রাজকীয়: কমলি। সঞ্জয়-ডুুবরি ব্যাঘ্র প্রকল্পে সংসার গুছিয়ে বসেছে সে
সবে রেস্ট হাউস থেকে বেরিয়েছি। তখনও সূর্য পুরোপুরি ওঠেনি। জঙ্গলের রাস্তায় মিনিট পাঁচেক চলার পরেই গাড়ির সামনে বসা পথপ্রদর্শক জয়রাজ গাড়িচালক ভানুর হাত চেপে ধরে বললেন, ‘‘রুক!’’ একটু পিছিয়ে এল গাড়ি। বাঁ দিকের মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ না!
জয়রাজ বললেন, ‘‘একেবারে টাটকা পায়ের ছাপ। কেউ কোনও কথা বলবেন না। চোখ খোলা রাখুন।’’ এক মিনিটও পুরো কাটেনি, পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল ডোরাকাটা, পূর্ণবয়স্ক একটি বাঘ। মাত্র মিটার দশেকের দূরত্বে। হেলেদুলে বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়ল সে।
বায়নোকুলার চোখে দিয়ে জয়রাজ চাপা গলায় বলে উঠলেন, ‘‘এটা তো কমলি।’’ বাঘিনি। পূর্ব মধ্যপ্রদেশের যে জঙ্গলের মধ্যে আমরা বাঘ দেখতে বেরিয়েছি, তার সম্রাজ্ঞী এই পাঁচ বছরের বাঘিনি।
সঞ্জয়-ডুবরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডুবরি বিটে রীতিমতো সংসার সাজিয়ে বসেছে কমলি। গত দুই বছরে সে জন্ম দিয়েছে সাতটি সন্তানের। ২০১৭ সালে জন্ম নেওয়া দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলে এখন আর মায়ের উপরে নির্ভরশীল নয়। এ বছর এপ্রিলে কমলি জন্ম দিয়েছে আরও চারটি শাবকের। হাতির পিঠে চেপে যাঁরা জঙ্গল পাহারা দেন, মা ও শাবকদের উপরে তাঁরা নজর রাখছেন ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু কমলি এখন বাচ্চাদের ছেড়ে খুব একটা দূরে যায় না। তাই তাকে দেখা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল বনকর্মীদের সবারই। সেই দলে জয়রাজও ছিলেন। কমলিকে দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমরা সবাই খুব ভাগ্যবান। আমি তো আগে কখনও ওকে এত কাছ থেকে দেখিনি।’’
আমরা গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম কমলির রাস্তায়। আমাদের কিন্তু পাত্তাই দিচ্ছে না বাঘিনি। একটা সময় ওর একেবারে কাছে চলে এলাম। এ বার রাস্তার উপরে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল কমলি। মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে এক বার দাঁতগুলো দেখাল। তার পর রাস্তা দিয়ে নেমে গেল জঙ্গলের মধ্যে। আর এইটুকু সময়ের মধ্যেই এসএলআর ক্যামেরায় ছবি উঠল পটাপট।
গাড়ির চালক ভানু বেশ উত্তেজিত, ‘‘ওর বাচ্চারা কাছেপিঠে কোথাও আছে স্যর। আমাদের আর ওর পিছু না নেওয়াই ভাল।’’ গাড়ির সওয়ারিরা কেউ কেউ দাবি তুললেন, ‘‘এত কাছে এসেছি, বাচ্চাদের দেখব না?’’ ‘‘বনকর্মীদের কেউ বাচ্চাদের কাছাকাছি যাননি এখনও। ক’টা ছেলে, ক’টা মেয়ে জানতে পারিনি। কাছে গেলে কমলি ‘চার্জ’ করতে পারে,’’ বলে গাড়ি ঘোরানোর নির্দেশ দিলেন জয়রাজ।
কে এই কমলি? ওকে চিনতে হলে আগে জানতে হবে ‘কানকাটি’র কাহিনি। পাঁচ মাসের তিন ছেলেমেয়েকে রেখে হঠাৎ করেই এক দিন মারা গিয়েছিল বান্ধবগড় ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাঘিনি কানকাটি। ২০১৪-র ৬ অগস্টের ঘটনা। সাতসকালে জঙ্গলের খালে পাওয়া গিয়েছিল তার মৃতদেহ।
মারা যাওয়ার আগের দিনও কানকাটিকে তার মাস পাঁচেকের তিন বাচ্চা-সহ ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। সে মারা যেতেই খোঁজ পড়ল ছেলেমেয়েদের। মেয়েটিকে পাওয়া গেল বটে, কিন্তু দুটি ছেলের দেখা আর মিলল না। এলাকা দখলের যুদ্ধে কানকাটি হঠাৎ লায়েক হয়ে-ওঠা এক বাঘের কাছে হেরে যায়। শুধু মাকেই মারেনি ওই বাঘ, দুটি দুধের শিশুকেও শেষ করে দেয়। অনাথ হয়ে পড়ে কানকাটির পাঁচ মাসের মেয়েটি।
সবে মায়ের দুধ ছাড়তে শুরু করেছিল সে। মায়ের কানের একটি অংশ কাটা ছিল। তা থেকেই নাম কানকাটি। আর মেয়ের গায়ের চামড়ায় এক জায়গায় ডোরাকাটার মধ্যে পদ্মের ছাপ খুঁজে পেয়েছিলেন কেউ। তা থেকেই নাম কমলি। কমলির মা কানকাটি বান্ধবগড়ের বিখ্যাত বাঘিনি সীতার নাতনি। বান্ধবগড়ে এখন যে বাঘেদের প্রতিপত্তি, তার মূলে সীতা আর আর তার সঙ্গী। সীতার পরে কানকাটি ছিল বান্ধবগড়ের সম্রাজ্ঞী।
কিন্তু কমলির কী হবে এখন? মা মারা গিয়েছে। মারা গিয়েছে দুই ভাইও। অনাথ কমলিকে নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। মা-ভাইদের খুনি ফিরে এসে মেরে ফেলতে পারে একরত্তি মেয়েটাকে। বান্ধবগড় জঙ্গল তার কাছে আর নিরাপদ নয়। কমলিকে কী ভাবে সাবলম্বী করে তোলা যায়, সেটাই প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়াল বনকর্মীদের।
কমলিকে আলাদা করে রাখা হল ০.২৫ হেক্টরের একটি ঘেরা জায়গায়। সেখানে খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠতে লাগল সে। মা নেই, তাই শিকার ধরা শেখেনি। তার জন্য বরাদ্দ হল মুরগি আর মোষের মাংস, যেমন চিড়িয়াখানায় দেওয়া হয়। পাশাপাশি চলতে থাকল পাত্রের খোঁজ। কমলির বয়স তখন ঠিক দেড় বছর, তখনই পাত্রের খবর এল।
বান্ধবগড় থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে সঞ্জয়-ডুবরি ব্যাঘ্রপ্রকল্পে রয়েছে সেই পাত্র। বিশাল বনাঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। ঠিক হল, সঞ্জয়-ডুবরিতেই সাজিয়ে দেওয়া হবে কমলির নতুন সংসার। পাত্রস্থ করার আগে চলবে মেয়েকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়ার কাজ।
শ্বশুরবাড়িতে সব আয়োজন তত দিনে সম্পূর্ণ। কাজরা ঝিলের কাছে কমলির নতুন ঘরও তৈরি। ২০১৬-র মার্চে কমলিকে নিয়ে যাওয়া হল।
সঞ্জয় ডুবরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের একেবারে মাঝখানে রয়েছে কাজরা ঝিল। এক সময় সেখানে একটি গ্রাম ছিল। সেই গ্রাম উঠে যেতে গোটা এলাকায় জন্মেছে বড় বড় ঘাস। এত বড় ঘাস যে হাতি পর্যন্ত ডুবে যায়। বাঘের লুকিয়ে থাকার আদর্শ জায়গা।
কাজরা ঝিলের আশেপাশে ৪০ হেক্টর জমি বরাদ্দ হল কমলির জন্য। ঘাসের জঙ্গল ঘিরে ফেরা হল লোহার মোটা জাল দিয়ে। জমির যেখানটায় উঁচু ঘাস রয়েছে, সেখানে জাল দিয়ে ঘিরে তৈরি হল ১০ হেক্টরের একটি ঘর। কমলি থাকবে সেখানে। আর বাইরের জাল ঘেরা এলাকায় চরবে চিতল হরিণেরা। মাঝে মধ্যে গেট খুলে কমলির ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হরিণ। বাইরে থেকে কোনও খাবার দেওয়া হবে না। কমলিকে শিকার ধরেই খেতে হবে।
ওই সময় কমলির উপরে নজরদারি করা বন দফতরের এক কর্মীর অভিজ্ঞতা, ‘‘বান্ধবগড়ে থাকার সময়ে কমলির সামনে মুরগি দিয়ে দেওয়া হত। সেটা যখন উড়ত তখন কমলি লাফ মেরে সেটাকে ধরত। কখনও দেওয়া হত মহিষের মাংস।’’ বাচ্চাদের নিজের তত্ত্বাবধানে শিকার ধরার প্রশিক্ষণ দেয় মা বাঘিনি। পাঁচ মাস বয়সেই কমলি মাকে হারানোয় তার সেই প্রশিক্ষণটাই হয়নি। তাই হরিণ, শুয়োর এ সব ও ধরতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল বনকর্মীদের।
প্রথমে একটি মহিষের বাচ্চা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কমলির ডেরায়। সেই মহিষের বাচ্চার ধারেকাছেই ঘেঁষেনি সে। তাই বাধ্য হয়েই দেওয়া হয় মোষের মাংস। এর পরে খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয় তার। সামনে দিয়ে ছোট-বড় হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে, মহিষের বাচ্চাটা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। প্রথম তিন দিন কিছু বলেনি মেয়েটা। ভেবেছে, বাইরে থেকে তার খাবার আসবে। ঘাসের ঝোপ থেকে সব দেখছে কমলি। সিসিটিভি ক্যামেরায় তা দেখে এক বন-কর্তা উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেননি। চেঁচিয়ে বলে উঠেছেন, ‘‘চার্জ কলমি, চার্জ।’’ সেই নির্দেশও কমলির কানে পৌঁছয়নি। তৃতীয় দিন ঝোপে লুকিয়ে থেকে সামনে দিয়ে যাওয়া একটি ছোট হরিণের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল কলমি। শিকার ছিটকে গেল। হরিণেরা বুঝে গেল, ঘাসের বনে লুকিয়ে থাকা বাঘিনি তাদের বন্ধু নয়।
চতুর্থ দিন শিকারে আর ভুল করেনি কমলি। ক্যামেরায় সেই দৃশ্য দেখে বনকর্তারা উত্তেজিত। সেটাই কমলির প্রশিক্ষণের প্রথম সাফল্য।
বেছে বেছে কমলির চার পাশে থাকা লোহার বেষ্টনীতে ঢোকানো হচ্ছিল স্ত্রী এবং বাচ্চা হরিণ। শিংওয়ালা পুরুষ হরিণ দেখলেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল গেট। প্রশিক্ষক দলের এক সদস্যের কথায়, ‘‘এক দিন তো ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল একটি শিংওয়ালা পূর্ণবয়স্ক হরিণ। কমলিকে দেখে হরিণ শিং বাগিয়ে তেড়ে এল। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল।’’ হরিণের ঝাঁক দেখলেই গুটিয়ে যাচ্ছিল কমলি। কারণ দলে রয়েছে সেই শিংওয়ালা। দিন তিনেক পরে দেখা গেল, সেই শিংওয়ালার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কমলি। টুঁটি চেপে ধরেছে দাঁত দিয়ে। বোঝা গেল, ভয় কাটিয়ে উঠেছে সে।
মাস তিনেকের মধ্যেই শিকার ধরায় একেবারে সড়গড় হয়ে গেল কমলি। ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর প্রায় আড়াই বছরের কমলিকে গলায় গয়না (আসলে রেডিয়ো কলার) পরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল উন্মুক্ত জঙ্গলে। সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তার বর। কমলি যে বেশ সুখী, তা বোঝা গেল বছর না ঘুরতেই। ২০১৭ সালের ১ জুন খবর এল, তিনটি শাবকের জন্ম দিয়েছে সকলের আদরের কমলি। একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে হয়েছে তার।
এ বছরের ৩ মার্চ ফের সুখবর। ফের মা হয়েছে কমলি। এ বার চারটি শাবক। সাতটি সন্তান আর সে নিজে— এই নিয়ে মোট আটটি বাঘে এখন জমজমাট ওই ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডুবরি বিট। সেখানে জঙ্গলের এক দিকে দুই রাজকন্যার (কমলির দুই মেয়ে) রাজত্ব। অন্য দিকে কমলি থাকে তার দুই বছরের ছেলেকে (গ্রামবাসীরা নাম দিয়েছেন ‘বড়া দেও’ বা বড় দেবতা) নিয়ে। কমলি যখন শিকারে যায়, দুই বছরের বড় ভাই সামলায় বাকি ভাইবোনদের। কমলির ভয়, কখন ওই বাচ্চাদের বাবা এসে হানা দেয়, মেরে ফেলে চার শাবককে! বড়া দেও এখন পূর্ণ যুবক। মা আর তার ছানাদের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন বড় ছেলের কাঁধে।
কমলি এখন নিশ্চিন্ত। তার মায়ের মতো বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে না তাকে। হারাতে হবে না সন্তানদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy