খুব প্রেমপত্র পাচ্ছ তো দেখছি আজকাল! ছাত্রীটাত্রী নাকি?”
গোপন চিঠি— বলে একটা অ্যাপে নামলুকিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে লোকে। যে পাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছে। নতুন ট্রেন্ড।
বছর আটাশের কালোবরণ সামন্তর তাতে প্রেমপত্র পাওয়ার কথা নয়। একে সে সার্থকনামা, উপরন্তু প্যাংলা চেহারা, ট্রেন্ডি চাপদাড়ি নেই। রংচটা শার্ট পরে, প্যান্টে হাঁটুর কাছটায় রিফু।
বর্ধমান ফিরতে রাত হয়ে যায়। প্রাইভেট কলেজে পার্ট-টাইম লেকচারারগিরির পাশাপাশি কালোবরণকে ম্যানেজমেন্টটাও দেখতে হয়। একস্ট্রা তিন হাজার টাকা মেলে। টাকাটা অনেক।
রিসেপশনিস্ট শিপ্রাও ইভনিং শিফ্ট সেরে ফেরে। সিট রাখে কালোবরণ। দু’জনে পাশাপাশি বসে। ঊরুতে ঊরু ঠেকে গেলে কালোবরণ শিউরে শিউরে ওঠে। চকচকে সুন্দরী শিপ্রাকে তার পাশে মানায় না। ডেলিপাষণ্ড লোফারটাইপ ছোকরাগুলো গুজুরগুজুর করে— সরকারি চাকরি বোধহয়!
হু হু করে পেরিয়ে যায় শ্রীরামপুর, শ্যাওড়াফুলি, ব্যান্ডেল, আদিসপ্তগ্রাম। কামরার আলো উজ্জ্বল হয়, মিঠে হাওয়া দেয়।
বৈঁচি আসতে আসতে একটা কল আসে। রোজ। শিপ্রা ফোনটা ধরে বলে— “আসছি।” কামরার আলো ঝুপ করে নিভেই আবার জ্বলে যায়। কালোবরণ একটু সরে বসে।
বৈঁচিতেই নামে শিপ্রা। অমনি লাস্ট বর্ধমান লোকালের আলো ময়লা হয়ে আসে। সিটগুলো শক্ত ঠেকে। ফ্যানের হাওয়া গরম, দেওয়ালে ঋতুবন্ধের বিজ্ঞাপনে দম বন্ধ হয়ে আসে কালোবরণের।
আজ হাওড়া কারশেডেই শিপ্রা জেদ ধরে, “কে মেয়েটা, বুঝতে পেরেছ?”
“ছাত্রীই হবে কেউ।”
কালকের চিঠিটায় ‘হা হা’ দিয়েছে তিরিশ জন। ক্লাসফ্রেন্ড পদা কমেন্টে লিখেছে, “কেলোর কীর্তি, মেয়েটা শিয়োর কানা।”
তবু বড় সুন্দর চিঠিটা— “আকাশগঙ্গায় ঘুরতে যাব কালোবরণ। পথে পড়ে থাকবে কুচি কুচি তারা। এক টুকরো বিঁধে যাবে আমার ডান পায়ে। কাচের মতো। আমি হালকা ‘আঃ’ করে শাড়ির কুঁচিটা সামান্য উঠিয়ে নেব। তুলে ধরব আমার ফর্সা পা-টা। তুমি হাঁটু গেড়ে বসে তুলে দেবে কুচো তারাটা, তার পর ম্যাজিকের মতো কোথা থেকে যেন একটা আংটি এনে তার মাথায় বসিয়ে দেবে। আর আমি টুক করে ডান হাতের আঙুল বাড়িয়ে দেব...”
শ্রীরামপুর ছাড়াতে ছাড়াতে হইহই ভিড়টা অনেকটা খালি। দু’-এক জন আছে। কালোবরণ বলে, “ভাল চিঠি, নয়?”
“ছাই ভাল!”
“কেন? কী সুন্দর কবিতা-কবিতা লেখা!”
“ইমপ্র্যাক্টিকাল লোকজনই ও সব কবিতা-ফবিতা লেখে।”
“তোমার কবিতা ভাল লাগে না?”
“না। সোজা কথাকে অমন পেঁচিয়ে ভৃগুর দাদু নৃপেনবাবুগিরি পোষায় না।”
কালোবরণদের প্রাইমারিতে পাঠ্য ছিল ভৃগুর দাদু নৃপেনবাবু। ঘি-কে বলেন ঘৃত, ঘাসকে বলেন তৃণ। কিন্তু নৃপেনবাবু রাগকে কী বলবেন? রোষ? নাকি ক্ষোভ?
দেখা যাচ্ছে, শিপ্রা রেগে গেছে। অথচ রাগের কোনও কারণ নেই। রাগলেও দু’গালেই টোল রয়ে গেছে মেয়ের। লাল-হলুদ বাটিক প্রিন্ট চুড়িদারের আভা ফুটেছে মুখে। গজদাঁত ঝিকিয়ে উঠছে— ইশ!
আগের দিন চিঠিটা আরও সুন্দর হয়েছিল— “...এক দিন স্ট্র্যান্ডে বসব দু’জনে। বিরাট একটা চাঁদ উঠবে গঙ্গার ও পারে। ঝুপ করে লোডশেডিং হবে। সবাই বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। চাঁদনিতে আমি গালে টোল ফেলে হাসব। গজদাঁত ঝিকিয়ে ওঠা হাসি। আর তুমি, হাঁদারামটা, হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। তোতলাবে, কিছুতেই বলতে পারবে না। কথাটা মেয়েদের প্রথম বলতে নেই, তবু আমিই হুট করে বলে দেব!”
চন্দননগরে শিপ্রাকে সে বলে, “বিয়ের পরে লাচেন-লাচুং যেয়ো, বন্দে ভারতে এনজেপি নামবে। সেখান থেকে…”
“বন্দে ভারত! ছোঃ!”
“বন্দে ভারতের চেয়ে ভাল ট্রেন আছে নাকি?”
“অভিনন্দন জাপানে সেটল করবে, বুলেট ট্রেনের কাছে বন্দে ভারত নস্যি!”
“এখানে থাকতে অসুবিধে কী?”
“সামান্য স্যালারির রিসেপশনিস্টের জীবন চাই না, তাই।”
“কিন্তু এটা তো অন্যের জীবন, তোমার নয়…”
“সো? সে জীবনে লাইফ আছে, এনজয়মেন্ট আছে, গতি আছে...”
“সবই ‘আছে’! ‘নেই’ লিস্টে কিছুই কি নেই?”
কালোবরণ তাকিয়ে থাকে। বাই চান্স, শিপ্রা যদি বলে, “তুমি নেই!” বলেই হয়তো টুক করে পটলচেরা চোখদুটো নামিয়ে নিল! বলতেও তো পারে, দুনিয়ায় কত রকম অসম্ভব কাণ্ড হচ্ছে।
তার প্রত্যাশা মেলে। শিপ্রা কথাটা বলে। কিন্তু অজান্তে হাংরিয়ালিস্টিক কবিতার মতো ঘুরিয়ে— “গরিবি নেই।”
কালোবরণ চুপ করে যায়।
শিপ্রার রাগ কমছে না, ব্যান্ডেলে বলছে, “মেয়েটাকে খুঁজে পেলে ঠাটিয়ে চড় দিয়ো তো— পড়া নেই, শোনা নেই, মাস্টারকে প্রেমপত্র দিচ্ছে!”
“পরবর্তী স্টেশন বৈঁচিগ্রাম”— স্পিকারে ঘোষণা হয়। শিপ্রা ব্যাগ থেকে একটা খাম বার করে। মেরুনরঙা বিয়ের কার্ড। খসখস করে লিখে একটা সাদা চিরকুট ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। তার পর বলে, “কাল থেকে আর আসব না। রিজ়াইন দিলাম আজ। যদিও কার্ডে অ্যাড্রেস লেখা আছে, তবু আলাদা করে লিখে দিলাম। তুমি যা ভুলোমন! দেখো, উঁ!”
ফোন এল অভিনন্দনের। শিপ্রা নেমে গেল। জানলা থেকে কালোবরণ এক পলক দেখল ছেলেটাকে। শিপ্রার সঙ্গে মানায়। সাড়ে ছ’ফুট হাইট। চওড়া কাঁধ, জিম করে নিশ্চিত। ধপধপে ফর্সা। বিদেশি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। কোটি টাকার প্যাকেজধারী।
ট্রেন ছেড়ে দেয়। বৈঁচির পর থেকে দেবীপুর অনেকটা গ্যাপ। কামরা ফাঁকা। কালোবরণ গোপন চিঠি অ্যাপটা খোলে।
“সাড়ে তিনশো কিলোমিটারে ছুটলে বাইরে কি কিছু দেখার অবসর হয়? তার চেয়ে ধিকিধিকি লোকালে বোলপুর লাইনে যাব কালোবরণ। জানালার বাইরে ধু ধু মাঠ। হাফবয়েল কুসুমের মতো সূর্যাস্ত, মরিচগুঁড়োর মতো উড়ন্ত পাখি। মাঠের ও পারে আলকাতরা লাগানো কালো কালো মাঠকোঠা দোতলা। ব্যালকনি নয়, বারান্দাও নয়, দাওয়া। নোয়াদা কিংবা ঝাপটের ঢালের মতো ছোট্ট কোনও স্টেশনে নেমে আমরা ওই বাড়িগুলোতে পৌঁছে যাব। বাসা করব। বুলেট ট্রেন ছোট স্টেশনে থামে না। বিচ্ছিরি। চাপব না, দূর…”
“... ইতি তোমার শিপ্রা”— চিঠি টাইপ করছে কালোবরণ। ‘টু’-বক্সে লিখেছে নিজের নামটাই।
শক্তিগড় পেরোচ্ছে ট্রেন। কালোবরণ শিপ্রার নামটা এ বারও মুছে ফেলে সেন্ড করে। ইনবক্স থেকে চিঠিটা শেয়ার করে দেয় ফেসবুকে। অমনি তিনটে ‘হা হা’ পড়ে।
গাংপুরে কামরার জানালা দিয়ে উড়ে যায় কুচো কাগজ। টুকরো টুকরো বিয়ের কার্ড, মেরুনরঙা। আর একটা দলা পাকানো সাদা চিরকুট। গোপন চিঠি, সোজাসাপ্টা প্র্যাকটিক্যালিটি— “ওয়েডিং গিফ্টটা নিজেই চেয়ে নিচ্ছি... এসো না, তা হলেই হবে। শান্তিতে বুলেট ট্রেনে চাপতে দিয়ো, লক্ষ্মীটি!”
ট্রেন বর্ধমানে পোঁছয়। কিন্তু কালোবরণকে নামতে দেখা যায় না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)