চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো, আরেকটু থাকতাম’— লাইনগুলো ভাস্কর চক্রবর্তীর। তাঁর চলে যাওয়ার কয়েক বছর আগে লেখা। প্রকাশের জন্য দিয়েছিলেন ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার জীবনানন্দ সংখ্যায়, ২০০১ সালে। কেন যে সে বার তাঁর লেখা আমরা চাইনি, কারণটা এখন মনে নেই। ওই সংখ্যার প্রস্তুতির শেষ কালে এক মধ্য-দুপুরে কফি হাউসে প্রুফ দেখতে দেখতে এক টেবিলে তাঁকে একা পেয়ে বলি, ‘‘দেখছি এক পৃষ্ঠার কবিতা কম পড়ছে। কী দেওয়া যায় বলুন তো?’’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘এখনই চাই? কয়েকটা টুকরো দেব?’’
পরের দিনই তাঁর ‘জিরাফের ভাষা’ সিরিজ়ের চারটি টুকরো দিয়ে ওই পাতাটা ভর্তি করি। ভাস্কর তখন ওই সিরিজ়ের কবিতাগুলো লিখছেন। লেখা শুরু ১৯৯৭ থেকে। তার মধ্যেই যেন বাজতে শুরু করেছে চলে যাওয়ার ঘণ্টা।
২০০৩-এর নভেম্বরে তাঁকে আহ্বান করা হয়েছিল ‘কমলকুমার মজুমদার স্মারক বক্তৃতা’ দিতে। এক কথায় রাজি! বললেন, ‘‘আমি কিন্তু কবিতা নিয়েই বলব।’’ কবিতা নিয়ে কোথাও আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন ভাস্কর। সেই শেষ। সে দিনের বক্তব্য লিখে এনে, পাঠ করেছিলেন। লেখাটির নাম ছিল ‘পাখি সব করে রব’। অনুষ্ঠানের দিন একটু যেন অন্য রকম লাগছিল ভাস্করকে। পরনে দুধসাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। সাদা পাঞ্জাবির আড়ালে যেন নিজের চেহারা ঢাকতে চাইছেন। অন্তত সে দিন ভাস্করের সঙ্গে তোলা আমাদের একটা রঙিন ফটো তা-ই বলে। এখনও রয়েছে ছবিটা। তখন মনে হচ্ছিল, সারা জীবন অনিদ্রা, মনখারাপ, বিষণ্ণতা, অসুখের দিনলিপি লিখে যাওয়া এই কবি কি সত্যি টুপি খুলে এ বার বলবেন, ‘বিদায়, চোখের জল’!
অনেক দিন আগে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কী প্রচণ্ডভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে... ডাক্তারবাবুর কাছে গেলেই প্রার্থনা করি, মাথা থেকে, আত্মহত্যার ভয়াবহ বীজটা মুছে দেওয়ার জন্যে। সন্দীপনদা মাঝে-মধ্যে চায়ের দোকানে আসেন, এসে দেখে যান, আমি কতোটা মরেছি।’ সেই প্রথম তাঁর লেখায় পেয়েছিলাম বরানগরে একই পাড়ায় থাকা লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি ভাস্করের সরস অনুযোগ।
‘জিরাফের ভাষা’, ৪৮টি ভাস্কর-কথিত টুকরো নিয়ে প্রকাশিত হয় ২০০৫-এর জুলাইয়ে। শুনেছিলাম, এক দিন শঙ্খ ঘোষ ওই বইয়ের প্রকাশককে সঙ্গে নিয়ে যান ভাস্করের বাড়িতে। তখন তাঁর কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। ভাস্করের হাতে শঙ্খবাবু তুলে দিয়েছিলেন তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘জিরাফের ভাষা’।
২০০৫-এর ২৩ জুলাই ভাস্করের চলে যাওয়ার খবর পাই কবি উৎপলকুমার বসুর কাছ থেকে, ফোনে। কলকাতার বাইরে থাকায় শেষ দেখা হয়নি। আজও যায়নি সে আফশোস। চলে যাওয়ার আগে এক দিন ফোন করেছিলাম। তখন ওঁর গলার স্বর বন্ধ। জানতাম না। ফোনে একাই কথা বলে যাচ্ছিলাম।
এত দিন পর হঠাৎ ভাস্কর চক্রবর্তীর একটা কাটাকুটির খাতা হাতে পেয়ে দেখি তাতে সন্দীপনকে নিয়ে ভাস্করের একটি অসমাপ্ত লেখার খসড়া। লিখেছেন: ‘সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের তরুণ বয়সের এক জবর বিস্ময়। ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ আর ‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য’ কতবার যে পড়েছিলাম।’
মনে পড়ছিল সন্দীপনের কথাগুলোও। ভাস্কর তখন প্রয়াত, তাঁর সহধর্মিণী বাসবী চক্রবর্তীর উপহার দেওয়া ‘জিরাফের ভাষা’ কাব্যগ্রন্থটি সন্দীপনকে দিতে গিয়েছিলাম এক দিন। বই হাতে পেয়ে একটু উল্টেপাল্টে দেখে সন্দীপন বলেন, ‘‘আমার আগেই পড়া হয়ে গেছে। বাংলা কবিতায় ভাস্করের স্থান নিশ্চিত করেছে এ বই।’’
চোদ্দো বছর হয়ে গেল ভাস্কর চলে গিয়েছেন। নেই সন্দীপনও। এক সময় বরানগরে পাশাপাশি বাস করা এক কবি আর এক গদ্যকারের পরস্পরের লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার দৃষ্টান্ত এই ভাঙাচোরা সময়ে অবাক করে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy