Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2020

পুজো বদলে যায়

তেতাল্লিশের মন্বন্তর বা ষাটের দশকের খাদ্যসঙ্কট— হাজার ঝড়ঝাপটাতেও হারায়নি বাঙালির পুজো। বদলেছে শুধু মাইকের গান, প্রতিমার ধাঁচ। বৃষ্টিধোয়া নীল আকাশ, এক্সপ্রেসওয়ের ধারে কাশফুল, ভোরবেলার শিউলি-গন্ধে আজও আগমনীর সুর। মণ্ডপে থার্মাল গান কিংবা স্যানিটাইজ়ার থাকলেই বা ক্ষতি কী! এ সব প্রায় তিন দশক আগের কথা। তার পর কলকাতার পুজো-পরিক্রমা যে কত বদলে গেল! দক্ষিণে সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র আলো হারাল।

গৌতম চক্রবর্তী 
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২০ ০০:০৮
Share: Save:

পুজো বদলে যায়! জীবনের শিক্ষা এটাই। মনে পড়ে, সপ্তমীর আলোময় সন্ধ্যা। কালীঘাট ফায়ার ব্রিগেডের পাশে ফরওয়ার্ড ক্লাব এবং আরও দু’-একটা বড় পুজো। তার আগে উজ্জ্বলা সিনেমার গলিতে সঙ্ঘশ্রী। ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে সোজা হরিশ মুখার্জি রোড ধরে হাঁটলে মুক্তদল, ২৩ পল্লি এবং আরও অনেক দিকচিহ্ন।

ভিড় মণ্ডপ থেকে বেরোতে বেরোতে ছেলেটার হাতে ছোট্ট চিমটি কাটল নতুন শাড়ি-পরা মেয়েটা, ‘কী দেখছিলে অত ক্ষণ হাঁ করে?’ মেয়েটা কয়েক মাস আগে কলেজে ঢুকেছে, ফার্স্ট ইয়ার। ছেলেটা হাল্কা চাপদাড়ি, সেকেন্ড ইয়ার। মেয়েটার হাত ধরে রাস্তা পেরোতে পেরোতে সে মৃদু হাসল, ‘কী আবার! দুর্গা প্রতিমা-টতিমা এই সব।’ মেয়েটার ভ্রুভঙ্গিতে এ বার অনুযোগ, ‘প্রতিমা না দুর্গাপ্রতিমা সব? ঠিক করে বললেই পারো।’ বাংলা ভাষাতেও যে ফ্লার্ট করা যায়, সেকেন্ড ইয়ার সেই সপ্তমী-সন্ধ্যাতেই প্রথম জেনেছিল।

এ সব প্রায় তিন দশক আগের কথা। তার পর কলকাতার পুজো-পরিক্রমা যে কত বদলে গেল! দক্ষিণে সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র আলো হারাল। এক-এক করে রাসবিহারী, হাজরা মোড়ের রাস্তার এ পাশে-সে পাশে উঠে এল বাদামতলা, চেতলা অগ্রণী, আরও কত উজ্জ্বল উদ্ধার! নতুন আলো জ্বলল শহরতলিতে, ই এম বাইপাসের দিকে… বোসপুকুর, টেগোর পার্ক। সোজা গিয়ে লেকটাউন, উল্টোডাঙার দিকে বাঁক নিলে শ্রীভূমি, তেলেঙ্গাবাগান, করবাগান। আর তিন দশক আগের সেই সব দিন? তখন হরিশ মুখার্জি রোড ধরে সোজা হেঁটে গেলে হরিশ পার্কের মেলায় নাগরদোলা, বেলুন ফাটানোর বন্দুকবাজি, শাঁখারিপাড়া দিয়ে আর কিছু দূর হেঁটে গেলে এসএসকেএম হাসপাতাল, রবীন্দ্রসদন, ময়দান অবধি আর পুজো নেই। কোলাহল নেই, আলো নেই। সেকেন্ড ইয়ারের কাছে পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই জনস্থানমধ্যবর্তী নির্জন প্রস্রবণগিরি।

পুজোর এই আলো-অন্ধকারেই প্রেমের উন্মেষ ঘটে। কলকাতায়, শহরতলিতে, মায় পদ্মা নদীর ধারে কেতুপুর গ্রামে। কপিলা কি আচমকা শেষ মুহূর্তে কুবেরের নৌকোয় উঠে ময়নাদ্বীপ যেতে চেয়েছিল, ‘আমারে নিবা মাঝি?’ তার আগে তাদের সাহস দিয়েছিল দুর্গাপুজো। ‘কেতুপুরে চার দিন পূজার ঢাকঢোল বাজিল— উৎসব হইল। জেলেপাড়ার ছেলেবুড়া দু বেলা ঠাকুর দেখিল, কেহ কেহ তাড়ি গিলিয়া খুব মাতলামি করিল...’, উপন্যাসে লিখছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই পুজোতেই সন্ধ্যার সময় জমিদারবাড়িতে ঠাকুর দেখতে যায় কপিলা, বাবুদের কর্মচারী শীতলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে। দেখে কুবেরের বুক জ্বলে যায়। ফিরতি পথে তেঁতুল গাছের নীচে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। কুবের হঠাৎ কপিলার আঁচল চেপে ধরে, ‘শীতলের লগে অত কথা কিসের তর, আঁই?’ কপিলা আঁচল ছাড়ানোর চেষ্টা করে, ‘পোলাপানের লাখান কইরো না মাঝি, ছাড়ো।’ শেষে আঁচল টানাটানিও সে আর করে না। কুবের তাকে জড়িয়ে ধরলে শান্ত হয়ে থাকে। বাঙালি জানে, পুজো মানে শুধুই ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ’ বলে অঞ্জলিদান নয়। এই সময়েই আকাশে-বাতাসে-হৃদয়ে প্রেম-প্রেম পায়।

‘যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!’

ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ ছবি মনে করতে পারেন। বনেদি বাড়িতে পড়ন্ত বেলার দুর্গাপুজো। ঢাক বাজে, আরতি হয়। অথচ সম্পর্কগুলি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছে। বড়দির বিয়েটা অসুখী, এক ভাই বড় চাকুরে ছিল, কিন্তু চাকরি চলে গিয়েছে। ছোট মেয়ের বর শিল্পী এবং মাতাল, সে বিবাহবিচ্ছেদের চিঠি পাঠিয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে এই চরিত্ররা নিজেদের খুঁজে পায়। চাকরি-হারানো ভাইয়ের স্ত্রী আশ্বাস দেয়, ‘তুমি না বললেও আমি ব্যাপারটা জানি। আমার গয়নাগুলি তো আছে।’ ছোট মেয়ের বর প্রসেনজিৎ জ্বর গায়ে ধুঁকতে-ধুঁকতে এসে হাজির। বিসর্জন দেওয়া পুরনো কাঠামোতেই তো নতুন মাটি আর রঙের ছোপে তৈরি হয় নতুন প্রতিমা। ফলে পুরনো ঝগড়া, মান-অভিমান, উকিলের চিঠি সত্ত্বেও কি আবার নতুন ভাবে তৈরি করা যায় না সম্পর্কের বুনিয়াদ? পুজো মানে শুধু প্রেম নয়, ভুল বোঝাবুঝির অবসান এবং অনেক কিছু। ঘটনাচক্রে, এ বারেই সেই ছবির কুড়ি বছর। জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি, কুড়ি বছরের পার।

সাহিত্য, সিনেমার জনসংস্কৃতিতে পুজোর দিন এসেছে আরও নানা ভাবে। ‘নিশিপদ্ম’ ছবির শেষ দৃশ্যে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে বাড়ি নিয়ে যাবে তাঁর ছেলে। গর্ভজাত পুত্র নয়, রক্তের সম্পর্ক নয়। শুধু স্নেহের ভরেই সম্পর্ক। পশ্চাৎপটে দুর্গাপুজোর সকাল, সাবিত্রী পালিত পুত্রের সঙ্গে উঠে বসেন রিকশায়। ধুতি দিয়ে চশমার খুঁট মুছে নেন উত্তমকুমার। একই গল্প নিয়ে শক্তি সামন্তের হিন্দি ছবি ‘অমর প্রেম’-এও শেষ দৃশ্যে দুর্গার বোধন। শর্মিলা ঠাকুরকে রিকশায় তুলে দিতে দিতে রাজেশ খন্নার চোখে জল, মুখে বলেন, ‘পুষ্পা, আই হেট টিয়ার্স।’ অসুরদলনী, দশপ্রহরণধারিণী দেবীকে বাঙালি এক মাস আগে আগমনী গানে ঘরের মেয়ে করে তুলেছিল, ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা নাকি বড় কেঁদেছে’, পুজোর এই চার দিন ধূপধুনো আরতি ঢাকের বাদ্যিতে তার উত্তুঙ্গ শিখর। অবশেষে দশমীতে বিধুর বিষণ্ণতা। খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত মাইকেল মধুসূদন দত্তও ফ্রান্সে বসে বাংলায় সনেট লিখবেন, ‘যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!’ এখানেই বাঙালির ঐতিহ্য। মৃন্ময়ী দেবীর বিসর্জনে চোখের কোল চিকচিক করে ওঠা, ভরসা থাকে আসছে বছর আবার হবে। বিশ্ব জুড়ে মহামারি, মহালয়ার এক মাস পরে বোধন, মণ্ডপে মণ্ডপে সোশাল ডিস্ট্যান্সিং সবই হতে পারে, কিন্তু এই ভাল লাগা আর শেষ মুহূর্তে বুকের মধ্যে খাঁ-খাঁ শূন্যতা, কান্না ভাবকে অস্বীকার করব কী ভাবে?

এই যে দেবীর জন্য অপেক্ষা, আকাশে-বাতাসে ভাল লাগা, শেষ মুহূর্তে কান্না পাওয়া, এখানেই বাঙালির ক্যাথারসিস। নিছক দেবী-ভক্ত সম্পর্ক নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য ভালবাসা! লাল-বাল-পালখ্যাত বাঙালি নেতা বিপিনচন্দ্র পালের জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের পরের বছর, ১৮৫৮ সালে। আত্মজীবনীতে ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়েছেন তিনি, ‘‘আমাদের বাড়িতে দুর্গোৎসব হইত। পূজার সময় প্রতি বৎসরই আমাদের মুসলমান প্রতিবেশী বা প্রজারা মানত করা বলি লইয়া উপস্থিত হইত। কেহ পায়রা, কেহ আখ, কলা, শশা বা ছাঁচিকুমড়া আর কখনও কখনও কেহ বা পাঁঠা পর্যন্ত বলি দিবার জন্য লইয়া আসিত।…আমাদের গ্রামজীবনে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এই সম্বন্ধই ছিল।’’

এটাই বাঙালির দুর্গোৎসব। হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার স্থান সেখানে কোনও দিন ছিল না। শিল্পী পরিতোষ সেনের কথাই ধরা যাক। বিপিন পাল, প্রথম মহাযুদ্ধ ইত্যাদি পেরিয়ে ১৯১৮ সালের ঢাকায় তাঁর জন্ম। আত্মজীবনীতে তাঁর বাবা প্রসন্নকুমার সেনের কথা বলছেন শিল্পী, ‘‘আজ মহাষ্টমী। পুজোমণ্ডপের সামনে গ্রামবাসীদের মস্ত জমায়েত। প্রসন্নকুমার বাহিরবাড়ির বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন। পাশেই অনেক ধুতি এবং লুঙ্গি থাক করে রাখা আছে। হিন্দু-মুসলমান ভাগচাষী এবং প্রজারা তাঁর পায়ের ধুলো নেয়। তিনি সবার হাতে একটি করে ধুতি কিংবা লুঙ্গি এবং পোড়ামাটির বাসন তুলে দেন।’’

এ তো উচ্চবর্গের হিন্দুর কথা। গ্রামের নিম্নবর্গের মুসলমানের আনন্দও কি কম? বরোদায় (এখন বডোদরা) বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষকে বাংলা শেখাতেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। ‘পল্লীচিত্র’ বইয়ে পুজোর সময় নদীয়ার গ্রামের বর্ণনা, ‘‘চারখানা ছিটের একখানি অনতিদীর্ঘ লুঙ্গি ও হাতকাটা খাট মেরজাই-পরিহিত, সাদা ফিনফিনে পাতলা কাপড়ে প্রস্তুত অর্ধখণ্ড নারিকেলের মালার মত ফকরে টুপিতে আবৃতমস্তক, কপিশ-শ্মশ্রু মুসলমান দোকানদার মৌলাবক্স নানাবিধ বাক্য কৌশলে ক্রেতার মন নরম করিতেছে।” অতএব বাঙালির উৎসবকে আজ যাঁরা হিন্দু-মুসলমানে ভাগাভাগির চেষ্টা করবেন, তাঁরা ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন বাতুলমাত্র!

আজকের মহামারি পরিস্থিতিতে মাস্ক পরে, তিন দিক খোলা মণ্ডপের সামনে ভিড় করে আদৌ সেলফি তোলা যাবে? প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে চরকিপাকের জনজোয়ারে না ভাসলে আনন্দই বা কিসের? এই সব কথা যাঁরা ভাবছেন, জেনে রাখুন, পুজোর কলকাতায় এটাই প্রথম দুর্বিপাক নয়। ১৮২৯ সালে খবর, ‘‘পূর্বে এই দুর্গোৎসবে যেরূপ সমারোহ নৃত্যগীতাদি এক্ষণে বৎসর ২ ক্রমে ঐ সমারোহ ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আসিতেছে। এই বৎসরে নৃত্যগীতাদিতে যে প্রকার সমারোহ হইয়াছে ইহার পূর্বে ইহার পাঁচগুণ ঘটা হইত এমত আমাদের স্মরণে আইসে।’’

জনজোয়ারে ভাটা তিন বছর পরেও থামেনি। ১৮৩২ সালের ১৩ অক্টোবর ‘জ্ঞানাণ্বেষণ’ পত্রিকা জানাচ্ছে, সে বার রাস্তায় ভিড় এত কম যে ‘ইতর লোকের স্ত্রীলোকেরাও’ স্বচ্ছন্দে প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিমাদর্শন করেছে। ‘বাইজিরা গলি গলি বেড়াইতেছেন… যাহাদের বাড়ীতে পাঁচ সাত তরফা বাই থাকিত এ বৎসর সেই বাড়ীতে বৈঠকিগানের তালেই মান রহিয়াছে।’

নাচঘরে নিকিবাই, নুরবক্স প্রমুখ বাইজিদের রোশনাই নয়, সে বছর শুধুই বৈঠকি গান। ফলে এ বার বিজয়া সম্মিলনী, কার্নিভাল হচ্ছে না দেখে দুঃখ করে লাভ নেই। বর্ষণধোয়া নীল আকাশে মান-অভিমান প্রেম-অপ্রেম, এক্সপ্রেসওয়ের ধারে নুয়ে পড়া কাশফুল, ভোরবেলায় শিউলির গন্ধ, সব কিছু নিয়ে কলিকাতা রহিয়াছে কলিকাতাতেই। কলকাতা কেন, নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে দুঃখ-দারিদ্র সঙ্গে নিয়ে পুজোর দিন গোনার মধ্যেও তো রয়েছে আশাবরি রাগের ঝঙ্কার। বর্ষার রাত, ঝিঁঝিপোকার একটানা শব্দ— ‘অপু জিজ্ঞাসা করিল, পুজোর আর কদিন আছে, মা? দুর্গা বঁটি পাতিয়া তরকারি কাটিতেছিল। বলিল, আর বাইশ দিন আছে না মা?’ অতঃপর লেখকের মন্তব্য, ‘সে হিসাব ঠিক করিয়াছে। তাহার বাবা বাড়ি আসিবে, অপুর, মায়ের, তাহার জন্য পুতুল, কাপড়, আলতা।’ আপন মনে দিন গোনা, অপেক্ষার অবসান, এই সব কিছু মিলে হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে যে আনন্দ, সেটাই বাঙালির পুজো। পাঁজি-পুঁথির শুষ্ক নির্ঘণ্ট নয়।

দিন গোনার সাক্ষী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কবিতাতেই তো পুজোর আনন্দের উদ্যোগপর্ব— ‘‘কলেজের ইকনমিকস ক্লাসে/ খাতায় ফর্দ নিচ্ছে টুকে চশমা-চোখে মেডেল-পাওয়া ছাত্র/ হালের লেখা কোন্ উপন্যাস কিনতে হবে/ ধারে মিলবে কোন দোকানে/ ‘মনে রেখো’ পাড়ের শাড়ি/ সোনায় জড়ানো শাঁখা/ দিল্লির কাজ-করা লাল মখমলের চটি।’’ নতুন শাড়ি, গয়না, জুতো এবং শারদ-উপন্যাস কেনা যে বাঙালি জীবনে কতটা অঙ্গাঙ্গি, তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের আর একটা ছোট গল্প, ‘স্বর্ণমৃগ’। ‘‘আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে... টিনের বাক্সের মধ্যে ছেলেদের জন্য জুতা, ছাতা, কাপড় এবং প্রেয়সীর জন্য এসেন্স, সাবান, নূতন গল্পের বহি এবং সুবাসিত নারিকেল তৈল।’’ লম্বা লিস্ট। জামা, জুতোর দোকানে আজকের ভিড় দেখে যাঁরা আঁতকে উঠছেন, করোনা বাড়বে এবং পুজোর পর ভেন্টিলেটরের অভাবে সবাই খাবি খাবে ভাবছেন, তাঁরা একটি বিষয়ে আশ্বস্ত থাকতে পারেন। আধিব্যাধি, খাদ্যাভাব এবং সমস্যাসঙ্কুল বাংলায় এ ভাবেই বছরের পর বছর মা আসেন। ১৯৬৩ সালের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রবুদ্ধ লিখছেন, ‘‘সমাগত শারদীয়া আকাশে-বাতাসে/ বাজারে-অফিসে আর গৃহস্থের ঘরে/ লবণ আনিতে পান্তা ফুরোবার ধুম/ চাল মহামূল্য তবু চাল মারিবার/ বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই, দোকানেতে ভীড়... যুগের হুজুগে মত্ত সবে/ কেবা আজ কার কথা শোনে।’’ এই খাদ্যসঙ্কটের ঢের আগে, ১৮৭৮ সালে এক বাবু বাঙালি ‘দুর্গোৎসব’ নামে এক কবিতায় প্রায় এক কথা লিখছেন, ‘‘মেরেছ মা বারে বারে দুষ্টাসুরগণে মেরেছ মা তারকাসুর আজ বঙ্গ ক্ষুধাতুর মার দেখি ক্ষুধাসুর সমাজের রণে।’’ বাবুটির নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ২০২০ প্রথম নয়, যুগ যুগ ধরে বহুবিধ সমস্যার মাঝেই কৈলাসবাসিনী বঙ্গভূমে আসেন।

এ বারের করোনাসুরের আক্রমণেও সেটাই ঘটছে। মণ্ডপে মণ্ডপে স্যানিটাইজ়ার, থার্মাল গান ও ভিড় সামালের বন্দোবস্ত। থিমশিল্পীরাও অন্য পথে। ভবতোষ সুতার, সনাতন দিন্দার মতো দুই শিল্পীই জানালেন, ‘এ বার বাজেট কম। ফলে দেখতে হয়েছে, মাটির প্রতিমার বদলে কাপড়, বাঁশ ইত্যাদি অন্য উপকরণে কাজ করা যায় কি না। দেখতে হয়েছে, না খেতে পেয়ে মরার এই বাজারে অনেক জুনিয়র শিল্পী যাতে কাজ পান। বেশি মার্জিন, লাভ-ক্ষতি এই বছরে ভাবছিই না। এটা আসলে ক্রিয়েটিভ চ্যালেঞ্জ,’ বলছেন ওঁরা। দুর্যোগের বছরে ছোট, বড় শিল্পীরা সকলে মিলে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়াতেই তো আনন্দময়ীর প্রকৃত আবাহন।

আসলে পুজো কখনওই এক রকম থাকে না। ছেলেবেলায় মা-বাবার সঙ্গে যখন পুজোর ছুটিতে চুনার বা রাজগীর বেড়াতে যেতাম, বাড়ি ভাড়া নিয়ে এক মাস থাকা। সঙ্গে কুঁজো, হোল্ডঅল, ছুটিতে মাস্টারমশাইয়ের দেওয়া টাস্ক, রোজ ২০টা অঙ্ক, ১৫টা ইংরেজি ট্রানস্লেশন ইত্যাদি আরও আরও কত! একটু বড় হয়ে দেখলাম, পুজোয় বাইরে যেতে হলে তিন মাস আগে, সারা রাত কয়লাঘাট বা ফেয়ারলি প্লেসে লাইন দিয়ে ট্রেনে রিজ়ার্ভেশন করতে হয়। সঙ্গে নগদ টাকাপয়সা না রেখে ট্রাভেলার্স চেক। এক বার কেদার-বদ্রী থেকে ফিরছি। সকাল ন’টা নাগাদ বাস চামোলি বা গোপেশ্বরের কাছে আসতে সকলে মিলে হইহই। ওই তো রাস্তার পাশে ব্যাঙ্ক! গঢ়বালি ড্রাইভার মৃদু হেসে বাস থামিয়ে দিলেন। জনা দশেক বাঙালি যাত্রী ছুটল চেক ভাঙিয়ে টাকা তুলতে। আহা, সেই বছরেই আমার জীবনের সেরা দুর্গাপুজোটি দেখেছিলাম। হৃষীকেশে গঙ্গার ধারে এক নাম-না-জানা সরু গলিতে ছোট্ট প্যান্ডেল। আলোকসজ্জার বালাই নেই, সাদামাটা পরিবেশে আমাদের দিকে দেখছেন বিশ্বজননী। এখন লাইন দিতে হয় না, নেটে টিকিট রিজ়ার্ভেশন করা যায়, ডেবিট কার্ড ও এটিএমের দৌলতে ট্রাভেলার্স চেক উঠে গিয়েছে। হৃষীকেশ এখন হরিদ্বারের ঘিঞ্জি শহরতলি। শরতের হিমেল অন্ধকারাচ্ছন্ন ভোরে উঠে বাস ধরতে হয় না, সারাক্ষণই টাটা সুমো ছুটছে। বলছিলাম না, পুজো বদলে যায়। সোশাল ডিস্ট্যান্সিং, থার্মাল গানের ঢের আগে থেকে।

বদল যে আরও কত! পুজো মানেই মাইক এবং সন্ধ্যাবেলায় সুরেলা আশা ভোঁসলে, ‘লক্ষ্মীটি দোহাই তোমার আঁচল টেনে ধরো না’, কিংবা কিশোরকুমার, ‘আমার পূজার ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে’। পুজো উপলক্ষে সিনেমার গানের বাইরেও এই সব গান তৈরি হত। পাড়ায় পাড়ায় যে গান যত বেশি মাইকে বাজবে, সে গান তত বেশি জনপ্রিয়। ভুলভাল সন্দেহজনক টিআরপি তখন ছিল না। ক্লাবঘরের এক পাশে মাইকের সঙ্গে লাগানো রেকর্ডপ্লেয়ার, মাঝপথে অন্য রেকর্ড নামিয়ে নিজের প্রিয় গান চালিয়ে দেওয়া। মাঝে মাঝে গুরুজনস্থানীয়দের আগমন, ‘অনেক করেছিস। এ বার ভদ্রলোকের মতো গান চালা। মায়ের গান বা রবীন্দ্রসঙ্গীত।’ সঙ্গীতেও যে ভদ্র-অভদ্র আছে, এ জিনিস পাড়ার পুজোমণ্ডপ ছাড়া জানা যেত না। আর ছিল বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চাঁদা তোলা, ‘মেসোমশাই, একশো টাকা ধরলাম।’ তিনি নাছোড়বান্দা, শেষে ৮০ টাকায় রফা। যে বার টুনি বাল্‌ব, হ্যালোজেন ও অন্যান্য আলোকসজ্জার খরচ বাড়ত, সে বার পীড়াপীড়িও বাড়ত। লজ্জার মাথা খেয়ে বলি, সত্তর-আশির দশকেও পুজোর আগে রোজকার খবর থাকত চাঁদার জুলুম আর মাইকের কর্ণভেদী অত্যাচার।

পরিস্থিতি বদলে যায় বিখ্যাত শারদসম্মানগুলির আগমনে। তখন বিচারকরা দু’দফায় গাড়ি চেপে আসেন, সেরা মণ্ডপ, সেরা প্রতিমা থেকে সেরা পরিবেশ, অনেক কিছুর জন্য পুরস্কার। মাইক বাজে না, বরং বিচারকরা পৌঁছলে ঢাকের বোল বেড়ে যায়। পাড়ার মেয়েরা লাল শাড়ি পরে শঙ্খধ্বনিতে বিচারকদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসে। এক জীবনে কত যে দেখলাম!

নিজের বাড়ি বা পাড়ায় ভাল আলোকমালা কে না চায়! আমরা তো তুশ্চু ছেলেছোকরা ছিলাম। বিপিনচন্দ্র পাল আত্মজীবনীতে জানাচ্ছেন, ‘‘১৮৭২ ইংরাজীর পূজার সময় আমি ষোলো বৎসরে পা দিয়াছি, আর এই সময়েই বাবা আমার হাতে পূজার বাজারের কোন কোন সাজসজ্জা কিনিবার জন্য কিছু টাকা দেন। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এ যাবৎকাল বেলোয়ারী লন্ঠন ও দেওয়ালগির ও শামাদান যৎসামান্য ছিল। পূজার সময় মোমবাতির আলো দিয়াই যথাসম্ভব রোশনাই করা হইত... সেই বৎসরই আমার হাতে টাকা পড়াতে আমাদের বাড়ীতে হিঙ্কসের দুই পলিতার ওয়াল ল্যাম্প যায়।’’ অলিখিত নিয়মে তখন পাড়ার কোনও শাঁসালো লোক সভাপতি, বাজেট কম পড়লে বিসর্জনের দিন তিনি নিজের পকেট খসাতে বাধ্য হতেন। চাঁদা তোলা কি আজকের ব্যাপার? হুতোম লিখেছেন, অফিস যাওয়ার আগে এক সিঙ্গিবাবুকে ধরে বারোয়ারি পুজোর অধ্যক্ষরা ধরেছি ধরেছি বলে চেঁচাতে থাকলেন। কী ধরেছি? ‘‘মা ভগবতী সিঙ্গির উপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিঙ্গির পা ভেঙে গেছে।

মা স্বপ্ন দিয়েছেন, যদি আর কোনও সিঙ্গির দেখা পাও, তা হলে আমি যেতে পারি। আজ দেখা পেয়েছি, কোনও মতে ছেড়ে দেব না।’’ এই সব কুশলী শিল্পীরা আর নেই। বহুতল কমপ্লেক্সগুলিতে আজকাল মিটিং করে চাঁদার অঙ্ক বেঁধে দেওয়া হয়। চাঁদা আদায়ের থেকে বরং ‘রেট কার্ড’ প্রধান, ‘দেখুন না, একটা গেট যদি জোগাড় করে দিতে পারেন! একটা ব্যানার অন্তত!’ বদল যুগে যুগে। বস্তুত, পাড়ার দুর্গাপুজোয় যে চাঁদা না তুলেছে আর ক্লাবঘরে মাইক না বাজিয়েছে, তার মনুষ্যজন্ম বৃথা।

সিনেমার কথাও না বললে নয়। এক দশক আগেও পুজোয় সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় না কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় কে হিট ছবি দেবেন, সেই নিয়ে হরেক স্পেকুলেশন করেছি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যুগে এই ঐতিহ্যটি ভুললে চলবে না। পুজোর সময়েই রিলিজ় করত ‘শঙ্খবেলা’ থেকে ‘চৌরঙ্গী’। ‘অপরাজিত’ থেকে ‘ভুবন সোম’। অ্যাকাডেমিতে দেবশঙ্কর হালদার, কৌশিক সেনদের নাটক এবং একাধিক কল শো। জীবনের কোনও ওঠাপড়াই পুজোর চার দিন গায়ে লাগে না।

এ বারেও লাগবে না। সে মাস্ক পরে, সোশাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে নিজেকে বাঁচিয়ে বাড়ির বাইরে পা দিই বা না-দিই। এত স্মৃতি, এত ইতিহাস, এত আনন্দ, নাগরদোলার এত ওঠানামা, সব কি আণুবীক্ষণিক এক জীবাণুর ভয়ে বৃথা যাবে? মা আসছেন, এই আনন্দটুকুই তো সব। সেই আনন্দের বশে প্রথম তারুণ্যে বান্ধবীর হাত ধরে ঠাকুর দেখা বা উত্তরযৌবনে বসে বসে স্মৃতি হাতড়ে কপি লেখা, যা-ই হোক না কেন, তফাত ঘটে না!

ফার্স্ট ইয়ারের সেই মেয়েটা? সে তো জীবনানন্দ কবেই লিখে গিয়েছেন, এই সব নারীদের অপর পুরুষেরা নিয়ে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2020 festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy