ইউজিন মেরিল ডিচ
এমনও হয়? হতে পারে কখনও? যে ইঁদুর আর বেড়ালের আজ অবধি কখনও কোনও বিষয়ে মিলমিশ হয়নি, দু’জনের জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই হল কী ভাবে অন্যকে প্যাঁচে ফেলা যায়, সেই তারাই নাকি একই রকম আদরে, পরম মমতায় দু’দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে এক বৃদ্ধ মানুষকে! তাও আবার সব ঝগড়া, মিচকেমি ভুলে, সব শয়তানি সরিয়ে রেখে! হ্যাঁ, এমন অদ্ভুত ছবিই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
তাঁর নাম ইউজিন মেরিল ডিচ, বেশি পরিচিত জিন ডিচ নামে। অস্কারজয়ী মার্কিন ও চেক পরিচালক, ইলাস্ট্রেটর, অ্যানিমেটর তিনি। এবং বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় কার্টুন ‘টম অ্যান্ড জেরি’-র এক সময়কার পরিচালকও বটে। তেরোটি পর্ব জুড়ে এই বিখ্যাত ইঁদুর আর বেড়ালের সমস্ত দুষ্টুমি, দাপাদাপির নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনিই! সেই জিন ডিচ মারা গেলেন গত ১৬ এপ্রিল, চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। বয়স হয়েছিল ছিয়ানব্বই ছুঁই-ছুঁই। বর্ষীয়ান মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়ল এক রাশ ধন্যবাদ-বার্তা। যার মূল সুর: ‘ধন্যবাদ জিন ডিচ, আমাদের ছোটবেলাটা এত সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার জন্য।’
আমাদের ছোটবেলা বলতে যখন ইউটিউব-এর এমন দাপাদাপি ছিল না, শুধু কার্টুনের জন্যই এমন গাদাগুচ্ছের টেলিভিশন চ্যানেলেরও আবির্ভাব হয়নি, তখন ছিল সবেধন নীলমণি একটা কার্টুন নেটওয়ার্ক। হিন্দি নয়, ইংরেজি ভাষাতেই সারা দিন ধরে হাজির হত বিস্তর কার্টুন চরিত্র। টম অ্যান্ড জেরি তো ছিলই, আরও ছিল জনি ব্রাভো, পাওয়ারপাফ গার্লস, স্কুবি ডু, পপাই দ্য সেলরম্যান— এরা। অন্তত স্কুবি ডু আর পপাই-কে মনে আছে সবারই, তারাও ছিল বেজায় বিখ্যাত। এই পপাই-এর পরিচালনাও বেশ কিছু দিন ছিল জিন ডিচেরই হাতে। পপাই মানে সেই মুখে-চুরুট, মাথায়-টুপি মাসলম্যান। এক চোখ দিয়ে তেরছা ভাবে দেখে, মুখের প্রায় এক পাশ দিয়ে কথা বলে, আর বিপদে পড়লেই সঙ্গে থাকা কৌটো থেকে স্পিনাচ ঢালে মুখে। ওই স্পিনাচ খেয়েই পপাইয়ের গায়ে আসে কয়েকশো হাতির জোর। আর তার পরেই পরিস্থিতি বুঝে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। শিশুসুলভ এই কল্পনার নিতান্ত অবিশ্বাস্য অবাস্তবতাকেও রং-তুলি দিয়ে নিয্যস বাস্তব করে তোলার দায়িত্ব ছিল জিন ডিচের কাঁধে।
টম এবং জেরি
শৈশব তো সেটাই চায়। যাকে যুক্তি-বুদ্ধি ছুঁতে পারে না, সেই রঙিন দুনিয়ায় ডুবে থাকতে চায় শিশুমন। টম অ্যান্ড জেরির কার্টুন দেখতে গিয়ে কেউ কি কখনও যুক্তি দিয়ে খুঁজতে চেয়েছে— বোমা ফাটলে, মাথায় বিশাল ওজনের একটা জগদ্দল পাথর এসে পড়লে কিংবা আকাশ থেকে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়লেও বেড়াল টম কী ভাবে প্রত্যেক বার বেঁচে যায়? রাস্তায় স্টিকারের মতো আটকে গিয়ে, কিংবা দরজায় একেবারে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েও কী ভাবে পর মুহূর্তেই আসল চেহারা ফিরে পেয়ে আবারও সে দ্বিগুণ উদ্যমে জেরির পিছনে ধাওয়া করে? কার্টুনে এই যুক্তি-তর্কের গরহাজিরার প্রশ্নটা যাতে কোনও দিন উঠতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করাই এক জন দক্ষ ইলাস্ট্রেটর বা অ্যানিমেটরের কাজ। জিন ডিচ সার্থক ভাবেই সেই দায়িত্ব পালন করেছেন আজীবন। এমনই সুন্দর সেই রূপটান, যাতে ছোটরা তো বটেই, শিশুমনওয়ালা বড়রাও মজেছিল।
অবশ্য জিন ডিচকে শুধুই টম অ্যান্ড জেরি বা পপাই-এর আয়নায় দেখাটা মস্ত ভুল হবে। বরং তাঁর নানা কীর্তির মধ্যে এগুলো একটা অংশমাত্র। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, কেরিয়ারের গোড়ায় তিনি অ্যানিমেশন নিয়ে মোটেও ভাবনাচিন্তা করেননি। বরং তিনি কাজ করতেন নর্থ আমেরিকান এভিয়েশন-এর হয়ে। প্লেনের নকশা আঁকতেন! তার পর নিজেই পাইলট ট্রেনিংয়ে যোগ দিলেন। কিন্তু শরীর তাতে সায় দিল না। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন, এবং শারীরিক কারণেই তাঁকে কাজ থেকে সেই বছরই অব্যাহতি দেওয়া হল। ভাগ্যিস! তাঁর মতো এমন কল্পনার জগতের মানুষ যদি বিমান নিয়ে কেজো ওড়াউড়িতেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন, আমাদের শৈশবের ছোট্ট দুনিয়াটায় রঙের আকাল হত।
অ্যানিমেশনের জগতে জিন ডিচের পাকাপাকি ভাবে প্রবেশ ১৯৫৫ সাল নাগাদ। অ্যানিমেশন স্টুডিয়ো ‘ইউনাইটেড প্রোডাকশন্স অব আমেরিকা’-তে (ইউপিএ) শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করলেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে এই স্টুডিয়ো অ্যানিমেশনের ধরনটাই আমূল বদলে দিয়েছিল। পরে ডিচ অ্যানিমেশন সংস্থা ‘টেরিটুনস’-এ যোগ দিলেন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে। ‘টেরিটুনস’ তখন নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত অ্যানিমেশন স্টুডিয়ো। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে, দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে একের পর এক অ্যানিমেটেড কার্টুনের প্রযোজনা করেছে এই সংস্থা। ডিচ সেখানে যোগ দিয়ে, পুরনো চরিত্রগুলো সরিয়ে সৃষ্টি করলেন তাঁর নিজের চরিত্রদের— ‘সিডনি দি এলিফ্যান্ট’, ‘টম টেরিফিক’, ‘ক্লিন্ট কবলার’। তাঁর সৃষ্টি ‘টম টেরিফিক’ আমেরিকান টেলিভিশনে দেখানো হত ছোটদের শো ‘ক্যাপ্টেন ক্যাঙারু’-র অংশ হিসেবে। এই টম কিন্তু বেড়াল নয়, পুঁচকে একটা ছেলে। থাকত এক গাছবাড়িতে। তার মাথায় চোঙার মতো দেখতে একটা টুপি— ম্যাজিক টুপি। এই টুপি দিয়েই সে ইচ্ছে মতো বদলে ফেলত নিজেকে, বাড়িয়ে নিত বুদ্ধিটাও। সেই সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল ডিচের চরিত্ররা।
‘টেরিটুনস’-এ বেশি দিন টিকতে পারেননি ডিচ। ১৯৫৮ সালে তাঁর কার্টুন আর অ্যানিমেশন নিয়ে কাজকর্ম আর ব্যস্ততা তুঙ্গে, কিন্তু সে বছরেই টেরিটুনস-এর কাজটা চলে যায় তাঁর। এর পরই নিউ ইয়র্ক শহরে একেবারে নিজের একটা স্টুডিয়ো খোলেন জিন ডিচ।
‘টেরিটুনস’ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে তৈরি তাঁর চরিত্ররাও আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে টেরিটুনস যখন ফের এক সময়কার জনপ্রিয় শো ‘হেকল অ্যান্ড জেকেল’, ‘মাইটি মাউস’-কে ফিরিয়ে আনছে, তখন একমাত্র ডিচের তৈরি ‘সিডনি দ্য এলিফ্যান্ট’-ই চলছিল। সিডনি, ৪৪ বছরের এক হাতি। বয়স চল্লিশ পেরোলেও হাবেভাবে সে একদম শিশুর মতো। একটা ইঁদুর দেখলে দৌড়ে পালায়। জঙ্গলের জীবন তার মোটেই ভাল লাগে না। সিডনির মধ্যে তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন ইউপিএ স্টুডিয়োয় পাওয়া প্রশিক্ষণের সবটুকু। ১৯৫৮ সালে অস্কারের মনোনয়ন পায় ‘সিডনি’জ় ফ্যামিলি ট্রি’। ছবিটির সহ-প্রযোজক ছিলেন ডিচ নিজে।
আর তার পরের বছরেই তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে এলেন তিনি। এসেছিলেন দিন দশেকের জন্য, কিন্তু থেকে গেলেন পাকাপাকি ভাবে, জ়েডেঙ্কাকে বিয়ে করে। এই দেশটির নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী ছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে তাঁর স্মৃতিকথা ‘ফর দ্য লাভ অব প্রাগ’-এ কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়া এবং ১৯৮৯ সালের কমিউনিস্ট-বিরোধী ‘ভেলভেট রেভলিউশন’-এর পরের চেক প্রজাতন্ত্রের জীবন যাপনের নানা মুহূর্তকে ধরে রেখেছিলেন ডিচ।
এই প্রাগে থাকতে থাকতেই এল অস্কার। ১৯৬১ সালে সেরা অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্মের পুরস্কার পেল তাঁর তৈরি ছবি ‘মুনরো’। জুলে ফিফার-এর ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি, মাত্র সাড়ে আট মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি মুনরো নামে চার বছরের এক ছোট্ট ছেলের গল্প বলে। আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই সে বায়না ধরে, জেদ করে। এক দিন হঠাৎ তার কাছে আসে একটা চিঠি। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে তাকে! মুনরো বার বার বলতে চায়, তার বয়স তো মোটে চার বছর, সে তো একদমই ছোট, কিন্তু কেউ তার কথা শোনে না। দিব্যি তাকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। ঠিক বড়দের মতোই ব্যবহার করা হয় তার সঙ্গে, কঠিন সব কাজের দায়িত্বও পড়ে তার কাঁধে। এক সময় সে নিজেও ভাবতে শুরু করে, কেউ যখন তাকে বাচ্চা বলে ভাবছেই না, তখন নিশ্চয়ই সে বাচ্চা নয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেনাবাহিনীর হুঁশ ফেরে এক দিন, তারস্বরে মুনরোকে কাঁদতে দেখে। মিলিটারি তো কখনও কাঁদে না! তা হলে এ নিশ্চয়ই একটা শিশু! মা-বাবার কাছে ফেরে মুনরো, ফেরে আবার সেই ছোট্টবেলায়।
বিখ্যাত সংস্থা ‘এমজিএম’ প্রযোজিত কার্টুন ‘টম অ্যান্ড জেরি’র সঙ্গে ডিচ গাঁটছড়া বাঁধেন ১৯৬১-৬২ নাগাদ। তেরোটি নতুন পর্বের পরিচালনা করেন তিনি। এই পর্বগুলো কিন্তু সমালোচনাও কুড়িয়েছিল বিস্তর। বলা হয়েছিল, অ্যানিমেশনের মান খারাপ, বাজেট কম, স্ক্রিপ্ট দুর্বল, মিউজ়িক আর সাউন্ড এফেক্টও ভাল না। এর সঙ্গে আবার জুড়েছিল অন্য এক অভিযোগ— এই পর্বগুলোয় হিংসা যেন অনেকটাই বেশি। টম আর জেরির মধ্যে তো হিংসা থাকার কথা নয়। এই কার্টুন ইঁদুর-বেড়ালের নির্ভেজাল খুনসুটির গল্প।
কথা উঠল, ডিচের হাতে পড়ে টম যেন হঠাৎ করেই হয়ে উঠেছে এক বিপন্ন পাঞ্চিং ব্যাগ, যার ওপর ইচ্ছেমতো অত্যাচার করা যায়। আর জেরি নিজেকে বাঁচাতে বুদ্ধি খুঁজছে না, বরং তার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা। সে স্রেফ মজা পাওয়ার জন্যই যেন টমকে নাস্তানাবুদ করে। এমনিতেই টম অ্যান্ড জেরির গল্পের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিবাদ উঠছিল পশুপ্রেমীদের মধ্যেও। এ এমনই এক অসম লড়াই, যেখানে সব সময়ই টম হেরে ভূত। তার ওপর এমন অনাবশ্যক হিংসার আবির্ভাব। এও শোনা যায়, ডিচ ব্যক্তিগত ভাবে এই সিরিজ়ের এমন অনাবশ্যক হিংস্রতার কারণে কাজ করতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। অথচ, তাঁর ওপরেই এই কার্টুনের গুরুদায়িত্ব পড়েছিল। তবে বলা বাহুল্য, বাণিজ্যিক দিক থেকে এই সিরিজ় সফল। ফলে সমালোচনা ঢেকে যেতে সময় নেয়নি বেশি।
কিছু দিন আগেই ঘরবন্দি অবস্থায় ফেসবুকে জানিয়েছিলেন ডিচ, অ্যানিমেটর হিসেবে তাঁর নিজের জীবন নিয়ে আর একটা বই লিখছেন তিনি। ৯৫ বছরের টগবগে যুবকটি প্রবল আশাবাদী ছিলেন, এই বইয়ের কাজও যথাসময়ে শেষ করে ফেলতে পারবেন। শৈশবের কারিগরের সে কাজটুকু অসমাপ্ত রয়ে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy