সৃজনমগ্ন: শিল্পীর হাতে সেজে উঠছে ছৌ-নাচের বর্ণময় মুখোশ
২০০১-এর পুরুলিয়া বইমেলা। জার্মানি থেকে এসেছেন দুই কন্যা, আনা আর রিটা। আনার গবেষণার বিষয় মুখোশ-শিল্প। পৌঁছলেন বাঘমুণ্ডির চড়িদা গ্রামে। ছৌ-নাচের মুখোশের গ্রাম। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎই আনা এক মুখোশ-শিল্পী অনিল সূত্রধরকে দেখে চিনতে পারলেন, “একে তো আমি দেখেছি! জার্মানির একটা তথ্যচিত্রে। আমাদের দেশে এটা খুব বিখ্যাত ছবি।” জানা গেল, এক জার্মান সাহেব চড়িদা গ্রামে এক মাসের উপর ছিলেন। ছৌ-নাচের মুখোশ-শিল্পীদের নিয়ে ছবি তৈরি করেছিলেন।
আন্তর্জাল ঘাঁটলে চড়িদা আর মুখোশ-শিল্প নিয়ে তিন ডজন হরেক কিসিমের ভালমন্দ ছবি দেখতে পাবেন। সবই ওপর-ওপর। তাৎক্ষণিক ভাল লাগা আর বিস্ময়ের রসায়নে ছবিটবি তুলে নেট-দরবারে পেশ করা। বাস্তবে একটা পাঁচ-খিলান মুখোশ তৈরি করতে আট-ন’দিন লেগে যায়। কাঁচামাল আর পরিশ্রমের সম্মিলিত মূল্য দেড়-দু’হাজার টাকা শুনলেই আঁতকে ওঠেন শহুরে পর্যটক! তবে বিক্রি হয়। বিদেশেও চাহিদা আছে ছৌ-মুখোশের— কিন্তু তাতে দারিদ্র ঘোচে না! গম্ভীর সিং মুড়া যেমন ইউরোপ-আমেরিকায় শো করে এসে পেয়েছিলেন মাত্র কুড়ি হাজার টাকা, মুখোশের কারিগরদের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। যে জন আছে মাঝখানে— তার পকেটেই ঢোকে বেশির ভাগটা।
ছৌ নাকি ছো, তা নিয়ে যেমন তর্ক আছে, ছৌ নাচে মুখোশের ব্যবহারের সূত্রপাত নিয়েও বিতর্ক থামার নয়। ময়ূরভঞ্জ আর সেরাইকেলার ছৌ নাচে মুখোশের ব্যবহার তেমন নেই, আছে পুরুলিয়ার ছৌ-নৃত্যে। তবে তা নিয়ে এক দলের মত, “আগে ছৌ নাচে মুখোশের ব্যবহার ছিল না।… বাঘমুণ্ডির অবিনাশ সূত্রধর (১৩০৫-১৩৮২ বঙ্গাব্দ) মুখোশ শিল্পের পথিকৃৎ।” এটা যদি সত্য হয়, তবে মুখোশ-নাচের বয়স খুব জোর একশো। আবার ছৌ-বিশারদ আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, “তারাই (চড়িদার শিল্পী) ছৌ নাচের মুখোশের উদ্ভাবক এবং অন্তত দুশো বছর ধরে একই পদ্ধতিতে মুখোশ তৈরি করে সর্বত্র বিক্রয় করছে, সে অঞ্চলে আর কোনো গ্রাম নেই, যাতে ছৌ-নাচের মুখোশ তৈরি হয়।”
পুরুলিয়া শহর থেকে চড়িদা ঘণ্টাখানেকের পথ। প্রায় চল্লিশ কিমি। নিকটবর্তী স্টেশন বরাভূম। দু’দিকে পাহাড় ও অরণ্য দিয়ে ঘেরা গ্রাম। প্রচলিত জনশ্রুতি, ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির জন্য বাঘমুণ্ডির ভূস্বামী রাজা মদনমোহন সিংদেও দেড়শো বছর আগে বর্ধমান জেলা থেকে যে সব সূত্রধর কারিগর নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের বংশধরেরাই দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজ করে যাচ্ছেন। আগে চড়িদা ভৌগোলিক আর সামাজিক দিক থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল, ছেলের বিয়ে দিতে গেলেও পাত্রী আনতে হত বর্ধমান বা বাঁকুড়া থেকে। সংখ্যায় এই গ্রামে আদিবাসীরাই বেশি। তার পরই সংখ্যাধিক্য সূত্রধরদের। প্রত্যেকেরই জীবিকা মুখোশ তৈরি। অনতি-অতীতেও মুখোশের কাজ সারা বছর ধরে চলত না, তখন এরা পালকি বা সিন্দুক তৈরির কাজ করতেন। এখন সারা বছর ধরেই মুখোশ তৈরি হয়। দুর্গাপুজো-কালীপুজোয় থিমওয়ালা মণ্ডপ থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর প্রয়োজনে চাহিদা বেড়েছে, বিদেশযোগ তো আছেই— এ সব কারণে পেশা হিসেবে ছৌ-মুখোশের শিল্পীরা আর বিকল্প খোঁজেন না।
মুখোশ তৈরির উপকরণ অতি সাধারণ। আঠালো মাটি, পুরনো খবরের কাগজ, পুরনো পাতলা কাপড়, ময়দা বা তেঁতুলবীজের আঠা, গর্জন তেল, ধুনো, পাট, নকল চুল, পালক, রাংতা, পুঁতি, সলমা চুমকি আর রং। যন্ত্রের মধ্যে বাটালি, কর্ণিক, হাতুড়ি, কাঁচি। কাদার তাল দিয়ে একটা নমুনা মুখমণ্ডলের অবয়ব তৈরি করা হয় প্রথমে। একে বলে ‘ছাঁচা’। কাঁচা মাটি দু’দিন রোদে দিয়ে শুকিয়ে তার উপর মিহি ছাইয়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর কাগজ আঠায় চুবিয়ে দলা পাকিয়ে আবার খুলে ছাঁচার উপর লেপটে দেওয়া চলতে থাকে আট-দশ বার। এর নাম ‘চিটানো’। কাগজ সাঁটা শেষে তার উপর মাটি দিয়ে চোখ, ভ্রু, নাক, ঠোঁট ও থুতনির যথাযথ রূপ দিতে হয়। একটি পাত্রে তরল কাদামাটির মণ্ডে পাতলা মিহি কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে ছাঁচার উপর টান টান করে ‘কাবিজ লেপা’র কাজ চলে। এর পর বিশেষ ধরনের কাঠের মসৃণ কর্ণিকের মতো যন্ত্র দিয়ে মূর্তিটির উপর পালিশ করা শুরু হয়, যাকে বলে ‘থুপি’ পালিশ। রোদে শুকিয়ে মাটির ছাঁচা থেকে কাগজ-কাপড়ের আস্তরণটি খুলে নিয়ে মুখোশের প্রতিকৃতি বের করে নিতে হয়। মুখোশটিতে চোখ ও নাকের ছিদ্র করে নিয়ে খড়ি গোলা রং চড়িয়ে চরিত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট রঙের প্রলেপ পড়ে। যেমন, রাম বা কৃষ্ণ হলে নীল, মহিষাসুর হলে কালো ইত্যাদি। রং-তুলি দিয়ে চোখ-মুখ-গোঁফ আঁকা সাঙ্গ করে গর্জন তেল দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলেন শিল্পী। মূল মুখোশটি তৈরি। এ বার হয় সাজ-সজ্জা ও মুকুট। কালো রং-মাখানো শনের বা নাইলনের চুল লাগিয়ে, তারের বাঁধনে পাখির পালক, ময়ূরপাখা, রাংতা, পুঁতি, সলমা-চুমকি, জামির পাতা বাঁধা হয়। রীতিমতো শক্তপোক্ত এই বাঁধন, যার ফলে নাচিয়ের হাজার উল্লম্ফনেও মুখোশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বিশেষ আড়ম্বরে যে সব মুখোশের মুকুট সাজানো হয়, তাকে বলে ‘পঞ্চখিলান’ মুখোশ।
২০১০-এ ছৌ নাচ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছিল। পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর বলে প্রধান চরিত্রের মুখোশগুলি হয় রাম, সীতা, হনুমান, রাবণ, ভীম, অর্জুন, অভিমন্যু, দুর্যোধন, পরশুরাম। এ ছাড়া দুর্গা, মহিষাসুর, কার্তিক, গণেশ, শিব, মনসা, কালী, পাশাপাশি সিংহ, বাঘ, বরাহ, ময়ূর, ঘোড়া প্রভৃতি। ঘর সাজাবার উপকরণ হিসেবে শিল্পীরা তৈরি করেন টিয়াপাখি, জটাধারী শিব বা সাঁওতাল দম্পতি। প্রথা ভেঙে রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনাও ছৌ-নাচে স্থান পেয়েছে বলে সিধো-কানহো, ব্রিটিশ পুলিশ, আদিবাসী বিদ্রোহীদের মুখোশও তৈরি করেছেন সূত্রধরেরা।
এখন সারা বছর ধরে এই ‘হেরিটেজ’ শিল্পটির প্রদর্শন হলেও চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মুখোশের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। শিল্পীর বাড়ির বৌ-বাচ্চারাও কাজে হাত লাগায়। চড়িদা গ্রামে গম্ভীর সিং মুড়ার যে মূর্তিটি রয়েছে, তার পাশ দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। দু’পাশে মুখোশ ঘরের সারি— ফ্লেক্সে লেখা ‘সুচাঁদ মুখোশ ঘর’, ‘শিল্পী মুখোশ ঘর’ কিংবা ‘দুর্গাচরণ ছৌ-মুখোশ সেন্টার’। বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা— ‘এখানে অর্ডার অনুযায়ী থিমের কাজ করা হয়’। ‘জঙ্গলমহল ছৌ মুখোশ ঘর’-এর ছাদে লম্বা একটা লাল রঙের ফ্লেক্স, তাতে লেখা— ‘সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী উপেন্দ্র সূত্রধর, তাঁর পুত্র গণপতি সূত্রধর ও তাঁর পুত্র অমর, ভীম, বিপিন, বলরাম সূত্রধর’। আবার মনোরঞ্জন মুখোশ ঘরের মালিক মনোরঞ্জন সূত্রধর নিজেই। করোনাকালের আগে পর্যন্ত তাঁর ঘরে ছাব্বিশ জন শিল্পী এক সঙ্গে কাজ করতেন। কেউ ছাঁচা বানাচ্ছেন, কেউ রং করছেন তো কারও কাজ মুকুট তৈরি। কেউ পেতেন দুশো টাকা সপ্তাহে তো কেউ চারশো। এখন বাজার মন্দা। কোভিড আর মাস্ক অঙ্গাঙ্গি হলেও ছৌ-নাচ আর মুখোশের যথেষ্ট ক্ষতি করে গেছে।
কলেজ-পাশ একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। মন দিয়ে মুকুট সাজাচ্ছে। রাজ্য কলা উৎসবে বছর কয়েক আগে নিজের তৈরি মুখোশের জন্য প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। যুবভারতীতে এসেছিল প্রাইজ় নিতে। পুরস্কার পেয়েছিল একটা সুন্দর ট্রোফি আর মানপত্র। ‘টাকা পাওনি?’ জিজ্ঞেস করাতে সরল ও সুদর্শন ছেলেটি উত্তরে দু’দিকে মাথা নাড়ল। পায়নি। পাওয়ার কিন্তু কথা ছিল! আসলে যে জন থাকে মাঝখানে তাদের কীর্তি ঈশ্বরকেও ঘোল খাইয়ে দিতে পারে। তারা অতীতে গম্ভীর সিং মুড়াকে ঠকিয়েছে, এখন ঠকাচ্ছে স্কুলের গুণী ছাত্রকে। এরাই ‘মুখোশ’-এর প্রকৃত সমঝদার কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy