Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
বইমেলা শুধু উৎসব নয়, বইমেলা মানে বড় হয়ে ওঠার নানা ধাপের স্মৃতিকথাও! বইমেলা মানে প্রথম বই উপহার পাওয়ার স্মৃতি।
International Kolkata Book Fair

kolkata book fair 2022: স্মৃতির বইমেলা

গত দু’বছরে আমাদের মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার অনেকটা শুশ্রূষা করবে এ বারের বইমেলা!

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২২ ০৭:২৯
Share: Save:

লকাতা বইমেলা বলতেই প্রথম যে দৃশ্যটি স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, তা সেই ধূ ধূ ছেলেবেলার। ভেসে ওঠে মায়ের স্মৃতি। বইমেলা থেকে ফিরে মা বিছানার ওপর নামিয়ে রাখছে প্লাস্টিকের প্যাকেট। আর তার মধ্যে থেকে বেরোচ্ছে রংবেরঙের বই! মোটা চকচকে কাগজে ছাপা দারুণ সুন্দর সব ছবির সঙ্গে অল্প অল্প লেখা! রূপকথার গল্প! মা বলছে, “বই হল মানুষের সবচেয়ে ভাল বন্ধু!”

সেই ছোট বয়সে মেলা বলতে আমি বুঝতাম আমাদের মফস্সল শহরে পুজোর সময়ে বসা নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুলনাচ, টয় ট্রেন আর নানা খাবার দোকান দিয়ে সাজানো একটা জমায়েত! সেখানে বইমেলা ব্যাপারটা কী! সেখানেও কি সার্কাস বসে? সিংহ গর্জন করে? মরণকূপ কাঁপিয়ে মোটর সাইকেল পাক মারে গোঙাতে গোঙাতে!

মাকে জিজ্ঞেস করতাম আমি। মা সব শুনে হাসত। বলত, “সে সব কিছু হয় না। আসলে বইমেলা মানে এমন একটা জায়গা যেখানে অনেক দোকান খুলে নানা রকম বই বিক্রি করা হয়। ছোটদের বড়দের সবার জন্য দেশ বিদেশের অনেক বই থাকে সেখানে।”

মায়ের কাছে গল্প শুনে আমার বইমেলা যাওয়ার ইচ্ছে হত খুব! কিন্তু মা বলত, জায়গাটা অনেক বড়। অনেক হাঁটতে হয়। আমি যখন আর একটু বড় হব, তখন আমায় নিয়ে যাবে। আমি অবাক হতাম। বলতাম, “বড় জায়গা তো কী হয়েছে! রিকশা চড়ে তো ঘোরা যায়, না কি?” শুনে মা হাসত খুব। বলত “বইমেলায় রিকশা চড়ে ঘোরা যায় না! সেখানে রিকশা চলে না যে!”

আমি আরও অবাক হতাম! এ কেমন মেলা রে ভাই! আমাদের মফস্সলের মেলায় তো দিব্যি রিকশা চড়ে ঘোরা যায়! তা হলে এখানে যায় না কেন? না, সবটা শুনে খুব একটা সুবিধের মেলা বলে মনে হত না আমার। তাও শেষ চেষ্টা করতাম। বলতাম, “তা হলে ন-কাকার সাইকেলে করে কি ঘোরা যায়? মানে এখানকার মেলায় তো আমি সে ভাবেও ঘুরি!” মা বলত, “না তাও যায় না। এই বইমেলায় হেঁটে ঘুরতে হয়। আর সেটাতেই মজা!”

সেটাতেই মজা! কী রকম মজা? সেই মজা কি বড় না হলে পাওয়া যায় না? তাই সেই পাঁচ-ছ’বছর বয়স থেকেই বইমেলা নিয়ে আমার মনের মধ্যে একটা কৌতূহল জমা হতে শুরু করেছিল। আর তার পর ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় যখন প্রথম বইমেলা যাওয়ার সুযোগ এল, মনে হল আমিও বড় হয়ে গিয়েছি। এখন ভাবলে হাসি পায় বইমেলা যাওয়া, না-যাওয়াটা আমার কাছে ছিল বড় হয়ে ওঠার মাপকাঠি!

মনে আছে, এক দিন স্কুলে ক্লাস চলাকালীন নোটিশ এল যে, আমাদের হাইস্কুল থেকে বাসে করে বইমেলায় নিয়ে যাওয়া হবে। যারা ইচ্ছুক তারা যেন নাম দেয়। আমি বাড়িতে না জিজ্ঞেস করেই সঙ্গে সঙ্গে নাম দিয়ে দিয়েছিলাম! আসলে আমি তো সেই কবে থেকে ইচ্ছুক! যেখানে এত ইচ্ছে, সেখানে কি পারমিশনের অপেক্ষা করতে হয়!

তখন বইমেলা হত ময়দানে। মনে আছে বাস থেকে নেমে আমরা সারি বেঁধে ঢুকেছিলাম মেলায়। স্যরেরা টিকিট কেটে আমাদের এক-এক করে ঢুকিয়েছিলেন মেলার মধ্যে। তখন বইমেলায় ঢোকার জন্য টিকিট কাটতে হত।

সে বারের মেলাটার কথা আমার এখন সে ভাবে আর মনে নেই। শুধু মনে আছে কত্ত স্টল! বিশাল বড় জায়গায় গিজগিজে মানুষ! পায়ে পায়ে উড়তে থাকা সোনার গুঁড়োর মতো ধুলো! এই তা হলে বইমেলা! সামান্য হতাশ হয়েছিলাম কি! কে জানে!

এর দু’বছর পরে আবার স্কুলের সঙ্গেই গিয়েছিলাম বইমেলায়! তখন যে হেতু আর একটু বড় হয়েছি, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাপয়সাও দেওয়া হয়েছিল যাতে বই কিনতে পারি!

তত দিনে গল্পের বইয়ের সঙ্গে গভীর সখ্য তৈরি হয়ে গিয়েছে আমার! তাই বইমেলা যাওয়ার জন্যও যে একটা প্রস্তুতি লাগে, সেটা শিখে গিয়েছি। বাড়িতে ‘দেশ’ পত্রিকা নেওয়া হত। ‘দেশ’-এর বইমেলা সংখ্যা বেরোত বড় করে। আর সেই সংখ্যায় থাকত অনেক বইয়ের বিজ্ঞাপন। আমি সেই সব বিজ্ঞাপন দেখে ধরে ধরে আমার পছন্দের বইয়ের লিস্ট করতাম। পাশে লিখে রাখতাম স্টল নম্বর! তার পর মেলায় গিয়ে খুঁজে খুঁজে সেই স্টল বের করে সেখান থেকে কিনতাম বই।

সেই ময়দানি বইমেলা ছিল বিশাল বড়। তাতে স্টলও থাকত প্রচুর। মেলার এক মাথা থেকে আর এক মাথায় চক্কর কাটতেই হাঁপিয়ে যেতাম সেই বয়সে। তাও হাল ছাড়তাম না।

আমি বরাবর রাস্তা গুলিয়ে ফেলা মানুষ। তাই মেলার মাঠে মাঝে মাঝেই স্টল খুঁজে পেতাম না। মনে হত সব এক রকম লাগছে। এ কোন গোলকধাঁধায় আটকে পড়েছি রে বাবা! তবে মধুসূদন দাদা ছিল স্কুলের বন্ধুরা। তার মধ্যে অয়নাংশু, অমর্ত্য, সুদীপ্ত ছিল রাস্তা চেনায় পাখিদের মতো পারদর্শী। সেই স্টলের অলিগলির জট সহজেই ছাড়িয়ে আমায় ওরা নিয়ে যেত অভীষ্ট জায়গায়।

আমাদের, আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে যাওয়ার আগ্রহ ছিল খুব। কিন্তু সেখানে লম্বা লাইন! আমার চিরকাল ভিড় আর লাইন দেখলে ভয় করে! কেন যে করে, আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। তাই আমি ওই লাইনে দাঁড়াতে চাইতাম না। কিন্তু বন্ধুদের জোরাজুরিতে দাঁড়াতে হত। সাপের মতো সেই লাইন বেঁকে যেত দূরে। অনেকটা অপেক্ষার পর এক সময় ঢুকতে পারতাম স্টলে। আর যেটা প্রথম অনুভব করতাম, সেটা হল বইয়ের গন্ধ! নতুন বইয়ের গন্ধ! অত ভিড়ের মধ্যেও কী করে যে সেই গন্ধ পেতাম কে জানে! তবে সেই ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে এক কোণে দাঁড়িয়ে বই দেখতাম। যা যা লিস্ট করে নিয়ে যেতাম তার বাইরেও বই কিনতে ইচ্ছে হত। কিন্তু উপায় থাকত না। জীবন যে রেশনে বাঁধা!

বই পছন্দ করার পরে থাকত সবার সঙ্গে লড়াই করে ‘ও দাদা’, ‘ও কাকু’ বলে সেই বই অর্ডার করা আর তার সঙ্গে বিল করার প্রক্রিয়া। কিন্তু সেখানেও লাইন। অপেক্ষা! জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির হাল্কা ঠান্ডার মাঝেও ঘেমে-নেয়ে একশা হওয়া! তাও মনে মনে কিসের যেন একটা ভাললাগা থাকত! আনন্দ থাকত। ওই বই নিয়ে বিল করার লাইনে দাঁড়িয়ে দেখতাম কাউন্টারের অন্য দিকে, কর্মীদের দিকটা কী ফাঁকা! দেখতাম সেখানে থরে থরে বই সাজানো! মনে হত ওই দিকে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে কী মজাই না হবে! কিন্তু আমাকে
ওই দিকে কেন দাঁড়াতে দেবে? আমি কে?

আমার তৈরি করা লিস্টের বাইরের নানা স্টলেও ঢুঁ মারতাম। কমিক্সের বই কেনার আগ্রহ ছিল খুব। ছিল ফেলুদা আর শঙ্কুর বই কেনার আগ্রহও!
লীলা মজুমদারের বইও থাকত লিস্টে! সন্তু-কাকাবাবু, অর্জুন, কিকিরা এদের বইয়েও ভর্তি হত পিঠের ঝোলা!

বিদেশি ছবির বইয়ের জন্য যেতাম বিদেশি পাবলিকেশনের স্টলে। তবে সেখানে বই দেখতাম। কেনার পয়সা থাকত না। তার পর যেতাম ‘সন্দেশ’-এর স্টলে। সেখানে এক জন ‘কাকু’ বসে থাকতেন। কী নাম জানি না। শুধু মনে আছে তিনি হাসিখুশি ছিলেন খুব। আর বই কেনার পরে যে ব্রাউন খামে বই ভরে দেওয়া হত, সেই খামের এক দিকে উনি মোটা মার্কার পেন দিয়ে এঁকে দিতেন নানা কার্টুন! আমার কী যে ভাল লাগত সেটা! ‘সন্দেশ’ থেকে হয়তো তিনটে বই কিনব বলে লিস্ট করে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু সেটা এক বারে কিনতাম না। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে তিন বার আলাদা আলাদা সময়ে গিয়ে আলাদা আলাদা করে বই কিনতাম! কী? না ওই যে তিনটে প্যাকেট হবে! তাতে আলাদা আলাদা তিন বার ছবি এঁকে দেওয়া হবে!

আর এক বার আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমি ক্লাস টেন-এ পড়ি। সে বার বাবা মায়ের সঙ্গে গিয়েছি মেলায়। যথারীতি লাইন দিয়ে আমি আর মা ঢুকেছি আনন্দ পাবলিশার্স-এর স্টলে। সেখান থেকে মনে আছে এগারোটা বই কিনেছিলাম সে বার। পরে বাড়ি এসে মা সে দিনের কেনা সমস্ত বই ক্যাশমেমো দেখে মেলাবার সময় দেখেছিল যে এগারোটা বইয়ের মধ্যে দশটা বইয়ের বিল করা হয়েছে। একটা বইয়ের বিল করা হয়নি! মানে একটা বই এমনি চলে এসেছে! আজও মনে আছে বইটা ছিল সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘রুকু সুকু’। সবজেটে কভারের ওপর হাই অ্যাঙ্কল বুট আর পাইপের ছবি! দাম ছিল বাইশ টাকা!

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আগ্রহ পাল্টায়। জীবনের নির্দিষ্ট কিছু দিক আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তেমন আমার কাছেও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছিল বইমেলার আকর্ষণও। মানে ঠিক পাল্টে যায়নি, বরং বলা ভাল বইমেলাকে যে ভাবে দেখতাম সেই দেখায় যোগ হয়েছিল নতুন আনন্দের দিক!

তত দিনে আমিও টুকটাক লেখালিখি করছি। আমাদের একটা লিটল ম্যাগাজ়িন বেরোচ্ছে! বই কেনার সঙ্গে তাই তত দিনে যোগ হয়েছে লিটল ম্যাগাজ়িন কেনার আগ্রহও। আর এটাও জেনে গিয়েছি যে, বইমেলায় লিটল ম্যাগাজ়িনের জন্যও একটা জায়গা থাকে।

আর একটা ব্যাপারেও তখন মন সজাগ হয়েছে। সেটা হল বইমেলায় গেলে লেখক আর কবিদের দেখা যায়! তাঁদের সঙ্গে কথাও বলা যায়! বইমেলার আকর্ষণে এই কারণটাও তাই যোগ হয়েছিল।

মনে আছে বইমেলাতেই প্রথম কাছ থেকে দেখেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে! কৃত্তিবাস-এর মঞ্চ থেকে যে পুরস্কার দেওয়া হত, সেখানে দেখেছিলাম তাঁকে। ভিড়ের মধ্যে পিছনে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম মঞ্চের ওপর বসে আছেন উনি। পাশে শরৎ মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-সহ আরও অনেকে!

অনুষ্ঠান ভাঙার পরে মঞ্চ থেকে নামার সময় সবাই ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। আর উনি হাসি-হাসি মুখে সই দিচ্ছিলেন। আমি কাছে গিয়ে সই নেওয়ার সাহস পাইনি। কিন্তু দূর থেকেই দেখেছিলাম মানুষটিকে। মনে হচ্ছিল ইনিই ‘সেই সময়’ লিখেছেন! ‘পূর্ব পশ্চিম’ লিখেছেন! ইনিই লিখেছেন, “আমার করতল দেয় ও নেয় কিছু / জীবন কেটে যায় তাকে ভুলি না!”

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কেও দেখেছি বইমেলায়। আমি কথা বলার সাহস না পেলেও কাছ থেকে দাঁড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে বলা তাঁর কথাও শুনেছি! আমার জীবনের এঁরাই তো আসল হিরো! এঁরা কোথায় থাকেন তখন আমি জানি না। কী
করে মেলার বাইরে এঁদের সঙ্গে দেখা করা যায়, তারও ধারণা নেই! কিন্তু বইমেলাই এঁদের প্রথম কাছ থেকে দেখার সুযোগ
করে দিয়েছিল!

এই মাঠেই আলাপ হয়েছিল কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে। মনে আছে শ্রীজাত-সহ অনেকের সঙ্গে বসে কথা হচ্ছিল এক জায়গায়। সেখানে এক জন লম্বা সাদা চুলের মানুষ এসে দাঁড়ালেন কাছে। দেখলাম শ্রীজাত উঠে নিজের চেয়ার ছেড়ে দিলেন ওঁকে। জানলাম ইনি ভাস্কর চক্রবর্তী! প্রিয় কবি এত কাছে! আমি ভাবতেই পারছিলাম না। আমি আগে কোনও দিন দেখিনি তো! শুধু কবিতাই পড়েছি!

মনে আছে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় বলেছিলেন, “আপনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি!”

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘আমায়!’

উনি বলেছিলেন, “হ্যাঁ। কফি হাউসে কি?”

আমি বলেছিলাম, “আমি তো কফি হাউসে যাই না।”

“তা হলে চিড়িয়া মোড়ের কাছে!”

“কিন্তু সেখানেও তো যাই না,” আমি বিব্রত হয়েছিলাম বেশ।

উনি হেসে মজা করে বলেছিলেন, “আপনি নিজেও জানেন না আপনি কত জায়গায় ঘুরে বেড়ান নিজের অলক্ষে!”

এই বইমেলায় দেখেছি জয় গোস্বামীকে। কত্ত মানুষ পরিবৃত হয়ে হাঁটছেন। যেন মিছিল চলছে একটা! দেখেছি সুবোধ সরকার সই দিচ্ছেন, পাশে তাঁদের ‘ভাষানগর’-এর বইয়ের সেই ভীষণ পরিচিত ‘কার্ট’!

বইমেলাতেই প্রথম আলাপ হয়েছিল পৌলোমী সেনগুপ্তর সঙ্গে। তিনি লেখাও দিয়েছিলেন আমাদের পত্রিকায়। তিলোত্তমা মজুমদারকেও প্রথম দেখি বইমেলাতেই। গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন স্টলের বাইরে। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছেন। পরে আলাপ হওয়ার পরে দেখেছি উনি ততটাও গম্ভীর নন, বরং অনেক সহজ ভাবে কথা বলার মানুষ।

এমন কত কবির সঙ্গে লেখকের সঙ্গে যে আলাপ করার সুযোগ করে দিয়েছে বইমেলা তার ইয়ত্তা নেই!

বইমেলার আর একটা আকর্ষণ ছিল কবিতা পাঠ শোনা। ইউবিআই অডিটোরিয়াম, এসবিআই অডিটোরিয়ামে তো বটেই, মঁমার্তেও হত নানা কবিতা পাঠের আসর। কোথায় কে কবিতা পড়ছে সে সব জেনে আমরা সেই সব মঞ্চের সামনে গিয়ে ভিড় করতাম। ‘দেশ’-এর প্যাভিলিয়নে বসত আলোচনাসভা। সেখানে কত বিখ্যাত মানুষদের দেখেছি!

বইমেলার আর একটা আনন্দ ছিল গান! কত নতুন ছেলেমেয়ে যে গান গাইত দল বেঁধে! মনে আছে ‘বিজল্প’-র সদস্যদের এক সঙ্গে গান গাওয়ার সেই মুহূর্তগুলো। মঁমার্তে কত অজানা শিল্পীর গান শুনেছি। ভাললাগায় আচ্ছন্ন হয়েছি। অবাক হয়েছি।

এ ছাড়াও ছিল প্রেম! বইমেলা হবে আর সেখানে প্রেম থাকবে না, তা কি হয়!

আমার এক বন্ধু কবিতা লিখত। নাম দীনবন্ধু। মুখচোরা, লাজুক ছেলে দীনবন্ধু। দারুণ সুন্দর এক মফস্সলে থাকত। ও নিজের লেখা নিয়ে কথা বলত না একদম। চেয়েচিন্তে জোর করে নিতে হত ওর লেখা। আর এর উল্টো দিকে ছিল ঝোরা! ভাল নামটা আজ আর বলছি না। ওকে ‘ঝোরা’ বলেই আমরা ডাকতাম!

কলকাতার খুব নামকরা কলেজে পড়ত ঝোরা। ছোট করে কাটা চুলে আঙুল চালাত বার বার। শাড়ির আঁচল গুঁজে রাখত কোমরে। আর সারা ক্ষণ মেলাময় দৌড়ে বেড়াত। বকবক করে মাথা খারাপ করে দিত সবার। আমার অন্য বন্ধুরা ওকে বলত ‘পাগলিঝোরা’!

এই ঝোরার ভাল লেগে গিয়েছিল দীনবন্ধুকে। কী করে যে লেগেছিল কে জানে! কিন্তু আমি দেখতাম আমাদের আড্ডার মাঝে বসে ঝোরা একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে দীনবন্ধুকে!

আমি দীনবন্ধুকে বলতাম সে কথা। শুনে দীনবন্ধু হাসত। ওর ফর্সা কান লাল হয়ে যেত। ও নিচু গলায় আস্তে আস্তে বলত, “তুই কবিতা না লিখে গল্প লেখ। ভালই বানিয়ে লিখতে পারবি!”

মনে আছে, সে বার বইমেলার শেষ দিনে আমি আর দীনবন্ধু যখন বেরিয়ে যাচ্ছি মেলা থেকে, ঝোরা হাঁপাতে হাঁপাতে
এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সামনে! তার পর আমায় বলেছিল, “তোর এই দীনবন্ধু কি মানুষ?”

আমি উত্তর না দিয়ে হাসি চেপে তাকিয়েছিলাম দীনবন্ধুর দিকে। দেখেছিলাম সন্ত্রস্ত হয়ে দীনবন্ধু মাথা ঝুঁকিয়ে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন মেলার স্টল থেকে বই চুরি করে ধরা পড়েছে!

ঝোরা এ বার সরাসরি দীনবন্ধুকে বলেছিল, “আমার যে তোমাকে ভাল লাগে, তুমি বোঝো না? না কি বুঝেই ঘ্যাম নাও? কী চাও, আমি তোমার পায়ে পায়ে ঘুরব? খুব ভাব না তোমার? ঠিক আছে, আমি মোটেই তোমায় কোনও দিন বলব না যে, তোমায় আমার খুব ভাল লাগে। তোমায় ভালবাসি! কোনও দিন বলব না, দেখো!”

চার দিকে বইমেলা ভাঙার ভিড়। একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসছিল গিল্ডের বড় অফিসটার দিক থেকে। আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম, ঝোরা সত্যি সত্যি ঝরনা হয়ে নেমে আসছে আমাদের সামনে!

দীনবন্ধু কী করবে এ বার? কী বলবে? আদৌ কি কিছু বলবে?

দীনবন্ধু সময় নিয়েছিল। তার পর সেই লাজুক, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “ঝোরা, তুমি কি হবে আমার দীনবান্ধবী?”

ওদের প্রেম দেখেছিলাম আমরা। এক বছর ধরে কলকাতা জুড়ে ও তার পরের বছরও বইমেলা জুড়ে ওরা ঘুরে বেরিয়েছিল হাতে হাত রেখে। বাড়ির সমস্ত বাধা তুচ্ছ করে ঝোরা ঠিক করেছিল, ও দীনবন্ধুর সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাবে। আমাদের যে কী আনন্দ হয়েছিল!

তার পর বইমেলা শেষ হওয়ার এক দিন আগে ওরা বলেছিল, পরের দিন আমাদের সবাইকে খাওয়াবে। কারণ এক বছর পূর্ণ হচ্ছে যে ওদের সম্পর্কের! আমরা দারুণ খুশি হয়েছিলাম। সে দিন বইমেলা থেকে বেরিয়ে ‘আবার কাল দেখা হবে’ বলে চলে এসেছিলাম বাড়িতে!

আর ফোনটা এসেছিল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ! ঝোরা!

গলা কাঁপছিল ওর। কথা বলতে পারছিল না। কেমন যেন গোঙানি শুনছিলাম শুধু।

“কী হয়েছে? কী হয়েছে ঝোরা?” উত্তরে ঝোরা কথা বলতে পারছিল না। শুধু শব্দ। অস্ফুট গোঙানির শব্দ!

ঝোরার বোন এসে ধরেছিল ফোনটা। বলেছিল, “দীনবন্ধুদা আজ ট্রেন থেকে পড়ে মারা গিয়েছে! ভিড় ট্রেনে ঝুলছিল। পোস্টে লেগে পড়ে গিয়েছে...”

না, আর বাকিটা আমি শুনতে পারিনি!

ঝোরা আর কোনও দিন বইমেলায় আসেনি। আমরা ওর বাড়িতে গেলে কথাও বলেনি আমাদের সঙ্গে। কেমন যেন শূন্য চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসেছিল নিজের বিছানায়। আর আমি দেখেছিলাম ওর মাথার পিছনে দেওয়ালে ও বড় বড় করে লিখে রেখেছে ‘দীনবান্ধবী’!

আর তার পরের বছরই বইমেলা ময়দান থেকে উঠে চলে গেল মিলনমেলা প্রাঙ্গণে! শূন্য মাঠে পড়ে রইল রোদ্দুর আর দীনবন্ধু-ঝোরার স্মৃতি।

এই মেলার জায়গা পাল্টে যাওয়ায় আমরা সবাই কেমন যেন ভেবলে গেলাম! এটা কী হল! আগে যে মেট্রোয় উঠে চট করে চলে যাওয়ার সুবিধে পেতাম, সেটা শেষ হয়ে গেল! কিন্তু জীবন এমনই। সব কিছুই এখানে এক দিন না এক দিন শেষ হয়।

আমার দাদা, মৃণাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাও ওই মেলাতেও যেতাম এক দিন বা বড়জোর দু’দিন। এই নতুন জায়গায় মেলাটা কেমন যেন ছোট হয়ে গেল। স্টল কমে গেল। আমরা যারা ময়দানের বইমেলায় গিয়েছি তাদের কেমন যেন লাগত এখানে এসে! বিরাট বাগানবাড়ি থেকে আমরা যেন উঠে এলাম কোনও মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে!

কিন্তু সব জিনিসই সয়ে যায়! এটাও সয়ে গেল। তত দিনে বইমেলা আবার চলে গিয়েছে নতুন জায়গায়। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে। শান্ত পরিবেশের মধ্যে এই জায়গায় বইমেলার আসরটি আমার বেশ ভাল লেগে গিয়েছে প্রথম থেকেই।

সামান্য যে লেখালিখি করি তার জন্য মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় বেড়েছে কিছুটা। বইমেলা এখন সারা বছর পরে একটা রিইউনিয়নও যেন। এখানেই কত জনের সঙ্গে যে দেখা হয়! আড্ডা হয়। প্রচেতদা (প্রচেত গুপ্ত) মজা করে বলেন, “আমাদের পাড়ায় এখন বইমেলা!” কথাটা সত্যি। তা হলেও মনে হয় বইমেলা যেখানে হয় সেটাই তখন আপামর বাঙালির নিজের পাড়া!

আমার নিজের প্রথম উপন্যাস ‘পাতাঝরার মরশুমে’ এই বইমেলাতেই বেরিয়েছিল আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। কিন্তু সে বছর মেলায় আমার যাওয়া হয়নি। তার পরের বছরও যাওয়া হয়নি।

তার পরের বছর যখন গিয়েছি, দেখেছি কী আশ্চর্য জাদুবলে দু’-এক জন আমায় চিনে ফেলছে! ভাল লাগার চেয়েও কেন কে জানে আমার টেনশন হয়েছিল বেশি!

তবে এখন যখন মেলায় যাই আনন্দ পাবলিশার্সের কাউন্টারের অন্য দিকটায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি আমি। মানে সেই দিকটায়, যেখানে ভিড় নেই। আর রাশি রাশি বই রাখা থাকে! আমি সেই দিকে দাঁড়িয়ে ভাবি, সবটাই আসলে রূপকথা! না হলে আমি কি কোনও দিন ভেবেছিলাম ওই দিক থেকে কাউন্টারের এই দিকে লেখক হিসেবে এসে দাঁড়াতে পারব আমি!

এখন এই ফাঁকা দিক থেকে ওই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আমি খুঁজি! ভাবি ওইখানে কি আর এক জন কেউ আছে যে ভাবে, কাউন্টারের ওই দিকটা কী ফাঁকা! কেউ আছে কি, যার এই দিকটাতে এসে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে খুব?

এখন সারা বছরই বই কিনি। সে অনলাইন হোক বা কলেজ স্ট্রিট থেকে। এখন বইমেলায় যাই মূলত অজানা বই খুঁজতে। এমন বই যা চট করে পাওয়া যায় না, সে সব কিনতে।

বইমেলায় খেতে যাই না আমি। কলকাতা জুড়ে এখন নানা ধরনের খাবারের দোকান। বইমেলায় খেতে যাওয়ার কথা তাই মনেও আসে না।

এই সব কিছু পেরিয়ে, এখন এই মধ্য চল্লিশে এসে পিছন ফিরে তাকালে বুঝি, বইমেলা যে শুধু উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে তা নয়। বইমেলা নিয়ে আসে আমার বড় হয়ে ওঠার নানা ধাপের স্মৃতিকথাও! নিয়ে আসে প্রথম বই উপহার পাওয়ার স্মৃতি। নিয়ে আসে মায়ের সেই বইয়ের প্যাকেট হাতে হাসিমুখে বাড়িতে ফেরার ছবি। বইমেলা নিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের মুখ! নিয়ে আসে সেই নাম না জানা মানুষটিকেও, যিনি যত্ন করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বইয়ের প্যাকেটে এঁকে দিতেন ছবি! বইমেলা নিয়ে আসে দীনবন্ধুকে! নিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া ঝোরাকেও! আর নিয়ে আসে শীত শেষের জমজমাট ময়দানি রোদ্দুর। দূরে টাটা সেন্টারের ওপার থেকে ভেসে আসা হাওয়া! ধুলোর পাকে জড়িয়ে যাওয়া বইয়ের গন্ধ! লিটল ম্যাগাজ়িন প্যাভিলিয়নের সামনে মাঠে বসে, পড়ে ফেলা তরুণ কবির কবিতা! ফেরার মেট্রোয় বইয়ের প্যাকেট হাতে ক্লান্ত, কিন্তু তৃপ্ত মানুষদের ভিড়! বইমেলা নিয়ে আসে আমার কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠার কলকাতার স্মৃতি! নিয়ে আসে সেই সব মানুষের মুখ, যারা মেলার মাঠে বসে গান করেন! বাঁশি বাজান! নিমেষে এঁকে দেন জীবন্ত ছবি!

জীবন পাল্টায়। বইমেলা আমাদের জীবনের অঙ্গ, তাই সেটাও যে পাল্টাবে তা স্বাভাবিক! কিন্তু যা আজও পাল্টায়নি, তা হল বইমেলা ঘিরে আমাদের ভালবাসা।

অনেকে বলেন, বই কেনা কমে যাচ্ছে। কিন্তু মেলায় নানা স্টলে তা হলে এত ভিড় কেন! আমি জানি না সে সব। শুধু জানি মুগ্ধ পাঠক হিসেবে, কলকাতার সাধারণ
এক জন মানুষ হিসেবে, আর লেখক হিসেবেও বইমেলা আমায় দিয়েছে অনেক! বইমেলার কাছে আমি যে কতটা কৃতজ্ঞ তা কী করে বোঝাই!

তাই মহামারি পেরিয়ে এই নতুন বইমেলার দিকে আমিও তাকিয়ে আছি! আশা করছি গত দু’বছরে আমাদের মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার অনেকটা শুশ্রূষা করবে এ বারের বইমেলা! আশা করছি মানুষের বন্ধু হিসেবে বই আবারও এসে দাঁড়াবে মানুষেরই পাশে!

অন্য বিষয়গুলি:

International Kolkata Book Fair
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy