ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
এই ওঠো না, ওঠো না, এই... রাত বারোটার সময় রূপককে প্রায় ধাক্কা মেরে জাগাল অনিন্দিতা। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে জেগে উঠে রূপক যথেষ্ট কর্কশ ভাবে বলল, “কী হয়েছে?”
অনিন্দিতারও মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল। নতুন জায়গায় বাড়ি বদলে আসার ধকল গিয়েছে সারা দিন। রূপক তো ট্রাক থেকে মালপত্র নামিয়ে দিয়েই অফিসে পালিয়েছিল, সেখানে নাকি ভারী গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। জায়গাটা এমনিতেই ফাঁকা ফাঁকা। রাজারহাটের সীমান্তের পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে, একটা স্ট্যান্ড-অ্যালোন ফ্ল্যাটবাড়ির একতলার ফ্ল্যাট। অনিন্দিতার কিন্তু-কিন্তু ছিল। একেবারে ফাঁকা জায়গা, আর এখান থেকে রূপকের ওই ছাইয়ের আইটি অফিস ছাড়া কিছুই কাছে নয়, ধর্মতলাই যাও আর হাতিবাগান... ঠিক সেই দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। রূপক বলল, “ভাড়াটা কম পড়বে অনেকটা বুঝলে, কলকাতায় তো সেট্ল হতে আসিনি, সুযোগ পেলেই হয় বেঙ্গালুরু নয় আমস্টারডাম, একটু ম্যানেজ করে নাও লক্ষ্মীটি।”
সারা দিন ধরে একার হাতে সেই ম্যানেজই করেছে অনিন্দিতা। কাজের লোকের জন্য দালালকে বলা হয়েছে, কাল এক জন আসবে। সারা দিনের খাটুনির পরে বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিল সে। নতুন জায়গায় এমনিই এ পাশ-ও পাশ হয় তার, তার পর যত বার তন্দ্রা আসছে ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছে। রূপকের প্রশ্নের উত্তর তাই সেও উপযুক্ত রকম কাঠখোট্টা ভাবেই দিল।
“ঘুমোতে পারছি না। তখন থেকে একটা কুকুর ডেকে যাচ্ছে।”
রূপক একটু হকচকিয়ে গেল। তার পর বলল, “তো কী করব? আমিও ডাকব ওর সঙ্গে?”
“সে-ই তো। নিজে অফিস থেকে ফিরে গপগপ করে খেয়েদেয়ে তিন পেগ মদ গিলে ঘুমিয়ে পড়লে। বৌ ঘুমোল কী ঘুমোল না, তোমার কী? শুধু তো ডাক নয়, তার সঙ্গে কী একটা আওয়াজও হচ্ছে। তোমার তো কিছু হুঁশ থাকে না মদ খেলে, আমার কুকুর ভাল লাগে না কিন্তু।”
“তুমিও তিন পেগ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না বাবা,” ঘুমজড়ানো গলায় বলল রূপক।
অনিন্দিতা শুধু এক বার তাকাল। নেহাৎ সত্যযুগ নয় বলে রূপক এ যাত্রা বেঁচে গেল।
রূপক উঠে পড়ল। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অনিন্দিতা না ঘুমোলে আজ আর তার ঘুম হবে না।
ফ্ল্যাটের মূল দরজার পাশেই একটা জানলা আছে, সেখান থেকে মুখ বাড়াতেই কুকুরটা নতুন করে ডেকে উঠল। রূপক দেখল, একটা সাধারণ পাটরঙা নেড়ি কুকুর তার দিকে চেয়ে ডাকছে। মাঝে মাঝে দরজায় নখ আঁচড়াচ্ছে, আবার ডাকছে। রূপক জানালা থেকে দু-এক বার তাড়াবার চেষ্টা করল। কুকুরটা নড়লও না, শুধু একদৃষ্টে জানলার দিকে তাকিয়ে রইল, স্থির চোখে। রূপক একটু চুপ করে ভাবছিল কী করা যায়। এমন সময় কুকুরটা আবার ডাকল। ঠিক ডাক নয়, যেন গোঙানি। শীতের নিস্তব্ধ রাতে সেই আওয়াজ যেন দশগুণ হয়ে ফিরে এল রূপকের কাছে। অনিন্দিতা আবার চেঁচিয়ে উঠল, “একটা লোক নেই ধারেকাছে, কিন্তু কুকুর আছে, নিকুচি করেছে সব কিছুর।” রূপকের সারা শরীর দিয়ে একটা রাগ ঝিলিক দিয়ে গেল। চকিতে সে ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল বার করে কুকুরটার গায়ে ঢেলে দিল।
কুকুরটা পালিয়ে গেল না। খুব অবাক হয়ে চেয়ে রইল সোয়েটার গায়ে দেওয়া রূপকের দিকে। তার পর আস্তে আস্তে দরজা থেকে সরে গেল।
রাতটা এর পর শান্তিতেই ঘুমোল রূপক।
সকালে রূপক অফিসে চলে যাওয়ার পর বিউটি এল কাজ করতে। চটপটে মেয়ে, কিছুটা দূরের বস্তি থেকে আসে। দুপুরের দিকে আসবে সে, ঘর মোছা, বাসন মাজা ইত্যাদি সেরে এ বাড়িতে ভাত খেয়ে যাবে। মাইনেটা একটু বেশি নিচ্ছে বলায় বলল, “এ পাড়ায় তো বড় কেউ থাকেনে বৌদি। এ’ বাড়িতি যেমন তোমরা আর চারতলায় এক ঘর। সামনের বাড়িগুলো তো সব তৈরি হতিছে। এখন তো শুধু তোমার জন্যিই আসতি হচ্ছে।”
কী ফাঁকা পাড়া রে বাবা! অনিন্দিতা বিরক্তই হল।
বিউটি ভাত খেয়ে দরজা খুলে বেরোতে গিয়ে হঠাৎ অনিন্দিতাকে বলল, “বৌদি, পুষ্যি রেখিছ না কি?”
“পুষ্যি? কিসের পুষ্যি?”
“ওই যি পাটরঙা একখানা কুকুর বসি আছে এখানে। পুষছ না কি?”
“কুকুরটা আবার এসেছে! সকাল থেকে ছিল না তো। কুকুর আমার একদম ভাল্লাগে না। এই ওটাকে তাড়িয়ে দিয়ে যা তো।”
খিলখিল করে হেসে উঠল বিউটি। গালে হাত দিয়ে বলল, “ও মা বৌদি, তোমার কুকুরে এত ভয়?”
অনিন্দিতার ক্রমশ কঠিন হতে থাকা মুখটা দেখে হাসিটা মাঝপথে থেমে গেল বিউটির। অপ্রতিভ ভাবে বলল, “ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে। ওকে একটু ভাত দিলিই চলে যাবে।”
অনিন্দিতা কিছু বলল না। বিউটি আরও কিছু ক্ষণ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
অনিন্দিতা তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল। কুকুরটা কিন্তু চলে গেল না পুরোপুরি। প্রথম দিনের মতো আর দরজা আঁচড়ায় না ঠিকই। মাঝে মাঝে এ দিক-ও দিক যায়, আবার এসে বসে থাকে। খুব একটা লেজ-টেজ নাড়ে না, মন ভোলানোর চেষ্টাও করে না তেমন। একটু খুঁড়িয়ে চলে কুকুরটা। পায়ে চোট আছে, গাড়িতে-টাড়িতে লেগেছিল হয়তো, ভাবে অনিন্দিতা। কুকুরদের পাড়া থাকে, ও হয়তো অন্য পাড়ায় যেতে পারে না, বাকি কুকুরেরা মিলে ওকে তাড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ডাকাডাকি করে, তবে অনিন্দিতার এখন আর অতটা ঘুমোতে অসুবিধা হয় না। রূপক এক দিন বলল, “আসলে ম্যান-মেড সোসাইটিতে মানুষের সাহায্য ছাড়া ওদের সারভাইভ করা মুশকিল।”
কথাটা কী উদ্দেশ্যে বলা, অনিন্দিতা জানে। বিউটি দুপুরবেলা বেরোবার সময় রোজই এক বার কুকুরটার দিকে আর এক বার তার দিকে তাকায়, একই উদ্দেশ্যে। সে কিছুই বলল না, শুধু সিরিয়ালের আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দিল।
দুই-তিন দিন পরে বিউটি দুপুরবেলা খেতে খেতে বলল, “বৌদি, বলছি ভাতটা না আজ একটু বেশি মেখি ফেলিছি। ফেলি দিতি মন চায় না, কী করি বলো তো?”
অনিন্দিতা বলল, “পারবি না খেতে আর? দেখেশুনে নিবি তো।”
“কুকুরটাকে দিই দি?”
অনিন্দিতা হ্যাঁও বলল না, নাও বলল না। তবে অনুভব করল, তার মুখটা সম্ভবত আর প্রথম দিনের মতো কঠিন নেই।
বিউটি একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের সানকি এনে তাতে বাড়তি ভাতটা ঢেলে কুকুরটাকে দিল। একটু অপেক্ষা করে, শুঁকে দেখে, কুকুরটা খেতে শুরু করল। চেটেপুটে খেয়েও ফেলল সবটুকু। তার পরে অল্প একটু লেজ নেড়ে, ভুক করে একটু নরম স্বরে ডাকল। তার পর বাড়িটার ভিতরের দিকে নরম ভাবে চেয়ে দরজার কাছেই গুছিয়ে বসল।
বিউটির পরের দিনও ভাত বেশি হল, তার পরের দিনও। অনিন্দিতা আর বিউটি দুই জনেই এক দিন এক সঙ্গে হেসে উঠল। সানকিতে দেওয়া ভাত রোজই কুকুরটা খেয়ে নিল চুপচাপ, তবে খেয়ে চলে যাওয়ার লক্ষণ কোনও দিনই দেখাল না। বরং আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে বসে পড়ল নির্জন দুপুরগুলোতে। মাঝে মাঝে সদর দরজা খোলা পেলে সেটা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভিতরে ডাকতেও শুরু করল। এক দিন রাতের বেলা বাইরে থেকে কুকুরটার ডাক শুনতে পেয়ে রূপক মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল, “এই ব্যাপারটা কিন্তু ভাল হয়েছে। বাড়ি পাহারা দেওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়েছে।”
অনিন্দিতা বলল, “কাল ভুলুর জন্য একটা খাবারের প্লেট নিয়ে এস তো। ওই পুরনো সানকিটায় আর দেব না ওকে।”
রূপক অনিন্দিতার গায়ের কাছ ঘেঁষে বলল, “ভুলু? হ্যাঁ? ভুলু?”
অনিন্দিতা তরল গলায় স্বামীকে বলল, “তুমি ভুলে যাও এ সব। নো চান্স। মাতাল একটা।”
নতুন হলুদ-সাদা রঙের পাত্রটাতে ভাত দিয়ে বিউটি ভুলুকে ডাকল। বলল, “প্লেটটা বেশ দেখতি হয়িছে বৌদি।”
“ও তো খেতেই আসে রে”, বলল অনিন্দিতা, “দুটো ভাত খাবে বলে এত কিছু। তার প্লেটটা একটু ভাল করে দিলে ভাল হয় না বল। কী হল ভুলু? ওই...”
ভুলু খাচ্ছে না। সে একটা ভাতও মুখে তোলেনি, সে প্লেটটাকে দেখছে, প্লেটটাকে শুঁকে শুঁকে দেখছে সে। আর মাঝে মাঝে বিস্মিত ভাবে এক বার বিউটি আর এক বার অনিন্দিতাকে দেখছে। তার পর হঠাৎ চকিতে ভুলু ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে ঘরময় ছুটে বেড়াতে লাগল। অনিন্দিতা পাগল হয়ে উঠল রাগে। ঘর পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে তার কঠোরতা সাংঘাতিক, সেখানে রাস্তার একটা নোংরা কুকুর, যাকে সে-ই এত দিন ভাত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, সে এ ঘর-ও ঘর ছুটে বেড়াচ্ছে— এটা সে মেনে নিতে পারল না। দুই-তিন বার উঁচু গলায় নাম ধরে ডেকেও যখন ভুলুর দৌরাত্ম্য কমানো গেল না, তখন তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল অনিন্দিতা, “বিউটি, লাঠি দিয়ে মারতে মারতে এই কুকুরটাকে বাড়ি থেকে বার করে দে। রাস্তার কুকুর একটা! বেরো, বেরো!”
লাঠির তাড়ায় ভুলু বেরোল বটে, তবে সেই হলুদ প্লেটটাকে মুখে করে নিয়ে পালাল। বিউটি দেখল, কিছু দূর গিয়ে ওই প্লেটটাকে আঁকড়ে ধরে বসে পড়ল সে।
হলুদ-সাদা প্লেটটাকে কিচেনে রাখা দেখে সৌপ্তিক প্রিয়াঙ্কাকে বলল, “কী ব্যাপার? তোমার নতুন কুকুরটাকে খেতে দাওনি দুপুরবেলা?”
সন্ধে নেমে আসছে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যস্ত সিওল শহরে। কোম্পানির দেওয়া চকচকে ফ্ল্যাটের জানালার সামনে বসে প্রিয়াঙ্কা কফি খাচ্ছে, তার কোলে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে নতুন কেনা পিকিনিজ কুকুরছানাটা।
“খাইয়েছি”, বলল প্রিয়াঙ্কা, “তোমার ঘুম হল?”
“তা হল। অফিস ছুটি নেওয়াটা কাজে লেগেছে বটে”, সামান্য হেসে বলল সৌপ্তিক।
প্রিয়াঙ্কা উত্তর দিল না। সে পিকিনিজের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অন্যমনস্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল।
সৌপ্তিক বলল, “আমরা ওকে বুঝিয়েই আসতে চেয়েছিয়াম প্রিয়া। আমাদের প্যাকিং করে বেরনোর দিন ও এল না তো কী করব বলো। আমরা তো ওয়েট করেছিলাম ওর জন্য কিছু ক্ষণ।” একটু থেমে বলল, “চিন্তা কোরো না। ওর খাবার-দাবার জোগাড় হয়ে যাবে ঠিক।”
প্রিয়াঙ্কা পিকিনিজটাকে শুইয়ে রান্নাঘরে উঠে এল। যে বাসনটায় আজ পিকিনিজকে খেতে দিয়েছে, সেটা মেজে ফেলতে হবে। এই হলুদ-সাদা প্লেটটা সে দিতে পারবে না কাউকে, কিছুতেই না। খাবার? শুধুই কি খাবার দিত সে মান্টাইকে?
দু’ফোঁটা চোখের জল, সিওলে, টুপ করে শূন্য প্লেটটার ওপর ঝরে পড়ল।
কলকাতায় আচমকা শীতে অসময়ের গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছে। এই বৃষ্টিতেও হলুদ-সাদা একটা প্লেটে না-খাওয়া ভাত আঁকড়ে শুয়ে আছে একলা একটা পাটরঙা কুকুর।
অনেক দিন তাকে কেউ ‘মান্টাই’ বলে ডাকে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy