মান্না দে (১৯২০-২০১৩) ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (১৯২০-১৯৮৯) জন্মশতবর্ষ নানা ভাবে পালিত হচ্ছে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে আরও কেউ-কেউ আছেন, যাঁরা ততটা জনপ্রিয় না হলেও তাঁদের প্রতিভা প্রশ্নাতীত। তেমনই এক জনের জন্মশতবর্ষও চুপিসারে এসে উপস্থিত। তিনি সুধীরলাল চক্রবর্তী (১৯২০-১৯৫২)। প্রায়-বিস্মৃত এই অসামান্য সুরস্রষ্টা ও শিল্পীকে ঘিরে তেমন উদ্যোগ-আয়োজন এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি, অথচ তাঁর সাঙ্গীতিক অবদান সব সময়েই স্মরণযোগ্য।
সুধীরলালের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বালিয়াডাঙা গ্রামে। পিতা গঙ্গাধর চক্রবর্তী ছিলেন কালেক্টর অফিসের কর্মী। ছোটবেলা থেকেই গানবাজনার প্রতি সুধীরলালের অদম্য আকর্ষণ। শ্রুতিধরও ছিলেন, শুনেই তুলে নিতে পারতেন যে-কোনও গান। এক বার বহরমপুরের এক জমিদারবাড়িতে বালক সুধীরলাল গান শোনাচ্ছেন। সেখানে উপস্থিত বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পী ও প্রশিক্ষক গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। সুধীরলালের গান শুনে মুগ্ধ গিরিজাশঙ্কর তাঁকে কলকাতায় এসে গান শেখার কথা বলেন। এই সূত্রে কলকাতায় এসে সুধীরলাল হ্যারিসন রোডে গিরিজাশঙ্করের বাড়িতে থেকে তালিম নেওয়া শুরু করেন। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, মৈজুদ্দিন খান, খলিফা বদল খান প্রমুখের তালিমে সমৃদ্ধ গিরিজাশঙ্করের নিবিড় প্রশিক্ষণে সুধীরলাল খেয়াল-ঠুংরি-ভজন গানে দ্রুত পারদর্শী হয়ে উঠলেন। শিষ্যের নৈপুণ্যে গুরুও খুব খুশি। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক, সঙ্গীতরসিক সাগরময় ঘোষ মাঝে-মাঝে গান শুনতে আসতেন গিরিজাশঙ্করের বাড়ি। এক বার সাগরময়কে প্রিয় শিষ্য সুধীরলালের গান শোনালেন গিরিজাশঙ্কর। স্নেহভাজন সুধীরলালকে বিভিন্ন আসরেও নিয়ে যেতেন গিরিজাশঙ্কর। ঘরোয়া আসরে অংশগ্রহণের সঙ্গে-সঙ্গে রেডিয়োতেও গাইতে শুরু করেন সুধীরলাল। ইলাহাবাদ, অল বেঙ্গল— বিভিন্ন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন। ১৯৪২ সালে, সম্ভবত আর্থিক কারণেই, ঢাকা বেতারকেন্দ্রে সঙ্গীত-প্রযোজকের চাকরি নেন। আবার ফিরলেন ১৯৪৫-এ, কলকাতা বেতার-কেন্দ্রের সঙ্গীত-প্রযোজক হয়ে। তত দিনে তাঁর সঙ্গীতজীবন বিস্তৃত হয়েছে শিল্পী ও প্রশিক্ষক হিসেবে।
উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কৃতী মানুষ, কিন্তু বাংলা গানকে ভালবেসে বাংলা গানেই নিবেদিত হলেন। ১৯৩৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড। দেবেশ বাগচীর কথায় ও নিজের সুরে ‘ভালবেসেছিনু আলেয়ারে’ এবং ‘রজনী গো যেও না চলি’ (এইচ ৭৪০)। অনেক সম্ভাবনার স্বাক্ষর রইল গানে। তার পর নরেশ্বর ভট্টাচার্যের কথায় ও অনুপম ঘটকের সুরে ‘সন্ধ্যামালতী বনে’, বিনয় ঘোষের কথায় রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘ছাইল অম্বর ঘন মেঘে’, প্রণব রায়ের লেখায় নিজের সুরে ‘প্রথম দিনের প্রথম সে পরিচয়’— এমন সব মরমি গানের মধ্য দিয়ে তাঁর এগিয়ে চলা। সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী হল প্রণব রায়ের কথায় নিজের সুরে ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’। স্নেহময়ী মা-কে নিয়ে লেখা এটি একটি অনন্য বাংলা গান। তাঁর আরও কালজয়ী গান, পবিত্র মিত্রের কথায় নিজের সুরে ‘এ জীবনে মোর’, ‘খেলাঘর মোর’ ইত্যাদি। পরম বন্ধু পবিত্র মিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ঢাকায়। পবিত্রকে তিনিই গান লেখার অনুপ্রেরণা জোগান।
সুধীরলালের কণ্ঠ, পাশ্চাত্য মতে, ‘টেনর’। সূক্ষ্ম অলঙ্করণ সহজে ফুটত তাঁর স্বরময় কণ্ঠে— যেমন ক্ষিপ্রগতির ছুটতান। তাঁর নিজের সুরেই থাকতে এমনই সব কারুকাজ। সুরে মেলোডিকে প্রাধান্য দিয়েই খেয়াল-ঠুংরি-কাওয়ালির অঙ্গ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কোথাও কাব্যগীতির মেজাজ নষ্ট হয়নি। তাঁরই সুরে গেয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন ঢাকার ছাত্রী উৎপলা সেন (‘এক হাতে মোর পূজার থালা’, ১৯৪৪), ছাত্র শ্যামল মিত্র (‘স্মৃতি তুমি বেদনার’, ১৯৫২)। শ্যামলের প্রথম রেকর্ডও তাঁর সুরে ১৯৫১-তে, ‘শোনো শোনো ওগো’ এবং ‘বন্ধু গো জানি’ (এন ৩১৩৪৩)। তাঁরই আবেগমথিত সুরে গীতা রায়ের (দত্ত) কণ্ঠে মূর্ত হয় ‘বৃন্দাবনে শ্যাম নাই’।
সুরকার সুধীরলালকে মর্যাদা দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (‘শুধু অবহেলা দিয়ে’), নীতা বর্ধন (‘ওগো নয়নে আবীর দিও না’), মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (‘গানের সুরে’), গায়ত্রী বসু (‘মোর মনোবনে’) প্রমুখ শিল্পীও।
জহুরির চোখ ছিল সুধীরলালের। ভাল গলা, শৈল্পিক দক্ষতা চিনতে তাঁর ভুল হত না। এক আসরে এক কিশোরীর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে সুধীরলাল তাঁকে গান গাওয়ার সুযোগ দিলেন ‘সুনন্দার বিয়ে’ (১৯৪১) ছবিতে। সেই শিল্পীই কালক্রমে হয়ে উঠলেন মধুকণ্ঠী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ছাত্রবৎসল, দরদি সঙ্গীতসাধকের জীবন থেমে যায় ১৯৫২ সালের ২০ এপ্রিল। প্রয়াণের পর কয়েক বছর ‘সুধীরলাল স্মৃতিবাসর’-এর আয়োজন করেছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গায়ক নিখিলচন্দ্র সেন। আস্তে-আস্তে তাও বন্ধ হয়ে যায়। সুধীরলাল চক্রবর্তীর মতো শিল্পীরা কেন ক্রমশ হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অন্ধকারে, শিল্পীর জন্মশতবর্ষ এই প্রশ্নের সামনেই দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy