সঙ্গীতলিপি: যদুভট্টের নিজের হাতে লেখা সেই খাতার পাতা
তিন দিনব্যাপী বিষ্ণুপুর মিউজ়িক ফেস্টিভ্যাল (২০১৮)-এর উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল বাংলার কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ যদুভট্ট রচিত ভৈরবীর ধ্রুপদ ‘নাদ পরম বিদ্যা দেহো ভবানী’। ‘নাদ পরম বিদ্যা’-র উপাসক যদুভট্ট তাঁর গানের খাতায় একই প্রার্থনা জানিয়ে আরও গান বেঁধেছিলেন। খাতাটি কিন্তু বাংলার সঙ্গীতরসিক সমাজের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে এখনও। আগাগোড়া বাংলায় লেখা এ খাতার বাংলা হরফের ছাঁদও আলাদা। সেই খাতা নিয়ে বলতে গেলে ১৮৭৩-৭৪ সালে ফিরতে হবে। এ সময়েই পঁচেটগড় (বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুরে) জমিদার পরিবারে সঙ্গীতশিক্ষা দিতে এসেছিলেন ওস্তাদ যদুনাথ। কিন্তু তাঁর পায়ের তলায় সরষে। তাই মাসছয়েক থেকেই আবার অন্য জলসাঘরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় আপনভোলা সঙ্গীতসাধক তাঁর গানের খাতাটি ফেলে যান। সেই খাতা বুকে আগলে রেখেছেন পঁচেটগড় ‘দাসমহাপাত্র’ পরিবারের অশীতিপর অপর্ণাদেবী। জানালেন, “১৯৬৩ সালে বিয়ে হয়। বিয়ের পরই শ্বশুরমশাই তাঁর বইয়ের আলমারির দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। তখনই দেখালেন খাতাটা।”
কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
“বেশ থ্রিলিং। আমি তো শান্তিনিকেতনের মেয়ে। সঙ্গীত ভবনেরও ছাত্রী। তাই যদুভট্ট সম্পর্কে একটা ধারণা ছিলই। তা ছাড়া যদুভট্টকে নিয়ে তৈরি একটা সিনেমাও দেখেছিলাম। সেই যদুভট্টের হাতের লেখা গানের খাতা...”।
আর বলতে পারলেন না। কখনও কখনও নীরবতাও খুব অর্থময় হয়ে ওঠে। যদুভট্টের লেখা খাতার নীরব অক্ষরগুলিও ঠিক তেমন।
ঠিক কত সালে যদুভট্ট এই খাতায় লেখা শুরু করেছিলেন তা বলার উপায় নেই। কিন্তু হালকা নীলাভ রঙের প্রতিটি পাতায় ‘DAWTON AND SON’ এবং তার নীচে ইংরেজিতে ১৮৬১ জল ছাপ আছে। যদুভট্টর জন্ম ১৮৪০ সালে। সেই সূত্রে বলা যায়, ২১ বছর বা তার পরেই এই খাতায় লেখা শুরু করেন তিনি। আবার খাতার ৭৬ পৃষ্ঠাঙ্কে গানের নীচে ছোট অক্ষরে লিখেছেন, ‘সাল ১২৭২, ২১ অগ্রহায়ণ ইস্তক’। এ সময় যদুভট্টর বয়স পঁচিশের কোঠায়। সঙ্গীত-অনুরাগী পাতকুমের (বর্তমান ঝাড়খণ্ডে) সামন্তরাজা শত্রুঘ্নাদিত্যদেবের দেওয়া শংসাপত্রে উল্লেখ, ‘ইতি শন ১২৭৪ সাল। তারিখ ২ ভাদ্র’। এর কিছু দিন পরেই পঁচেটগড়ে আসেন যদুভট্ট। ১৩৬৪ সালে মেদিনীপুরের ‘কৃষ্টি সংসদ’ খাতাটি বাঁধিয়েছিল। তখনই শংসাপত্রটি খাতার প্রথমেই রাখা হয়।
খাতাটির প্রথম দিকের পাতাগুলিতে পৃষ্ঠাঙ্ক নেই। খাতার শুরু পেনসিলে অসম্পূর্ণ রচনায়, ‘মা বোলে কে ডাকিবে মোরে/ যেও না মা ধোরি করে।’ উলটো পাতায় ‘ওঁ রামায়’ লিখে দু’দফায় বিভিন্ন জমিদার সঙ্গীতরসিকের কাছে প্রাপ্ত নজরানার হিসেব লিখেছেন। পরের ডান দিকের পাতায় কিছু লিখতে চেয়ে টানা আঁকিবুকিতে পেনসিল চালিয়েছেন। তার নীচেই লিখেছেন, ‘কিছু পুরি মেঠাই খানা ন কর হবে’। পরের ষোলোটি পাতা ফাঁকা। মূল খাতার শুরু এর পর। ‘শ্রী শ্রী দুর্গা’ লিখে সিন্ধু রাগে ঠুমরি তালে লিখেছেন, ‘এরি আঁদ কেউ নাহি সাজেনা লবে মোরা মারূজি ঢোলা জিবেজি…’। ভাষা পঞ্জাবি। এ পাতায় খাম্বাজ, পিলু, ভৈরবী রাগে মোট ন’টি গান লিখে আড়াআড়ি ভাবে কেটেছেনও! পরে চার পাতা জুড়ে তিলং, বেহাগ, কাফি, কেদার, আড়ানা, লুম ইত্যাদি রাগ-রাগিণীতে মোট ৩১টি ‘চিজ’ বা গানে খাতা সাজিয়েছেন। বারো ও তেরো সংখ্যক গানের নীচে ‘নাথ’ শব্দটি লিখে ইঙ্গিত দিয়েছেন রচনা দু’টি তাঁরই। উল্লেখ্য, পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংহ যদুভট্টকে ‘রঙ্গনাথ’ উপাধি দিয়েছিলেন। যদুভট্টও তাঁর অজস্র রচনায় রঙ্গনাথ বা নাথ ভণিতা ব্যবহার করেছিলেন।
এক সময় রাজারাজড়া থেকে বিত্তবান ভূস্বামীরা সঙ্গীতজ্ঞের গুণগান আর পৃষ্ঠপোষকতায় রাগসঙ্গীতের ধারা সচল রেখেছিলেন। যদুভট্টের খাতায় তাই অনেক রাজবন্দনাধর্মী রচনা ছড়িয়ে। আড়ানা রাগে ‘রাজা নীলমণি সিংহ ভয়হরণ সুখদাতা’র উদ্দেশে স্তুতি করেছেন। ৯৫ পৃষ্ঠাঙ্কে একটি রচনায় শতরাজসূয় যজ্ঞের কামনা করে গুণগ্রাহী নীলমণি সিংহকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। খাতায় রয়েছে বর্ধমানরাজ মহাতপচন্দ্র, মহিষাদলরাজ প্রমুখের স্তুতি। আলাইয়া, সুরট, পরজ, টোড়ি ইত্যাদি রাগের রসে সিক্ত সেই সব গান এক বহমান ওস্তাদের নীরব সাক্ষী।
খাতার যে পাতা থেকে পৃষ্ঠাঙ্ক শুরু হয়েছে সেই পাতার উপরে ‘ওঁ তৎসৎ’ লিখেছেন। পরের সন্ধ্যার রাগ কল্যাণে পর পর পাঁচটি ধ্রুপদের বাণী। রাগ ও তালের সঙ্গে ‘খান্ডারি’ শব্দটিও লিখেছেন। অর্থাৎ এগুলি খান্ডারবাণ চালের ধ্রুপদ। ঋজু অক্ষরে অতি যত্নে লেখা এ পাতার গানগুলি। কিন্তু তৃতীয় পৃষ্ঠাঙ্কে প্রথম দু’টি গান লেখার পরই তাঁর লেখার ছাঁদে হঠাৎ বদল এসেছে। এর পর প্রতি পাতায় টানের দ্রুততা। এই দ্রুততা যেন দ্রুত গতির খান্ডারবাণ শৈলীর এক সিদ্ধ ধ্রুপদশিল্পীর উচ্ছল তরঙ্গ। যেখানে গায়কি, জীবন যাপন, হাতের লেখা মিলেমিশে একাকার। একটি রচনায় পাচ্ছি, নাদ বিদ্যা উপাসক যদুভট্ট ধনসম্পদ সুখ কিছুই চান না। ৭৫ পৃষ্ঠাঙ্কে ‘হামীর’ রাগে জানাচ্ছেন— নাদ নৌন্দ দীজে সাথ— নাদবিদ্যার আনন্দে যেন ভরপুর থাকতে পারেন।
লক্ষণীয়, একই ‘বন্দেজ’ বা ‘চিজ’ যদুভট্ট দু’বারও লিখেছেন। দিনের রাগ সুহাকানাড়াতে ‘এ চমৎকার দিদার’ ধ্রুপদটি আমি শিখেছিলাম আমার স্বর্গত আচার্য নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। যদুভট্ট রাগ বা তালের উল্লেখ করেননি। কিন্তু উক্ত ধ্রুপদটি ১৩ পৃষ্ঠাঙ্কে লেখার পরে আবার ৫৫ পৃষ্ঠাঙ্কে লিখেছেন। দু’বার লিখেছেন ভৈরবীর বিখ্যাত ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটী জাত’ ঠুমরিটি।
মিঞা তানসেন, সদারঙ্গ, অদারঙ্গ, তানসেনপুত্র সুরতসেন, তুলসীদাস, কদর-সনদের অজস্র রচনায় ঠাসা খাতাটি। ঋতুবন্দনা, রাগবিদ্যার নানা তত্ত্বকথার পদের সঙ্গে রাম-কৃষ্ণ-শিব-দুর্গা-গণেশের স্তুতিও আছে। আছে যদুভট্টর লেখা দু’টি গঙ্গাবন্দনা। যদিও রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানের ডালায় থাকা ‘জয় প্রবল বেগবতী’ গানটি এই খাতায় নেই। মোট কথা, তাঁর সংগৃহীত ও রচিত অনেক গানই বিষ্ণুপুর ঘরানায় সংরক্ষিত হয়নি। ঠুমরি-রসিক যদুভট্টকে বাঙালি চিনতেই পারেনি।
খাতার প্রথম দিকের একটি পাতায় পেনসিলে সিন্ধু রাগের সার্গম লিখে আলাইয়া রাগে একতালে বাংলা গান বেঁধেছেন—‘ত্রাহি তারিণী তুমী না তারিলে কে তারিবে/ ওগো ত্রিলোক তারিণী ত্রাণ কারিণী...’ ‘ত্রিলোক তারিণী’ শব্দ দু’টি ও পরের দু’টি ছত্র আবার কেটেছেন। এটি কি ত্রিলোকতারিণী মায়ের প্রতি মাতৃসাধক যদুনাথের অভিমানের সূচক? শাক্তপদাবলির অনুরণন? খাতার শেষাঙ্কে একগুচ্ছ রচনায় সেই রেশ ধরা পড়ে। ‘রামপ্রসাদী সুর’ লিখে বলেছেন, ‘জমী দিতে হবে না জিবন তুমী অন্য প্রজা তাথে করবে স্থাপন/ জে ভূমী পেয়েছ সে জন বার মাষ তার সস্য পুরণ কারেউ কর দিতে না...’ পরেই সিন্ধুভৈরবী-আড়াঠেকা তালে তাঁর প্রশ্ন—‘নাথে দুখ দাও কিসের কারণ কেমনে এদিন দিন করবে যাপন...’ আত্মিক উপলব্ধির সঙ্গে আধ্যাত্মিক উত্তরণের ছোঁয়া লেগেছে, ‘কেন না ভাব আপনঃ কে তুমি কাহার লাগী করবে রোদন, মন ভুল না কো আরঃ জে ধন পেয়েছ ওষে সকলেরই সার, বল কে হবে নিধনঃ জা বিনে নাহীক আর দিতিয় বরণ/ অসীম ব্রম্ভাণ্ড জার কটাক্ষে হয় বিস্তার সে জে বহুরূপ রূপ করেছে ধারণ/ কে তিনু রূপেতে তার পুজাদি করিতে পারে নাথ চিতে প্রকাসেরে আত্মনারায়ণ’ ইত্যাদি গানে।
এ সব গান যখন লিখেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মতো। সাঙ্গীতিক প্রতিভার কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, রচনাগুলি কবি যদুভট্টর দার্শনিকতার আলোয় উজ্জ্বল। সেই আলো কখনও ঠিকরে পড়েছে তাঁর বাউলধর্মী সাধনতত্ত্বের আবরণে। বাউলধর্মে কায়া সাধন করে মায়ার পারে যেতে হয়। ভৈরবীর আলো ছড়িয়ে নানা গানে বাউলবেশে যদুভট্টর আনাগোনা। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে এই শরীর পঞ্চভূত মাত্র। তাই লেখেন, ‘জে ধন বিহিন হোলে তনু পঞ্চভূতে খায়ঃ নাথ বলে হের তারে পড়েহি অবোধ দায়।’
যদুভট্টর লেখা খাতাটির প্রতি পাতায় মিশে আছে এক পরিব্রাজক সঙ্গীতসাধকের পিপাসা-শ্রম-শিক্ষা-নিষ্ঠা ও সংগ্রহ-রচনা। এক কথায় খাতাটি তাঁর অন্তরের প্রকাশিত রূপ। প্রাণভোমরা। কিন্তু শ্রুতিধর স্মৃতিধর যদুভট্ট সে খাতার তোয়াক্কা করেননি। খাতার টানে ফিরে আসেননি পঁচেটগড়ে। এগিয়ে চলার পথে স্মৃতি আর সাধনা তাঁর সম্বল। অন্তরের আকুতিই তাঁর চালিকাশক্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy