Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলা কল্পবিজ্ঞান শিশুপাঠ্য হয়ে রইল

তাতে হাস্যরস আর অ্যাডভেঞ্চার আছে, বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব ততটা নয়। নেই প্রাপ্তমনস্কের রাজনীতিবোধ বা সমাজসচেতনতাও। সাহিত্যের এই ধারাটি তাই এখন প্রায় মৃত, অপ্রাসঙ্গিক। তাতে হাস্যরস আর অ্যাডভেঞ্চার আছে, বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব ততটা নয়। নেই প্রাপ্তমনস্কের রাজনীতিবোধ বা সমাজসচেতনতাও। সাহিত্যের এই ধারাটি তাই এখন প্রায় মৃত, অপ্রাসঙ্গিক।

রূপক: স্তানিসোয়াভ লেম-এর উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি আন্দ্রেই তারকোভস্কির ছবি ‘সোলারিস’ (১৯৭১)-এর দৃশ্য

রূপক: স্তানিসোয়াভ লেম-এর উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি আন্দ্রেই তারকোভস্কির ছবি ‘সোলারিস’ (১৯৭১)-এর দৃশ্য

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৯ ০৭:৩৭
Share: Save:

ভূতের গল্প যেমন ভূতেদের জন্য নয়, ঠিক তেমনি কল্পবিজ্ঞানও বৈজ্ঞানিকদের জন্য নয়, এই আপ্তবাক্যটা মাথার মধ্যে রেখেই কল্পবিজ্ঞান রচনায় একনিষ্ঠ হয়েছিলাম ১৯৬৩ সাল থেকে”— ‘প্রফেসর নাটবল্টু চক্র সংগ্রহ’ বইয়ের ভূমিকায় এ ভাবেই অদ্রীশ বর্ধন জানিয়েছেন, সায়েন্স ফিকশন গল্প বা উপন্যাস তিনি কাদের কথা ভেবে লেখেননি। শব্দবন্ধের মধ্যে ‘বিজ্ঞান’ আছে বলেই কল্পবিজ্ঞানের গল্পে বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্বকে রাখতে হবে, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। এবং অদ্রীশ বর্ধন একা নন, বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মূলধারায় যে লেখকেরা প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এ ব্যাপারে একমত। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক’ গল্পে সত্যজিৎ রায় যখন প্রথম বারের জন্য ‘মিরাকিউরল’ ওষুধের কথা লিখছেন, তখন কোন জৈবরসায়ন বা জৈবপ্রযুক্তির দৌলতে এ ওষুধ সর্বরোগনাশক হয়ে দেখা দিল তা নিয়ে মোটেই বাক্যব্যয় করছেন না। শুধু জানাচ্ছেন, অনেক অদ্ভুত জিনিসের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে এ ওষুধ। সে লিস্টি থেকে একটি উপাদানই পাঠক জানতে পারে— গলদা চিংড়ির গোঁফ। স্পষ্টতই সত্যজিৎ এখানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি, বরং সুকুমার রায়ের ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’র আদলে হাস্যরস বজায় রাখতে চেয়েছেন। আর উপরি পাওনা থ্রিল। সত্যি কথা বলতে কী, সময় সময় শঙ্কুর গল্পের থ্রিল ফেলুদার গল্পকেও টেক্কা দিয়ে যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ঘনাদা’ সিরিজ়ে দেখি, লেখক নিজেই অধিকাংশ উপসংহারে পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এ গল্প আদতে ‘গুল্প’। ‘ধুলো’ গল্পে যেমন ঘনাদা দাবি করছেন, হারপুন কামানে ঠাসা সিলভার আয়োডাইড গোলা ছুড়ে তিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন ভয়াবহ সামুদ্রিক ঘূর্ণি; কিন্তু শেষকালে বনমালী নস্কর লেনের আড্ডার অন্যতম সদস্য সুধীর পাঠকদের জানায়, সিলভার আয়োডাইড সাধারণত বৃষ্টি নামানোর জন্য মেঘের ওপরে ছড়ানো হয়, যদিও কাজে দেয় কখনও সখনও। সেই মামুলি রাসায়নিক দ্রব্য কী ভাবেই বা থামাবে বাহামার প্রলয়ঙ্করী ঝড়কে? ঘনাদা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রওনা দিয়েছেন টঙের ঘরে।

নিখাদ ফ্যান্টাসি ফিকশন বা গুল্প হলেও এ সমস্ত গল্পই প্রবল জনপ্রিয়। কারণ সত্যজিৎ বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায় অসাধারণ মুন্সিয়ানা আছে, আছে হিউমার-থ্রিল-অ্যাডভেঞ্চারের কালজয়ী রেসিপি। গুগল বা উইকিপিডিয়ার যুগে জন্মানো ছেলেমেয়েরা না ভাবতে পারলেও এ কথা সত্যি যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা পড়ে বহু প্রজন্মের কচিকাঁচারা নিজেদের সাধারণ জ্ঞান বাড়িয়েছে। বছর পাঁচেক আগে তুরস্কের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বোদরুমে বেড়াতে গিয়ে মনে পড়েছিল, এ শহরের নাম সাত বছর বয়সে প্রথম পেয়েছিলাম ঘনাদার ‘ঢিল’ গল্পে।

সাফল্যের রসায়নটি বুঝতে গেলে একটি তথ্য চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। এই সমস্ত গল্প বা উপন্যাসই কিন্তু আদতে কিশোরপাঠ্য। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা বাংলা কল্পবিজ্ঞানকাহিনির নাম জানতে চাইলে বহু মনোযোগী পাঠকও মাথা চুলকোবেন। অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’ এবং ‘ফ্যানটাসটিক’ বা অধুনা ‘কল্পবিশ্ব’ ওয়েবজ়িনের পাতায় কখনও-সখনও এ রকম লেখা চোখে পড়লেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি পাঠকের কাছে তা পৌঁছয়নি। কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞানের বাইরেও যে এক বিশাল পৃথিবী আছে, তার আঁচ পেয়েছিলাম আশির দশকে প্রকাশিত ‘দেশ’-এর একটি সংখ্যায়, যেখানে বাংলায় অনূদিত হয়েছিল বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকরের একটি গল্প। ‘দেশ’-এর সেই সংখ্যাটি ছিল ব্যতিক্রম। একই সময়ে ‘আনন্দমেলা’, ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’, ‘কিশোর ভারতী’র পাতায় প্রায়শই চোখে পড়ত কল্পবিজ্ঞানের গল্প। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়রা আর একটু ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন ‘শুকতারা’-র পাতাতেও। সুনীলের ‘নীলমানুষ’ সিরিজ় ভালই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তখন। সেই নীলমানুষ, যে গ্রহান্তরে গিয়ে দানবিক চেহারা পায় এবং যার প্রিয় বন্ধু ছিল বামনাকৃতি গুটুলি। বাঙালির নিজস্ব গালিভার আর লিলিপুটের এই আখ্যানের সূচনাটুকু বাদ দিলে অবশ্য কল্পবিজ্ঞানের রসদ বিশেষ কিছু নেই।

অতীত: অদ্রীশ বর্ধনের ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকা। ছবি সৌজন্য: পল্লব রায়। ডান দিকে, জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকর

বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে কিন্তু মনে হতে বাধ্য, বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগৎটি ব্যতিক্রম। আমেরিকা থেকে রাশিয়া, জাপান থেকে চিন— কল্পবিজ্ঞানের জগৎ আদতে প্রাপ্তবয়স্কদের। ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ বলার অর্থ কী? এই সব গল্পেই কি এসেছে হিংসা ও যৌনতা? নাকি বিজ্ঞানের তত্ত্ব-তথ্যে ভরপুর সে সব? কোনওটাই নয়। বিজ্ঞান, হিংসা বা যৌনতা দরকার মতো নিশ্চয়ই এসেছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য প্রায় সব গল্পেই প্রধান ভূমিকা রাজনীতির! বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে যে রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা, বাংলার অন্য ধারার সাহিত্যে সযত্ন স্থান পেয়েছে যে, সেই রাজনীতিই সম্পূর্ণ ব্রাত্য বাংলার কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে। কিশোরদের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম না বলেই কি রাজনীতি ঠাঁই পেল না, না কি ভাবী কালের রাজনীতি ঠিক কেমন হতে পারে তা নিয়ে বিশ্লেষণে গেলাম না বলেই সব গল্প কিশোরপাঠ্য হয়ে রইল? অথচ ভাবীকালকে বোঝার জন্য কিন্তু আমরা অতীতের দিকে তাকাতেই পারতাম, ইতিহাস থেকে রসদ কম মিলত না। একটি উদাহরণ দিই, স্মরণ করা যাক পোলিশ লেখক স্তানিসোয়াভ লেম-কে। তাঁর সাহিত্যসম্ভারে একটি থিম বারবার উঠে আসে— ভাবী বিশ্বের মানুষ বা অ-মানুষী জীবদের মধ্যে চিন্তার আদানপ্রদানের ধারাটি ক্ষীণ হয়ে গেলে ঘটতে পারে বহু অনর্থ। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘সোলারিস’-এ (যে উপন্যাস থেকে তৈরি আন্দ্রেই তারকোভস্কির চলচ্চিত্র কান-এ পুরস্কার জয় করেছিল) আমরা দেখি জেলিসদৃশ এক সমুদ্র পরিমাণ ভিনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এক দল বিজ্ঞানী, এবং বৌদ্ধিক ব্যর্থতার পরিণামে তাঁরা ক্রমেই আগ্রাসী পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে শুরু করেছেন। যে আগ্রাসন শেষে ট্র্যাজেডি ডেকে আনবে তাঁদের জন্যই। বহু সমালোচক মনে করেন, ‘সোলারিস’-এর এই সমুদ্র সোভিয়েট ইউনিয়নের রূপক, আর বিজ্ঞানীরা আসলে সোভিয়েট সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রতীক। স্তানিসোয়াভ নিজে তেমন কিছু বলে না গেলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে কমিউনিস্ট শাসনাধীন পূর্ব ইউরোপে চিন্তাভাবনার আদানপ্রদানের যোগসূত্রগুলি ক্ষীণ হয়ে আসাটা তাঁর সাহিত্যিক সত্তাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ‘সোলারিস’-এর দুনিয়ায় তাই দেখি— মেধাবী মানুষও নিজের গোপন, গভীর ইচ্ছাগুলিকে পরিস্ফুট করে তুলতে পারেন না এক অচেনা কর্তৃত্বের কাছে।

প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় ৫৫ বছর ধরে বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত কল্পবিজ্ঞান কাহিনির তকমা পেয়ে এসেছে আমেরিকান লেখক ফ্র্যাঙ্ক হার্বার্টের লেখা উপন্যাস ‘ডিউন’। ডিউন এক মরুগ্রহ, যেখানে জলের দেখা মেলা ভার। অথচ সেখানেই ছুটে এসেছে এই উপন্যাসের একাধিক প্রধান চরিত্র। তাদের চাই ‘মেলঞ্জ’ নামে এক বিশেষ পদার্থ, যার অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাগতিক যাতায়াত ও যোগাযোগ। ন’শো পাতার এই বিরাট উপন্যাসের সাবপ্লট একাধিক, এবং সব ক’টি ধরে না এগোলে মূল প্লটটি পুরোপুরি বোঝা দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু এ কথা বেশ বোঝা যায়, ডিউন আসলে আমাদের পৃথিবীরই প্রতিচ্ছবি, ‘মেলঞ্জ’ নিয়ে যুদ্ধ আসলে পশ্চিম এশিয়ায় তেলের যুদ্ধ। ফ্র্যাঙ্ক এই উপন্যাস লিখছেন ১৯৬৫ সালে, তার সাত বছর আগেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ইরাকে কুড়ি হাজার সৈন্য পাঠিয়েছেন যাতে নিজেদের তেলের দায়িত্ব সম্পূর্ণ ভাবে ইরাকের হাতে না থাকে। ফ্র্যাঙ্ক নিজেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ছিলেন, উপন্যাসেও দেখি উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলি ক্রমাগত বিদ্রোহ করে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে। ওয়াশিংটন এবং অরেগন রাজ্যের বাসিন্দা ফ্র্যাঙ্কের রাজনীতি রূপ পেয়েছিল আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের ‘কাউন্টারকালচার’ আন্দোলনের মাধ্যমে। একাধিক বিশেষজ্ঞের দাবি, এই আন্দোলনের ভিত্তিতেই লেখা হয় ‘ডিউন’।

যে কোনও শিল্পমাধ্যম নিয়েই একটি যথাযথ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য চাই উপর্যুপরি বিশ্লেষণের সুযোগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিশ্লেষণ যাতে নিয়ে আসতে পারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, খুঁড়ে বার করতে পারে বহু দিন ধরে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত বক্তব্য। লেখক কী ভেবে লিখেছেন আর পাঠক কী ভাবে ব্যাখ্যা করছেন, এই দুটি প্রশ্নেরই উত্তর সংস্কৃতি গড়ে তোলার তাগিদেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। কল্পবিজ্ঞানে রাজনৈতিক মাত্রা তৈরি করে দেয় সেই উপর্যুপরি বিশ্লেষণের সুযোগ। আর এখানেই বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পিছিয়ে পড়েছে, নিজেকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে। আমাদের পছন্দের গল্পগুলি তাৎক্ষণিক ভাললাগায় ভরিয়ে দেয়, কিন্তু বিশ্লেষণের কোনও সুযোগ দেয় না। যদি বা কাটাছেঁড়া কিছু হয় তা শুধু জনপ্রিয় চরিত্র নিয়ে, গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে নয়। ‘উপর্যুপরি বিশ্লেষণের সুযোগ’, এই প্রসঙ্গটির প্রেক্ষিতে একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে মার্গারেট অ্যাটউড-এর কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য হ্যান্ডমেড’স টেল’। এ গল্প গড়ে উঠেছে ভবিষ্যৎ কালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে রাষ্ট্র সন্তানোৎপাদনে সক্ষম মহিলাদের বাধ্য করে শোষক শ্রেণির সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তানচাহিদা মেটাতে। ১৯৮৫ সালে যখন এ বই বেরোয় তখন সব সমালোচকই তার তুলনা করেছিলেন জর্জ অরওয়েল-এর কালজয়ী উপন্যাস ‘১৯৮৪’-র সঙ্গে। দুটি বইয়েই আমরা দেখেছি, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র কী ভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো। মার্গারেটের কল্পনার সেই রাষ্ট্র প্রবল পুরুষতান্ত্রিকও, সে নিয়েও আশি বা নব্বইয়ের দশকে আলোচনা কম হয়নি। দু’বছর আগে ‘দ্য হ্যান্ডমেড’স টেল’ টিভি সিরিজ় হিসাবে ছোটপর্দায় দেখা দিলে ফের শুরু হয় বিশ্লেষণ। বহু নবীন সমালোচক ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে মার্গারেটের কল্পনার আমেরিকার আশ্চর্য মিল খুঁজে পান। সেই মিলের কথা স্বীকার করে নেন স্বয়ং লেখিকাও। পুরুষতান্ত্রিকতা ছাপিয়েও এই আলোচনায় মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে সন্তানহীনতার কারণগুলো। ২০১৯-এর আমেরিকায় মহিলারা বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের ডিম্বাণু ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে, ভয় পাচ্ছেন একটি বাচ্চাকে মানুষ করার প্রবল খরচের সম্মুখীন হতে, সামাজিক পরিচিতি ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে ইচ্ছা থাকলেও অস্বীকার করছেন গৃহবধূ হয়ে থাকতে। এবং এ সমস্যা শুধু আমেরিকারই নয়। ভারতেও শ্রেণি নির্বিশেষে ক’জন মহিলা স্বেচ্ছায় প্রজনন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি নিতে পারেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চেহারাটাও এত দিনে বদলে গেছে— কর্তার ইচ্ছেয় আর নয়, বাজারের ইচ্ছেয় কর্ম। শ্রেণিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটাতে হ্যান্ডমেডদের মালকিনদের যে মূল্য দিতে হচ্ছে তাও নেহাত কম নয়। প্রায় ৩৫ বছর পর দেখতে পাচ্ছি, তথাকথিত শোষক আর শোষিতের ব্যবধান ক্রমেই ঘুচে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে কল্পবিজ্ঞান আর বাস্তবের গণ্ডিও।

জুল ভের্ন ‘টুয়েন্টি থাউজ়েন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ লেখার প্রায় আঠারো বছর পর বানানো হয় সত্যিকারের ইলেকট্রিক সাবমেরিন, এইচ জি ওয়েলস ‘দ্য ওয়র্ল্ড সেট ফ্রি’ লেখার প্রায় তিরিশ বছর পর তৈরি হয় আসল পারমাণবিক বোমা। কিন্তু দুটি উপন্যাসের কোনওটিই পৃথিবীবিখ্যাত হয়নি স্রেফ সাহিত্যিকের কল্পনা পরীক্ষাগারে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে। দুই লেখকের রাজনৈতিক বক্তব্যই বরং সারা দুনিয়ার পাঠককুলকে বারবার আলোড়িত করেছে। ক্যাপ্টেন নিমোর সাবমেরিন এক শোষিত পৃথিবীর প্রতীক, যেখানে প্রযুক্তি বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। ওয়েলস-এর পৃথিবীতে আবার প্রযুক্তির উন্নতি যুদ্ধকে করে তোলে অবশ্যম্ভাবী। এক শতাব্দী পরেও প্রযুক্তির এই পরস্পরবিরোধী দুই ভূমিকা আমাদের সমান ভাবায়। তাই সার্থক কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব আবশ্যিক নয়, আবশ্যিক হল বাস্তবিক বা কাল্পনিক বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমাজ সচেতনতা।

আমাদের প্রতিবেশী দেশের এমনই এক সমাজসচেতন সাহিত্যিকের কথা বলে শেষ করি। সিশিন লিউ এই মুহূর্তে চিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক। তাঁর ‘রিমেমব্রেন্স অব আর্থ’স পাস্ট’ ট্রিলজি বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে। সেই ট্রিলজির প্রথম খণ্ডের নাম ‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’, যে গল্প শুরু হচ্ছে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। ১৯৬৬-৭৬, দশ বছর ধরে চলেছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যদিও তার ভিত স্থাপন হয়েছিল আরও আগেই। মাও জে দং জানিয়েছিলেন, আগের বুর্জোয়া সরকার এবং তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে পুরনো চিনা সংস্কৃতি। তাকে নির্মূল করতে না পারলে নতুন গণতন্ত্র আনা সম্ভব নয়। যদিও মাও নিজেই জানিয়েছেন, পশ্চিমি দুনিয়া যে ভাবে গণতন্ত্রকে বোঝে, এই নতুন গণতন্ত্র তার থেকে আলাদা, সে পদ্ধতি বহুলাংশেই স্বৈরাচারী। লিউ-এর উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার শিকার। সেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা হৃদয়বত্তা, কোনওটাই দর পায় না। ঘটনাচক্রে তার সঙ্গেই যোগাযোগ হয় ভিনগ্রহী প্রাণীর। তারা চায় নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মানবজাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে। কিন্তু নতুন পৃথিবীর জন্য তাদের সাহায্য দরকার পুরনো পৃথিবী থেকেই। অসাধারণ দক্ষতায় লিউ তাঁর উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন সমান্তরাল আর এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে। যেন দেখাচ্ছেন, মাল্টিভার্সের এক প্রান্তে যার নাম সাধারণ বোধ, অপর প্রান্তে তাকেই বলা হচ্ছে ধর্মান্ধতা।

অন্য বিষয়গুলি:

Science Fiction Bengali Language Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy