ছবি: রৌদ্র মিত্র।
এই কলকাতা ১৯৪০-এর। মেডিক্যাল কলেজের উঁচু ক্লাসের ছাত্র দিলীপ একটু শান্তিতে পড়াশোনা করবে বলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে শহরের বাইরে টালিগঞ্জে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, আশপাশে বাড়িঘর তেমন নেই, শুধু উপরের তলায় থাকেন ভৈরববাবু। একলা মানুষ, লোকের সঙ্গে খুব একটা মেশেন না, কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। তাঁরই সঙ্গে সামান্য কথাবার্তার সূত্রে দিলীপ জেনেছে, প্রাচীন মিশরের লোকজন নাকি মড়া জ্যান্ত করার কৌশল জানত। তার ডাক্তারি বোধবুদ্ধিতে সে সব অলৌকিক তেমন পোষায়নি, তবে ভৈরববাবুর একবগ্গা বিশ্বাস দেখে সে আর কথা বাড়ায়নি। যা হোক, ভালমন্দ মিশিয়ে দিলীপের দিনগুলো কাটছিল বেশ, কিন্তু হঠাৎ করেই কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল এক অজানা আততায়ীর গল্প। লোক মরছে ক্রমাগত, যদিও তাতে বিশেষ অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ শহরের পথেঘাটে মানুষের মৃতদেহ তো আজকাল হামেশাই চোখে পড়ে। অনাহারে গ্রাম থেকে শহরে এসে ভিড় জমানো মানুষগুলো জীর্ণ বিকারগ্রস্ত শরীর নিয়ে রাস্তায় ভিড় করে বসে থাকে। বোঝাই যায় না কে বেঁচে আছে আর কে মৃত। এ সব তো কবেই চোখ-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই বারে বাদ সেধেছে হত্যাকারী। দু’-চার জন যারা হত্যার সাক্ষী দিয়েছে, বলেছে, হত্যাকারী নাকি সাধারণ মানুষ নয়, প্রায় সাত-আট ফুট লম্বা, গায়ে ব্যান্ডেজের মতো সাদা কী যেন একটা জড়ানো, আর তার চোখগুলো নাকি বীভৎস। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে নির্বিবাদী দিলীপও মাথা ঘামাতে বাধ্য হয় এবং হতবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে হত্যাকারী আর কেউ নয়, তারই সহ-আবাসিক ভৈরবের ঘরে সাজিয়ে রাখা কাঠের কফিন-বন্দি মিশরীয় মমিটি।
সমালোচকেরা এই কথাটা প্রায়ই বলে থাকেন যে, হেমেন রায়ের গল্পে সমাজচিহ্ন খুঁজতে যাওয়া অবান্তর। তাঁর গল্পের ভূত-ভ্যাম্পায়ার-পিশাচ অর্থাৎ ভয়াবহতার যে কোনও রূপকল্পই নিছক বিলিতি কল্পনা-অনুসারী। এই যেমন উপরের ‘মড়ার মৃত্যু’ গল্পটি একেবারেই কোনান ডয়েলের বাংলা অপভ্রংশ। বাঙালি পাঠকের সুবিধার্থে স্থান-কাল-পাত্রের বদল ঘটিয়েছেন লেখক, গল্পের রূপক নির্বাচন বা নির্মাণে নিজস্বতা আনেননি। এমনকি বিদেশি ভূতের কফিন-প্রীতির বিষয়টিও বেবাক মিশিয়ে দিয়েছেন বাঙালি ভূতের চারণ-সীমায়। কোথায় বিশালগড়ের রহস্যময় রাজপ্রসাদ, তার চার পাশে ভূতুড়ে নীল আলো জ্বলে। সেখানকার রাজা রুদ্রনারায়ণের আয়নায় ছায়া পড়ে না। সম্পত্তির সলিসিটর নিরীহ বিনয়বাবু দেখেন, সন্ধে হতে না হতেই রাজা মাটি ছেড়ে দেওয়াল বেয়ে উঠে অন্ধকারে মিলিয়ে যান। দুর্গের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই খুঁজে পান রাজাবাহাদুরের শুকিয়ে যাওয়া মৃতদেহ কফিনবন্দি, প্রাচীনত্বের ভারে কালো, অস্থিসর্বস্ব, কিন্তু ঠোঁটের কোণে তখনও লেগে আছে দু’ফোঁটা তাজা রক্ত। এই রুদ্রনারায়ণ কি নিছকই ট্রানসিলভানিয়ার সেই বুড়ো কাউন্টের বাঙালি প্রতিচ্ছবি নয়? তার পর ধরুন, মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী! শহরতলির শিক্ষিত সমাজের সদস্যা কুমুদিনী রাত্রি হলেই খিদে মেটাতে বেরিয়ে পড়েন শহরের আনাচেকানাচে। শহর জুড়ে জাগে অ্যানিমিয়া মহামারি, তাও কুমুদিনীর ভয়ঙ্কর খিদে মেটে না। খোলা চুল-সাদা শাড়িতে বাঙালির কুমুদিনী কি বিলিতি ‘মিসেস অ্যামওয়ার্থ’-এর অনুকরণ নয়? সোজা চোখে দেখলে তা-ই মনে হয় বটে, কিন্তু একটু ভাল করে খতিয়ে দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ এমন তীব্র ভয়াবহতা নির্মাণই বা কেন করলেন লেখক? এবং এই বিকৃত রূপকল্প তৈরির পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে একটা নির্দিষ্ট জায়গা বা সময়কেই বা বেছে নিলেন কেন?
ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। হেমেন রায়ের লেখায় এই সব মৃতদেহ, বিকৃতি, অতৃপ্ত ক্ষুধা— এই ধরনের রূপকগুলো মূলত দেখা যায় তিরিশের দশকের শেষ থেকে শুরু করে চল্লিশের দশক জুড়ে। তাঁর বিশের দশকের লেখাগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্যটা আরও স্পষ্ট হয়। বিশের দশকের মাঝামাঝি লেখক যখন বিমল-কুমারের বাংলা-কাঁপানো অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখছেন, ডানপিটে দুই বাঙালি যুবককে গুপ্তধনের ম্যাপ হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন খাসিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে, যেখানে প্রাচীন সব যক্ষ আগলে রয়েছে সাত রাজার গুপ্তধন, অথবা কাফির দেশের বৌদ্ধ গুহায় অজানা আতঙ্কেরা জেগে উঠছে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে— সেখানেও তো ভয়ের উপকরণের অভাব রাখেননি লেখক। একে তো বাঙালির ছেলে বন্দুক হাতে ভিন্দেশে পাড়ি দিচ্ছে, এই অনুভূতিটাই তখন যথেষ্ট শিরশিরে। তার পর যখ, গুপ্তধন, মড়ার মাথার ম্যাপ এ সবও আছে জমজমাট অনুপান হিসেবে! কিন্তু তা বলে বিকৃত মৃতদেহ বা জান্তব ক্ষুধার রূপক তো কোথাও রাখেননি। বরং তখনকার গল্পগুলো পরতে-পরতে এনে দেয় বাঙালিয়ানার সুতীব্র অনুভূতি আর পৌরুষ-যৌবনের আবেদনে ভরপুর মন ভাল করে দেওয়া একটা রেশ। এই অনুভূতি অবশ্য তখনকার অনেক বাংলা গল্প-উপন্যাসেই স্পষ্ট। সমাজ গড়ার স্বপ্নে বাঙালি-দেহ আর বিপদে-ঝাঁপ-দেওয়ার রূপকের মধ্যে সাহিত্যিকরা হামেশাই গাঁটছড়া বেঁধেছেন সে সময়ে। এবং সেই সব যৌবন আকাঙ্ক্ষা-স্ফুরণের ধারক হিসেবে তাঁরা কখনওই হাতের কাছের স্থানিক রূপক প্রয়োগ করেননি। হেমেন রায়ের গল্পে তাই তিরিশের দশকের শুরুতেও ঘর ছাড়ার টান প্রবল। বিমল-কুমার অ্যাডভেঞ্চারে যায় আফ্রিকায়, ল্যাটিন আমেরিকায়, রেঙ্গুনের জঙ্গলে, এমনকি মঙ্গল গ্রহেও। তা হলে হঠাৎ তিরিশের দশকের শেষে ভয়ের গল্পগুলোয় এমন উল্টো বিন্যাস করলেন কেন লেখক? লক্ষণীয়, এই গল্পগুলোয় লেখক কলকাতার বাইরে বিশেষ বেরোননি, বড়জোর এগিয়েছেন শহরতলি অবধি, যেখানে ট্রেনে পৌঁছতে সময় লাগে কমবেশি দু’-তিন ঘণ্টা। অর্থাৎ চেনা শহরের চৌহদ্দিতেই তিনি ছকেছেন মাত্রাহীন বীভৎসতা আর ভয়ের আবহ।
কলকাতা শহর, শহরের অমানুষী বিকৃতি আর তার আবর্তে তৈরি হওয়া কিছু অদ্ভুত শরীরী-মৃতের রূপকই তাঁর এই সময়ের গল্পের প্রধান উপজীব্য। অবশ্যই খেয়াল করতে হবে, এরা কিন্তু বাংলার আবহমান কাল ধরে প্রচলিত ভূত-প্রেত-ব্রহ্মদত্যি নয়, খাস কলকাতার আদি ঔপনিবেশিক সাহেবসুবো-কেন্দ্রিক নস্ট্যালজিয়ার অংশও নয়, এমনকি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির হালফ্যাশনের পরলোক-চর্চার শরিকও নয়। এরা হল কতগুলো বিকৃত মৃতদেহ, যাদের মৃত্যু আছে অথচ শেষ নেই। মৃত্যুর পরেও তাদের অতৃপ্তি আর খিদে বেঁচে থাকে, জীবিত স্বাভাবিক মানুষের মনে আতঙ্ক বুনে দেওয়ার জন্য। ‘ওলাইতলার বাগানবাড়ি’-র জমিদার কৃতান্তবাবুর কথাই ধরা যাক। কলকাতা থেকে মাইল দুই-তিন দূরে ওলাইতলা এস্টেটের ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিতে প্রতি শনিবার একটি করে নতুন লোক আসে। প্রত্যেকেই আসে সন্ধে ছ’টার ট্রেনে, স্টেশন মাস্টারের কাছে ঠিকানা জেনে নিয়ে রাজবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়, কিন্তু কেউই আর ফিরে আসে না। গল্পের বুনোটেই বেশ একটা গা-ছমছমে ভাব আছে বটে, কিন্তু কিছু দূর এগোলে বোঝা যায় এই অনুভূতির উৎস প্রথাগত অশরীরীদের উদ্যাপন নয়, শরীরী বিকৃতির সীমাহীনতা। জমিদার কৃতান্তবাবু দিব্যি লোক, নতুন ম্যানেজারকে কাজ বুঝিয়ে দেন, কিন্তু তাঁর চোখের চাউনিতে একটা জান্তব ক্ষুধা মিশে থাকে। তার পর রাত্রি আসতে না আসতেই শুরু হয় মৃত রাজার পাশবিক প্রবৃত্তিযাপন। অমাবস্যার রাত, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, আর তারই মধ্যে হ্যাজাকের আলোয় নতুন ম্যানেজার খুঁজে পায় পচাগলা অসংখ্য দেহ— বিশুষ্ক, রক্তহীন, পাণ্ডুর— আর তাদের গলায় বিশাল বিশাল গর্ত। কেউ যেন তাদের প্রাণগুলো ওই গর্ত দিয়েই বার করে নিয়েছে।
বিকৃতির বর্ণনায় খোদ কলকাতা শহরের উপস্থাপনাও রয়েছে বিস্তর। নিশ্চুপ রাতে কোথাও প্রাণের সাড়া নেই, চার দিকে কুয়াশা আর কুয়াশা, আর তারই মধ্যে শহর জুড়ে ছুটে চলেছে একখানা বাস। লেখক বলেছেন, চার দিকে খালি অন্ধকার, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো দানবাকৃতি গাছ— তারা যেন এই মৃত শহরের আবহ-নিয়ামক। আর বাসের দরজায় দাঁড়ানো কন্ডাক্টর ঠান্ডা গলায় ডাকছে, ‘ভবানীপুর, ওয়েলিংটন, ধর্মতলা...’। তার চোখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু বাতাসে ভেসে আসছে মৃত্যুর হিম-হিম গন্ধ। এ কোন শহর চেনালেন লেখক? এ-ই কি কলকাতা? যে শহর এত দিন পশ্চিমি আধুনিকতা আর সংস্কার-আন্দোলনজাত ঝকঝকে বিজ্ঞান-চেতনার সদর্থক ব্যঞ্জনা দিত, সেই শহরই হঠাৎ তাঁর গল্পে এত ভয়াবহ হয়ে উঠল কী করে? কেন লেখক বার বার সেই শহরে ফিরিয়ে আনলেন শরীরী মৃত্যু আর অশরীরী মৃত্যুহীনতার অনুষঙ্গ?
এর উত্তর খুঁজতে একটু বরং সেই সময়টার খোঁজখবর নেওয়া যাক। যে ক্ষয়, মৃত্যু আর সংবেদনহীনতার রূপক হিসেবে লেখক তাঁর শরীরী-মৃত চরিত্রদের জাগিয়ে তুলেছেন চল্লিশের দশকে, তার উৎস সম্ভবত তিরিশ-চল্লিশের দশকের সমাজ-ইতিহাসেই বিদ্যমান। তিরিশের দশকে কলকাতার ক্ষত অনেক। খরা, খাদ্যাভাব, অর্থনৈতিক মন্দা, সশস্ত্র বিপ্লবের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতায় তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনাগোনা। চল্লিশের দশকে আবার তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরে জাগছে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ— জাপানি বোমার ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মানুষগুলো প্রতি মুহূর্তে নতুন করে চিনছে মৃত্যুযন্ত্রণার স্বরূপ, তারই পাশাপাশি দেখছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাপানউতোর, মরছে দাঙ্গায়, অনুভব করছে জীবনের বিকৃতি আর স্বপ্নভঙ্গ, কেমন করে নির্দয় হাতে নিংড়ে ফেলে মনুষ্যত্ববোধ। হয়তো এ সবই লেখকের নগর-আলেখ্যয় বীভৎস রূপ পেয়েছে। হ্যাঁ, খগেন্দ্রনাথ মিত্র অবশ্য এক বার বলেছিলেন হেমেন রায় নাকি লেখায় রাজনীতির আঁচড় পড়তে দিতেন না। কিন্তু শরীরী-মৃতের এই বিকৃত রূপকল্প নির্মাণে কি সমকালীন সমাজ-রাজনীতির দায় পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব? এই যে আগ্রাসী ক্ষুধা, তার জন্মও তো এই সমাজেরই জঠরে। তান্ত্রিক ভৈরবের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে? ছোট্ট শহরে তান্ত্রিক ভৈরবের হঠাৎ মৃত্যু একটা দোলাচল জাগায় কারণ তার মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ক্রমাগত মারা পড়তে থাকে লোকজন। রাত্তিরে বেরোনোর জো নেই, কোথায় মৃত্যু ওত পেতে বসে কে জানে! তাও বেরোতে হয় ডাক্তারকে। ফেরার পথে টর্চের আলোয় তিনি হারানো ভৈরবের খোঁজ পান। সে আর জীবিত নয়। ডেথ সার্টিফিকেট তো তিনি নিজেই লিখেছিলেন সপ্তাহ-দুই আগে, তবে ভৈরব মৃতও নয় পুরোপুরি। তার চোখে খিদে, দুই কষ বেয়ে ঝরে পড়ছে রক্ত, গলায় অবিশ্বাস্য ক্রূরতা। নির্বাক ডাক্তার শোনেন ভৈরব বলছে, “বুঝলে ডাক্তার, দারুণ ক্ষুধা আমার, মাংস চাই, হাড় চাই, রক্ত চাই...”
ভৈরবের এই খিদেও কি চল্লিশের সমাজেরই তৈরি নয়? তখনকার মন্বন্তর আর খাদ্যাভাবের আলোচনায় এ ছবি তো আকছার চোখে পড়ে যে, বুভুক্ষু মানুষগুলোকে গাড়িতে ঠেসে ভরে শহরের বাইরে কোনও ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে সরকার। প্রচণ্ড খিদে নিয়ে সেখানেই শুকিয়ে মরছে তারা, তার পরে তাদের ফেলে রাখা হচ্ছে প্রকাশ্য রাস্তায়। তথ্য বলে, শুধু ’৪৩-৪৪ সালেই নাকি মৃতদেহের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল চার লক্ষ। শহরের রাজপথে হাঁটা যেত না, আর গ্রামে? গ্রামে নাকি পথচলতি রাস্তায় সূর্যের আলোয় শুকোত দেহগুলো— কখনও বা শেয়াল-কুকুর ছিঁড়ে খেত তাদের শীর্ণ, ক্ষুধার্ত ভেতরটা। জীবিত মানুষ হরদম সেই দৃশ্য দেখত। অবশ্য যে সমাজ সকালে জানলা খুলেই মৃতের চোখে চোখ মেলায় আর দিনশেষে শবদেহের দুর্গন্ধ আঁকড়ে ভাতের থালায় জীবন খোঁজে, তার কাছে বাড়তি দু’-দশটা মৃতদেহ কি এমন অস্বাভাবিক? খরা কি শুধু খাদ্যে আসে? খরা আসে অনুভূতিতেও। সেই খরার সমাজের চরিত্ররা যে মাত্রাহীন বিকৃত বা জৈবিক হবে— তাতে আর আশ্চর্য কী?
হেমেন রায়ের এই সব নিশাচর চরিত্ররা বোধহয় সেই সমাজব্যাপী খরার অন্ধকারেই জিইয়ে রাখে তাদের বিকৃতি। প্রকৃতিতে এরা আসলে ‘লিমিন্যাল’— এদের জীবনও নেই, মৃত্যুও নেই। সেই অ্যাকিলে মেম্বের ‘নেক্রোপলিটিক্স’-এর চরিত্রগুলোর মতো এরা জীবন আর মৃত্যুর মাঝে থমকে থাকা শুধুই দেহ— রোজ মরে, আবার বাঁচে, নিজেদের বেঁচে থাকার ক্ষত ঢাকা দিতে অন্য লোকের রক্ত চুষে খায়। তাই তাদের চিত্রায়নে যে বিষয়টা প্রাধান্য পায়, সেটা মৃত্যু নয়, মৃত্যু-উত্তর দেহ। সে দেহ স্পন্দনহীন বিকৃত, অথচ তার উপাঙ্গগুলি সচল। সেই দেহ তার অমানুষী প্রবৃত্তি মেটায় সীমাহীন ক্ষুধা আর যৌনাচারে। লেখক তাঁর ‘মানুষ পিশাচ’ গল্পে বলেন, আলিনগরের নবাব রোজ রাতে মেয়েদের চুরি করে নিয়ে যায় তার ভাঙা প্রাসাদে। যোগ্য বেগম খুঁজছে সে। আর সেই নবাবের সেপাই কারা? মন্ত্রপূত ছ’টি জীবন্ত মৃতদেহ, যারা রোজ রাতে জেগে উঠে নবাবের অভিষেক করে, অভিসারের সঙ্গিনী খুঁজে আনে। আর নবাবের সেই বিকৃতিকে রসদ জোগায় আলিনগরের রহস্যময় অন্ধকার। শোনা যায়, সিরাজউদ্দৌলা এক কালে কলকাতার নাম রেখেছিলেন আলিনগর। যদিও লেখকের গল্পের আলিনগরের ভূগোল আলাদা, তাও নামগত সাদৃশ্য চোখে পড়ে বইকি! এই শহরই যে নবাবের বিকৃত-চেতনার উৎস, তার অমানুষী কামনার ধারক, তার ক্রূরতা আর ভয়ানক প্রবৃত্তিগুলোর পরিপোষক।
সমাজের প্রেক্ষিতে সাধারণত ভূতের গল্পের একটা নস্ট্যালজিক ভূমিকা থাকে। চলতি স্থান-কাল-পাত্রের বিন্যাস বদলে অতীত আর বর্তমানের একটা অদৃশ্য সেতু বাধা হয়, ফ্রয়েডসাহেব যাকে ‘ফরট’ (বিগত) আর ‘ডা’র (পুনরাগত) ছকে দেখিয়েছেন। এখন এই সেতুপথে আপাতভাবে কিছু ভয়ের চিহ্ন থাকলেও স্মৃতি থাকে, সংবেদন থাকে, ছেড়ে আসার বেদনাবোধও থাকে। যেমন হেমেন রায়ের ‘বাদলার গল্প’-তে মুড়ি-বেগুনি সহযোগে শ্যামচন্দ্রদের বৃষ্টিযাপন আরও মিষ্টি লাগে দেশের বাড়ির গল্পে। আজন্ম কলকাতায় বড় হওয়া লেখক কালিপুরে দেশের ভিটেয় গিয়ে দেখেন সেখানে শুধুই স্কন্ধকাটা, ব্রহ্মদত্যি আর মামদোদের বাস। তারা আবার যে-সে ভূত নয়, স্বয়ং প্রপিতামহের বন্ধুবান্ধব। দশমীর চাঁদের ফুটফুটে আলোয় মানুষ-ভূতে মিলে দিব্যি আড্ডা জমে ওঠে, সেখানে স্মৃতিরোমন্থন, পরচর্চা কিছুই বাদ পড়ে না। লেখক এই গল্প লেখেন সম্ভবত তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। কিন্তু এই ক্ষুধার্ত, বিকৃত, মৃত্যু আর জীবনের মাঝামাঝি দেহগুলো তো কোনও স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসে না। কেমন করেই বা আসবে? কারণ তারা তো কখনওই পুরোপুরি শেষ হয় না। একটা ভঙ্গুর সমাজের ফুরিয়ে আসা মানব-বোধে ভর করে, আর তার বাড়তে থাকা ক্লেদাক্ত জৈবিক প্রবৃত্তিগুলোকে অস্ত্র করে তারা তো থেকেই যায় চিরকাল। স্বপ্নহীন শহরে তাদের বিকৃতিও মেটে না কোনও দিন, আর শহরের অন্ধকারের রোগও সারে না। লেখক সেই যে বলেছিলেন, ‘অন্ধকারে ভুগিতেছে কলিকাতা নগরী... আর সেই অন্ধকারে আত্মগোপন করে আছে মারাত্মক সব বিভীষিকা...।’ রাত বাড়ে, বছর গড়ায়, খরা যায়, আসে দাঙ্গা। উপনিবেশ ভাঙে, সঙ্গে ভাঙে মানুষগুলোও; ভেঙেচুরে ঝাঁঝরা হয়ে দেখে কোথায় সভ্যতা? চার দিকে শুধু খুন-জখম, রাহাজানি, অবিশ্বাস, বিকৃত কামনা— মানব আর দানব শব্দ দুটো যেন এক রকম হয়ে যায়। তাদের দ্বৈরথে আরও স্পষ্ট করে ফুটে ওঠে অন্ধকারের সীমারেখা— তা সে রাজনীতিতেই হোক বা মানুষের মনে।
হেমেন্দ্রকুমার রায় ১৯৪৮-৪৯ সালে লিখেছিলেন ‘মোহনপুরের শ্মশান’। মোহনপুরের মৃত মহারাজা আসঙ্গ-বাসনায় বিয়ে করেন কিশোরী লীলাকে। লীলা আর ফিরে আসেনি, শুধু বছর কুড়ি পরে মোহনপুরে ফিরে গিয়ে আনন্দ তাদের দেখতে পেয়েছিল। তারা মৃত, অথচ অতৃপ্ত উদগ্র কামনা তাদের প্রতি রাতে বাঁচিয়ে তোলে। নির্জন শ্মশানভূমিতে মরা চাঁদের আলোয় তারা সাজায় বাসর-শয্যা। অবাক আনন্দ দেখেছিল রাজার দুই চোখ— মৃত, নিষ্পলক অথচ শরীরী ক্ষুধায় উত্তেজিত। হয়তো এই বীভৎসতাও শহরের বিকৃতিরই প্রতীক। শহর যেখানে অন্ধকার আর নৃশংস, শ্মশানভূমির সঙ্গে তার কতটুকুই বা পার্থক্য? তাই হয়তো লেখক এই ভয়ের গল্পগুলোয় প্রথাগত যবনিকা টানেননি কখনও। বিকৃত আবহে হঠাৎই শেষ হয়ে যায় তারা... বেড়ে চলে কুয়াশা, জমে ওঠে ভয়, তীব্র হয় অপেক্ষা— অন্ধকারের পরে একটুখানি আলোর জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy