উদ্যাপন: নতুন ধান মজুত হচ্ছে গোলায়। ডান দিকে, উঠোনে নবান্নের আলপনা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ওই মরাই আর এই পালুই।
ধানের গুঁড়ো খোসা আর খড়-বিচুলির কুচো উড়ছে চার পাশে। তারই সোনা-ঘষা রঙে মাখামাখি ঘর-বাড়ি-রাস্তা-বাজার। দু’পাশে গোল, চতুষ্কোণ সেই মরাই আর পালুইয়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কানে আসছিল দলে দলে চড়াই, পায়রার শোরগোল।
খড়ের তৈরি বিনুনি-দড়িতে বাঁধা খড়েরই দেওয়ালের বিশাল আকারের কুয়োর মতো আধার মরাই। আর ধান ঝেড়ে নেওয়ার পর পড়ে থাকা গাছ, যা গুছিয়ে আঁটি বেঁধে ছোট ছোট টিলার মতো তৈরি করা হয়েছে, তা পালুই। প্রায় সব বাড়িরই আশপাশে সর্বত্র হয় মরাই, নয়তো পালুই। ধানের মরাই হল গোলা। আর খড়ের পালুই যে গাদা, তা জানা থাকলেও অঘ্রানের বসন্তে রঙিন গ্রামবাংলায় তার চোখ-ধাঁধানো সাজ অচেনা লাগে। বিশেষত চাষি যে বছর হাসিমুখে বলেন, ‘এ বার ধানটা ভাল হয়েছে...’ সে বছর অন্য বসন্তের রঙে চোখে ঘোর লেগে যায়।
শীতের ঝিম-ধরা দুপুরে ঘোর ভাঙল রোহিতের কথায়। এ বাড়ির উঠোন হয়ে পাশের বাড়ির গোয়াল, আনাজের খেত ডিঙিয়ে আর এক বাড়ির বিবরণ দিতে দিতে কিশোর হঠাৎ বলে উঠল, “এ বছর আমাদের বাড়িতে কুটুম কম। অনেকেই আসে নাই।” ছোটবেলা থেকে দুর্গাপুজোর মতো এই সময়ও আত্মীয়-সমাগমে ঘর-বার মেতে থাকতে দেখেছে এই নবম শ্রেণির ছাত্র। কে আসেনি রে? কিশোরের জবাব, “আমার দাদাটাই আসতে পারেনি। বেঙ্গালুরুতে পড়তে গেছে। ছুটি পায়নি।”
শস্যগোলা হিসেবে পরিচিত বর্ধমানে এ বারও ধান আর ধান। এই রং ধরেছে বীরভূমের মাটিতেও। নতুন ধান ঘরে তোলার কথা তুলতে বোলপুরের যুবক বলেছিলেন, “আমরা বলি ‘লবান’। ছোটবেলায় পুজোর পর থেকেই দিন গোনা শুরু করতাম। ওই দিন কীর্ণাহারে মামাবাড়িতে যেতেই হবে। হাতে ক’টা নতুন ধানের চাল আমাদের সবার গালে দিয়ে দাদু ছড়া কেটে বলতেন, ‘নতুন বস্ত্র, নতুন অন্ন/ থাকে যেন সবার জন্য’।”
দুর্গোৎসবের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দ উদ্যাপনের এই আয়োজন বীরভূমে ‘লবান’ আর বর্ধমানে ‘নবান’। বর্ধমান থেকে গুসকরা হয়ে বীরভূমের রাস্তা জুড়ে এ এক রঙিন সময়। আকাশের নীচে দু’পাশে বিস্তীর্ণ স্বর্ণগর্ভা মাটি। আর বাঙালির হাসিমুখ। সকলের মঙ্গলকামনার এক সোনালি পরম্পরা। পাড়ায় অন্নপূর্ণা পুজো। তার আলো, বাজনা। এ ছবি হুগলি, বর্ধমান, বীরভূমে, বাঁকুড়া, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদেও।
চাষে আর আগের মতো লাভ নেই। সারের খরচ, জলের খরচ, মাঠের শ্রমিকের খরচ সবই বাড়ছে। তবু বসে থাকতে পারেন না রোহিতের ছোটদাদু সুনীল হাটী। ধানের খনি ভাতারের স্বর্ণচালিদা গ্রামের এই বাসিন্দা নিজেকে চাষের সঙ্গে জুড়েছেন পরিবারের সূত্রেই। কয়েক পুরুষের দেখিয়ে যাওয়া রাস্তায় এখনও আছে তাঁর প্রজন্ম।
সুনীলবাবুর একমাত্র ছেলে জিষ্ণুর অবশ্য চাষবাসের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। মা মিনতি সে কথা তুলে ছেলেকে তুলোধোনা করেন, “চাষির বাড়ির ছেলে জমি চেনে না। অন্য খেয়ালে ব্যস্ত।” দরজায় হেলান দিয়ে মায়ের কথা শোনেন, হাসেন জিষ্ণু।
চাষের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও ফোনে তোলা নিজের গ্রামের একের পর এক ছবি তুলে তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে তাঁর বাড়িতে নবান্নের খোলা নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন জিষ্ণু। বীরভূমে বেসরকারি সংস্থায় চাকরিরত এমএ পাশ যুবক বলেন, “এ আমাদের মিলন উৎসব।”
ধানি জমি, গোয়াল আর ভরা পুকুর চাষিকে ভুলিয়েও দেয় চাষের লাভ-লোকসানের হিসেব। সুনীলবাবু বলছিলেন জমির সঙ্গে সম্পর্কের কথা। চাষ তো মায়াও। বলেন, “আর কী করব? হিসেবে তো আর চাষের টানকে আটকে রাখা যায় না।”
খানিকটা গায়ে পড়ে নবান্নের সেই নিমন্ত্রণ নিয়ে জিষ্ণুর গ্রামে পৌঁছলে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী, মা, বাবাকে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা যে আসবেন ভাবতেই পারিনি। খুব ভাল লাগছে।” পিচরাস্তা ছেড়ে ঢালাই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে সমবায় অফিসের পাশেই ওঁদের একতলা পাকা বাড়ি। পাঁচিলে কাঠের দরজা। তার গায়ের গাছে ধানের ভারে নুইয়ে পড়া প্রথম ধানের ছড়া জরি-পাড়ের ঘোমটার মতো ঝুলছে। গোবর-লেপা মাটির রাস্তা উঠোন, গোয়াল, তুলসীতলা, সর্বত্র নবান্নের আলপনা।
বাড়ির দরজা ঠেলে ডান দিকে মুখ ঘোরালেই পাঁচ-সাতটা পুকুর। কানায় কানায় ভরা সেই পুকুরে এখনও দশ-বারো কিলোর কাতলা মিলবে জাল ফেললেই। পুকুরে মাছ চাষ সে আর ভাবে হয় না। তবু তাল গাছে ঘেরা সেই জলে হাঁসের দলের যাতায়াত সে খামতি বুঝতে দেয় না।
চাষ আর তাকে ঘিরে এই উৎসবের আয়োজনও তাই গ্রামে গ্রামে বাঙালির রক্তে মিশে! তাই তো ‘নবান’-এর দিন ঠিক হওয়ার পর থেকে আর এক হিসাব শুরু করে দিয়েছেন সুনীলবাবু। একটা ‘বোতাম-টেপা’ ফোনে দিনকতক আগে থেকেই বোন, ভগ্নিপতি, শ্বশুরবাড়ি, প্রতিবেশীর জন্য কী আয়োজন করতে হবে, তা মনে করতে করতেই নিমন্ত্রণ শুরু করে দেন তাঁদের। বলেন, “নবানে এসো। দিনে না পারো, রাতের দিকে এক বার ঘুরে যেয়ো।” তাও না পারলে অন্তত পরদিন ‘বাসি নবান’-এ আসতে বলে দিচ্ছেন তাঁদের। সে দিন যে খাসি কাটা হবে! কোনও বাড়িতে একটা, কোনও বাড়িতে দুই বা তিন।
বাড়ি জুড়ে লক্ষ্মীর আবাহন। অন্নপূর্ণার আরাধনা। গ্রামের সব বাড়িতেই একই আবহ। এ বারে ওঁদের গ্রামে নবান্নের দিন স্থির হয়েছিল ১০ ও ১১ ডিসেম্বর। সেই রাস্তা দিয়ে এগোতেই উৎসবের খুশি চোখে পড়ছিল। হঠাৎ কানে এল, “কী রে, আজই এলি?” বাপের বাড়ির পাড়ার পথ পেরিয়ে মহিলা উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। থাকব দু’দিন।” মুখোপাধ্যায় বাড়ির রূপালি আরও যোগ করলেন, “দুর্গাপুজোর সময় আসতে পারি না। নবানে তো আসতেই হবে। দু’টো দিন থেকে যাই।”
মেঘ সরে শীতের আকাশ পরিষ্কার হলে ঢালাই রাস্তা, নিকোনো উঠোন, ঘুঁটে লেপা দেওয়াল ঝলমলে। দু’পাশে শুকনো গোবর আর ধানের গন্ধে মিশে রয়েছে খেজুররসের গন্ধ। সেই বাতাসই খেলে বেড়াচ্ছে গ্রামের দুর্গাদালানের অন্নপূর্ণা পুজোয়, আরও একটু এগিয়ে শিবতলার আটচালার অন্নপূর্ণার আরাধনায়। দুপুর পর্যন্ত ঘরের ব্যস্ততা কাটিয়ে সে দিকেই চলেছেন গ্রামের মানুষ। দুই আয়োজনের মধ্যে রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তোড়জোড়ে ব্যস্ত পাড়ার ছেলেরা। চাঁদা তোলার গুঞ্জনও। পাড়া জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহর থেকে আনা ব্যান্ড পার্টির দল। তার পিছনে বাচ্চার দল। বাজছে, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি...’
বেলা গড়াতে দুপুরে পাত পড়েছে সব বাড়ির উঠোনে। বিত্তশালীর দরজা ঠেলে ঢুকেছেন সাধারণেরা। কাঁসার থালায়, কলাপাতায় নতুন চালের ভাত। বিজোড় সংখ্যার ভাজা। কোনও ঘরে তো ১৩টা বা ১৫ টাও! মাছের টক আর মিষ্টিমুখে গুড়পিঠে। অতিথিকে সাজিয়ে দিয়ে গৃহকর্ত্রী বলছেন, মাছের টকের কী কী আছে। চালের গুঁড়োয় মৌরি বাটা দিয়ে কী ভাবে ভাজা হবে এই পিঠে। ঘরের দুধে নিজের তৈরি ক্ষীরের পাক, সেও বলে দেন এই সুযোগে। আর যিনি খাবেন না, তিনি সঙ্গে পাত্র এনেছেন।
এই যাতায়াত কমেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি। আগে যেমন সকাল থেকে রাত, কে কার বাড়িতে খেয়ে নিয়েছেন, বাড়ির লোক তার খোঁজ রাখেননি, এখন আর সে রকম নেই। তবে সে ধারার প্রমাণ এখনও আছে। হাটীবাড়ির দরজায় ফিরে আসতে হয়েছিল হরিনামের দলটিকে। গোটা কার্তিক মাস রাত থাকতে বেরিয়ে তাঁরাই বাতাসে গানের সুর ছড়িয়ে ঘুম ভাঙিয়েছেন স্বর্ণচালিদার। সে কথা বিড়বিড় করতে করতে গামলায় চাল, আলু, কলা আর মিষ্টি, নাড়ু নিয়ে ছুটেছিলেন গৃহকর্ত্রী মিনতি।
উলু-শঙ্খধ্বনি, উপোস, পুজোর আচারে যেমন ঈশ্বর-বিশ্বাস, তেমনই সোনার ফসলে গোলা ভরিয়ে দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা নিয়ে ঠাকুরের কাছে সব ঘরের জন্য মঙ্গলকামনা করছেন চাষি আর চাষের সঙ্গে যুক্ত সবাই। নবান্ন উদ্যাপনে যে মাটির উনুনে নতুন চাল প্রথম রান্না হয়, তার পাশে রাখা কাঁসার পাত্রে সিঁদুর দিয়ে সেই প্রার্থনাই আঁকা হয় সব ঘরে। ভরা থাকে ধানে, শস্যে। সেই ‘পূর্ণপাত্র’ ঘরে ঘরে মঙ্গলের প্রত্যাশা হয়ে থাকে নবান্নের দিন।
এই যে স্বর্ণচালিদা, তার গল্প অনেক। দীর্ঘ সময় এ গ্রাম ছিল সিপিএমের আঁতুড়, এখন তৃণমূল কংগ্রেসের। সেই বদলের ছাপ নেই মাটিতে। তার ছায়া নেই এখানকার মরাইয়ে, পালুইয়ে। ছায়া পড়েনি গ্রামের এই মঙ্গল উৎসবেও। দু’এক বার দুর্যোগ এসেছে। শিলাবৃষ্টিতে গাছ ভেঙে মাঠে জলে ধানের সঙ্গে ভেসে গিয়েছে এই উৎসবের স্বপ্ন। এ বার তা নয়, উপচে পড়ছে।
এ বারের নবান্নের দু’দিন আগে পূর্ণিমা গেছে। রাতে তার আলোই এসে পড়েছে তাল কাঁঠাল আমগাছের মাথায়। আলো-ছায়ায় আবছা আলপনা ফুটেছে মাজা উঠোন, খামারের মরাই আর পালুইয়ের গায়ে। দিনভর আপ্যায়নের পরে অঘ্রানের রাতেও তুলসীতলায় জ্বলে চলা প্রদীপ, ঝরে পড়া মাধবীলতা ফুলে নকশাকাটা উঠোনে আসন বিছানো থাকে অতিথির অপেক্ষায়। তিনি যে-ই হোন।
সময় এগিয়ে চলে আনন্দে-বিষাদে। এক ধানের মরসুম থেকে আর এক ধানের মরসুমে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy