Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Science

যুদ্ধে আহত সৈনিকের জন্য ভ্রাম্যমাণ এক্স-রে

পুরোটারই দায়িত্বে নারীবাহিনী। বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি সেনাদের চিকিৎসার জন্য সমস্ত মহিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন মেরি কুরি। লেখাপড়া ছাড়িয়ে মেয়ে আইরিনকেও যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি।

—ফাইল চিত্র।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:০০
Share: Save:

অক্টোবর মাস। ১৯১৪ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে উঠেছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জার্মানি সম্মুখযুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একটা গাড়ি প্যারিসের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। গাড়ি চালাচ্ছেন মধ্য-চল্লিশের এক ভদ্রমহিলা, সঙ্গে এক কিশোরী আর সেনাবাহিনীর এক জন ডাক্তার। ভদ্রমহিলা পোল্যান্ডের বাসিন্দা, ফ্রান্সে অভিবাসনের পর সেই দেশকেই মাতৃভূমি বলে স্বীকার করেন। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির প্যারিস আক্রমণের মোকাবিলা করতে উনি নিজের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে চলেছেন। ভদ্রমহিলা দু’বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এক বার তেজস্ক্রিয়তার সাধারণ ধর্ম আবিষ্কার করার জন্য পদার্থবিদ্যায় (১৯০৩), আর এক বার দু’টি তেজস্ক্রিয় মৌল, রেডিয়াম আর পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য রসায়নে (১৯১১)। ফ্রান্সের রেড ক্রস রেডিয়োলজি সার্ভিসের প্রথম অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্বভার পেয়েছেন।

তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে বিশদে গবেষণার জন্য যখন তিনি ফ্রান্সের রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে তাঁর গবেষণাগার গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত, তখনই যুদ্ধ শুরু হয়। তাঁর সহকর্মীরা প্রায় সবাই যুদ্ধে যোগ দিলেন। উনিও গবেষণার কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ রেখে ফ্রান্সের সমস্ত তেজস্ক্রিয় সম্পদ সিসায় মোড়া একটি ‘নিরাপদ’ বাক্সের মধ্যে ভরে ৬০০ কিলোমিটার দূরে বোর্দোউ শহরের একটি ব্যাঙ্কের লকারে গচ্ছিত করে, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। নিশ্চিত ছিলেন যুদ্ধে ফ্রান্স জয়ী হবেই, আর উনিও ওঁর গচ্ছিত সম্পদ উদ্ধার করে আবার গবেষণার কাজ শুরু করবেন।

এত ক্ষণে নিশ্চয়ই পরিষ্কার, ভদ্রমহিলার নাম মেরি কুরি, বিজ্ঞানের দু’টি বিষয়ে নোবেল পাওয়ার বিরলতম রেকর্ড যাঁর আয়ত্তে। এ-হেন এক জন আদ্যন্ত বিজ্ঞানীর সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের সম্পর্ক কী? প্রশ্নটা শুনলে বিজ্ঞানের লোকজনের এক মুহূর্তে দুটো উদাহরণ মনে পড়ে যাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়ে মাত্র ২৮ বছর বয়সে প্রতিভাবান তরুণ বিজ্ঞানী মোসলের (যিনি পর্যায় সারণির ধারণায় বড়সড় পরিবর্তন এনেছিলেন) মৃত্যু, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ম্যানহাটান প্রকল্পের অধীনে বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীদের ‘অ্যাটম বোমা’ তৈরির কাজে নিবিষ্ট থাকা, যার ফল হিরোশিমা-নাগাসাকি। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা হয় মারণাস্ত্র তৈরি করবেন, নয় নিজেরা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়বেন। কিন্তু এই দুইয়ের বাইরেও যে বিজ্ঞানীর কিছু করার থাকতে পারে, তা দেখিয়ে দিলেন বিজ্ঞানে প্রথম মহিলা নোবেলজয়ী, মাদাম কুরি। তাঁর কাজ হয়ে উঠল প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করা।

তত দিনে রয়েন্টজেনের এক্স-রে আবিষ্কার হয়ে গেছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাড়গোড় ভাঙার চিকিৎসায় তার ব্যাপক ব্যবহারও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সেই চিকিৎসার সুযোগ শুধু শহরে; বহুদূরে যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে হাজার হাজার আহত সৈন্য ভাঙা হাড়, শরীরে ঢুকে থাকা বুলেট নিয়ে পড়ে আছেন, সেখানে কোথায় এক্স-রে যন্ত্রপাতি? সুতরাং রয়েন্টজেনের আবিষ্কারের সঙ্গে নিজের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মেরি কুরি তৈরি করলেন বিশ্বের প্রথম ‘রেডিয়োলজিক্যাল কার’ মানে এক্স-রে উৎপাদনের যন্ত্র, আনুষঙ্গিক ‘ডার্করুম’ (যেখানে এক্স-রে প্লেটগুলো ‘ডেভলপ’ করা যাবে) আর পেট্রল-চালিত ‘ডায়নামো’ (বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য) সমেত গোটা একটা ‘চলমান ইউনিট’ যা সারসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যাবে, যাতে সেনাবাহিনীর ডাক্তারবাবুরা আহত সৈনিকদের চিকিৎসায় এক্স-রে ব্যবহার করতে পারেন।

এই রকম একটা চলমান ‘এক্স-রে ইউনিট’ তৈরি করার জন্য তো টাকা দরকার। সেই টাকা পেতে ওঁকে বিস্তর লেখালিখি করতে হয়েছিল ফরাসি সেনা দফতরে। বোঝাতে হয়েছিল, এক্স-রে’র ব্যবহার কী ভাবে আহত সৈন্যদের প্রাণ বাঁচাতে জরুরি হয়ে উঠতে পারে। তাদের বিলম্ব দেখে হতাশ হয়ে মেরি ‘ইউনিয়ন অব উইমেন অব ফ্রান্স’ নামক একটি মানবতাবাদী সংস্থায় যোগাযোগ করে প্রথম ইউনিটটি তৈরির অর্থ জোগাড় করতে পারেন। মেরি বুঝেছিলেন যে এই রকম মোটে একটা গাড়িতে কাজ হবে না, তাই উনি ক্রমাগত ওঁর বিত্তবান বন্ধুদের কাছে আবেদন জানালেন গাড়ি দান করতে, যার মধ্যে রেডিয়োলজির যন্ত্রপাতি লাগিয়ে নেওয়া যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানিকেও অনুরোধ করেছেন এক্স-রে যন্ত্র, ডায়নামো ইত্যাদি দান করতে এবং বিনামূল্যে গাড়িতে লাগিয়ে গাড়িগুলোকে রেডিয়োলজির উপযুক্ত করে দিতে। এই ভাবে চেয়েচিন্তে মোট কুড়িটা গাড়ি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল।

এক্স রে-র তাত্ত্বিক দিকটা জানা থাকলেও ব্যবহারিক দিক নিয়ে মেরির কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না; তাই তিনি নিজে আগে মেশিন চালানো, প্লেটের ছবি ডেভলপ ও বিশ্লেষণ করা, শারীরতত্ত্ব (অ্যানাটমি), এমনকি গাড়ি চালানো থেকে গাড়ির ছোটখাটো মেরামতি পর্যন্ত শিখে নিলেন, এবং কন্যা আইরিনকেও তৈরি করে নিলেন। ১৯১৪-র অক্টোবরে আইরিনকে সঙ্গে নিয়ে মেরি প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন। কিন্তু তার পর? দু’জনে তো এতগুলো ইউনিট চালানো যাবে না, তাই মেরি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটেই তাঁর অধীনে কিছু মেয়েকে এই সব বিষয়ের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। প্রথমে কুড়ি জনের একটা দল তৈরি হল, তাদের যুদ্ধে পাঠিয়ে মেরি পরের দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। এই ভাবে পরের দু’বছরে তিনি মোট ১৫০ জন মেয়েকে যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করে তুললেন। তাঁদের এই গাড়িগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ‘ছোট্ট কুরি’ নামে পরিচিত ছিল। এই মেয়েরা ডাক্তারদের সহায়ক হিসেবেই কাজ করতেন, যদিও মেরি নিজে স্বীকার করেছেন, এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রায় ডাক্তারদের মতোই অভিজ্ঞ ও দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শুধু তাঁর অধীনস্থ মেয়েদেরই যুদ্ধে পাঠাতেন না, নিজেও মেয়েকে নিয়ে নিজের ‘ছোট্ট কুরি’ চালিয়ে নিয়মিত যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াতেন, বিভিন্ন রোগীর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন। এই ভ্রাম্যমাণ যুদ্ধ-পরিষেবার পাশাপাশি সেই সময়েই মেরি বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ২০০টা স্থায়ী রেডিয়োলজি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যবস্থাপনাতেও লেগে ছিলেন। এই নিরলস সেবায় অন্তত এক লক্ষ আহত সৈন্য সুস্থ হয়েছিলেন।

মেরি কুরি যুদ্ধ-পরিষেবা ছাড়াও নির্দ্বিধায় নোবেল পুরস্কারের পদক দুটো দান করে দিতে চেয়েছিলেন, ফরাসি সরকার অবশ্য তাতে রাজি হয়নি। তবে নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে উনি ফরাসি বাহিনীর জন্য ‘ওয়ার-বন্ড’ কিনেছিলেন। পুরুষশাসিত সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু পুরস্কারই জিতে নেননি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীবাহিনী তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরেও বেড়িয়েছেন।

মেরি সেই বিরল প্রকৃতির মা, যিনি নিজের সতেরো বছরের কিশোরী কন্যাকে পড়াশোনা ছেড়ে যুদ্ধের বীভৎসতার মধ্যে কাজ করতে পাঠাতেও দ্বিধা করেননি। এতে আইরিনের পড়াশোনার ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি; হলে তিনিও পরবর্তী কালে নোবেল পুরস্কার পেতেন না! তবে মেরি কুরির গবেষণার কথা, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি যত শোনা যায়, এই অন্য রকম কর্মকাণ্ডের কথা সেই তুলনায় অনেকটাই থেকে যায় আলোচনার বাইরে।

অন্য বিষয়গুলি:

Science Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy