরা কী সাংঘাতিক ঝাঁ-চকচকে কালো স্যুট পরেছেন, সঙ্গে ডার্ক শেডের চশমা! তার পর ব্যারিকেড, হেলিকপ্টার, প্রমোদতরী, কালো কাচ তোলা বিলাসবহুল সব গাড়ি— উৎসবের প্রতিটি ইঞ্চি-সেন্টিমিটার বলে দেয়, তারকাখচিত বৈভবের মহাযজ্ঞ চলছে।
আর আমি? আমি কি এখানে গ্ল্যামারের প্রতি এই চরম লোভ ও চোখ-চকচকের বাইরে? কক্ষনও না! দিব্যি ভেতরে ঢুকে, বিখ্যাত ফরাসি অভিনেত্রী মারিয়ন কোটিয়ার-এর সঙ্গে ছোট্ট আড্ডাও দিয়ে এলাম! এঁকে আমি চিনি কেন? চমৎকার ফরাসি ছবির জন্য? না না, হলিউডের ‘ইনসেপশন’, ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’-এ দেখেছি। তা হলে সেই হলিউড দিয়েই কান বুঝলাম না কি শেষ অবধি? রীতি মেনে, মারিয়নের সঙ্গে ‘সেল্ফি’-ও তুললাম। উনি অবশ্য, আমরা আঞ্চলিক সিনেমা করেছি শুনে, খুব মন খুলে অভিনন্দন জানালেন। প্রথম ছবির জন্যই আমরা কান-এ আসতে পেরেছি, তাতেও উনি খুব খুশি। অবশ্য ওঁর একটা, যাকে বলে, ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ গড়ন আছেই, উনি নামী পরিবেশকর্মীও বটে!
এত কিছুর পরেও রাতের বেলায় জর্জ ক্লুনি’র ইয়টের প্রাইভেট পার্টিতে ঢুকতেই পারলাম না! হাঁকিয়ে দিল! স্বাভাবিক। আমরাও খুব হাসছিলাম। কিন্তু হাসি আর বজায় থাকল না, যখন আমার এক পঞ্জাবি বন্ধু, যে আমাদের সিনেমাটার সহ-প্রযোজক, একটা রেড কার্পেট স্ক্রিনিংয়ে ঢুকতেই পেল না, কারণ, ও পাগড়ি পরেছিল। যখন পাগড়িটা খুলতে চাইল না, ওকে অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলা হল, কোনও মতেই ঢুকতে দেওয়া হবে না।
তারকার শক্তি কতটা, ইন্ডিয়ান প্যাভিলিয়নের প্যানেল ডিসকাশনেও ভাল রকম মালুম হল। সবচেয়ে ভিড় হল যে দিন অনুরাগ কাশ্যপ এলেন। একটু অচেনা ছবি-করিয়ে, বা যাঁরা তথাকথিত স্টার নন, তাঁরাও তো বেশ কয়েকটা প্যানেল ডিসকাশনে অংশ নিলেন। আঞ্চলিক সিনেমার কথা হল তাতে। কত আশ্চর্য গল্প বললেন তাঁরা। কিন্তু সে সব শুনতে আর আসছে কে!
mahul.brahma@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy