Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Bhanu Bandopadhyay

বসুশ্রীর সেই আড্ডাটা

আজ আর নেই। এখানে বসেই লেখা হয়েছিল ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র চিত্রনাট্য। উত্তমকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো আড্ডাবাজরা আজ স্মৃতি। অন্যতম আড্ডাধারী, আমার বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও একশো পেরোলেন। আজ আর নেই। এখানে বসেই লেখা হয়েছিল ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র চিত্রনাট্য। উত্তমকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো আড্ডাবাজরা আজ স্মৃতি। অন্যতম আড্ডাধারী, আমার বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও একশো পেরোলেন।

নক্ষত্রমণ্ডলী: বসুশ্রী সিনেমা হলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (সামনের সারিতে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ যথাক্রমে)।

নক্ষত্রমণ্ডলী: বসুশ্রী সিনেমা হলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (সামনের সারিতে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ যথাক্রমে)।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আমার বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষ তাঁদের প্রিয় অভিনেতা হিসেবে চেনেন। ভালবাসেন। এই অতিমারির মধ্যেই সদ্য তাঁর শতবর্ষ পার হল। বাবাকে ঘিরে কত কথাই তো মনে পড়ে। সব সময়েই। বাবার সঙ্গে স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকা মানুষ, বাবার সঙ্গে জুড়ে থাকা জায়গাগুলোর কথাও মনে হয় খুব। বাবার বন্ধুরা— যাঁদের জ্যাঠা-কাকা বলে ডেকে এসেছি বরাবর— ক’জন আর আছেন এখন! বাবার প্রিয় থিয়েটারপাড়া নেই! বাবার ছবি আসত যে সব সিনেমা হল-এ, সেগুলো আদ্ধেকই নেই! বাবার প্রিয় আড্ডার জায়গা যে বসুশ্রী, সেও তো ধুঁকছে!

অথচ এই বসুশ্রী এক দিন বাবার এবং সেই সূত্রে আমাদেরও, দ্বিতীয় ঘরবাড়ির মতো ছিল। শুধু আমরাই বা কেন! বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের কত ঘটনার মঞ্চ যে বসুশ্রী, তার ঠিক নেই! বাবার কথা, আড্ডাধারী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা, বাংলা সিনেমার আড্ডা আর জলসার কথা— বসুশ্রীকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। এই অবসরে সেই সব স্মৃতির কিছুটা বরং ভাগ করে নিই।

বসুশ্রীর আড্ডায় বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আর এক বিখ্যাত অভিনেতা অজিত চট্টোপাধ্যায়। সেটা ১৯৫৪ সাল। তার আগেও বাবার যাতায়াত ছিল, কিন্তু ওই সময় থেকে বাবা ওখানকার আড্ডার একেবারে নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠলেন। বসুশ্রীর আড্ডা তখন কলকাতার সিনেমা আর গানের আড্ডাগুলোর অন্যতম পীঠস্থান। আরও নানা রকম আড্ডাও জমত। রাজনীতি-ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ ছিল না কিছুই। বসুশ্রীর কর্ণধার মন্টুবাবু (বসু) তখন ইস্টবেঙ্গলের সেক্রেটারি। খেলার আড্ডাও হত খুব। ইস্টবেঙ্গলের আমেদ খান বসুশ্রীর তিন তলাতেই থাকতেন। সকাল-বিকেল নিত্যদিন জমজমাট।

আরও পড়ুন: শ্বশুর দেখলেন নতুন জামাই ভানু কালিঝুলি মাখা, ছেঁড়া চট গায়ে জড়ানো

ওখানে এক সঙ্গে অনেককে পাওয়া যাবে এবং বাকিদের মন্টুবাবু ব্যবস্থা করে দেবেন বলে বহু ফাংশন-করিয়েরাও ভিড় জমাতেন বসুশ্রীতে। বারীন ধর, অজয় বিশ্বাসদের ঘাঁটি ছিল ওটা।

কারা বসুশ্রীর আড্ডার মধ্যমণি? অজিত চট্টোপাধ্যায়, বাবা তো ছিলেনই। এ ছাড়া সুশীল মজুমদার, অসিতবরণ, বিকাশ রায়দের আনাগোনা লেগেই থাকত। মুম্বই থেকে কলকাতায় এলেই ঘুরে যেতেন বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, দুলাল গুহ (যাঁর ‘দো আনজানে’র শুটিং বসুশ্রীতে হয়)। এ দিকে অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নিয়মিত আড্ডাধারী। মাঝে মাঝে ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার। উত্তমকাকার ছোটবেলার বন্ধুরা প্রায় সবাই বসুশ্রীতে আড্ডা মারতেন। ফলে উনি মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার পথে ওখানে এসে দেখা করে যেতেন। মেগাফোনের কমল ঘোষ আসতেন। আর ছিলেন শ্যামল মিত্র। মন্টুবাবুর অভিন্নহৃদয় বন্ধু।

শ্যামল মিত্র যখন ছবির প্রযোজনায় নামলেন— ‘দেয়ানেয়া’, ‘রাজকন্যা’— এ সবের পরিকল্পনাই হয়েছে বসুশ্রীতে বসে। আমার মনে আছে, সিনেমা দেখে বেরিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছি। বাবার গল্পগাছা শেষ হলে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরব। তার মধ্যেই শুনছি, ‘দেয়ানেয়া’ ছবির কথাবার্তা হচ্ছে। নায়িকা হিসেবে উত্তমকাকার প্রথমে পছন্দ ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। কিন্তু তাঁর ডেট পাওয়া গেল না। তখন নূতনের কথা ভাবা হল। সেখানেও ডেট সমস্যা। ফলে শেষ পর্যন্ত এলেন নূতনের বোন তনুজা। এ সব কথা আমি জানলাম কী করে? বসুশ্রীর আড্ডার রেশ যেটুকু ওই বয়সে কানে এসেছিল, তা থেকেই! ডিরেক্টর সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় স্ক্রিপ্ট লিখতেন ওখানে বসেই! ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ও ওখানে লিখেছেন! পাছে এ দিক-ও দিক করে দেরি করেন, প্রোডিউসার ভোলা রায় সুনীলবাবুকে বসুশ্রীর ঘরেই চপ-কাটলেট দিয়ে বসিয়ে দিতেন!

বসুশ্রী সিনেমা হল এখন

এ সব অবশ্য বেশ কিছু দিন পরের কথা। বাবা যে বছর থেকে বসুশ্রীর আড্ডার নিত্যযাত্রী হলেন, খুব সম্ভবত সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই বসুশ্রীর বিখ্যাত পয়লা বৈশাখের ফাংশন শুরু হল। সেও এক গল্প। লতা মঙ্গেশকর সে বার কলকাতায় আসছেন। জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, পরেশনাথের মন্দির দেখবেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভবানীপুরের বাড়িতে উঠবেন। হেমন্তই লতাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবেন। হেমন্ত মন্টুবাবুকে বললেন, লতা থাকবে কলকাতায়! একটা কিছু করা যায় না? তখন ঠিক হল, তা হলে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান হোক! হেমন্ত-লতা-সন্ধ্যা সবাই ছিলেন। মন্টুবাবুর গাড়িতেই লতা কলকাতা বেড়ালেন। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান সেই থেকে বাৎসরিক উৎসবে পরিণত হল। আর বাবার সঙ্গে যেতে যেতে বসুশ্রীও আমাদের ঘরবাড়ির মতো হয়ে গেল। বাবা তো কাজের চাপে আমাদের বিশেষ বেড়াতে নিয়ে যেতে পারতেন না। তার বদলে রবিবার সকালে বসুশ্রীর মর্নিং শো-টা ছিল আমাদের বাঁধা। ‘টারজান’, লরেল-হার্ডি সব আমরা ওখানেই দেখেছি। বাবা আড্ডা মারতেন। আমরা সিনেমা দেখতাম। তার পর বাবার সঙ্গেই বাড়ি ফিরে আসতাম।

বাবা বসুশ্রীর আড্ডায় যোগ দেওয়ার অল্প কিছু দিন পর ছবি বিশ্বাস যেতে শুরু করলেন ওখানে। রোজ নয়, কোনও কোনও দিন। যে দিন আসবেন, সে দিন সাঙ্গু ভ্যালি থেকে চপ-কাটলেট আনা হবে। ছবিজ্যাঠা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে খুব শৌখিন। আমি নিজে ‘কাঞ্চনমূল্য’র শুটিংয়ে দেখেছি, রোজ বিকেল চারটের সময় ওঁর জন্য স্কাইরুম থেকে সসেজ আর হ্যাম আসছে! ছবিজ্যাঠার একটা মজার গল্প এই ফাঁকে মনে পড়ছে। তখন বৌবাজার এলাকার একটা পাব-এ ছবিজ্যাঠা প্রায়ই যেতেন। এক দিন সেখান থেকে বসুশ্রী আসছেন। গাড়ি আনেননি, ট্যাক্সি নিয়েছেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার ছেলেটির বয়স বেশি নয়। ছবিজ্যাঠাকে চিনতে পেরে ‘জ্যাঠাবাবু’ বলে সে প্রচুর বকবক জুড়েছে। ছবিজ্যাঠা বেশ একটু বিরক্ত। তাকে থামানোর জন্য বললেন, ‘‘আচ্ছা আমি যে তোমার বাপের থেকে বয়সে বড়, সেটা তুমি জানলে কী করে?’’ তাতেও সে দমবার পাত্র নয়! নামার সময় ছবিজ্যাঠা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কত হল? সে হয়তো বলেছে, দু’টাকা! এই বার ছবিজ্যাঠা পড়লেন তাকে নিয়ে। ‘‘আচ্ছা ভাইপো, বৌবাজার থেকে বসুশ্রী যদি দু’টাকা হয়, তবে বসুশ্রী থেকে বৌবাজার কত হবে?’’ ‘‘কেন জ্যাঠাবাবু! দু’টাকাই হবে!’’ ‘‘তা কী করে হয় ভাইপো! আচ্ছা বলো তো, দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো কত দিন?’’ ‘‘আজ্ঞে তিন হপ্তার মতো!’’ ‘‘তা হলে কালীপুজো থেকে দুর্গাপুজো কত দিন?’’ ড্রাইভার ঘেমেনেয়ে একসা! ছবিজ্যাঠা বলে চলেছেন, ‘‘সেটা যদি তিন হপ্তা না হয়, তা হলে বসুশ্রী থেকে বৌবাজার দু’টাকা কেন?’’

এই হলেন ছবিজ্যাঠা। লেগপুলিংয়ে ওঁর জুড়ি ছিল না। ট্যাক্সির এই ঘটনাটা বাবা পরে একটা কমিকে ব্যবহার করেছিলেন। ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবি হচ্ছে। আমার বোন ভুটি (বাসবী) তাতে অভিনয় করেছিল। ছবিজ্যাঠা এক দিন ওকে ডেকে চুপিচুপি কী একটা শিখিয়ে দিলেন। ভুটি সটান গিয়ে বাবাকে বলে এল, ‘‘আচ্ছা বাবা, আমি যে পার্ট করলাম, আমি তো প্রাইজ় পাব। তুমি এত দিন পার্ট করেও কোনও প্রাইজ় পেলে না তো?’’ বাবা বুঝেই গিয়েছেন, কথাটা কোথা থেকে এল! অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ছবিজ্যাঠাকে। ছবিজ্যাঠাও ভালবাসতেন ততোধিক। বাবার কথাতেই উনি অভিনেতৃ সঙ্ঘের সেক্রেটারি হন।

অভিনেতৃ সঙ্ঘের জন্ম পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে। পুরনো দিনের নামী অভিনেত্রী কুসুমকুমারী তখন সদ্য খুব অর্থকষ্টের মধ্যে মারা গিয়েছেন। বিকাশ রায় বাবাকে এসে বললেন, একটা কিছু করা দরকার। বাবা তখন বললেন, খুবই ভাল প্রস্তাব। কিন্তু দুজনেরই মনে হল, মাথার উপরে ছবি বিশ্বাস না থাকলে কাজ হবে না। গেলেন ছবিজ্যাঠার কাছে। উনি দেখেই বললেন, ‘‘কী ব্যাপার? জগাই-মাধাই এক সঙ্গে যে?’’ শুনলেন সব। শুনে বললেন, ‘‘বেশ। আমি কিন্তু খাটাখাটনি কিছু করতে পারব না। সে সব তোমরা করবে!’’ বাবারা খুব রাজি। বললেন, ‘‘আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আপনি শুধু মাথার উপরে থাকুন!’’ প্রথম মিটিং ছবিজ্যাঠার বাড়িতেই হয়। তার কয়েক বছর পর অভিনেতৃ সঙ্ঘের বাঁধা অফিসঘর হওয়ার আগে পর্যন্ত নানা জায়গাতেই মিটিং হয়েছে। বসুশ্রীও তার মধ্যে অন্যতম। অভিনেতৃ সঙ্ঘ থেকে যে সব নাটক করা হত টাকা তোলার জন্য, তারও কিছু কিছু বসুশ্রীতে অভিনয় হয়েছে। ‘মিশরকুমারী’র কথা যেমন আমার মনে আছে স্পষ্ট।

বাবা তো সিনেমার পাশাপাশি নাটক করে গিয়েছেন সারা জীবনই। স্টারে ‘শ্যামলী’ হচ্ছে যখন, উত্তমকাকা প্রায়ই চলে আসতেন আমাদের বাড়ি। বাবা আর উত্তমকাকা এক সঙ্গে বেরোতেন হাতিবাগানের উদ্দেশে। এক বার উত্তমকাকা এসেছেন, আমি ওই ঘরে বসে পড়ছি। মাস্টারমশাই এসেছেন পড়াতে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ রিলিজ় করেছে তখন। গলিতে জমা ভিড় থেকে রব উঠছে, ‘‘কিরীটী, কিরীটী!’’ ছবিতে উত্তমকাকার চরিত্রের নাম ওটাই। উত্তমকাকার নিজের ছেলের নামও গৌতম বলে উনি আমার নাম বলতেন না, মাস্টার বলে ডাকতেন! এ দিকে আমার নিজের মাস্টার উত্তমকাকাকে দেখে সেই যে মুখ নামিয়েছেন, তুলছেনই না! উত্তমকাকা আমায় বলে চলেছেন, ‘‘কী হল! মাস্টার, পড় পড়!’’ কে পড়াবে! মাস্টার অধোবদন! এই সিন আরও বদলে গেল কিছু দিন পরে। সে বারও উত্তমকাকা এসেছেন! এ বার আর চরিত্রের নাম নয়, ‘উত্তমকুমার উত্তমকুমার’ ধ্বনিতে মুখরিত গলি। আমাদের জানলা অবধি ভিড়! থেকে থেকেই ভেসে আসছে গানের কলি— ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস!’ ‘শাপমোচন’ বেরিয়েছে সবে। উত্তমকাকা হেসে বললেন, ‘‘তোদের পাড়ায় অনেক গায়ক আছে দেখছি!’’ আর খুব বেশি দিন আমাদের বাড়ি আসতে পারেননি উত্তমকাকা। রাস্তায় বেরনো মুশকিল হয়ে গেল এর পর থেকেই। বসুশ্রীর ফাংশনে এলে সামনে দিয়ে কোনও রকমে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। বেরনোর সময় পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেন।

আগেই বলেছি, ১৯৫৪ থেকে আমাদের কাছে পয়লা বৈশাখের সকাল মানেই ছিল বসুশ্রীর ফাংশন। মনে রাখতে হবে, মন্টুবাবু ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এক নম্বর ভক্ত। শ্যামল মিত্রের বন্ধু, কিন্তু ভক্ত হেমন্তের! শ্যামলকাকা মাঝে মাঝে মজা করে বলতেন, ‘‘মন্টু! আমাদেরও একটু দেখ! আমরাও তো গাই-টাই!’’ যে বছর হেমন্ত কোনও কারণে আসতে পারবেন না বলে জানাতেন, (যেমন ১৯৬১ সালে হেমন্ত এলেন না। তখন উনি ‘বিশ সাল বাদ’ নিয়ে খুব ব্যস্ত) মন্টুবাবুর মাথায় হাত পড়ে যেত। উত্তমকুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সবাইকে পাগল করে দিতেন— ‘‘হেমন্তদা আসছে না, তোমরা বাঁচাও।’’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রতি বার আসতেন না। কিন্তু হেমন্ত না এলে ওঁকে আসতেই হবে, এ রকম ব্যাপার ছিল। বেশ ঘরোয়া মিলনোৎসবে পরিণত হয়েছিল অনুষ্ঠানটা। কালীঘাট মন্দির থেকে পেঁড়া এনে বিলি করা হত। আমরা সার দিয়ে বড়দের প্রণাম করতাম। উত্তমকাকু ছবিজ্যাঠা আর বাবাকে প্রণাম করতেন। ছোটদের প্রণাম নিতেন। মা‌ইক লাগানো হত বাইরে। অন্তত হাজারখানেক লোক দাঁড়িয়ে ভিড় করে শুনত অনুষ্ঠান। হেমন্ত উঠতেন একেবারে শেষে। কোনও কোনও বার সেই ঘোষণাটা করে দিতেন উত্তমকাকু। নিজে গানও গাইতেন দু’-এক বার। ওঁর গলায় ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’ বা ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’ শোনার কথা খুবই মনে আছে।

শুধু কি নববর্ষের অনুষ্ঠান? ‘কাবুলিওয়ালা’র জন্য ছবিজ্যাঠার সংবর্ধনা, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার পরে শচীন দেব বর্মণের সংবর্ধনা, এ সবও বসুশ্রীতে হতে দেখেছি। ১৯৫৫-য় ‘পথের পাঁচালী’ রিলিজ় হল। ২৬ অগস্ট, বাবার জন্মদিনেই। বাবা আমাদের বললেন, ‘‘ছবিটা দেখে আয়।’’ রবিবার ম্যাটিনি শো দেখলাম। সোমবার আবার গেলাম ঠাকুমাকে নিয়ে। বসুশ্রীতে বাবার ছবির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। তখন স্পুটনিক নিয়ে চার দিকে হইচই। ‘যমালয়ে’র শো-এর জন্য স্পুটনিকের একটা ঢাউস মডেল বানিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছিল বসুশ্রীর ছাদে। সেটা দেখে ঋত্বিক ঘটক খুব মজা পেয়েছিলেন। তার পর ওঁর ‘অযান্ত্রিক’ যখন রিলিজ় হল, উনিও জগদ্দলের গাড়িটা তুলে দিলেন বসুশ্রীর মাথায়। আজ সাবেকি সিনেমা হলগুলো নিজেরাই এক-একটা জগদ্দলে পরিণত হওয়ার পথে! এই কি ভবিতব্য ছিল?

সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

Bhanu Bandopadhyay Basusree Cinema Tollywood Celebrities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy