Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
এ ভাবেই গতকাল পুজো হল নামখানা, গোসাবার নানা গির্জাঘরে। বড়দিনে কেক খাওয়ার কথা জানেন না গ্রামের অনেকে। খাবার বলতে পিঠেপুলি, পায়েস। চলে পালাকীর্তন, গাজন, যাত্রা, ফুটবল ম্যাচ।
christmas

Christmas: জিশুর জন্মদিনে মানতের বাতাসা

গির্জার গাইয়েরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের বাড়ি গিয়ে শোনান ঈশ্বরপুত্রের জন্মের গান। চাল-ডাল-আলুর উপহারে ভরে ওঠে তাঁদের কোঁচড়।

মিলনক্ষেত্র: পাথরপ্রতিমা ব্লকের বড় রাক্ষসখালিতে সাধু স্টিফেনের গির্জাঘর। ডান দিকে, জিশুবন্দনার জন্য সুরসন্ধ্যার আয়োজন।

মিলনক্ষেত্র: পাথরপ্রতিমা ব্লকের বড় রাক্ষসখালিতে সাধু স্টিফেনের গির্জাঘর। ডান দিকে, জিশুবন্দনার জন্য সুরসন্ধ্যার আয়োজন। ইউটিউব ঘেঁটে জোগাড় করা হয় জিশুর নতুন নতুন গান। বড়দিনের আগে শীতের সন্ধ্যাগুলিতে চলে তারই মহড়া ।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:২৪
Share: Save:

বড়দিনে কেক খেতে হবে, এমন নিয়ম জানেন না তৃপ্তি কর্মকার। ঠিক বোঝেন না ‘হ্যালেলুয়া’ শব্দটার মানেও। তা বলে তো গাইতে বাধা নেই। দমদমের কাজের বাড়িতে ফুরসত পেলেই মা মারিয়া আর জিশুর কাছে ছুটে যেতে ভেতরটা হাঁকপাক করে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির ভাবনা বা এগারো ক্লাসের ছেলেটার ভবিষ্যৎ চিন্তায় আর কে কপালে হাত বুলিয়ে দেবে!

ভাবতে ভাবতেই গুনগুনিয়ে ওঠা— ‘প্রভু তোমার মুখের কথায়, তোমার হাতের ছোঁয়ায় / রোগীরা সুস্থ হল, মৃতেরা জীবন পেল / হ্যালেলুয়া হ্যালেলুয়া, ও হোই সকতা…!’ এটা কি গাইলেন? গানের কথা গুলিয়ে ছাইপাঁশ গেয়ে লজ্জা পান ভক্তিমতী ক্যাথলিক তৃপ্তি। কলকাতার লোকে হাসে। সুন্দরবনে দুই তরুণ ছেলেমেয়ের, অনূর্ধ্ব ৪০ মায়ের চোখের সামনে তবু জ্যান্ত হয়ে ওঠে বছর শেষে ঝড়খালি কোস্টালের হিরণ্ময়পুর গ্রামের সন্ধেগুলো। কলকাতার গির্জাঘরের জৌলুস নেই। পাথরপ্রতিমা থেকে নামখানা, কাকদ্বীপ থেকে গোসাবা জুড়ে তবু প্রাণ-ঢালা সুর-সন্ধ্যা। বাঙালিয়ানার অন্য রং।

ইয়াস বা আমপান এসে গির্জাঘরের টিনের চাল, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে যায়। জোড়াতালির মেরামতি সেরে সেখানেই বেঁচে থাকার আনন্দে প্রার্থনাসভা বসে। ঝড়ে নদীবাঁধ ভাঙে। নোনা জল ঢুকে চাষের দফারফা। পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুরা বলে, আকাশবন্যা আর নোনাবন্যা, এই নিয়ে সুন্দরবনের বারমাস্যা। এ বছরও নামমাত্র ফসল ঘরে উঠেছে। তবু তো বেঁচে থাকা! তার উপরে বড়দিনে ঘরের ছেলেদের দূর-দূরান্ত থেকে ফেরার সুখ! কেউ মালদহে আলুস্টোরের কর্মী, কেউ বেঙ্গালুরুর দিনমজুর। রংচটা গির্জাঘরে সস্তার রঙিন কাগজ, প্লাস্টিকের ফুলের পাহাড়। গির্জার সকাল-সন্ধের সাজগোজ। কলকাতার হোটেলের চাকরি থেকে পুত্র সমীর পেরেরা ফেরার আনন্দে আটখানা কমলেন্দু পেরেরা উৎসবের তদারকি করেন।

বঙ্গোপসাগরের কিনারায় সুন্দরবনের এই দ্বীপের নাম বড় রাক্ষসখালি। পাথরপ্রতিমা ব্লক। ৮০-৯০ বছরের পুরনো রোম্যান ক্যাথলিক গির্জাটির বাহারি সাদা-লাল রং এখন ফিকে। তুলনায় সিএনআই (চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া) গির্জার টুকটুকে হলুদ বেশ জেল্লাদার। তবে দ্বীপের তিনটে গির্জার মধ্যে ক্যাথলিক গির্জাতেই সব চেয়ে বেশি লোক ধরে। বড়দিনে এ বারও গির্জাঘর উপচে কত জনকে বাইরে ত্রিপল বিছিয়ে বসতে দিতে হয়েছে। দ্বীপে ৩০০-৪০০ ঘর খ্রিস্টান পরিবার, কিন্তু ঢের বেশি লোক জড়ো হবে উপাসনায়। এই সেদিন পর্যন্ত বড়দিনের কেক খায়, না মাথায় দেয় জানত না দ্বীপবাসী। স্যান্টাক্লজ় বা ক্রিসমাস-ট্রির নামই বা জানত ক’জন! তবু বড়দিনের আগের সন্ধে থেকে শুরু হওয়া জিশুর গানের আসরই বছর শেষের উৎসবের সুর বেঁধে দেয়। সঙ্গে খ্রিস্টীয় জন্ম-মহোৎসবের মেলা। হিন্দু, মুসলিম, জনজাতির সক্কলে চাঁদা দেন। চলে জিশুর পালাকীর্তন, গাজন, যাত্রা, বাইরের টিম এনে ফুটবল ম্যাচ। আমন চাষের ফসল তোলার পর বড়দিনই সব চেয়ে বড় উৎসব। চাষবাস যেমনই হোক, উৎসব থেমে থাকবে না।

ক্যাথলিক গির্জার সহ-পুরোহিত কমলেন্দুবাবু এবং বয়সে তাঁর অগ্রজ সাধু স্টিফেনের সিএনআই গির্জার মহীতোষ মাঝি প্রতি বারই জিশুমেলা আয়োজনের গুরুভার কাঁধে নেন। স্থানীয় ব্যাপটিস্ট গির্জার খ্রিস্টানরাও তাঁদের সঙ্গে একজোট হন। একটা বিষয়ে সকলে এক মত— খ্রিস্টানেরা গির্জাঘরে বসতে পান না পান, উৎসবের দিনে যে ভিনধর্মী সজ্জনেরা উপাসনা দেখতে আসবেন তাঁদের যেন বসতে অসুবিধে না হয়।

জিশু বা মা মারিয়াকে ঘিরে প্রতি বারই চমকপ্রদ কাণ্ডের অভাব নেই। এই তো হিন্দুধর্মী হারাধন মান্নার ছেলেটা করোনায় বেহুঁশ জ্বর নিয়ে গ্রামে ফিরল। হারাধনবাবু গির্জার মেরি-মার পা-ধোয়া জলটুকুর জন্য কাতর! ক’দিন বাদেই ছেলে সুস্থ। টেস্টে করোনা উধাও। ছেলেকে ফিরে পেয়ে মানত রক্ষায় এই বড়দিনে সেই বাবা গির্জায় সাড়ে ছ’ফুটের মোমবাতি জ্বালিয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব মহীতোষেরও বড়দিন এলেই গ্রামের স্বর্গীয় সাগর গুড়িয়ার কথা মনে পড়ে। রোগমুক্তির প্রার্থনায় প্রভু জিশুর জন্মদিনে ক্যানসারে ধুঁকতে ধুঁকতে লোকটা মাথায় অ্যালুমিনিয়ামের বালতি করে গির্জায় মানতের মুড়ি-বাতাসা নিয়ে যাচ্ছেন। গির্জার পাশেই শম্ভু দলুই, অশোক দলুইয়ের ঘর। ওঁরাও হিন্দু। বড়দিনের আগের রাতে জিশু-কীর্তনের গান শুনে ফি-বছর গাইয়েদের আঁচল, কোঁচড় চাল, ডাল, আলু দিয়ে ভরে দেন। জিশুর জন্মের খবর নিয়ে পাড়া বেড়ানো কীর্তনিয়ারা তাঁদের বাড়িতে না-থামলে ভারী অভিমান হয় গ্রামের হিন্দু বা মুসলিমদের অনেকের।

ইউটিউব ঘেঁটে জিশুর নতুন নতুন গান তুলে মহড়াও বঙ্গজীবনে বড়দিনের আগমনীর অঙ্গ। বড় রাক্ষসখালির গোবিন্দপুর আবাদ গ্রামে নৌকোর মিস্ত্রি পল্লব নেয়ের স্ত্রী সোমা এই গাইয়েদের প্রধান কণ্ঠ। আগে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে জিশুর জীবনীমূলক ছোট নাটকও করতেন। এ তল্লাটে গাজনে এখনও ছেলেরাই মেয়েদের পার্ট করে। কিন্তু বাইবেলের নাটকে সোমার জুড়ি নেই। ভাল ভিলেন না-পেলে নিজেই কাগজের মুকুট, তরবারিতে রাজা হেরোদ সেজে যাত্রার কংসরাজার অট্টহাসিতে হা-হা করে কাঁপিয়ে দেবেন।

তবে নাটক এখন হয় কম। গির্জার মুরুব্বি মাস্টারমশাই (প্রাথমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক) মহীতোষবাবুর বাড়িতেই তবলা, হারমোনিয়াম, খোল, করতাল নিয়ে গানের মহড়া বসে। এই বাহাত্তরেও দিব্যি সুর খেলে মহীতোষের গলায়। শুনে শুনেই তুলে নিয়েছেন, ‘আজি শুভ দিন, হয়েছে রঙিন / মাখব যে ধরার ধূলা, হৃদয়েতে আজ শুধু দেয় দোলা’ কিংবা ‘মাঠে মাঠে রঙিন ফুলের স্বর্গ হয়েছে / প্রভু জিশু মোদের ঘরে নেমে এসেছে / আকাশে ফুটল ওই তারার মালা / জিশু জন্ম নিয়েছে, জিশু ফিরে এসেছে’!

কলকাতার ঠাকুরপুকুরের ইস্কুলে লেখাপড়া শেখা সোমার ঝুলিতে নতুন-পুরনো জিশুসঙ্গীতের ভাঁড়ার। বাংলা গানের বইয়ে ছাপা কিছু গান উনিশ শতকে বাঁধা হয়েছিল। কিছু গান নতুন। নেট মারফত শুনে নিজে তুলে গির্জার গানের দলের ছেলে মেয়েদের শিখিয়েছেন সোমা। ডুয়ার্স, কালিম্পঙে নেপালি ভাষা বা জনজাতিদের সাদ্রি ভাষা ঢুকে পড়েছে শতাব্দী-প্রাচীন সব গির্জার সার্ভিসে। ঠিক তেমনই দক্ষিণবঙ্গের গির্জায় বাংলা ভাষা ছাড়া বড়দিন, বড়দিন মনে হবে না। ২৪ ডিসেম্বর পাথরপ্রতিমা, গোসাবা ব্লকের নানা গ্রামে কনকনে ঠান্ডায় ঈশ্বরপুত্রের আবাহন অনুষ্ঠানের জন্য মধ্য রাত অবধি অপেক্ষা করা মুশকিল। রাত আটটার মধ্যেই গির্জাপর্ব শেষ। চাদর, জ্যাকেট, মাফলারে সর্বাঙ্গ মুড়ে বাড়ি-বাড়ি জিশুর জন্মের গান শোনাতে ছুটবেন গাইয়েরা। ফিরতে ফিরতে ভোর রাত।

পরম কারুণিক ঈশ্বরপুত্রকে নিয়ে এমন আবেগ বাংলার মাটিতে ধর্মের সঙ্কীর্ণতা ভাঙারই হাতিয়ার। নদিয়ার চাপড়ার কাছে নবীননগরে একবার বড়দিনের কাছেপিঠেই রটে গেল রোম্যান ক্যাথলিকদের গুহায় ক্রুশবিদ্ধ জিশুর পা দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। তা চাক্ষুষ করতেও ধর্ম নির্বিশেষে হাজারো লোকের ভিড়। রহস্য রহস্যই থাকে। জাগ্রত মন্দির বা পিরের মাজারের মতো জিশুবাবার মহিমার ঠাঁইটিও বাঙালির মনে সযত্নে রক্ষিত। কয়েক দশক আগে পুজোসংখ্যার এক ছোটদের উপন্যাসে সাঁওতাল পরগনার কোনও অখ্যাত জনপদের পটভূমিতে ধার্মিক খ্রিস্টান পাগলাসাহেবের গল্প শুনিয়েছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সাহেবের গলার রত্নখচিত ক্রুশ ঘিরে লোভ ছিল দুষ্কৃতীদের।

খুন হয়েছিলেন সবার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া পরোপকারী মানুষটি। মৃত্যুর পরও গোপন কবর থেকে বেরিয়ে সাহেব অন্যায়ের মোকাবিলা করেন, বিপন্নদের প্রাণ বাঁচান। অসহায় মানুষের জন্য এমন আত্মবলি সব ধর্মের মানুষের কাছে জিশুর আদর্শ। নিষ্পাপ এক কিশোরই হঠাৎ পাগলাসাহেবের কবরটি খুঁজে পাবে। ‘মধুসূদনদাদা’কে সমর্পিত সরল ভক্তির নিবেদনে একটি ছোট ছেলের ভাঁড়ে দই অফুরান হওয়ার গল্প সবার জানা। পাগলাসাহেবের গল্পও জিশুকে ঘিরে একই ধাঁচের বিশ্বাসের ভাষা মেলে ধরে।

গোসাবা দ্বীপ পাস্টরেট বা পালকীয় অঞ্চলের গির্জাগুলির তরুণ পাদ্রিবাবু জন বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় বুঝেছেন, গির্জায় বড়দিনের আসর নিছকই খ্রিস্টানদের নয়। হিন্দু বা মুসলিমদের জিশুপ্রীতি কখনও খ্রিস্টানদেরও ছাপিয়ে যায়। বাংলাদেশ সীমান্ত-ঘেঁষা নদিয়ার শিকারপুর এবং তাহেরপুরের পরে এই বড়দিনেই প্রথমবার গোসাবায় উপাসনা পরিচালনার ভার নিয়েছেন জন। বিশ শতকের গোড়ায় ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন সাহেবের গড়ে তোলা জনপদের সর্বত্র প্রাচীন খ্রিস্টীয় অনুষঙ্গ। খেজুর গাছে ঘেরা পাড়াগেঁয়ে মাঠে বা পুকুরধারে সাধু মার্ক, সাধু থোমার গির্জা শান্তির নীড়। হ্যামিল্টন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি জড়ানো সাধু আন্দ্রীয়র (অ্যান্ড্রু) গির্জাঘর সবচেয়ে পুরনো। দুঃখী মানুষের পরম বন্ধু জিশুর কথা বলতে পাদ্রিবাবুর গলা সেখানে থমথম করে।

বছর তিনেক আগে বড়দিনে কলকাতার সন্ত পলের ক্যাথিড্রালে উদ্বাস্তু জিশুর ব্যথা মনে করিয়েছিলেন বিশপ পরিতোষ ক্যানিং। রাজা হেরোদের ভয়ে সন্ত্রস্ত মা মেরি ও জোসেফ দেবশিশুটির জন্মের পরই বেথলেহেম থেকে মিশরে পালিয়ে যান। নবজাতক জিশুও তখন দেশহীন, পরিচয়হীন একটি শিশু। এ দেশে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদে উত্তাল সেই শীতে বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল বড়দিনের বচ্ছরকার জন্মকাহিনি স্মরণ-পার্বণ। সুন্দরবনের প্রান্তিক সব দ্বীপে বারো আনাই মেদিনীপুর কিংবা পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তু। অজস্র অকিঞ্চিৎকর জীবনের কাহিনি মিলে যায় জিশুর জীবনের সঙ্গেই।

এই সময়টা খেশ্চান-ঘরে খাটের নীচে তোরঙ্গের ধুলো ঝেড়ে কেষ্টনগরের পুতুল বের করারও সময়। পুতুল গরু, ঘোড়া, লাঠিধারী রাখাল, আলখাল্লাধারী পণ্ডিতগণ, জোসেফ, মা মারিয়া এবং বিরাট পদ্মপাতার মতো গামলায় শায়িত শিশু জিশুকে সাজান মহীতোষবাবুর বৌমা ভবানী বা সোমারা। খড়, কাগজে নিজেদের ঘরেই ছোট্ট গোশালা গড়তে গড়তে সোমা বলেন, “ঠিক ঝুলনের পুতুলের মতো লাগছে দেখুন!” তাঁর মনে চিন্তার ভাঁজ ঘুরপাক খায়। কী ভাবে, কোন পথে জীবনের স্রোতে ভেসে শিশুকোলে জোসেফ, মারিয়ার মতো এই বানভাসি দ্বীপে এসে পড়েছিলেন তাঁদের দাদু-দিদারা।

মহীতোষবাবুর ঠাকুরদা না কি বামুন ছিলেন। হেমচরণ ভট্টাচার্য। তাঁর ভাইরা পুজোআচ্চা নিয়ে থাকলেও তিনি নৌকো চালাতেন। কোনও এক দাঙ্গাহাঙ্গামার দিনে বোট চালিয়েই মেদিনীপুর থেকে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা এই দ্বীপে হাজির হলেন। বিপদের দিনে হয়তো কোনও গির্জাঘরেই আশ্রয় নিয়েছিলেন হেমচরণ। তাতেই জীবন পাল্টে যায়। নৌকো চালানোর সুবাদেই তাঁদের পদবিটিও মাঝি হয়ে যায়। ক্যাথলিক কমলেন্দু পেরেরা আবার বলেন, “আমরা কিন্তু আদি খ্রিস্টান। এখন রং দেখলে বুঝবেন না, তবে শিরায় খাঁটি পর্তুগিজেরই রক্ত!” কমলেন্দুর ঠাকুরদা জোসেফও মেদিনীপুরের গাঁওয়াখালি থেকে সুন্দরবনে আসেন। এ দ্বীপে কয়েক ঘর পেরেরা, তেরেজা বা পেরেসা ছাড়া বাকি খ্রিস্টানরা কয়েক পুরুষ আগে হিন্দু বা মুসলিম ছিলেন। তবে কমলেন্দুর মা হিন্দু ঘরের মেয়ে।

জাতধর্ম কোষ্ঠী মিলিয়ে বিয়ের সংস্কৃতি অনেকটাই আলগা এই সব প্রান্তিক এলাকায়। আবার বিয়ের পরেও নানা ধর্ম জট পাকিয়ে থাকে জীবনে। ধর্ম নিয়ে খোঁচাখুঁচির রাজনৈতিক দিনকালেও কয়েক পুরুষের খ্রিস্টান-ঘরে বৌমানুষে শাঁখা, সিঁদুরের অভ্যেস জারি রেখে দেন। সোমা, ভবানীরা হিন্দু গৃহিণীদের মতোই নিয়মিত শোওয়ার ঘরের অল্টারে জিশুবাবা বা ক্রুশকাঠের সামনে ধুপ জ্বেলে সন্ধ্যা দেবেন।

ঝড়খালির তৃপ্তিই বিয়ের আগে হিন্দুকন্যা ছিলেন। খ্রিস্টান স্বামী, শ্বশুরকুল তাঁকে দেখে বিয়ের জন্য পছন্দ করলেন। তৃপ্তির বাড়ির লোকেরও অমত ছিল না। সে বিয়েটা গির্জার বাইরে এক সহকারী পুরোহিত দিয়েছিলেন। তৃপ্তি তখনও মনে, মনে প্রার্থনার সময়ে কালী, মহাদেব বা শীতলাকেই ডাকেন। জিশু বা মারিয়ার কল্পনা তাঁর মাথায় ঢোকে না। পরে কোনও এক অসুখের ঘোরে জিশুর বই পড়তে পড়তে জিশুকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসে ফেলা। পরে এক বার ফের বরের সঙ্গে গির্জায় গিয়ে ফাদারের আশীর্বাদ নিতে হয়েছিল। ততদিনে তৃপ্তি দুই বাচ্চার মা। মেয়ে ছ’বছরের! অত বড় মেয়ে পাছে মা-বাপের বিয়ে দেখছি ভাবে, ওকে বাড়িতেই রেখে যান। কোলের ছেলেটাকে নিয়ে গির্জায় যাওয়ার সময়ে মাথার সিঁদুর ছাড়া গেলেও প্রাণ ধরে শাঁখা খুলতে পারেননি তৃপ্তি।

এমনিতে বাঙালি খ্রিস্টান বিয়েতে পাদ্রিবাবু নিজে এসে বরের বাড়িতে গায়ে-হলুদের সার্ভিস করেন। বিয়েতে মালাবদল, সিঁদুরদান থেকে সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন হওয়া চাই। প্রবীণ মহীতোষ বলেন, “একটু পায়েস খেয়ে অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণে আপত্তি কোথায়! তবে আমি বলি, মা-শিশুর পুষ্টির আগে ব্যবস্থা হোক। তার পরে লোক খাওয়ানো।”

বড়দিনের কেক ব্যাপারটাও নিজের বোনেদের আমতলায় বিয়ে হওয়া ইস্তক দেখেননি মহীতোষ। বড়দিন মানে এই সেদিন পর্যন্ত পুলিপিঠে, পাকনপিঠে, নতুন গুড়ের পায়েসই বুঝতেন। পাথরপ্রতিমা, গোসাবার দোকানেও আজকাল কলকাতা কি কাকদ্বীপের কেকের ছড়াছড়ি। তবে গ্রামে খ্রিস্টান-বাড়িতেও কেক তৈরির চল নেই। যদিও নিমকির মতো রোজকুক (রোজকুকি) ভাজা হবে। গোলাপ পাপড়ির মতো খাস্তা ভাজার স্টিলের ফ্রেম ঘরে ঘরে রয়েছে। মেয়ে-বৌরা সুজি, ময়দা, নারকেলের দুধ মেখে ছাঁকা তেলে লালচে কড়া ভাজা মুচমুচে গোলাপপাপড়ি ফুটিয়ে তোলেন। মহীতোষের অকালপ্রয়াত ভাই ঈশতোষের ছেলে বারুইপুরের স্কুলমাস্টার সৌরভ বড়দিনে তাঁর কলেজের বাংলার মাস্টারমশাই দীনেশকুমার খান, মকবুল ইসলামদের গ্রাম দেখাতে এনেছিলেন। ধুনচির জঙ্গল লাগোয়া নদীতে পিকনিক করতে গিয়ে বোটে বসে মুচমুচে রোজকুকির স্বাদে সক্কলে খুশি!

প্রার্থনাঘর: সাধু থোমাস চার্চ, পাখীরালা।

প্রার্থনাঘর: সাধু থোমাস চার্চ, পাখীরালা।

রাতভর জেগে বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে ক্লান্তিতে বড়দিনের সকালটা কোনওমতে রান্না সারেন সোমা। তাঁর তখনও সাততাড়াতাড়ি গান গাইতে গির্জাঘরে ঢোকার তাড়া! পরের বার বড়দিনে কে থাকবে না থাকবে ঠিক নেই। তাই রান্নার আড়ম্বর রাতেই হবে। পরম বন্ধু আবু মল্লিক, খাদেম শেখরা বড়দিনের সন্ধ্যায় আসবেনই মহীতোষবাবুর বাড়িতেও। সকালে লুচি, দেশি মুরগি, রাতে বিরিয়ানিতেই খুশির বান ডাকবে।

গোসাবার খ্রিস্টীয় মহোৎসব এখনও হ্যামিলটন সাহেবের ট্রাস্টের টাকায় হয়। দক্ষিণবঙ্গের নানা এলাকার জিশুমেলায় স্থানীয় পঞ্চায়েত বা প্রশাসনেরও সক্রিয় উপস্থিতি। সাবেক কলকাতায় নাচা, গানা, খানা, পিনায় ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার কাটাতে একদা খোদ বড়লাট থেকে তামাম দেশীয় রাজারাজড়ার হাট বসত। এই একুশ শতকে সেই শহর থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরেই এক অন্য জগৎ। নদিয়ার চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলায় নামের পাশে ‘বোম্বে’ লেখা গাইয়ে বা টিভি চ্যানেলের পাপ্পু সিংহ, রণশ্রী, তন্ময়দের দেখা মিলবে। মেদিনীপুরের যাত্রাপার্টি ছাড়া সুন্দরবনের বড়দিন পানসে। মহীতোষ, কমলেন্দুবাবুরা মেলায় কলকাতার যাত্রাপার্টির খরচ কুলোতে পারেন না। এ বার রাক্ষসখালি মাতাবে মুক্তবীণা অপেরার ‘বিদ্রোহিণী পুত্রবধূ’। জিশুর পালাকীর্তনে ক্যানিংয়ের তৃপ্তি মাখাল, গাজনে বৈদ্যপুরের পরমেশ্বর গাঙ্গুলির দল। কমলেন্দু বলেন, “গাজনের রঙ্গরসে মেয়েরা একটু অস্বস্তিতে পড়েন। তাই মেয়ের পার্ট এখনও ছেলেরা করাই দস্তুর। মজা, হাসির মোড়কে ওরা কিন্তু পরিবারকে এক রাখা বা করোনা সচেতনতার কাজও করেন!”

রাক্ষসখালির ছেলে সৌরভ এখন বারুইপুরের এক গির্জার সেক্রেটারি। বলেন, “মায়ের শরীর খারাপ, যখন তখন রক্ত লাগে! তাই ইচ্ছে থাকলেও দু’দু’টো নদীর ও পারে নিজের গ্রামে থাকার সাহস হয় না।” মহীতোষের অপেক্ষা, বড়দিনের মেলায় আমতলা থেকে দুই বোন ঠিক একবার আসবে। তখনই একটু কেকের স্বাদ জুটবে। বছরশেষের মদির রাতে যখন কলকাতা তন্দ্রাহারা তখন নিঃসাড়ে ঘুমিয়েই নতুন বছরকে আহ্বান জানাবেন প্রান্তিক দ্বীপবাসীরা। পয়লা জানুয়ারি গির্জায় খ্রিস্টানদের শস্য উৎসব। ডায়োসিস বা ধর্ম প্রদেশের জন্য সাধ্যমতো সঞ্চয়ের ছিটে জড়ো হয়। আর দুরাশায় বুক বাঁধা— জিশুবাবা দেখো... ঝড়ঝঞ্ঝার দিনকালে দুঃখী দ্বীপের সংসারটুকু অটুট রেখো, আরও একটা বছর…

অন্য বিষয়গুলি:

christmas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy