প্রকাশক: গোপালদাস মজুমদার।
এখন বিধান সরণি, তখন কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। আজ থেকে ৯৭ বছর আগে ৬১ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের একটা ছোট্ট ঘরের সামনে নিতান্ত সাধারণ এক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিলেন বছর বত্রিশের এক যুবক। নাম গোপালদাস মজুমদার। প্রকাশনা-ব্যবসায় নামছেন, সঙ্গী বন্ধু বিধুভূষণ দে। পুঁজি মাত্র ৩০০ টাকা। সংস্থার নাম দিলেন ‘ডি এম লাইব্রেরী’। আজ শুনলে অবাক লাগবে, বন্ধু বিধুভূষণ দে আর নিজের পদবি মিলিয়ে সংস্থার নাম হল ‘দে মজুমদার’, সংক্ষেপে ডি এম লাইব্রেরি। বিধুভূষণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শুরু ১৯২১ নাগাদ, ‘বিজলী’ পত্রিকার দপ্তরে। হিন্দুস্থান ইনশিয়োরেন্সের চাকরি যাওয়ার পর তিনি তখন বেকার। মেজদা, বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র মজুমদার তাঁকে নিয়ে গেলেন বিজলী পত্রিকা দপ্তরে। শ্রীঅরবিন্দের বোন সরোজিনী দেবী তখন কর্মী নিয়োগের বিষয়টি দেখতেন। তাঁর সুপারিশে বিজলী-র সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ জুটে গেল গোপালদাসের। বেতন ২৫ টাকা। বিধুভূষণ তখন ম্যানেজার। বন্ধুত্বের সেই সূচনা। বছর দেড়েকের মাথায় তাঁদের যৌথ চেষ্টায় ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশ পেল বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের লেখা বই ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’, শচীন সেনগুপ্তের ‘চিঠি’, বারীন্দ্রের ‘মুক্তির দিশা’, নলিনী গুপ্তের ‘স্বরাজ গঠনের ধারা’ আর সুরেশ চক্রবর্তীর একটি কবিতার বই। ‘বিজলী’র কাজও চলছিল। কিন্তু পুরোপুরি প্রকাশনায় নামার ইচ্ছে তখন চেপে বসেছে তাঁর মনে। অতএব ঝুলিয়ে দিলেন সেই সাইনবোর্ড।
শুরুতেই বিপর্যয়। ব্যবসার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিধুভূষণ ত্যাগ করলেন সম্পর্ক। গোপালদাস স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমার শুরু কিন্তু আমার পার্টনারের সঙ্গে বিচ্ছেদ। দোকান চলবে কিনা, ধারদেনাগ্রস্থ হয়ে পড়বো কিনা— এই সব নানাকথা ভেবেচিন্তে আমার পরম সুহৃদ সহকর্মী বিধুভূষণ দে ডি এম লাইব্রেরীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে কাগজে এক বিজ্ঞপ্তি দিলেন… কিন্তু আমি দমলাম না।’ বন্ধুবিচ্ছেদ হল, বিজলী-র চাকরিও গেল। দৈন্যদশা তখন। দোকানের সামনে ফুটপাতে টুলের ওপর বসে কার্যত মাছি তাড়ানো। কিন্তু ব্যবসার নেশা ছাড়ল না তাঁকে। বদলালেন না সংস্থার নামও। বিজলী-র অফিসে তাঁর আলাপ হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। আলাপ ক্রমে গড়াল গভীর বন্ধুতায়। এক দিন নজরুল এসে বললেন, ‘‘গোপালদা, আমার বই ছাপবে?’’ নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’ তখন বিপুল জনপ্রিয়। প্রকাশকের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি ওই দুটি বই তুলে নিয়ে ছাপতে দিলেন গোপালবাবুকে। সঙ্গে ‘বিষের বাঁশী’। হাতে চাঁদ পেলেন যেন গোপালদাস। ছাপলেন পরম যত্নে। কিন্তু ‘বিষের বাঁশী’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করল। প্রকাশক গ্রেফতার হলেন। দোকানের সব বই খোয়া গেল। এক রাত্তির হাজতবাস। তবু আখেরে লাভ হল তাঁর। ‘শাপে বর হল, দপ্তরিখানায় কিছু বিষের বাঁশী বাঁধাবার জন্যে পড়েছিল। পুলিশ তার সন্ধান পায়নি। ঝড়ের হাওয়ায় গোপন রক্ষিত সেই বই সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে গেল।’—‘স্মরণ–বরণ’ নামে স্মৃতিকথায় লিখেছেন গোপাল দাস। লক্ষ্মীলাভের এই শুরু।
ডি এম তখন অতি সামান্য এক প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মতো লেখকের বই প্রকাশ করা তার কাছে স্বপ্ন। কিন্তু সে পেল নজরুলকে। নজরুলের কবিতা, গদ্য, গান, স্বরলিপি— সবই ছাপলেন গোপালদাস। বইপাড়ায় সে সময়ে তুমুল চাহিদা শরৎচন্দ্র আর নজরুলের। নজরুলের আনুকূল্যে জেগে উঠল এই বাঙালি বিপ্লবীবান্ধব প্রতিষ্ঠান। বিদ্রোহী কবি ভরসা দিলেন গোপালদাসকে, বন্ধুতার বন্ধনও— ‘তুমি আমার বই ছাপার ভার নাও। আমি তোমাকে আমার সব বই দেব।’ কেমন বিক্রি হত সে বই? গোপালদাস লিখেছেন, ‘তখনকার দিনে বাইশশো করে ছাপা বই এক বছরের মধ্যে ফোর্থ এডিশন হওয়া দুঃস্বপ্নের কথা। নজরুলের ‘বুলবুল’ কিন্তু তাই হয়েছিল। দাম পাঁচ সিকা। পাঁচ সিকা থেকে কত সিকে যে লাভবান হয়েছি তা ঈশ্বরের অনুগ্রহ, নজরুলের বন্ধুপ্রীতি এবং আমার সৌভাগ্যের নিদর্শন।’
ডি এম লাইব্রেরি, এখন যেমন। ছবি সৌজন্য: আশিস গোপাল মজুমদার
গোপালদাস জন্মেছিলেন ১২৯৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে, যশোর জেলার বাগডাঙ্গায়। ৯১ বছর বয়সে বাংলা ১৩৮৭ সালে যখন প্রয়াত হচ্ছেন, বাংলা প্রকাশনার জগতে তখন তিনি ইতিহাস। তত দিনে ৬১ নম্বর ঠিকানা থেকে ডি এম লাইব্রেরি চলে এসেছে ৪২ নম্বর বাড়িতে। মেজদা, বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্রের হাত ধরে বিপ্লবী দলে নাম লিখিয়েছিলেন কৈশোরে। মেজদাই শিখিয়েছিলেন রিভলভার চালানো। বিপ্লবীর জেদটা বুকের মধ্যে জিইয়ে রেখেছিলেন গোপালদাস। শ্রম আর নিষ্ঠায় এ বার তা উজাড় করে দিলেন প্রকাশনায়। একেও দেশসেবা ভাবতেন।
নতুন লেখকদের আশ্রয় ছিলেন তিনি। নজরুল তখন বিখ্যাত। তাঁর বইয়ের পাশাপাশি গোপালদাসের ডি এম ছাপল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘আকস্মিক’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘বেনামী বন্দর’, শৈলজানন্দের ‘বানভাসি’, অন্নদাশঙ্করের ‘সত্যাসত্য’, বনফুল, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, মণীন্দ্রলাল বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তীর বই। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র আখ্যানপত্রেও পাওয়া যায় ডি এম লাইব্রেরির নাম। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অনেক লেখার প্রেরণা ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর একাধিক রচনার প্রথম শ্রোতা ছিলেন তিনি, এ তথ্যও মিলছে তাঁর স্মৃতিকথায়। এক স্মৃতিলেখায় রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন—‘এই অধম লেখকের যখন কোনও উপন্যাস পত্রপত্রিকায় বের হয়নি, তিনি ডেকে এনে চেক লিখে দিয়েছেন।... ‘দেওয়াল’ যখন বের করলেন তখন বিমল কর বিখ্যাত লেখক ছিলেন না। আমি তো একেবারেই অনাদৃত।’ এমন জহুরি ছিলেন গোপালদাস। আর তাঁর উদারতা? রমাপদবাবু লিখেছেন, ‘শুধু লেখকদের ক্ষেত্রেই নয়, অন্তত এক ডজন প্রেস তাঁরই টাকায় গড়ে উঠেছিল।… বেকার মানুষ কিংবা পড়ন্ত প্রেস মালিককে মোটা টাকা দিয়ে বলেছেন, চেষ্টা কর। কেউ দাঁড়িয়েছে, কেউ দাঁড়ায়নি। তিনি তাঁকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়েছেন, তাঁর প্রকাশনার কাজ করেই টাকা শোধ করতে বলেছেন।’ বিমল করের কথায়, ‘শুধু ব্যবসা মানুষকে বাঁচায় না, গোপালদা ব্যবসা করতেন ঠিকই— কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা তিনি বিচিত্রভাবে একটা সম্পর্কও গড়ে তুলতেন তাঁর লেখকদের সঙ্গে।’ অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ প্রকাশ করেছিল ডি এম লাইব্রেরি। গোপালবাবু খবর পেলেন, অন্নদাশঙ্কর বিয়ে করতে রাঁচি যাচ্ছেন, অথচ হাতে টাকা নেই। শোনামাত্র প্রথম সংস্করণের রয়্যালটি তাঁর হাতে গুঁজে দিয়ে এলেন। সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’-এ লিখেছেন, ‘কল্লোল পত্রিকার মাহাত্ম্যের এক ব্যক্তি ভাগীদার আছেন। তিনি ডি এম লাইব্রেরীর অধ্যক্ষ গোপালদাস মজুমদার। কাজী নজরুল হইতে আরম্ভ করিয়া কল্লোল গোষ্ঠীর অধিকাংশের রচনা পুস্তকাকারে ইনিই প্রথম ছাপাইয়াছিলেন। তাহা না হইলে ইহাদের মধ্যে অনেককেই হয়ত তৎক্ষণাৎ সাহিত্যক্ষেত্র হইতে বিদায় লইতে হইত।’
প্রকাশনা জগতে এমন বিরল ধারা তৈরি করেছিলেন গোপালদাস। আজও যা রক্ষায় ব্রতী গোপালবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র, ডি এম-এর বর্তমান কর্ণধার আশিস গোপাল মজুমদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy