ঐতিহ্য: ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজ়িয়ামে রাখা ‘ফার্স্ট ফোলিয়ো’।
যে মেলাকে আমাদের আধুনিক বইমেলার পূর্বসূরি বলা চলে, তা হল ফ্রাঙ্কফুর্টের শিল্প মেলা। এখানে দ্বাদশ শতক থেকে বিক্রি হত হাতে লেখা বই বা পুঁথি। ১৪৬২ সালের আগেই এখানে পুরোদস্তুর বইমেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। বইমেলা থাকলে তো তার ক্যাটালগও থাকবে। সে যুগে ক্যাটালগ বেরোত মেলার আগে, বইপ্রেমী মানুষের কাছে তা ছিল খুবই আগ্রহের। টেমসের এক পারে ছিল মূল লন্ডন শহর, আর ‘গ্লোব’ থিয়েটার, যেখানে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা নাটক অভিনয় হত, তা ছিল অন্য পার। দুপুর-দুপুর নাটক দেখে বিকেলের মধ্যে নৌকো করে বাড়ি ফিরে যেতেন সকলে।
শিক্ষিত মানুষের প্রধান বিনোদন ছিল বই। নতুন বইয়ের খোঁজ দিত ক্যাটালগ। বই প্রকাশের সংখ্যাও তখন খুব কম। ১৬২২-এর বইমেলার ক্যাটালগে দেখা গেল, সে বছর অক্টোবরের মধ্যে প্রকাশিত হবে একটি বই— শেক্সপিয়রের ৩৬টি নাটকের সঙ্কলন। আজ সাহিত্যমহলে যা ‘ফার্স্ট ফোলিয়ো’ হিসেবে খ্যাত। সেই প্রথম শেক্সপিয়রের সমস্ত নাটকের একত্র প্রকাশ, যার মধ্যে মাত্র ১৯টি নাটক তখন পর্যন্ত পুস্তিকাকারে প্রকাশিত। শেষ পর্যন্ত বইটি ১৬২২-এ বেরোয়নি, বেরোয় পরের বছর, ১৬২৩-এ। চারশো বছর আগে।
বইটির প্রকাশের তারিখ জানা না গেলেও, জানা যায় কবে ও কে কিনেছিলেন প্রথম কপি। ১৬২৩-এর ৫ ডিসেম্বর এডওয়ার্ড ডেরিং নামে এক ভদ্রলোক অক্সফোর্ডের বডলিয়ান লাইব্রেরির তরফে কেনেন বইটির দু’টি কপি। বই প্রকাশের সেই আদিযুগে বইয়ের দু’টি চেহারা বা আকৃতি ছিল, ‘কোয়ার্টো’ ও ‘ফোলিয়ো’। ‘ফার্স্ট ফোলিয়ো’ ছাপা হয়েছিল সাড়ে সাতশো কপি, যার মধ্যে আড়াইশোরও কম কপির হদিস পাওয়া যায় আজ। এর মধ্যে সব থেকে বেশি কপি রয়েছে ওয়াশিংটন ডি সি-র ফোলগার শেক্সপিয়র লাইব্রেরিতে, ৮২টি কপি।
অভিনেতা, নাট্যকার, ‘কিং চেম্বারলেন’স মেন’ (পরে নাম হয়েছিল ‘কিং’স মেন’) দলের সদস্য, এমন বহুবিধ কর্মবহুল জীবন যাপন করে ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল প্রয়াত হন শেক্সপিয়র। ফার্স্ট ফোলিয়ো প্রকাশের প্রায় সাত বছর আগে। নিজের সব নাটক দু’মলাটের মধ্যে দেখে যাননি এই প্রবাদপ্রতিম লিখিয়ে। শেক্সপিয়রের প্রথম প্রকাশিত বই (কোয়ার্টো) প্রকাশিত হয় ১৫৯৩ সালে, ‘ভেনাস এন্ড অ্যাডোনিস’ আর তার পর ‘রেপ অব লুক্রেস’ (১৫৯৪)। দু’টিই আখ্যানকাব্য। ১৯টি নাটক পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল এই ফার্স্ট ফোলিয়ো প্রকাশের আগে। এগুলির কোনও বাঁধাই ছিল না, অনেকটা ভাঁজ করা গোছা কাগজের মতো ব্যাপার ছিল, সবগুলি একত্রে কিনলে যা দাম পড়ত আজকের হিসাবে তা পাঁচ পাউন্ডের মতো। যিনি কিনছেন তাঁর রাখার ইচ্ছে থাকলে নিজের খরচে বাঁধিয়ে নিতে হত। কোয়ার্টো বা ফোলিয়ো ছাড়া আর একটা পুস্তক-আকার ছিল যাকে বলা হত ‘অক্টাভো’, তার আয়তন ছিল মোটামুটি কোয়ার্টোর অর্ধেক। সে যুগে বই ছাপানোর খরচের ৭৫% চলে যেত কাগজের দামে। কাজেই অক্টাভো-র মধ্যে বইকে আঁটিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলত, যাতে দাম থাকে কম আর বিক্রি হয় বেশি। গ্রিক পুরাণভিত্তিক শেক্সপিয়রের আখ্যানকাব্যগুলি এই অক্টাভো চেহারাতেও পাওয়া যেত, সেগুলি ছিল বেশি জনপ্রিয়। নেপথ্যে অন্য কারণও ছিল। অগাস্টাস সিজ়ার-এর সমসাময়িক রোমান কবি ওভিদ গ্রিক পুরাণভিত্তিক যে কাব্য লিখেছিলেন তা পাওয়া যেত এই অক্টাভো চেহারায়। তাই একই ধরনের বিষয় নিয়ে লেখা শেক্সপিয়রের রচনাকে ‘অক্টাভো’ চেহারায় প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন প্রকাশকেরা, হয়তো কবিকে ‘জাতে তোলার’ জন্যই।
ফার্স্ট ফোলিয়ো-র সম্পাদনা করেন জন হেমিংগে ও হেনরি কনডেল। দুজনেই ‘কিংস মেন’ নাট্যদলের অভিনেতা। প্রকাশক ছিল ‘স্টেশনারস কোম্পানি’ যারা ১৫৫৭-তে পাওয়া সনদের জোরে তখনকার একমাত্র প্রকাশক। হেমিংগে ও কনডেল-এর বক্তব্য ছিল ‘ফার্স্ট ফোলিয়ো’ প্রকাশের পর সেটিই একমাত্র গণ্য করা হবে কারণ আগে যা প্রকাশিত হয়েছে সবই ‘অসাধু লোকের দ্বারা চুরি করে ছাপা’। তখন ইংল্যান্ডে কাগজ সবে বানানো শুরু হয়েছে। ভাল কাগজ তেমন নেই। তাই ‘র্যাগ পেপার’ আনা হল প্যারিস থেকে। এ কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন এডওয়ার্ড ব্লাউন্ট এবং উইলিয়াম ও আইজ্যাক জ্যাগার্ড-ও। শেষোক্ত দু’জন পিতাপুত্র। জ্যাগার্ডদের ছিল ছাপাখানার ব্যবসা। এই ফার্স্ট ফোলিয়ো-র টাইপসেটিং ও ছাপা এমনই এক ব্যাপার ছিল যা জ্যাগার্ডদের ছাপাখানা ছাড়া সম্ভব ছিল না বলে অনেকের মত। এ কাজ যখন চলছে তখন উইলিয়াম জ্যাগার্ড বৃদ্ধ ও অসুস্থ, বই প্রকাশের এক মাস আগে তিনি মারাও যান। বেশির ভাগ কাজটাই সামলাতে হয় আইজ্যাককে। ১৬২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু হয়ে বই তৈরি হয় ১৬২৩-এর নভেম্বরে এসে। যে নাটকগুলি এর আগে প্রকাশিত হয়নি সেগুলি হল ‘দ্য টেম্পেস্ট’, ‘দ্য টু জেন্টলমেন অব ভেরোনা’, ‘মেজার ফর মেজার’, ‘দ্য কমেডি অব এররস’, ‘অ্যাজ় ইউ লাইক ইট’, ‘দ্য টেমিং অব দ্য শ্রু’, ‘অল’স ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল’, ‘টুয়েলফথ নাইট’, ‘দ্য উইন্টার’স টেল’, ‘কিং জন’, ‘হেনরি দ্য সিক্সথ প্রথম ভাগ’, ‘হেনরি দ্য এইটথ’ ‘কোরিয়োলানুস’, ‘টিমন অব আথেন্স’, ‘জুলিয়াস সিজ়ার’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিয়োপেট্রা’, ‘সিম্বেলিন’।
প্রুফ দেখেছিলেন এডওয়ার্ড নাইট, যিনি ছিলেন ‘কিং’স মেন’ নাট্যদলের প্রম্পটার। তখন অবশ্য বলা হত ‘বুক কিপার’ বা ‘বুক হোল্ডার’। আজ যেমন সিনেমার সেন্সর তথা সার্টিফিকেশন বোর্ড রয়েছে, সে রকম ব্যাপার তখনও ছিল। ফার্স্ট ফোলিয়ো-র পাণ্ডুলিপি ছাপার আগে পুরোটা পড়ে দেখে ছাড়পত্র দিয়েছেন ‘মাস্টার অব রেভেলস’ পদাধিকারী এক ব্যক্তি। এটি রাজা নিয়োজিত একটি পদ, এর প্রাথমিক কাজ ছিল রাজবাড়ির সব অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধান, পরবর্তী কালে যোগ হয় এই খবরদারির ব্যাপারটা। মাস্টার অব রেভেলস যা পরিমার্জন করতে বলছেন তা ঠিকমতো করা হচ্ছে কি না দেখার দায়িত্বও ছিল প্রম্পটার এডওয়ার্ডের। ফার্স্ট ফোলিয়ো-র পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ন’শো। নিয়মমতো পুরোটা কম্পোজ় করে প্রুফ দেখে তার পরেই ছাপা শুরু হওয়া উচিত, কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে পুরো প্রুফ দেখা শেষ হওয়ার আগেই ছাপা শুরু করে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১৩৪ পাতার প্রুফ দেখা হয়েছিল ছাপা শুরু হওয়ার পরে। কাজেই এ বইয়ের কিছু কপিতে ভুলের মাত্রা অন্যান্য কপির থেকে বেশি। আর ওই ১৩৪ পাতায় ভুলের সংখ্যা ছিল পাঁচশোরও বেশি। মোট চার জন কম্পোজ়িটর কাজ করেছিলেন এই বই নির্মাণে, তাঁদের কাজের দক্ষতাও সমান ছিল না।
ফার্স্ট ফোলিয়ো উৎসর্গ করা হয় দুই ভাই, উইলিয়াম হার্বার্ট ও ফিলিপ হার্বার্ট-কে। প্রথম জন পেমব্রোকের তৃতীয় আর্ল, পেমব্রোক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, অক্সফোর্ডের চ্যান্সেলরও ছিলেন কিছু দিন। ফিলিপ ছিলেন পেমব্রোকের চতুর্থ আর্ল। চামড়ায় বাঁধানো বইটির যা দাম তখন ছিল এক পাউন্ড (আজকের হিসাবে প্রায় ২০০ পাউন্ড), তখনকার এক জন শ্রমিকের দু’মাসের রোজগারের সমান!
ফার্স্ট ফোলিয়ো-র আগেও এক বার চেষ্টা হয়েছিল শেক্সপিয়রের নাটককে দু’খণ্ডে জড়ো করার। সেটা ১৬১৯ সালের কথা। সে প্রচেষ্টা অবশ্য খুব ছিমছাম পরিষ্কার ব্যাপার ছিল না। বইয়ে ছিল দশটি নাটক, তার সবগুলো আবার শেক্সপিয়রের লেখাও নয়। এই বই পরিচিত ‘ফলস ফোলিয়ো নামে। এর মাত্র দু’টি কপি আজ পাওয়া যায়, যার একটি আছে ফোলগার শেক্সপিয়র লাইব্রেরিতে। এই ফলস ফোলিয়ো-তে জায়গা পেয়েছিল ‘হেনরি দ্য ফিফথ’, ‘কিং লিয়ার’, ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইনসর’, ‘আ মিডসামার নাইট’স ড্রিম’, ‘পেরিক্লিস, প্রিন্স অব টায়ার’, ‘স্যর জন ওল্ড কাসল’, ‘আ ইয়র্কশায়ার ট্র্যাজেডি’, ‘হেনরি দ্য সিক্সথ, পার্ট টু’ ‘হেনরি দ্য সিক্সথ, পার্ট থ্রি’। এর মধ্যে ‘স্যর জন ওল্ড কাসল’ ও ‘ইয়র্কশায়ার ট্র্যাজেডি’-র সঙ্গে শেক্সপিয়রের কোনও সম্পর্ক নেই; ‘পেরিক্লিস’-এর অংশবিশেষ শেক্সপিয়রের লেখা, এমন মত প্রচলিত।
আজ ফার্স্ট ফোলিয়ো-র কোনও কপি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর মহার্ঘতম বইগুলির একটি। ২০২০-তে ক্রিস্টির নিলামে এক কপি ফার্স্ট ফোলিয়ো বিক্রি হয়েছে দশ মিলিয়ন ডলারে। এই বইয়ের কপি চুরিও হয়েছে। ডারহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চুরি যাওয়া একটি কপি উদ্ধার হয়েছে অনেক পরে, ২০০৮ সালে। সেটা ফার্স্ট ফোলিয়ো-রই কপি কি না, নিঃসন্দেহ হতে এক জন জমা দিয়েছিলেন ফোলগার লাইব্রেরিতে! ২০১৪ সালে প্যারিসের এক প্রাসাদে পাওয়া গিয়েছে এক কপি ফার্স্ট ফোলিয়ো, যা নাকি ওই পরিবারের কাছে রয়েছে দুশো বছর ধরে। ২০১৬ সালে এক কপি পাওয়া গিয়েছে স্কটল্যান্ডেও। বাঙালি তো গুপ্তধন ভালবাসে, প্রাচীন বঙ্গরাজা কিংবা জমিদারবাড়ির উত্তরপুরুষেরা চাইলে খুঁজে দেখতে পারেন, কোথাও ভাগ্যক্রমে এক কপি ‘ফার্স্ট ফোলিয়ো’ মেলে কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy