Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

আমেরিকান শিশুসাহিত্যে সম্মানিত প্রথম বাঙালি

শুধু বাঙালি নন, দক্ষিণ এশিয়া থেকেও ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ই প্রথম এই নিউবেরি পুরস্কার প্রাপক। তাঁর ‘গে-নেক, দ্য স্টোরি অব আ পিজিয়ন’ বইটির জন্য। তিনিই প্রথম ইন্দো-আমেরিকান লেখক, যিনি ঝরঝরে কাব্যিক ইংরেজিতে নিজের দেশ, তার আধ্যাত্মিকতা, দর্শন এবং দেশের মানুষের গল্প পাশ্চাত্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটি বইই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের নিবিড় গল্প।

সাহিত্যিক: ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়।

সাহিত্যিক: ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৬
Share: Save:

তুষারঝড় বন্ধ হয়েছে গত রাত থেকে। ঝিরঝির করে বরফ পড়ছে অবশ্য এখনও। জানালার গায়ে ছোট ছোট বরফকণা লেগে যাচ্ছে। অস্পষ্ট কাচের বাইরে স্পষ্ট দেখা যায় না। তার মধ্যেই ঝাপসা জ্যামিতিক কিছু বাড়ি আর সেগুলির স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল বোঝা যাচ্ছে। স্ট্রিটলাইটের আলো-আঁধারে কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে সেগুলি। জানলার এ পাশে একটা ছোট আরামকেদারায় বসে অন্যমনস্ক ভাবে এ সবের দিকেই তাকিয়ে আছেন এক ভদ্রলোক। এই ব্যক্তি সুপুরুষ, দীর্ঘনাসা এবং তাঁর চোখ গভীর। তাঁর বন্ধুরা বলেন, ভারতের অধ্যাত্মদর্শন আত্মস্থ করেছেন যিনি, তাঁরই এমন চোখ থাকা সম্ভব। তাঁর চোখে যে তীব্র বিষাদও আছে, তা অবশ্য বোঝে কম জনই। এই শীত, এই তীব্র হিমেল হাওয়া ভয়াবহ শূন্যতা সৃষ্টি করে মানুষটির মধ্যে।

ফায়ারপ্লেসের আগুন উসকে দিতে গিয়ে জওহরলাল নেহরুর কথা মনে পড়ল তাঁর। প্রিয়দর্শন এই ছেলেটির সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত সখ্য তৈরি হয়েছে। এই তুষার-ঝরা রাতের কথা তাঁকে লিখবেন বলে ডেস্কে এসে বসতে গিয়ে দেখলেন, ম্যান্টলপিসের উপর কয়েকটা চিঠি পড়ে আছে। একটা চিঠিতে এসে থমকে গেলেন। চিঠিতে লেখা রয়েছে সাহিত্যিক ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়কে তাঁর বই ‘গে-নেক, দ্য স্টোরি অব আ পিজিয়ন’-এর জন্য আমেরিকান শিশুসাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান, নিউবেরি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। চোখ ভিজে এল তরুণের। স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদা যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় আর নেহরু, এই দু’জনকে খবরটা দিতে মন চাইছে এখনই। স্ত্রী এথেল দুগানকেও দিতে হবে খবরটা। প্রথম ভারতীয় শুধু নন, তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী হিসেবেও এই পুরস্কার পাচ্ছেন। চিঠি লিখতে বসলেন ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। তখন রাত প্রায় শেষ। সারা রাত তুষারপাতের পর আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ।

শুধু ‘গে-নেক’ নয়, বাচ্চাদের জন্য আরও কিছু বই লিখেছিলেন ধনগোপাল। ‘কারি দ্য এলিফ্যান্ট’, ‘ঘোন্ড দ্য হান্টার’, ‘হিন্দু ফেবলস ফর লিটল চিলড্রেন’-সহ বেশ কিছু। প্রতিটি বই-ই সমাদৃত হয়েছিল পাঠক মহলে। বড়দের জন্যও বেশ কিছু বই লেখেন তিনি। ‘কাস্ট অ্যান্ড আউটকাস্ট’, ‘মাই ব্রাদার’স ফেস’, ‘দ্য ফেস অব সাইলেন্স’, ‘আ সন অব মাদার ইন্ডিয়া আনসারস’ ইত্যাদি। তাঁর প্রতিটি বইয়েই তিনি বুনেছেন আধ্যাত্মিকতা, জীবনদর্শন আর প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের নিবিড় গল্প। ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রথম ইন্দো-আমেরিকান লেখক, যিনি ঝরঝরে কাব্যিক ইংরেজিতে নিজের দেশ, তার আধ্যাত্মিকতা, দর্শন এবং দেশের জল-মাটি-মানুষের গল্প পাশ্চাত্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। রীতি নীতি আদর্শ ধর্ম নিয়ে যে ভারত, সেই ভারতকে আমেরিকায় বাস করে আমেরিকানদের চিনিয়েছিলেন তিনি। আজ বিস্মৃতপ্রায়, কিন্তু এক সময়ে আমেরিকার হৃদয় জিতে নেওয়া এই গল্পকার তাঁর অতি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনে লিখেছেন প্রায় ২৫টি বই।

১৮৯০-এর ৬ জুলাই কলকাতার কাছে একটা ছোট গ্রামে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। বাবা আইনজীবী ছিলেন, মা নিরক্ষর। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘কাস্ট অ্যান্ড আউটকাস্ট’-এর প্রথম পর্বে বড় হয়ে ওঠার যে গল্প তিনি লিখেছেন, তার পুরোটাই তাঁর মায়ের ছোঁয়ায় স্নিগ্ধ। হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে যে তাঁর জন্ম, সে কথা বার বার বলেছেন বর্ণ-সচেতন লেখক। তৎকালীন সমাজের রীতিনীতিগুলি তাঁর বাড়িতে মেনে চলা হত কঠোর ভাবে। কিন্তু এই দুঃসহ নিয়মের বেড়াজালও আলগা হত মায়ের অন্তর্দৃষ্টিতে। গোঁড়া হিন্দু পরিবারের নিয়ম মেনে চলতে চলতেই কী ভাবে যেন মিশনারি স্কুলে পড়া ছেলের বিশ্বাস রাখতে গিয়ে মা তাঁর ঠাকুরের আসনে রাধাকৃষ্ণের পাশে ঠাঁই দিতেন ক্রুশবিদ্ধ জিশুকেও। সামাজিক বাধা সত্ত্বেও তাঁদের বাড়িতে বাবাকে তালিম দিতে আসতেন এক মুসলমান সঙ্গীতসাধক

‘গে নেক’ বইটির প্রচ্ছদ।

‘গে নেক’ বইটির প্রচ্ছদ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

এই সব কারণেই সম্ভবত, তাঁর কাছে ধর্ম নেহাত অনুষ্ঠানসর্বস্বতা ছিল না। ধর্ম ছিল ঈশ্বরলাভের, সত্য লাভের উপায়। নিরন্তর এই অনুসন্ধানই তাঁকে এক সময় টেনে নিয়ে গিয়েছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক চেতনার সান্নিধ্যে। কিন্তু এ সব অনেক পরের ইতিহাস। ছোটবেলায় স্থানীয় মিশনারি স্কুলে পড়া শেষ করার পর তিনি পড়তে যান ডাফ কলেজে। এর কিছু দিনের মধ্যেই দেশ ছেড়ে পাড়ি দেন বিদেশে। অনেকের মতে, তাঁর সহোদর যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বিপ্লবী কার্যকলাপ এর জন্য দায়ী। এই দাবি যদি সত্যি হয়, তবে ধনগোপালের বাড়ি ছাড়ার বিবরণ রীতিমতো রোমাঞ্চকর।

যাদুগোপাল ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী কালে গান্ধী-অনুগামী যাদুগোপাল তখন ব্যাঙ্ক ডাকাতি থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম, সবেতেই ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। ধনগোপাল সরাসরি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হলেও দাদার হয়ে বার্তাবাহকের কাজ প্রায়ই করতেন। ধনগোপালের ছেলে জুনিয়র ধনগোপালের বক্তব্য অনুযায়ী, গোপন আস্তানার সন্ধান পেয়ে পুলিশ তাঁকে ধরতে হানা দিলে যাদুগোপাল শেষ মুহূর্তে ভাইকে সতর্ক করে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ধনগোপাল গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে এক জাপানগামী ডাচ জাহাজে গিয়ে ওঠেন। সেখানে গিয়ে তিনি টোকিয়ো স্কুল অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন। তবে তাঁর পক্ষে এই ভীষণ যান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে সমঝোতা করা সম্ভব হয়নি। জাপানে পড়া ছেড়ে তিনি চলে যান ক্যালিফোর্নিয়া। সেখানে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন। কখনও কখনও ভবঘুরের মতো সারা দিন রাস্তায় ঘুরে কোনও ক্রমে রাতের আশ্রয় জোগাড়ের জন্য বাগান পরিচর্যা থেকে বাসন মাজা, সবই করেছেন।

এত দিনের চিন্তা আর জীবনধারণের এই বৈপরীত্যের ধারণায় নতুন মাত্রা যোগ করে নৈরাজ্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্টরা সেই সময় তীব্র ভাবে পুঁজিবাদের বিরোধিতা করছে। এঁদের মতাদর্শ জানার আগ্রহ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ধনগোপালকে এঁদের কাছাকাছি এনেছিল। আমেরিকায় পা দেওয়ার পর থেকেই তীব্র বর্ণবিদ্বেষের শিকার ছিলেন তিনি। ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিবেকানন্দের যুগান্তকারী বক্তৃতায় সারা আমেরিকা তুমুল আলোড়িত হলেও সাধারণ ভারতীয়দের গ্রহণযোগ্যতা তেমন বাড়েনি। ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর সদস্যরা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে তাঁদের দলে আহ্বান জানান। বিদেশে এঁরাই ছিলেন ধনগোপালের প্রথম বন্ধু। পরে অবশ্য যখন নামডাক হয়, তখন আমেরিকায় বিবেকানন্দের প্রধান অনুগামী জোসেফাইন ম্যাকলাউডের অনুরোধে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনের মুখ্য প্রবক্তা হন ধনগোপাল। ভারতীয় বলে সুবিধেই হয়েছিল তাঁর। ১৯২৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন ‘দ্য ফেস অব সাইলেন্স’। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে এই বইতে উঠে এসেছে রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন এবং বিবেকানন্দের কথাও। ১৯১৩ নাগাদ ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় সানফ্রান্সিসকোতে পাকাপাকি থাকা শুরু করেন। তত দিনে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছেন। ১৯১৬-১৭ নাগাদ তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হয়— ‘রজনী’ (সংস অব নাইট), ‘সন্ধ্যা’ (সংস অব টোয়াইলাইট) এবং তিন অঙ্কের নাটক ‘লায়লা মজনু’।

এর পর শুরু হয় ছোটদের বই লেখা। যে গ্রামে তিনি থাকতেন, তার পাশেই বিরাট জঙ্গল থাকায় ধনগোপাল প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে পশুপাখি আর মানুষের সহাবস্থান দেখে বড় হয়েছেন। স্মৃতি আর কল্পনায় ভরা ছোটবেলার দিনগুলি তাঁর হাতে প্রাণ পেয়েছে। ‘চিফ অব দ্য হার্ড’ বা যূথপতি এক সর্দার হাতির জীবনের গল্প। ‘কারি, দ্য এলিফ্যান্ট’ অথবা ‘গে-নেক, দ্য স্টোরি অব আ পিজিয়ন’— বাংলায় যে বইটি সমাদৃত হয় ‘চিত্রগ্রীব’ নামে, সবই মানুষ আর পশুপাখির বন্ধুত্বে লালিত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক তীব্র প্রভাব ফেলেছিল তাঁর মনে। গে-নেক আর তার সহযোগী দুই বার্তাবাহক পায়রার সূত্রে সেই ভয়াবহতার কাহিনি লিখেছেন তিনি। জায়গায় জায়গায় চিত্রগ্রীবের মুখে ভাষা দিয়েছেন লেখক। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সে বলছে, প্রকৃতি নিজের নিয়মে চলছে। ইঁদুর গর্ত থেকে গর্তে ছুটে বেড়াচ্ছে, মাকড়সা জাল বুনছে পোকা ধরার জন্য। তারা নিজেদের কাজকর্ম এমন ভাবে করে চলেছে, যেন বাইরে সংঘটিত ভয়ঙ্কর এই মানবহত্যালীলার কোনও গুরুত্বই নেই। লেখক নিজে ভুগেছেন বলেই হয়তো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগেছে তাঁর চরিত্ররা। হিমালয়ের বিশালত্ব এবং বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা আর শান্তি শেষ পর্যন্ত শুশ্রূষা করেছে যুদ্ধপীড়িতদের। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় বইটি। ‘দ্য হর্ন বুক ম্যাগাজ়িন’ লেখে, গে-নেক সত্যিই বার্তাবাহক পায়রা, যে ভালবাসা আর শান্তির বাণী বহন করেছে। ‘দ্য নিউ রিপাবলিক’ লেখে, শিশুসাহিত্যে এই বই এক উল্লেখযোগ্য অবদান। আমেরিকার বুক স্টল আর লাইব্রেরিগুলি ভরে যায় এই বইটিতে। ‘গে-নেক’ ১৯২৮-এ নিউবেরি পুরস্কার পায়।

রুডইয়ার্ড কিপলিং আগেই ভারতের বনভূমি আর মানুষের গল্প লিখেছেন। তাঁর লেখার প্রশংসাও করেছেন ধনগোপাল। কিন্তু আগাগোড়া কিপলিং-এর চিন্তাভাবনার বিরোধী লেখক নিজের লেখায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায়, আমেরিকার সাহিত্য সম্মেলনগুলিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতু বাঁধার চেষ্টাই করে গেছেন। ভারত সম্পর্কে কিপলিং-এর বর্ণনা যেখানে একটু বহিরঙ্গ-প্রধান, খানিক ঔপনিবেশিক মনোভাবে ক্লিষ্ট, সেখানে ধনগোপালের গল্প বলার ধরন অনেক বেশি আন্তরিক আর সরল।

বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পর মাত্র দু’বার দেশে আসতে পেরেছিলেন ধনগোপাল। ‘মাই ব্রাদার’স ফেস’, ‘ভিজ়িট ইন্ডিয়া উইথ মি’ এই অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। নিজের দেশে পাশ্চাত্যের পোশাক, সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, বাঙালি উচ্চবিত্তদের অনর্গল ইংরেজি বলার অভ্যাস তাঁর ভাল লাগেনি। ধনগোপালের মনে হয়েছে, আধুনিতার চাপে বাংলা ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। মেয়েদের অনাবৃত মুখ তাঁকে পীড়া দিয়েছে। ভারত-দর্শন শেষে ধনগোপালের মনে হয়েছে, দেশ অতিধনী মানুষ আর গান্ধী-অনুগামী মানুষে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা না হলেও বিশ্বভারতী তাঁকে প্রত্যাশিত শান্তি দিয়েছিল।

এই সময়ে ধনগোপালের ব্যক্তিগত জীবনেও টালমাটাল চলেছে। আমেরিকান কংগ্রেসের ১৯১৭-এর ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট ইত্যাদির ফলে তৈরি প্রলম্বিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব পাননি। ক্রমাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন ধনগোপাল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে, তাঁকে নিগ্রো রেজিমেন্টে দিয়ে দেবে আমেরিকা। এক দিকে স্ত্রীর সঙ্গে চলছিল মনোমালিন্য, এরই মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের সময় হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে লেখালিখি শুরু হলে দেশে তাঁর পরিবারের উপর নজরদারি শুরু হয়। রুশ নৈরাজ্যবাদী এমা গোল্ডম্যান ও আলেকজ়ান্ডার বার্কম্যান-এর সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে যায়। গুজব উড়তে থাকে, তিনি বলশেভিক। তাঁকে এম এন রায় বলে ভুল করে ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দাদা যাদুগোপালের সহযোগী না হয়ে উঠতে পারার গ্লানি ছিল অনুক্ষণ, এক সময় প্রবল মানসিক চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে যায় তাঁর পক্ষে।

বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা এবং প্রকাশকদের সঙ্গে ক্রমাগত আইনি বিবাদে জড়িয়ে পড়ার ফলে ধনগোপালের বই বিক্রিও কমে যায় ভীষণ ভাবে। ক্যাথারিন মায়োর লেখা বই ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র প্রতিবাদে লেখা ‘আ সন অব মাদার ইন্ডিয়া আনসারস’ সমালোচকদের ভাল লাগলেও পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়নি। বক্তৃতা সফরগুলির মাধ্যমে ক্ষতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা ভীষণ ক্লান্ত করে তাঁকে। পর পর দু’বার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় তাঁর। যে ধনগোপাল কিছু দিন আগেই নিউ ইয়র্কের বসন্তের শোভা বর্ণনা করে নেহরুকে চিঠি লিখেছিলেন, তিনিই দেশে ফেরার জন্য কাতর হয়ে অর্থ ভিক্ষা করেন তাঁর কাছে। মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে নেহরুকে চিঠিতে লেখেন, “পৃথিবী খুব সুখকর জায়গা নয়, তাই না?”

১৯৩৬ সালের ১৪ জুলাই আত্মঘাতী হন ধনগোপাল। ৪৬ বছর মাত্র বয়স তখন তাঁর। এথেল তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখেন, নিখুঁত গোছানো ঘরের টেবিলে কিছু অসমাপ্ত লেখার পাণ্ডুলিপি, আর বিছানায় পড়ে আছে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সেই দিনই পাঠানো এক গেরুয়া আঙরাখা। পাশেই ঝুলছে ধনগোপালের মৃতদেহ। পরে এথেল এই প্রসঙ্গে লেখেন, “ওঁর মৃত্যুতে কী করে দুঃখ করব আমরা? উনি যা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন। একমাত্র এটাই তো উনি চেয়েছিলেন।”

ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় নৈঃশব্দের মধ্যে লীন হতে চেয়েছিলেন বরাবর। চিত্রগ্রীবের শেষ লাইনে লিখেছিলেন, ফুল যেমন সুগন্ধে ভরা থাকে, তেমনই আমাদের হৃদয় ভরা থাকুক ভালবাসা আর পবিত্রতায়। সবার উপর শান্তি নেমে আসুক। জাগতিক কোলাহলে দীর্ণ, নিরন্তর বিষাদ-অবগাহনে ক্লান্ত লেখক হয়তো শান্তি খুঁজতে চেয়েছিলেন মৃত্যুর স্তব্ধতায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy