মনস্বী: বুদ্ধদেব বসুর লেখনী প্রথা ভাঙতেই অভ্যস্ত ছিল চিরকাল ।
নারীপুরুষের সম্পর্কে কামনাবাসনা নিয়ে সারা পৃথিবীতে অজস্র লেখালিখি হয়েছে। সেই সব লেখার অনেকগুলিই ছাপা হওয়ার পর নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লেখককে ছুটতে হয়েছে থানা থেকে আদালত, উকিলের বাড়ি থেকে সাক্ষীর দরজায়। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘বিজয়িনী’ নিয়ে, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ গান নিয়ে চেঁচামেচির কথা আমরা জানি। কিন্তু বাংলায় এই ঝামেলা সবচেয়ে বেশি সামলাতে হয়েছে বুদ্ধদেব বসুকে। সারা জীবন। স্কুল ম্যাগাজ়িনে তাঁর একটি গল্পের দ্বিতীয় অংশ মাস্টারমশাই ছাপতে রাজি হননি অশ্লীল বলে। আঠারো বছর বয়সে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় তাঁর একটি গল্প বেরিয়েছিল, ‘রজনী হল উতলা’। গল্পটি পড়ে তখনকার দিনের নামী লেখক বীণাপাণি দেবী ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় লিখেই দিলেন, ‘এই লেখককে আঁতুড়েই নুন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল!’ আর এক জন মহিলা বলেছিলেন, ‘লেখক যদি বিয়ে না করে থাকে তবে যেন অবিলম্বে বিয়ে করে, আর বৌ যদি সম্প্রতি বাপের বাড়িতে থাকে তবে যেন আনিয়ে নেয় চটপট।’ কী ছিল সেই গল্পে যার জন্য এত ধমক, এত ধিক্কার? এখনকার কোনও পাঠক যদি গল্পটি পড়েন, তিনি হয়তো খুঁজেই পাবেন না ঠিক কোন শব্দের জন্য, কোন বর্ণনার জন্য তখন অশ্লীল বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল গল্পটিকে। শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, সেই সময়ের কিছু কবিতার বিরুদ্ধেও এই রকম অভিযোগ ছিল, যেগুলো পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল এই সব লেখা পড়লে এখন মনে হয় কোনও সংস্কৃত কবিতার অনুবাদ!
কিন্তু সদ্যযুবক বুদ্ধদেবের নিরীহ গল্পটি নিয়ে তখন তুলকালাম হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে আসরে নেমেছিলেন সজনীকান্ত দাস। গল্পটিকে ব্যঙ্গ করে একটি নাটক লিখলেন তিনি, আর তার পরে সোজা অভিযোগ জানালেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। বললেন, যে সব পারিবারিক সম্পর্ককে সম্মান করা হয় সমাজে, এই লেখায় সেই সব নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ জরুরি। রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন। লিখলেন যে তাঁরও মনে হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যে ‘হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে।’ মাস চারেকের মধ্যেই লিখলেন ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধটি। সেখানেও তিনি ‘ল্যাঙট-পরা গুলি-পাকানো ধুলোমাখা আধুনিকতা’র বিরুদ্ধেই কথা বললেন। ছেড়ে দিলেন না বুদ্ধদেব বসুও। রবীন্দ্রনাথসহ তাঁর বিরোধীদের কড়া আক্রমণ করলেন তিনি। আরও অনেক কথার সঙ্গে বললেন যে, ‘বেশ্যাবাড়ি নিয়েও যে ভালো গল্প লেখা যায়, এবং অতিপরম সতীসাধ্বী স্ত্রীর কথা নিয়েও যে খারাপ গল্প লেখা যায়’, এটাই কেউ বুঝতে চাইছেন না।
কয়েক বছর পর বেরোল বুদ্ধদেবের প্রথম উপন্যাস ‘সাড়া’। আবার একই অভিযোগ। কিন্তু তার তিন বছর পর বেরোনো ‘এরা আর ওরা এবং আরো অনেকে’ লেখাটির জন্য এই অভিযোগ গড়াল একেবারে আদালত থেকে পুলিশ পর্যন্ত। পুরো ব্যাপারটা দুঃখজনক তো বটেই, কৌতুককরও। পুলিশের দু’জন স্পাই বুদ্ধদেবের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বইটি কিনতে। স্বভাবতই ভয় পেলেন বুদ্ধদেব। কাঠগড়া, পাহারাওলার গুঁতো আর জেলখানার ঠান্ডা মেঝেয় কম্বলের বিছানার ভয়ঙ্কর ছবি মাথায় এল তাঁর। পুলিশের সঙ্গে রফা করলেন তিনি। যদিও প্রথমদিকে যুদ্ধ ঘোষণার একটা ভাব ছিল তাঁর। দিলীপকুমার রায় এক জন দুঁদে ব্যারিস্টারের সঙ্গে তাঁর কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে এবং তাঁর গলার আওয়াজ শুনে বুদ্ধদেবের মনে হয়েছিল তাঁর একটি হুঙ্কারে ‘হাইকোর্ট সুদ্ধ কেঁপে উঠবে’। কিন্তু বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর কয়েক মুহূর্তের বাক্যালাপে পুরো ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে গেল। বুদ্ধদেবেরই ভাড়া করা ট্যাক্সিতে লালবাজারের দিকে যেতে যেতে তিনি বুদ্ধদেবের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী লিখেছিলেন বলুন তো?’ প্রশ্নটা অদ্ভুত, কারণ বুদ্ধদেব এক কপি বই তাঁকে দিয়ে এসেছিলেন এবং ধরেই নিয়েছিলেন তিনি খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চয়ই বুদ্ধদেবের পক্ষে যুক্তি তৈরি করে রেখেছেন। যাই হোক, তাঁকে আশ্বাস দেওয়ার ধরনে বুদ্ধদেব জানালেন, ‘কিছু না— এই তরুণ তরুণীর প্রেমের কথা আর কী।’
বুদ্ধদেবের এই উত্তর শুনে শূন্যে হাত তুলে আঁতকে উঠেছিলেন ব্যারিস্টার সাহেব, বলেছিলেন, ‘লাভ বিটুইন আনম্যারেড মেন অ্যান্ড উইমেন? আপনি করেছেন কী? এসব কথা কি শেক্সপিয়র লিখেছেন, না মিল্টন লিখেছেন? আমরাও তো বিলেতে স্টুডেন্ট ছিলুম— কই, এ-রকম তো দেখিনি!’ এই অকল্পনীয় উত্তর শুনে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল বুদ্ধদেবের। তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। লালবাজারে গিয়ে তাঁকে একটি মুচলেকা দিতে হল এই মর্মে যে আগামী পাঁচ অথবা দশ বছরের মধ্যে তিনি আর বইটি প্রকাশ করবেন না। তার পরও যদি প্রকাশ করতে চান পুলিশের অগ্রিম অনুমতি নিতে হবে। লালবাজার থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার সাহেব বুদ্ধদেবকে আদেশ দিলেন, ‘আমার জুনিয়রকে আট টাকা দিয়ে দিন।’ সকৌতুক বেদনার সঙ্গে লিখছেন বুদ্ধদেব, ‘আমি ভেবে পেলাম না কেন দেবো, কেননা সেই কনিষ্ঠ উকিলটি কিছুই করেননি আমার জন্য। কেন তাকে লাঙ্গুল রূপে আনা হয়েছিল তাও আমার ধারণাতীত...’ বলাবাহুল্য না দিয়ে উপায় ছিল না। শুধু টাকা নয়, আরও মজার কথা এই যে, বইটির সর্বশেষ কপিটিও তিনিই হস্তগত করলেন। বুদ্ধদেব চেয়েও পেলেন না।
তবে বুদ্ধদেবের সমর্থনে প্রতিবাদও হয়েছিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। আরও অনেক কথার সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘উপন্যাসের নর-নারীরা কিভাবে প্রেম নিবেদন বা হৃদয় বিনিময় করিবে, তাহার ‘হুদ্দা’ যদি পুলিশ-নিয়ন্ত্রিত হয় তাহা হইলে বাঙ্গলা সাহিত্যের অতি শোচনীয় দুর্দিন সমাগত হইয়াছে বুঝিতে হইবে।’
যে-বই নিয়ে এত কাণ্ড, পরে যখন আবার সেই বই ছেপে বেরোল, তখন বুদ্ধদেব লিখছেন, ‘আমার এক বন্ধুর বারো বছরের মেয়ে তা পড়ে বলে উঠলো,—ও মা! এতে আবার দোষের কী আছে! এ তো ডাবের জল।’
এখানে বলা দরকার, এই করুণ ঘটনাই বুদ্ধদেবকে প্রকাশক করে তুলেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘শুনলাম এর পরে আমার প্রকাশক পাওয়া শক্ত হবে। আমার মাথায় খেলল দু’-একটা বই নিজেরা ছেপে দেখলে মন্দ হয় না—তাতে পারমার্থিক এবং আর্থিক লাভও বেশি হতে পারে।’ এই চিন্তা করে এর পরেই ‘গ্রন্থকার মণ্ডলী’ নামে প্রকাশনা সংস্থা খুললেন তিনি।
অশ্লীলতার ভূত নানা ভাবে তাড়া করেছে তাঁকে। একদিন খোশমেজাজে প্রেস থেকে ‘কবিতা’ পত্রিকার নতুন সংখ্যা আনতে গেছেন। কিন্তু দেখলেন সবাই কেমন চুপচাপ, কোনও কথার স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছেন না কেউ। শেষমেষ এক জন জানালেন যে পত্রিকা তৈরি আছে, কিন্তু চালান দেওয়া মুশকিল। কেন? পত্রিকার বিশেষ একটি পৃষ্ঠা দেখিয়ে তিনি বললেন, আগে খেয়াল করলে এইসব অশ্লীলতা তাঁরা ছাপতেন না। অবাক বুদ্ধদেব বুঝতেই পারলেন না কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তর সেই কবিতায় সমস্যাটা কোথায়! তবে কি নারীর শরীরের কয়েকটি অংশের নামেতেই আপত্তি তাঁদের? বুদ্ধদেব অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁদের টলাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত নামী লেখক ও আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্তর কাছ থেকে লিখিত অভয়বাণী নিয়ে এসে পত্রিকা ছাড়াতে হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুকে।
শুধু নিজের জন্য নয়, বুদ্ধদেব লড়াই করেছিলেন অন্য লেখকদের জন্যও। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু নিজে সেই মামলায় সমরেশ বসুর পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সেই মামলার বর্ণনা— ‘দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হাবড়ে চুমু খাচ্ছিল—’ এই লাইনটি বলে বুদ্ধদেবকে কৌঁসুলির প্রশ্ন ছিল, ‘এই বাক্যগুলি কি অশ্লীল বলে
মনে করেন?’
বুদ্ধদেব উত্তর দিয়েছিলেন : ‘না। আমার বক্তব্য এই বইয়ের নায়ক বা অনায়ক সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের রকবাজ ছেলেদের টাইপ।... এই যুবকেরা সাধারণত যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাতেই এই উপন্যাস লেখা।’ মনে পড়বে, সমরেশ বসু লিখেছিলেন, ‘জীবনে যদি অন্ধকার থাকে, তাকে অন্ধকারেই রাখতে হবে কেন। আলোয় আনতে গেলে পেঁচক শৃগাল চিৎকার করবে। করুক না। তবুও অন্ধকারে যেন না থাকতে হয়।’
অশ্লীলতা প্রসঙ্গে আইন-আদালতের ঝামেলা শেষজীবন পর্যন্ত সামলাতে হয়েছে বুদ্ধদেব বসুকে। ১৯৬৯ সালে ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাস লেখার জন্য মামলা হল তাঁর বিরুদ্ধে। মামলা করেছিলেন নীলাদ্রি গুহ। বুদ্ধদেব বসুর পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন মানসী দাশগুপ্ত, শিশির চট্টোপাধ্যায় ও অরূপরতন বসু। প্রাথমিক ভাবে দোষী সাব্যস্ত হলেও পরে হাইকোর্টের রায়ে অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্তি পান বুদ্ধদেব। এই মামলা প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছিলেন, মনস্তত্ত্ববিদ মানসী দাশগুপ্তকে সওয়াল করার সময় ‘কৌঁসুলি কেবল সাক্ষীর শরীরে হাত দিতে বাকি রাখেন’। প্রবাসী মেয়েকে লেখা চিঠিতে বুদ্ধদেবের সেই সময়ের মানসিক উদ্বেগ ধরা পড়েছে। ‘বাংলাদেশ পাগল হয়ে যাচ্ছে’— লিখেছিলেন তিনি।
এই লেখার কয়েক বছর পরে ‘চরম চিকিৎসা’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন বুদ্ধদেব, যেখানে একটি ‘অশ্লীলতা-নিবারণী সংঘ’-এর উদ্বোধন করেছিলেন ‘ড. মদনভস্ম ভট্টাচার্য, গোবর্ধন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক’। অশ্লীলতা-বিরোধী দলের একটি ইশতেহারে এমন এক জগতের কথা আছে, যেখানে ‘মানুষ নেই। শুধু আছে লক্ষ-লক্ষ রোবট, লোহা, তামা আর প্ল্যাটিনামে তৈরি।’
বুদ্ধদেব ছাড়াও আরও অনেক বাংলা ভাষার লেখককে নীতিপুলিশের গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। অশ্লীল কবিতা লেখার জন্য একাধিক লেখকের চাকরি পর্যন্ত চলে গেছে এমন গল্পও আমরা শুনেছি। পঞ্চাশের দশকের কয়েক জন লেখকের নাম এই প্রসঙ্গে মনে আসতেই পারে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সরাসরি লিখেছিলেন, ‘খিস্তির ভাষাই সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি পবিত্র। তার কারণ, সাহিত্যে যেসব শব্দ আগে ব্যবহৃত হয়নি বা খুব কম ব্যবহৃত হয়েছে — সেইগুলোই পবিত্র।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy