Advertisement
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজনৈতিক স্বার্থেই কি এমন বিভাজনের চেষ্টা?
Assam

দুই রাজ্যে লড়াই

উত্তর-পূর্বের অসম ও মিজোরাম। দুই অঞ্চলের পুলিশের মধ্যে হয়ে গেল বুলেটযুদ্ধ। হিন্দু-মুসলমান-রিয়াং-চাকমা মিলেমিশে ছিলেন, হঠাৎই সেখানে ছড়ানো হল ভুল ধারণা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২১ ০৭:৩৬
Share: Save:

রিন্টু চাকমার মোমোর দোকানের ব্র্যান্ডলাইন অনায়াসে হতে পারে, ‘ভাল মোমোর একটাই ঠিকানা— ঋষিতা মোমো। আমাদের কোনও শাখা নেই।’ ১০ কিলোমিটার দূর থেকেও মানুষ এই দোকানে আসেন মোমো খেতে। ঋষিতা মোমো হাউসের মোমো খেয়ে ধন্য ধন্য করেছেন আমেরিকা, তাইল্যান্ড, আফ্রিকা, আফগানিস্তান, জাপান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা-সহ বহু দেশের সেনা-কম্যান্ডোরা! কারণ অদূরেই সেনাবাহিনীর বিখ্যাত ভাইরেংতে গেরিলা-যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শিবির। কমন সার্ভিস সেন্টার, প্যান কার্ড তৈরির ব্যবসা করতে করতেই ছ’বছর আগে কপাল ঠুকে মেয়ের নামে মোমোর দোকান খুলেছিলেন রিন্টু। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আর্মি ক্যাম্পে রোজকার অর্ডার বাঁধা। সীমানার ও পারে মিজোদের মধ্যেও ঋষিতা মোমো সুপারহিট। মোমোর পর পিৎজ়া, পাস্তা, লস্যি, চাট... একে একে মেনুর বাহার বেড়েছে। কিন্তু ২৬ জুলাই যেন সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। যে বাইকে পৌঁছে দিতেন মোমোর অর্ডার, সেই বাইকে চাপিয়েই হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হচ্ছিল জখম হওয়া একের পর এক পুলিশ জওয়ানকে। রক্তে ভিজে যাচ্ছিল জামা। দোকান তিনি খুলেই রেখেছেন। কিন্তু খদ্দের কই!

ধলাখালের প্রবীণ ব্যবসায়ী পি সোমাইওয়া জাতিতে মিজো। ঠিকানায় অসমিয়া। ছোটবেলায় হাতেখড়ি অ-আ-ক-খ পড়ে। অনায়াসে বাংলা ব্যাকরণ, সহজপাঠ-এর ধাপ পেরিয়েছেন। এখনও বাংলা বলেন ঝরঝরে। হবে না-ই বা কেন। কাছাড় ও লুসাই পাহাড়ের সীমানায় প্রথম যে স্কুল তৈরি হয়, তা তো বাংলা মিডিয়াম। সোমাইওয়া জানান, সত্তরের দশকের আগে যেমন মিজোরাম বলে আলাদা রাজ্য ছিল না, তেমনই মিজোরামের সঙ্গে কাছাড়ের এ পারের মিজোদের সরাসরি যোগাযোগ তৈরিও হয়েছে সবে ২০০৩ সালে! সীমানার জমি নিয়ে ঝামেলা ছিল বরাবর। কিন্তু ২৬ জুলাই এই এলাকা যে অশান্তি দেখল, তা হয়তো বাঙালি ও মিজোদের মধ্যে পাকাপাকি দেওয়াল তুলে দিল। সোমাইওয়া সে দিনের পর থেকে বাঙালি বন্ধুদের ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ভয়ে, লজ্জায় না রাগে— নিজের কাছেই উত্তর নেই।

গত বছর অক্টোবরে প্রথম বার লায়লাপুরে সীমানা-বিবাদ হিংস্র চেহারা নিয়েছিল। সীমানার এ পারে বহু বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছিল। ২৬ জুলাইয়ের ঘটনার পরে কারা যেন রটিয়ে দিল, মুসলিম মানেই বাংলাদেশি দখলদার! তার পর ১ অগস্ট রাতে আগুনের লক্ষ্য হলেন তাঁরা। মশালধারীরাও নির্বিচারে আগুন লাগিয়ে দিলেন!

বাঘা বাজারের হুসেন মজুমদার বাড়ির এক সদস্য বলছিলেন, তাঁরা শতাধিক বছরের বাসিন্দা। ঠাকুরদা সাজিদ রাজা মজুমদার জেল-খাটা বিপ্লবী। ঠাকুরদাকে জেল থেকে ছাড়াতে যে পরিমাণ বিষয়-সম্পত্তি বেচে ইংরেজ পুলিশকে টাকা দিতে হয়েছে, তার মূল্য এখনকার হিসেবে কোটি টাকার উপরে।

লায়লাপুরের চৌহানটিলার বাসিন্দা সানি চৌহানের পূর্বপুরুষ ভাইরেংতে-র খাদ্যপণ্য গুদামে মজুরি করতে বহু আগে উত্তর ভারত থেকে এসেছিলেন। লায়লাপুরে এখনও তাঁদের বেশ কিছু পরিবার বর্তমান। রিন্টু, সোমাইওয়া, মজুমদার পরিবার, চৌহানবস্তির লোকজন এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মণিপুরি, হিন্দুস্তানি (হিন্দিভাষীদের প্রচলিত ডাকনাম), আদিবাসী, নাগা, রিয়াং, বর্মণ, চাকমা আর অবশ্যই সিঙ্গুয়া-শ্যামাচরণপুরের একদা শরণার্থী হিন্দু পরিবারগুলো— সহাবস্থানের অন্য নামই তো লায়লাপুর!

সেখানকার মানুষ ভাবতেও পারেননি সাধের ও সম্প্রীতির লায়লাপুর স্বাধীন ভারতে প্রথম বার রাজ্য বনাম রাজ্যের এমন বিদ্বেষের সাক্ষী হিসেবে ইতিহাসে নাম তুলবে। অবশ্য আঁচ মিলেছিল গত বছরের হাঙ্গামা-হাতাহাতি-বিস্ফোরণের পরেই। কাছাড় প্রশাসনের তৈরি দু’টি স্কুলই রহস্যজনক বিস্ফোরণে উড়ে যায় গত অক্টোবরে। সীমানায় মোতায়েন দু’পারের সশস্ত্র বাহিনী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে সেই প্রথম খুচরো ঝগড়া গুরুতর হাতাহাতির চেহারা নেয়। মাসখানেক বন্ধ ছিল যান চলাচল।

বাঘার বাসিন্দা রুবুল লস্কর জানাচ্ছিলেন, “আমাদের সঙ্গে মিজোদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেন হিন্দুস্তানি, নেপালি, বর্মণ, মণিপুরি, মুসলিম, চাকমা, হিন্দু। ধলাইতে ডার্বি, এলেনপুর, পালৈ, ভুবনডোর, রুকনি চা-বাগানে কাজ করতে আসা আদিবাসী শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক। মিজোরা ভাল করেই জানেন, এখানকার কেউ বাংলাদেশি নন।” কিন্তু ছবিটা বদলে গেল অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে। অসমের অন্য অংশে যেমন সংখ্যালঘু হলেই বাংলাদেশি বলে দাগানো হচ্ছে, ঠিক তেমনই মিজোদের মনেও ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সমতলের সংখ্যালঘুরা অসমে তাড়া খেয়ে মিজোরামের জমি দখল করতে আসছেন।

স্থানীয় এক ব্যাঙ্ক-কর্মী এর পিছনে অন্য রাজনীতি দেখছেন। তাঁর মতে, মিজোরা সত্যিই সরল। ওঁদের ভুল পথে চালিত করা হচ্ছে। হঠাৎ করেই লায়লাপুরের মানুষদের ‘বাংলাদেশি’ বলার চিত্রনাট্য শুনে বোঝা যাচ্ছে তা লিখে পাঠানো হয়েছে সীমানার এ পার থেকেই। ২৬ জুলাই গুলি বিনিময়ের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এলাকার মুসলিমরা কোনও মন্তব্য করলেই মিজোরামের দিক থেকে পাল্টা কমেন্টে লেখা আসছে, ‘গো ব্যাক টু বাংলাদেশ।’ এলাকায় ৫৫ হাজার মুসলিম। হিন্দু ৭৫ হাজার। বর্মণ ও রিয়াং-চাকমার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। হিন্দুস্তানিও ৫০ হাজারের উপরে। কোনও জায়গায় এত জনজাতি, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু মিলেমিশে থাকাটা হয়তো রাজনৈতিক স্বার্থেই লাভজনক নয়।
কিন্তু বিভাজনের রাজনীতি কখন যে বুমেরাং
হয়, বোঝা শক্ত।

বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য মিজোরাম সরকারে ৩৭ বছর চাকরি করেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মিজোদের মানসিকতা, আবেগ। তাঁর মতে, একটা কাল্পনিক লাইন নিয়ে এত বছরের ঝগড়া জিইয়ে রাখার ফলেই আজ এই সমস্যা। ‘মি’ ‘জো’ ‘রাম’— এই শব্দবন্ধের অর্থই হল পাহাড় দেশের মানুষ। তাই ১৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অসম-মিজোরাম সীমানায় থাকা মিজোরা বংশপরম্পরায় মনে করেন, সমতল শেষ হয়ে যেখান থেকে পাহাড় শুরু, সেখান থেকেই মিজোদের এলাকাও শুরু হয়। ১৮৭৫ সালে, তদনীন্তন লুসাই হিলে, বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন অ্যাক্ট (১৮৭৩)-এর আওতার সীমানায় থাকা ৫০৯ বর্গমাইল ব্যাপী সংরক্ষিত অরণ্যকে ইনার লাইন রিজ়ার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করে অসম ও লুসাই পাহাড়ের সীমানা টেনেছিল ব্রিটিশরা। মিজোদের দাবি, সেই সীমানাই খাঁটি।

অশান্ত: বাইকে তুলে জখম জওয়ানদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন রিন্টু চাকমা। মূল ছবি, সীমানার মিজোরামের দিকে প্রহরায় পুলিশ ও গ্রামবাসীরা।

অশান্ত: বাইকে তুলে জখম জওয়ানদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন রিন্টু চাকমা। মূল ছবি, সীমানার মিজোরামের দিকে প্রহরায় পুলিশ ও গ্রামবাসীরা।

১৯৮৭ সালে মিজোরাম পৃথক রাজ্য হল। র‌্যাডক্লিফ বা ম্যাকমোহন ব্রিটিশ আমলে দেশের সীমানা টানতে গিয়ে যে অনাসৃষ্টি ঘটিয়েছিলেন, স্বাধীন ভারতে অবিভক্ত অসমকে দফায় দফায় টুকরো করার সময় দিল্লির আমলারাও সেই একই পথের পথিক। ফলে ব্রিটিশ আমলে যেমন বাঙালির দাদাগিরি নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিল এখানকার মানুষ, এখন তেমনই অসমের দাদাগিরি মানতে নারাজ পড়শিরা। তাই আঞ্চলিকতাবাদ, হীনম্মন্যতা ও আধিপত্য বিস্তারের ত্র্যহস্পর্শে জ্বলছে আগুন। ১৯৯৪ থেকে শুরু হল সীমানার এলাকা দখল নিয়ে দুই পারের চাপানউতোর। কিন্তু তখন মিজোরাম, অসম ও কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার, সব সমস্যা চাপা পড়ে যায়।

অসমের জখম পুলিশ জওয়ান গোপীকান্ত সিংহ বা সরাফত আলি লস্কররা বুঝতেই পারছেন না কোথা থেকে কী হয়ে গেল! তাঁরা বলছেন, “মিজোরামের পুলিশ ও অসমের পুলিশের মধ্যে সীমানা এলাকায় ‘ভাইচারা’-র সম্পর্ক। তাঁরা যে অসমের এসপি-র কাতর মিনতি অগ্রাহ্য করে এভাবে লাইট মেশিনগান থেকে গুলি চালাবেন, তা সত্যিই অকল্পনীয়।”

বিশ্বনাথবাবুর মতে, “মিজোরা যোদ্ধা জাতি। আগ্নেয়াস্ত্র তাদেরও আছে। কিন্তু ওরা আগ বাড়িয়ে মারামারি করে না। দাদাগিরি অসমই দেখিয়েছে। যেভাবে সাঁজোয়া গাড়ি, পুলিশ কনভয় নিয়ে মিজোরামের পোস্ট দখলের চেষ্টা চালিয়েছিল অসম, তার ফলেই দুই রাজ্যের সীমানা যুযুধান চেহারা নিয়েছে। মিজোদের চিরকালের আক্ষেপ— তাঁরা সমতলের মানুষের হাতে বঞ্চিত, প্রতারিত। যোদ্ধা জাতি দীর্ঘদিনের হীনম্মন্যতা পুষে রাখলে এক দিন পাল্টা বিস্ফোরণ হবেই।”

কিন্তু মিজোদের আক্রমণের সামনে অসম পুলিশ এতটা অসহায় হয়ে পড়ল কেন? ধলাই থানার এক অফিসার বলেন, “ভুললে চলবে না, মিজোরাও অনেক দিন থেকেই নিজেদের তৈরি করছিলেন। ওঁরা ছিলেন উপরের দিকে সুবিধাজনক স্থানে। মিজো-পুলিশের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ অসমের তুলনায় অনেক উন্নত। সেই সঙ্গে মিজো-পুলিশের হাতে রয়েছে এমপি-৫ সাব মেশিনগান, এম-৪ কার্বাইনের মতো উন্নত জার্মান ও মার্কিন আগ্নেয়াস্ত্র। তাই বহরে বড় হলেও অসম পুলিশ দক্ষতা ও অস্ত্রের জোরে পিছনে পড়ে যায়।”

এ পারে মূলত খুলিচরা, ফাইনুম, ধলাখাল ও বোরছে গ্রামে মিজো বসতি। সেখানকার মিজোদের সঙ্গে কথা বললে অবাক হতে হয়। তাঁরা নিজেদের এক দিকে ভূমিপুত্র মিজো হিসেবে গর্ব করেন, অন্য দিকে অসমের বাসিন্দা হওয়ার সুবিধে পান। মিজো গ্রামের বাসিন্দাদের রেশন আসে অসম থেকে, রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে অসম। বিদ্যুৎ ও জলের লাইন দিয়েছে মিজোরাম। শুধু তাই নয়, অসমের ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও মিজোরামও ভোটার কার্ড দিয়েছে সেখানকার মানুষকে। দু’দিকেই ভোট দেন তাঁরা। ব্যতিক্রম এ বারের বিধানসভা নির্বাচন। গত অক্টোবর থেকে হওয়া গন্ডগোলের জেরে ভোটার কার্ডে নাম থাকা সত্ত্বেও মিজোরা এ বার অসমে ভোট দিতে আসেননি।

ধলাই থানার ওই অফিসার জানান, “গত বছর অক্টোবরে মিজোরা ও পার থেকে এসে অসমের ভিতরে সাড়ে ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়েন। পুলিশ-প্রশাসন ঠেকাতে গেলে মহিলা বাহিনী এগিয়ে যায়। খুলিচরায় তখন থেকেই মিজোরা জোর করে অসমের জমি দখল করে রেখেছেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমাও ছোড়া হয়েছিল। উড়িয়ে দেওয়া হয় স্কুলবাড়ি। তার পর থেকেই মিজোরা অসমের রাজস্ব এলাকায় থাকা জমিতে নতুন করে গ্রাম তৈরি করে ফেলেন। মিজোরামের দিকে সীমানা পর্যন্ত ভাল রাস্তা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই এখানকার সংরক্ষিত অরণ্যে ঝুমচাষ করছেন মিজোরা। তৈরি করেছেন ঝাড়ুবাগান, সুপুরিবাগান।”

লায়লাপুর বনাঞ্চলের বিট অফিস সূত্রে খবর, সাম্প্রতিক ঝামেলার মধ্যেই মিজোরা রেংতি পাহাড়ে জঙ্গলের মধ্যে গাছ কেটে বিস্তীর্ণ জমি তৈরি করে ফেলেছেন। অভিযোগ উঠছে, তাদের জমি-জঙ্গল দখলে নাকি ভেঙে যাচ্ছে মিজোরাম, হাইলাকান্দি, কাছাড়ের নির্ধারিত সীমানা।

পাইনুম, আপার পাইনুম, ধলাখালে মিজো দোকান বেশি। সেখানকার মিজো বস্তির পুরনো, বাংলা বলা মিজো-বাসিন্দারা নিজেদের এখনও অসমিয়া মনে করেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম অসমের পরিচয় মুছে ফেলেছে। গত বছর লকডাউনের সময় লায়লাপুরের রেশন ডিলার রেশন নিয়ে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু অসমের রেশন ফিরিয়ে দেন মিজোরা।

এ দিকে হাওইতাং সংরক্ষিত অরণ্য এলাকায় থাকা বর্মণরা ফরেস্ট ভিলেজার। তাঁরা রাজস্ব দেন বন দফতরকে। অসম ও মিজোরাম সরকারের যা মনোভাব অনুমান করা যাচ্ছে, তাতে নতুন সীমানারেখা টানা হলে বর্মণদের উৎখাত হতে হবে। রফা প্রস্তাবে যদি বলা হয়, যে যেখানে রয়েছে সেই স্থিতাবস্থাই মেনে নেওয়া হবে, তা হলে অন্তত ৫ হাজার বাঙালি, বর্মণ, নেপালি, হিন্দুস্তানি পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে অসম সরকারকে।

আবার মিজোরাম সীমানার পাহাড়গুলোয় রিয়াং জনজাতিদের সংখ্যাও কম নয়। রিয়াংদের সঙ্গে মিজোদের ঝামেলা অনেক দিনের। ১৯৯৮ সালে হাইলাকান্দিতে থাকা রিয়াং গ্রাম, গুটগুটি ও রাইফেলমারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল মিজো দুষ্কৃতীরা। রিয়াংরা নিজেদের অসমিয়া বলে দাবি করলেও ঝুমচাষ করলে কর দিতে হয় মিজোদের। তাঁদের ক্ষোভ, সেই করও মিজোরা বাড়িয়ে দিয়েছেন।

ঘটনার পর অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ মিজোরামের জীবনরেখা ৩০৬ নম্বর জাতীয় সড়কে। লায়লাপুরে পুলিশ পয়েন্টের ও দিকে ডাক্তার দেখাতে, বাজারেও যেতে পারছেন না কেউ। ট্রাকচালক সংগঠনের লায়লাপুরের সভাপতি সামসুদ্দিন মজুমদার বলেন, “কেউ ধর্মঘট ডাকেনি। প্রাণ বা গাড়ির ক্ষতির ভয়েই এ পার থেকে ও দিকে যাচ্ছে না গাড়ি।”

এ তো গেল এ পারের ছবি। কী বলছেন ও পারের মানুষেরা?

ভাইরেংতে বাজারে ব্যবসা করা লালডিঙা উগরে দেন ক্ষোভ। বলেন, “৫০ টাকার আনাজ ৮০ টাকা-১০০ টাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু অসম রাস্তা বন্ধ রাখলেও ভিক্ষে করে খাব না আর। দরকারে চাল আর ব্যাম্বু শুট খেয়ে দিন কাটাব। কেন্দ্র ব্যবস্থা না করলে সাহায্য চাইব মায়ানমার, বাংলাদেশের কাছে। কিন্তু দাদাগিরি দেখিয়ে, ভাতে মারার চেষ্টা করে আর মিজোদের দমিয়ে রাখা চলবে না।”

মিজোরাম কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাসোসিয়েশন-এর সহ-সভাপতি ভানথাংপুইয়া-র বক্তব্য, “খাবার না এলেও ওষুধ, ইঞ্জেকশন, অ্যান্টিবায়োটিক, করোনার টিকা ও পরীক্ষার কিট আটকে রয়েছে। রাজ্যে করোনা পজ়িটিভিটির হার ১০ শতাংশের বেশি। অসম মিজোদের শুধু ভাতে মারাই নয়, বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারও ছিনিয়ে নিয়ে সন্ধিতে বাধ্য করছে।”

মিজোরামের এমএনএফ বিধায়ক লালরিনলুয়াঙ্গা সাইলোর দাবি, তাঁর রাজ্য অসমের প্রতি শত্রুমনোভাবাপন্ন নয়। সব ঝামেলার জন্য দায়ী অনুপ্রবেশকারী বাসিন্দারা। তাঁর অভিযোগ, লায়লাপুরের দিকের গ্রামগুলিতে থাকা বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশই অবৈধ বাংলাদেশি। যারা অসমে ভিত মজবুত করে এখন মিজোরামে ঢুকতে চেষ্টা করছে।

মিজো সংগঠনগুলি এ জন্য অসম সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলছে। তাদের দাবি, সীমানার গ্রামে ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর জন্য অসমের কংগ্রেস ও বিজেপি সরকার অবৈধ বাংলাদেশিদের গ্রাম তৈরির অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছে। তাদের সামনে রেখেই, মিজোরামের ভিতরে প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত জবরদখল করেছে অসম।

তার উপরে বিজেপি সিএএ আনায়, গো-সংরক্ষণের নামে গো-মাংসে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর চেষ্টা চলে। হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার শুরু হয়। এ সবের প্রতিবাদে খ্রিস্টান রাজ্য মিজোরাম নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর বিরুদ্ধে আইজলের রাস্তায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিরাট মিছিল বের করে।

স্থানীয় বাসিন্দা ভানলাল রুয়ানা, লালানপুইয়াদের অভিমান, “আমাদের প্রতি অসমের মানুষজন কখনও সম্মান দেখায়নি। আগেও অসমের পুলিশ আমাদের ঝাড়ু বাগান, সুপুরিবাগান সাফ করে দিয়েছে। মহিলাদের গায়ে হাত তুলেছে। তবুও আমরা নিজে থেকে ঝামেলা করিনি। ওরা বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে চড়াও হয়ে এলাকা দখল করতে গিয়েছিল। বাড়িতে ডাকাত পড়লে রুখে দাঁড়াতেই হবে। আমরা সেটাই করেছি।”

(অনেকের নাম প্রকাশ করা হল, কয়েক জনের নাম ব্যক্তিগত নিরাপত্তার খাতিরে বদলে দেওয়া হয়েছে)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam Assam-Mizoram Border Dispute
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy