দীপিকা সিংহ রাজওয়াত
ওই যে মেয়েটা শুয়ে আছে উপুড় হয়ে, পরনে ঘন বেগুনি রঙের সালোয়ার কামিজ, পায়ে জুতোও আছে। নিশ্চল, সব ডাকের ও পারে... ফুটফুটে সে মেয়ে... মানে, ফুটফুটে ছিল, কিন্তু এখন আর তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না!
তার নীচের ঠোঁটটা কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে কেউ... আর মাথাটা পাথর দিয়ে থ্যাঁতলানো, যাতে চেনা না যায়, যাতে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত হয়, যাতে এই ঘটনার নির্মমতা সম্পর্কে সাধারণের মনে কোনও ধন্দ না থাকে।
মেয়েটার বয়স আট। এই বয়সের মেয়ে তো আমার-আপনার বাড়িতে খেলা করে, স্কুলে যায়, বায়না করে চকোলেটের জন্য, অথবা বাবা-মায়ের মোবাইলে ছবি দেখতে বা তুলতে ভালবাসে, তার বন্ধুরা তাকে বিকেলবেলায় খেলার জন্য ডাকে...
কিন্তু এই মেয়ে, তার খেলার অত সময় থাকত না। সে ঘোড়া চরাতে জঙ্গলে যেত। গ্রামের পথে ঘুরত। তার পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র। জম্মু জেলার কাঠুয়ায় থাকত তারা। জম্মু শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে এই কাঠুয়া। সে মেয়ে এক দিন নিখোঁজ হয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি চলল জঙ্গলে-রাস্তায়-চেনা পরিচিতদের বাড়ি। পুলিশেও যাওয়া হল। অবশেষে দিন সাতেক পরে সে মেয়েকে উদ্ধার করা গেল জঙ্গল থেকে। ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮। উদ্ধারই বটে! গণধর্ষণ করে আট বছরের সেই বালিকাকে মাথা থেঁতলে খুন করা হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ তদন্ত শুরু করল। জানাল, মেয়েটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে একটি ধর্মস্থানে আটকে রেখে রোজ নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছে। পুলিশ আট জন অভিযুক্তকে ধরল। তাদের মধ্যে দুজন আবার বিশেষ পুলিশ অফিসার! প্রায় পাঁচশো পাতার চার্জশিটও পেশ করল আদালতে। মামলা শুরু হল দায়রা আদালতে।
তত দিনে ঘটনার ভয়াবহতা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে আবার এই কাঠুয়া! এই আদালতেই আর এক চরিত্র আমাদের বিবেকবোধকে আরও এক বার ঝাঁকিয়ে দিল।
কালো ফ্রেমের চশমা, চুলটা পিছন দিকে টানটান করে বাঁধা, গায়ে কালো কোট, সঙ্গে সাদা ওড়না। চোখের দৃষ্টিতে প্রশান্তি মাখা, কিন্তু তার মধ্যে থেকে দৃঢ়তা ঠিকরে বেরোচ্ছে। দীপিকা সিংহ রাজওয়াত। জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টের আইনজীবী। বরাবরই একটু অন্য রকম। স্রোতে গা ভাসানো চরিত্র নয়।
সেই দীপিকা গুজ্জর-বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের ওই শিশুর পরিবারের হয়ে দাঁড়ালেন। সেই মেয়ের উপর নৃশংস অত্যাচার ও তাকে খুনের সুবিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হলেন তিনি। গন্ডগোলটা শুরু হল তার পরেই। জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন এ বার তাঁর বিরোধিতা শুরু করল। তাদের বক্তব্য, বার অ্যাসোসিয়েশনের ডাকা স্ট্রাইকের মধ্যেই তিনি কেন ওই বালিকার পরিবারের হয়ে কোর্টে দাঁড়িয়েছেন? যুক্তিবাদী দীপিকা সওয়াল করলেন, তিনি যা কিছু করছেন তা এই মামলায় সুবিচারের স্বার্থে। জম্মু এখন জ্বলছে। তিনি সেই আগুন কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে চান। আর তা ছাড়া, তিনি কার হয়ে দাঁড়াবেন, সেটা তো সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরে নির্ভর করছে!
দীপিকা যুক্তিবাদী। পেশার কারণে তাঁকে যুক্তিবাদী হতেই হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু, তাঁর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে যাঁরা তাঁর দিকে আঙুল তুলছেন, সমস্বরে প্রশ্ন তুলছেন, কেন তিনি একটি বাকারওয়াল মুসলিম পরিবারের হয়ে এই মামলায় দাঁড়ালেন? যেখানে এই ঘটনায় যারা অভিযুক্ত, তারা সকলেই হিন্দু? দীপিকা কি বুঝতে পারছেন না যে এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত?
তাঁর দিকে শাসানির আঙুল তোলা লোকগুলিও কিন্তু আইনজীবী। একই পেশার কারণে তাঁদেরও যুক্তিবাদী হওয়ারই কথা। তবে তাঁরা তা হননি। হুমকিও থামেনি। দীপিকা অভিযোগ করছেন, এক জন আইনজীবী ফেসবুকে তাঁর উদ্দেশে লিখেছেন, তাঁকে ক্ষমা করা হবে না।
কিন্তু দীপিকার কথা শুনলে বাকিদের চলবে কেন? তত দিনে জম্মু জ্বলতে আরম্ভ করেছে। কাঠুয়ার ঘটনার তদন্তে পুলিশের যে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করা হয়েছিল, আইনজীবীরা সেই দলকে পর্যন্ত আদালতে চার্জশিট পেশ করতে বাধা দেন। জম্মু বন্ধ ডেকে, রাস্তায় শুয়ে পড়ে আন্দোলন চালান আইনজীবীদের একটি অংশ। ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’-র নেতৃত্বে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। দীপিকা যে আসলে দেশদ্রোহী, তিনি যে আসলে জঙ্গিদের হয়েই লড়তে নেমেছেন, প্রচার করা হয় তা-ও।
দীপিকা নিজে কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের। তা সত্ত্বেও কেন তিনি বাকারওয়াল মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি পরিবারের হয়ে দাঁড়ালেন, প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তা নিয়েও। প্রচারের এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ তোলা হয়, দীপিকা দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) গিয়ে কাঠুয়ার মেয়েটির নাম করে, তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নাম করে প্রচুর টাকা তুলেছেন। তিনি যে আইনি লড়াই লড়ছেন তার পারিশ্রমিকও নাকি এই টাকা থেকেই নেওয়া হচ্ছে। টিভি চ্যানেলে এই নিয়ে সাক্ষাৎকারও সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু দীপিকা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, তিনি জেএনইউ-তে যাননি, কোনও রকম টাকাও তোলেননি। দীপিকা জানিয়েছেন, তিনি ও তাঁর লিগাল টিম কোনও টাকাপয়সা নিচ্ছেন না।
মজার কথা হল, অনেক আইনজীবীই অনেক মামলায় পারিশ্রমিক নেন না। অনেক জনস্বার্থ মামলা বা সামাজিক আলোড়ন ওঠা মামলায় অনেক কৌঁসুলিই পারিশ্রমিক নেননি। এটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর উপর। আর এ ক্ষেত্রে? যাঁরা এই পারিশ্রমিক নেওয়ার কথা প্রচার করছেন তাঁরাও কি জানেন না, কাঠুয়ায় ধর্ষিত ও খুন হওয়া মেয়েটির হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এই পারিশ্রমিক দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই নেই! পরিবারটি তো এমনিতেই ভয়ে, হুমকিতে, সামাজিক নানা টানাপড়েনে এক্কেবারে গুটিয়ে রয়েছে।
এমনিতেই জম্মু ও শ্রীনগরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্পষ্ট। এই ঘটনায় সেই বিভাজন গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এতটাই সে বিভাজন যে এই বালিকাকে তার বাড়ির পাশে কবর পর্যন্ত দিতে দেওয়া হয়নি। বাড়ি থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে এক আত্মীয়ের জমিতে তাকে কবর দিতে হয়। কোন লজ্জায় কোন ধরণী দ্বিধা হয়?
আর তারই মাঝে যেন বিবেকের মতো দাঁড়িয়ে আছেন দীপিকা। তাঁরও বাড়িতে তাঁর ছোট্ট মেয়ে। সেই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েও তিনি এই নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচার চান। শঙ্কিত দীপিকার আর্জি মেনে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য কাঠুয়া থেকে এই মামলা সরিয়ে পঞ্জাবের পঠানকোট কোর্টে পাঠিয়েছে। এই ঘটনার সিবিআই তদন্ত চেয়ে হিন্দু একতা মঞ্চ ও জম্মুর আইনজীবীদের দাবিও নাকচ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
শুধু তো এই মামলাই নয়, কাঠুয়াতেই নাবালিকা ধর্ষণের আর একটি মামলাতেও সেই নাবালিকার হয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন দীপিকা। এই নাবালিকার বয়স যখন ১২, তখন সে ধর্ষিত হয়। এখন সে ১৪। ইতিমধ্যেই সে জন্ম দিয়েছে এক সন্তানের, যার শারীরিক অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। সে মেয়েও জঙ্গল থেকে বাড়ি ফিরছিল।
কাঠুয়ায় এত জঙ্গল! আর খাস শহরে? জম্মুতে? দীপিকার নিজেরও আশঙ্কা, তিনি খুন হয়ে যেতে পারেন। তাঁকেও ধর্ষণ করা হতে পারে!
কেন? একটি মেয়ে আইনের পথে থেকে, একটা জঘন্য অপরাধের সুবিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, সে জন্য? অভিযুক্তদের ধর্মীয় তকমা পরিয়ে তাদের বাঁচানোর চেষ্টার প্রতিবাদ করেছেন বলে তাঁকে সামাজিক ভাবে বয়কটের চেষ্টা করা হবে? তিনি তো দীর্ঘ কাল শিশু ও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত, ধর্মের প্রলেপ সে কথাও ভুলিয়ে দেবে?
দীপিকা বলছেন, এই ধর্ষক ও খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াইটা তাঁরা চালিয়ে যেতে চান। তিনি চান না আরও কোনও নাবালিকা ধর্ষিত ও খুন হয়ে যাক।
কালো ফ্রেমের চশমা, চুলটা পিছন দিকে টানটান করে বাঁধা, গায়ে কালো কোট, সঙ্গে সাদা ওড়না। দীপিকা হেঁটে যাচ্ছেন একা...কাঠুয়ার জঙ্গলের পথে... নাগরিক জঙ্গলের পথে... সে পথের দু’ধারে আরও অজস্র ছোট ছোট হাত সাহায্য চাইছে তাঁর... ছোট ছোট ক্ষতবিক্ষত ঠোঁট-শরীর-ছোট ছোট মাংসের তাল কেঁদে উঠছে তাঁকে দেখে...
বেঁচে তো থাকতেই হবে দীপিকা সিংহ রাজওয়াতকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy