Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব ২০)
novel

মায়া প্রপঞ্চময়

হাতিদেরও তো আবার আসার সময় হল। পুরনো রেকর্ড বলছে যে বান্দোয়ানের ময়ূরঝরনা দিয়ে প্রতি বছরই ঢোকে ওরা।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:১২
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: ধীরেনবাবুর পাঠানো প্রতিনিধি লম্ভোদর মানকিকে সঙ্গে নিয়ে ঢ্যাঙাডুংরির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল অনিকেতরা। জায়গায় পৌঁছে অফিসার লোহারবাবু বেশ কিছু কুঁড়ে ধসিয়ে দেন। হঠাৎই এক অদ্ভুত তীব্র আওয়াজ শুনে সকলে পালায়। তির-কাঁড়, টাঙি, সড়কি আর ফারসা নিয়ে বহু লোক লোক ঘিরে ফেলে বোসস্যরকে। আতঙ্কিত বেন্দা স্যরের আশা ছেড়ে দেয়। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে নিশ্চিত বিপদ থেকে বেঁচে ফেরেন অনিকেত।

পিচরাস্তায় উঠে হাত নেড়ে তখন দূরে-থাকা গাড়িগুলোকে সিগন্যাল দিয়েছিল বেন্দা। জিপ থেকে নেমেই থানার বড়বাবু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘তোমাদের পাগলা সাহেব আছেন না টেঁসে গিয়েছেন? উফ! এ সব জায়গায় ফুল ফোর্স নিয়েও আমি আসতে চাই না, আর উনি নিধিরাম সর্দার হয়ে এমসিসি ট্যাকল করতে বেরিয়েছেন! অ্যাই, তোরা রাইফেলগুলো ঠিকঠাক করে বাগিয়ে বোস। অন্ধকারে আবার কেউ তির বা পেটো না ছুড়ে দেয়...’’

সবাইকে চমকে দিয়ে অন্ধকার থেকে স্যর বেরিয়ে এলেন, ‘‘প্লিজ় বড়বাবু, আবার গুলি-টুলি ছুড়ে বসবেন না যেন! অতি কষ্টে কাঁড় আর ফারসার কবল থেকে বেরিয়েছি, এর পরে পুলিশের গুলি সহ্য হবে না। গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বলুন, এখন অন্তত কেউ তির-পেটো মারবে না। আমি গ্রামবাসীকে অহিংসা-ব্রতে উদ্বুদ্ধ করে এসেছি।’’

গাড়িতে ফিরতে ফিরতে বড়বাবুর প্রশ্নের উত্তরে স্যর জানালেন, ‘‘একটা কাজ করে আর একটা কাজ না করে আজ আমি বেঁচে গিয়েছি। প্রথমত, আমি আন্দাজ করেছিলাম যে, বিপদে পড়লে সবাই পালাবে কিন্তু আমি ময়দানে টিকে থাকার জন্যে কোনও হুইপ দিইনি। দিলে দু’চার জন অন্তত আমার পাশে থাকত। একা থাকার বেনিফিট না পেলে অন্যদের সঙ্গে আমিও খুন হতাম। দ্বিতীয়ত, মেয়েদের গায়ে হাত দিতে দিইনি। ওদের ঘরে চড়াও হওয়াও আটকে দিই। সুকর্মের ফল হিসেবে ওই মেয়েরাই শুরুতে আমায় ঘিরে প্রোটেকশন দিয়েছিল, পরে এমসিসি ছেলেগুলোও জনমত তৈরি করল আমার ফেভারে। জানেন তো, আদিবাসীদের কাছে মেয়েদের সম্মান অনেক বড়।’’

এর পর অন্য বিষয়ে কথা শুরু হল, কিন্তু স্যর এক বারও উল্লেখ করলেন না যে বেন্দাকে বাদ দিলে সব স্টাফ-অফিসারই ওঁকে বিপদের মুখে ফেলে পালিয়েছিল। রেঞ্জে ফিরে বেন্দা এই প্রশ্নটা ওঁকে করেছিল। উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে ফেলে পালিয়েছিল, এই লজ্জার কথাটা আমি না বললে বরং বেশি করে থাকবে ওদের মনে। বারবার কথাটা তুললে ওদের অপরাধবোধটা কমে যাবে। চুপ থাকলে সেটা বরং বেশি সুবিধে দেবে আমাকে। ধীরেনবাবুকেও চাপে রাখতে সুবিধে হবে এখন।’’

সুবিধে যে হল, সেটা পর দিন সকাল সাড়ে দশটার সময় বুঝতে পারল বেন্দা। কুয়োর পাশে বাইকটা রেখে ও আগের দিনের ধুলো মাটি সাফ করছে, লজ্‌ঝড়ে মোপেড ফটফটিয়ে ধীরেনবাবু রেঞ্জ অফিসে ঢুকলেন হন্তদন্ত হয়ে। স্যর টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কী করছিলেন, ধরমশাই প্রায় ককিয়ে উঠলেন, ‘‘আপন্যে ত্যো বিশ্বঘাতী লোক মহায়, বিকেলে কী করে এল্যেন বল্যেন তো, মাঝরাত্যে দেখি কি না একশো-সোয়াশো লোক মশ্যাল-মিচ্ছিল করে আমার বাড়ি ঘিরছ্যে! আবার স্লোগ্যান দিছে কী, আম্মিই না কী দায়ী ওদ্যের উচ্ছ্যেদ করার জন্যে! ভাব্যেন কাণ্ডটো, আমাকে কথা দিতে হল্য য্যে যুদ্ধ্যকালীন ভিত্তিতে উয়াদের পাট্টা দিব খাসজমির, তব্যে ছাড়ান পেল্যম!’’

জানলা দিয়ে স্যরের মুখে হাসি দেখতে পেল বেন্দা, ‘‘কী আর করি বলুন, আপনি ঢিলটা ছুড়লে তো পাটকেলটা খেতেই হবে! তা ছাড়া, ওদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমার আঁতে ঘা দিলেন আপনি। ওদের আর্থিক অবস্থাটা কি দেখেছেন এলাকার কর্মকর্তা হয়ে? ওরাই তো সরকারি খাস জমির পাট্টা পাওয়ার উপযুক্ত লোক। শুধু সেইটুকুই আমি ওদের বলেছি, আর কিচ্ছু নয়।’’

ধরমশাই হাঁ-হাঁ করে ওঠেন, ‘‘রক্ষ্যা করেন মহায়, আর কিছু বইলত্যে হব্যেক নাই, বুঝ্যে লিয়েছি। আমার কাছ্যে গোলা লোক্যে কত্তই কমপেলেন করে, আমি সেগুলান যথাযোইগ্য স্থান্যে পাঠ্যায়েঁ দিই। আপনাকে বল্যে গেল্যম আমার সবুজ কালিতে লেখ্যা চিঠ্যিগুলান আপনেও যথাযোইগ্য স্থান্যে পাঠ্যায়েঁ দিব্যেন...’’ বলে উনি আঙুলের ইশারায় বাতিল কাগজের জন্য ঝুড়িটা দেখিয়ে দিলেন। তার পর বললেন, ‘‘তব্যে হ্যাঁ, লাল কালিতে যেগুলান আইসব্যেক, সেগুলান টুকু সিরিয়াসলি নিব্যেন, ক্যামন কি ন্যা?’’

স্যর হো হো করে হেসে বলেন, ‘‘আপনার লাল-সবুজের নিয়মটা আমি মনে রাখব। দেখেছেন তো, ফরেস্টের সাইনবোর্ডও কিন্তু লাল-সবুজ রঙের। তা হলে এখন থেকে আমাদের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি থাকল না। আপনার সাহায্য ও সহযোগিতা সব সময়, সব জায়গায় কাম্য। কাচের ঘরে বাস করে অন্যকে ঢিল না ছোড়াই ভাল।’’

পর দিন সকালেই স্যর আবার আগের মতো, যেন আগের দিন তেমন কিছুই হয়নি। ওকে বললেন, ‘‘নান্না বিট অফিসের শেষ মাথায় রেঞ্জের একটা ওয়াচ টাওয়ার হচ্ছে। দলমা থেকে আসা হাতির পালকে আগে থেকে ট্র্যাক করার জন্যে। গিয়েছিলে নাকি ওখানে কোনও দিন?’’

বেন্দা জায়গাটা চেনে শুনে বললেন, ‘‘চলো এক বার। কাজ কতটা এগোল দেখে আসি। হাতিদেরও তো আবার আসার সময় হল। পুরনো রেকর্ড বলছে যে বান্দোয়ানের ময়ূরঝরনা দিয়ে প্রতি বছরই ঢোকে ওরা। এক-দু’দিন থেকেই মেদিনীপুরের গড়বেতার দিকে চলে যায়। বিট অফিসার রসময়বাবুকে খবর দেওয়ার সময় নেই, তার উপর কাল যা দৌড়ঝাঁপ গেল, বয়স্ক মানুষ হয়তো একটু ডাউন আছেন, তাই নিজেই ঘুরে আসি।’’

বান্দোয়ান-কুইলাপাল হয়ে যে রাস্তাটা ঝিলিমিলি ছুঁয়ে রানিবাঁধ-খাতড়ার মধ্যে দিয়ে বাঁকুড়া শহরে গিয়েছে, সেই রাস্তা থেকে কুইলাপালের আগেই ডান দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নান্না বিট অফিসে যাওয়ার আঁকাবাঁকা ফরেস্ট রোড। জিপ কোনও মতে যেতে পারে, বাইক বেশ স্বচ্ছন্দে যায়। অফিসে বিটবাবু নেই, ডাক্তার দেখাতে ঝিলিমিলি গিয়েছেন, বাড়িও তার কাছাকাছি। ফলে আজ আর ফিরবেন না। কাল রেঞ্জ অফিসে কাজ সেরে তবে বিটে ফিরবেন। লোকাল স্টাফরা জানাল, কাল পর্যন্ত হাতির কোনও খবর নেই। টাওয়ারের কাজ সামান্য বাকি আছে। ময়ূরঝরনার বাংলা-বিহার সীমান্তের শেষ আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম, নাম গুড়পনা।

গ্রামের শেষ প্রান্তে বাইক রেখে দু’জনে নির্মাণস্থলে গিয়ে কাজ দেখে মাপজোক করতে বেলা এগারোটা বেজে গেল। স্যর বললেন, ‘‘এত দূর যখন এলামই যখন, চার পাশটা খুঁটিয়ে দেখে যাই। গ্রামের লোক তো বলল যে, পুরুলিয়ার এ দিকটার নাম ময়ূরঝরনা আর বিহারের ও দিকটার নাম লটঝরনা। টাওয়ারের উপর থেকে মাঝখানে একটা সরু ঝোরা দেখলাম, ওটা পার হয়েই হাতির পাল ঢোকে। আমি সামনের ডুংরিটা পেরিয়ে ঝোরায় ওদের বর্ডার ক্রস করার লোকেশনটা দেখে আসি। তুমি মনে করলে এখানে একটু জিরিয়ে নিতে পার।’’

স্যরকে একা ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে ওর ছিল না, তাই বেন্দা সঙ্গে যাওয়াই ঠিক করল। ডুংরিটা চড়তে গিয়ে বুঝল, ভুলই করেছে পাগলের পিছন পিছন এসে। টিলাটা বেশ খাড়াই আর ওঠার মতো সে রকম কোনও রাস্তাও নেই। এখান থেকে তেমন শুকনো কাঠ পাওয়া যায় না বলে গ্রামের লোকেও উপর দিকে ওঠে না। ফলে তাদের পায়ে-পায়েও কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি। তবুও বলে যখন ফেলেছেন, উনি ওটা টপকে উল্টো দিকে যাবেনই! সুতরাং ঝোপঝাড় টপকে কখনও ছোট গাছের ডাল, কখনও মোটা শালগাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ওদের উপর দিকে যাত্রা চলল। এক সময় হাঁপাতে-হাঁপাতে টিলার মাথায় উঠল ওরা। তার পর উল্টো দিকে নেমে ঘন জঙ্গলের ঝোপ ঠেলে ঝোরার পাশটায় পৌঁছেও গেল দু’জনে।

ছোট্ট নদীটা এখানে বাঁক নিয়েছে। পাড়টা ধসপ্রবণ। নদীর জলটুকু পেরোলেই ঘন শালজঙ্গল। বেন্দা আন্দাজ করল, দলমার হাতির পাল ওই শালজঙ্গলের ভিতর দিয়ে এই নদীতে নামে, তার পর জল-টল খেয়ে, কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে মেদিনীপুরের পথে এগোয়। কথাটা ভাবতে-ভাবতে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। তার পর যা ভাবছে, সেটা বলবে বলে স্যরের দিকে মুখ তুলে তাকাতে ওঁর পরিবর্তনটা টের পেল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছে। স্যর ওর জামার কলার ধরে টানতে টানতে একেবারে পাড়ে নিয়ে গিয়ে এক ধাক্কায় অপ্রস্তুত বেন্দাকে নদীগর্ভে ফেলে দিলেন।

গাড়িতে উঠে ফোনে খবরাখবর নিয়ে অন্নু দেখল, বিষয়টা গুরুতর আকার নিতে চলেছে। কিছু অডিট কোয়্যারি তো আছেই, সেগুলো তেমন বড় ধরনের নয়। সমস্যা মারাত্মক চেহারা নিয়েছে বেণুকে নিয়ে, যার পুরো নাম বেণুগোপাল মেহতা। বছর চারেকের ছেলেটা স্প্যাস্টিক চাইল্ড না হলেও অটিজ়মের শিকার। নড়াচড়া করতে ওর অসুবিধে নেই। মানসিক ভাবে একটু পিছিয়ে থাকলেও একেবারে জড়বুদ্ধি নয়। নিজে থেকে সব কাজ এখনও করতে পারে না, কিন্তু অনেকটা বুঝতে পারে। মুখের আদলটা একেবারে ঝুঁটি-বাঁধা কেষ্টঠাকুরের মতো। অন্নুর খুব নেওটা। ওকে বেশি ভাল লাগে মুখের ইনোসেন্ট ভাবটার জন্য। অন্নু কাছাকাছি গেলেই ও হাত পাতবে পাওনা আদায়ের জন্য। ব্যাগ থেকে এক-আধটা চকলেট বা লজেন্স বার করে ওকে দিতেই হবে, না হলে পিছু ছাড়বে না। সেই বেণু একটা নতুন পাঁচ টাকার কয়েন গিলে ফেলেছে।

সমস্যাটা অন্নুর কাছে উভয়সঙ্কটের, মানে লিগ্যালি আর মর‌্যালি দু’দিক থেকেই অন্নুর সংস্থা এবং অন্নুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ওদের এনজিও কিছু দিন হল স্প্যাস্টিক বাচ্চাদের সঙ্গে-সঙ্গে বয়স্ক ও নিঃসঙ্গ মানুষদের দেখাশোনা শুরু করেছে। এ দিকে বেণুর বাবা রতনলাল মেহতা প্রীতের ব্যবসার বড় অংশীদার। জন্মের পর থেকে ছেলে আদরেই বড় হচ্ছিল। কিন্তু দেড় বছরেও বাচ্চা স্বাভাবিক রিঅ্যাক্ট করছে না, মা-বাবার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না, কারও চোখে চোখ রাখছে না— এ সব লক্ষ করে স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখানোয় রোগটা ধরা পড়ে। তাঁরই ঐকান্তিক অনুরোধে অন্নু বেণুকে স্পেশাল কেস হিসাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়েছিল। স্প্যাস্টিকদের জন্যে ওদের বিশেষ ধরনের থেরাপি আছে। তার জন্য ডেডিকেটেড সাইকোলজিস্ট, ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, রিক্রিয়েশনাল থেরাপিস্ট আছেন। কিন্তু বেণুকে ঠিকমতো মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট দেওয়ার পরিকাঠামো অন্নুদের নেই। তা সত্ত্বেও স্রেফ ব্যবসার বড় অংশীদার হওয়ার দরুন মি. মেহতাকে ‘না’ বলা যায়নি। বোর্ডে এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিল অন্নু, সেই সঙ্গে জানিয়েছিল, মি. মেহতা ওদের সংস্থায় বড় অ্যামাউন্টের ডোনেশন দেবেন।

সকলে মিলে ডিসিশন নিয়েছিল যে, এখন বেণুকে ক্যাজুয়াল থেরাপির আওতায় রাখা হবে। পরে আরও এ ধরনের পেশেন্ট পেলে অটিজ়ম থেরাপির একটা পুরোদস্তুর সেকশন চালু করা হবে। মাসখানেক ঠিকঠাকই চলছিল, হঠাৎই আজ এই দুর্ঘটনা। ও কয়েনটা গিলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই অন্নুর বাড়ির সামনে অপেক্ষারত ড্রাইভারকে ফোনে খবরটা দেওয়া হয়েছে। ফলে অন্নুরও দেরি হয়নি পৌঁছতে। তবে ও ফোনেই নির্দেশ দিয়েছিল, একটুও সময় নষ্ট না করে শহরের সবচেয়ে নামী নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে। তার পর নিজেও গাড়ি ঘুরিয়ে সেই রাস্তায় যেতে যেতে ওর চেনা ড. দেশাই আর ড. জোশীকে ফোনে ঘটনাটা জানিয়ে মতামত আর সাহায্য চাইল। দু’জনেই ওই নার্সিংহোমে অ্যাটাচড এবং ড. দেশাই আবার ইএনটি স্পেশালিস্ট।

রাস্তায় কিছুটা জ্যামে পড়ে টেনশন বেড়ে গেল অন্নুর। ওর নিজেকে দায়ী করার অন্য একটা কারণ হল ওর দেওয়া চকলেট। প্রীতের সঙ্গে দিনদশেক আগে ব্যবসার প্রয়োজনে আবার একই সঙ্গে ছুটি কাটাতে সিঙ্গাপুর আর কুয়ালা লামপুর গিয়েছিল ও। এয়ারপোর্টে গিনির মতো দেখতে চকলেটগুলো দেখে খুব পছন্দ হওয়ায় বড় এক প্যাকেট কিনে এনেছিল বেণুর জন্য। দু’টো চকলেট পেয়ে মনের খুশিতে অন্নুকে জড়িয়ে ধরে দুর্বোধ্য আওয়াজে আনন্দ প্রকাশ করেছিল, যা সচরাচর ও করে না।

আরও তিন দিন বেণুকে ওই চকলেট দিয়েছে অন্নু। অন্নুর মনে হচ্ছে যে, সোনালি রঙের গোলাকার চাকতিগুলো খেতে খুব ভাল, সেটা বেণু তার দুর্বল মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝে নিয়েছিল। তার পর কারও কাছ থেকে পড়ে-যাওয়া নতুন চকচকে কয়েন হাতে পেয়ে সেটা মুহূর্তে মুখে পুরে ফেলেছে। ভাগ্য ভাল, এক জন আয়া সেটা সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায়, তবে ওর মুখ থেকে আর সেটা বার করা যায়নি।

অন্নু যখন গিয়ে পৌঁছল, তখন বেণুকে সিডেটিভ দিয়ে ওটি-তে ঢোকানো হয়েছে। অন্নু ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে পাশের ঘরে গিয়ে বসল, যেখানে একটা মনিটরে দেখানো হচ্ছিল কী ভাবে এক্স-রে প্লেটের ছবি অনুযায়ী কয়েনটা খাড়া ভাবে বেণুর গ্রাসনালী বা ইসোফেগাসে আটকে আছে। একটু পরে এন্ডোস্কোপির মাইক্রো-ক্যামেরার মাধ্যমে ওর গলার ভিতরে নরম মাংসপেশির খাঁজে ঢুকে থাকা কয়েনটাকে দেখা গেল। খুব সূক্ষ্ম ক্যাথিটারে লাগানো ক্লিপের সাহায্যে ডাক্তার ও নার্সেরা আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে মিনিট পনেরোর চেষ্টায় কয়েনটা বার করে আনলেন। যত বার কয়েনটা ক্লিপের গ্রিপ থেকে ফসকে যাচ্ছিল, অন্নুর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। কয়েনটাকে চোখে দেখে মুক্তির শ্বাস ফেলল অন্নু। মনে মনে ঠিক করল যে, যদি একান্তই বেণুর বাবাকে বোঝানো না যায় ছেলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য, তবে ছেলেটাকে সর্বক্ষণ নজরে রাখতে স্পেশাল নার্স রাখতেই হবে।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Novel Maya Prapanchamay Rabibasoriyo Novel Kanailal Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy