সৃজনশিল্পী: টি এস এলিয়ট। ছবি: গেটি ইমেজেস।
বন্ধ্যা জমিতে জলের আশা ফুরিয়েছে। অক্ষম রাজার পাপে সারা দেশে অজন্মা। মধ্যযুগের উপকথার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলা পথিক এক নিষ্ফলা আধুনিক সভ্যতাকে চোখ মেলে দেখতে চায়, দেখাতে চায় সকলকে— কী ভাবে ভেঙে পড়ছে পশ্চিমী সভ্যতার অন্যতম প্রতীকী স্তম্ভ লন্ডন ব্রিজ, যৌবন থেমে থাকছে দুয়ারে অপেক্ষায় থাকা ট্যাক্সির মতো, রূপকথার ফুলকন্যের স্নিগ্ধতা বা ইতিহাসের ক্লিয়োপেট্রার মতো তুমুল রাজকীয় রূপ-বৈভবের প্রতিচ্ছবি সরে গিয়ে সামনে ভেসে উঠছে শহরের কোনও এক ভাড়া ঘরে দিনগত ক্লেদযাপনে ব্যস্ত সেই অবিবাহিত টাইপিস্ট মেয়েটি, যে নেহাতই জৈবিক তাড়নায় ক্ষণিকের প্রেমহীন আলিঙ্গনে জড়ায় অফিসের আর এক কেরানিকে। ইতিহাস-পুরাবৃত্ত-আদিম জনজাতির নানা হারিয়ে যাওয়া রীতিনীতির অনুষঙ্গ থেকে সমসাময়িক পাশ্চাত্য নাগরিক জীবনের টুকরো টুকরো ছবি— এমনই সব আপাত-সম্পর্কহীন ভাঙা ভাঙা চিত্রকল্পে ভরা দীর্ঘ একটি কবিতার খসড়া কবি দেখতে দিয়েছিলেন তাঁর এক কবি-বন্ধুকে। কবির ভাবনায় এ কবিতার প্রাথমিক নাম ছিল ‘হি ডু দ্য পুলিস ইন ডিফারেন্ট ভয়েসেস’—এই পঙ্ক্তিটিও এক উদ্ধৃতি, ডিকেন্সের ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ উপন্যাস থেকে। সেই কবি-বন্ধু কেটেছেঁটে রূপ দিলেন তাকে ৪৩৪ লাইনের কবিতায়, যা ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ নামে ইংল্যান্ডে আত্মপ্রকাশ করল ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে, ‘দ্য ক্রাইটেরিয়ন’ পত্রিকায়। নভেম্বরে এই কবিতাটিই আবার প্রকাশ করল আমেরিকার ‘দ্য ডায়াল’ পত্রিকা। গ্রন্থাকারে প্রকাশও ওই বছরেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে ধ্বংস ও নিরাশার প্রেক্ষাপটে, ভাঙনের মধ্য থেকেই গড়ে ওঠা আধুনিক কবিতার দিক্চিহ্ন হয়ে ওঠা এই কবিতার ‘জননী’ টি এস এলিয়ট, আর বন্ধু-কবি এজ়রা পাউন্ড করেছিলেন সম্পাদনা— ধাত্রীর কাজ। এ হেন সম্পর্কের আভাস কৌতুকের সুরে দিয়েছিলেন পাউন্ড নিজেই, তাঁর ‘সেজ হোম’ কবিতায়। ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতাটি এলিয়ট উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর ‘কুশলতর নির্মাণশিল্পী’ বন্ধু পাউন্ডকেই।
জেসি ওয়েস্টন-এর ‘ফ্রম রিচুয়াল টু রোমান্স’ আর জেমস ফ্রেজ়ার-এর ‘দ্য গোল্ডেন বাও’— এই দু’টি আকর গ্রন্থে বর্ণিত গ্রেল-উপকথা এবং প্রাচীন নৃতত্ত্বের কাহিনি-সূত্রকে ভিত্তি করে এলিয়ট গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আধুনিক মহাকাব্যের রূপক-কাঠামো। গড়ন, চিত্রকল্পের ব্যবহার, মুক্তছন্দ ও দৈনন্দিন বাক্রীতির সঙ্গে আখ্যানকাব্য ও গীতিকবিতার মিশেল, উদ্ধৃতি ও অনুষঙ্গের প্রাচুর্য, বহু কণ্ঠস্বরের সমাবেশ— সব দিক থেকেই আধুনিক কবিতার এক মাইলফলক, আধুনিক যুগযন্ত্রণার এক অভূতপূর্ব দলিল হয়ে উঠেছিল ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’। এক দিকে ওভিদ, দান্তে, শেক্সপিয়র, ওয়েবস্টার, মিডলটন, বোদল্যেয়র— পূর্বসূরি কবি ও দার্শনিকদের উদ্ধৃতি-প্রসঙ্গের প্রাচুর্য আপাতদৃষ্টিতে এই কবিতাপাঠের পথকে করে তুলেছে দুরূহ, অন্য দিকে বাইবেল, উপনিষদ আর বৌদ্ধ দর্শনের অনুষঙ্গ এর উত্তরণ ঘটিয়েছে এক অন্যতর বোধরাজ্যে, ক্ষয় ও লয় পেরিয়ে আসার এক আপ্রাণ প্রয়াসে। তাই কবির স্বকৃত টীকা বা ভাষ্যের সাহায্য ছাড়া এ কবিতার পাঠ অসম্পূর্ণই থেকে যায়— এও আধুনিকতার এক নতুন দিক, যা কবিতাকে করে তোলে অনেক বেশি বুদ্ধিগ্রাহ্য, জটিল মননের অভ্যাস-নির্ভর, শুধু আবেগগ্রাহ্য নয়। সুচিন্তক এলিয়টের মতে, আধুনিক মানুষের মন জটিল আবর্তেই চলে, তাই এ যুগের সাহিত্যও সহজ-সরল পথে রূপ নিতে পারে না। কবি এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ যেন এই ভাবনারই প্রতিফলন।
এই কবিতাটি পাঁচটি অংশে বিভক্ত। ‘দ্য বেরিয়াল অব দ্য ডেড’, ‘দ্য গেম অব চেস’, ‘দ্য ফায়ার সারমন’, ‘ডেথ বাই ওয়াটার’ এবং ‘হোয়াট দ্য থান্ডার সেড’— এই পাঁচটি অংশকে প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে খাপছাড়া, একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু একটু গভীরে গেলে ধরা পড়ে, এই বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন কাব্যরূপ আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের ভাঙন-ধরা, অর্থহীন সভ্যতারই ছবি। নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক অসারতা, প্রাণহীন, হতাশাক্লিষ্ট জীবনযন্ত্রণার শরিক হয়ে হেঁটে চলা, উদ্দেশ্যহীন জনতার ভিড়, বাদামি কুয়াশায় ঢাকা আকাশের চিত্রকল্প যেন দান্তের নরক-দর্শনকেই মনে করিয়ে দেয়। বহতা নদীর গতিকে বার বার বাধা দেয় মৃত্যু, ক্ষয় ও রুক্ষ জমির চিত্রকল্প। প্রেম, আবেগ বা নৈতিক দায়-বর্জিত এই দুনিয়ার আগুনে ভয়াবহতা থেকে মুক্তির আশায় উচ্চারিত হয় সন্ত অগাস্টাইনের প্রার্থনা, তার সঙ্গে মিলে যায় ভগবান বুদ্ধের অগ্নি-উপদেশ। মাদাম সসট্রিস-এর ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, যখন ফিনিসীয় নাবিক ফ্লেবাস অল্পবয়সেই প্রাণ হারায় জলপথে, তার যৌবনের স্বপ্নকে গ্রাস করে সমুদ্রের ঢেউ। যে জল এখানে মৃত্যুর কারণ, সেই জলেরই আশায় চেয়ে থাকে অভিশপ্ত বন্ধ্যাদেশ। খ্রিস্টের দেহত্যাগ ও পুনর্জন্মের আর্তি ছড়িয়ে যায় বিশ্বে, ভেঙে পড়তে থাকে জেরুজালেম আথেন্স আলেকজ়ান্দ্রিয়া— অনেক দূরে গঙ্গার ও পারে হিমালয়ের মাথার ওপরে মেঘ ঘনায়, সেই মেঘ ডেকে ওঠে ‘দ, দ, দ’ শব্দে— যা বৃহদারণ্যক উপনিষদের ‘দত্ত, দয়ধ্বম, দম্যত’-এর প্রতীকী উচ্চারণ, যার সঙ্গে মিশে যায় শান্তিপাঠ। হার্ভার্ডে ছাত্র থাকাকালীন এলিয়ট-এর পাঠ্য ছিল প্রাচ্য দর্শন, প্রাচীন ভারতীয় উপনিষদ-পুরাণের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন এক ক্ষয়রহিত রহস্যময় প্রজ্ঞার সন্ধান। পশ্চিমি সভ্যতার সামগ্রিক অবক্ষয় ও নিরাশার পটভূমি থেকে যদি কোনও ইতিবাচক আদর্শের দিকে মুখ ঘোরাতেই হয়, তবে তা দিতে পারে প্রাচ্য দর্শন— এই ইঙ্গিতই দিতে চেয়েছেন কবি ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর অন্তিম পর্বে। এই প্রাচ্য দর্শনের প্রতি অনুরাগ ভবিষ্যতেও ধরা দিয়েছে তাঁর অন্যান্য কবিতায়, বিশেষ করে ‘দ্য ফোর কোয়ারট্রেটস্’-এ।
টি এস এলিয়টের এই কবিতা অচিরেই হয়ে উঠেছিল আধুনিক কবিতার পথনির্দেশক এক রূপরেখা, যা বদলে দিয়েছিল বিশ শতকের কবিদের ভাবনাচিন্তার গতিপথ। ওয়েস্ট ল্যান্ড-পরবর্তী যুগে আর আগের মতো প্রচলিত আঙ্গিকে, নির্দিষ্ট ভাবকে কেন্দ্র করে আবেগ বা অলঙ্কার নির্ভর কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না। এ কবিতাকে কী ভাবে, কোন পর্যায় বা সাহিত্যরূপে ফেলা যায়, তাই নিয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত। এজ়রা পাউন্ড বলেছেন, “১৯০০ সাল থেকে আমরা আধুনিকতার যে পরীক্ষানিরীক্ষা, যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তাকেই ন্যায্য প্রতিপন্ন করেছিল।” আই এ রিচার্ডস একে বলেছেন ‘মিউজ়িক অব আইডিয়াজ়’, কেউ কেউ এর উদ্ধৃতিবাহুল্য দেখে বিরূপ সমালোচনা করেছেন, এমনকি কবি নিজেও পরবর্তী সময়ে একে বলেছেন জীবন সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভের কাব্যিক প্রকাশ— “জাস্ট আ পিস অব রিদমিকাল গ্রাম্বলিং।” কবির জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯২১ সাল নাগাদ এলিয়ট আর তাঁর স্ত্রী ভিভিয়েন দুজনেই ভুগছিলেন স্নায়বিক সমস্যা আর অনিদ্রারোগে। কাছাকাছি থেকেও মানসিক দূরত্বের বোধে আক্রান্ত দু’জনেই। ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর এক জায়গায় নিদ্রাহীন রাত কাটানো এক অসুখী দম্পতির চিত্র মনে হয় তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের এক টুকরো ছবি। যদিও এ রকম আরও কিছু পঙ্ক্তি, যা ‘খুব ব্যক্তিগত’— এলিয়ট পরে বাদ দিয়েছিলেন কবিতার শরীর থেকে। সে বছর অক্টোবর মাসে লয়েডস ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে কিছু দিনের ছুটি নিয়ে এলিয়ট চলে গিয়েছিলেন মার্গেট-এর সমুদ্রসৈকতে, অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। সেখানেই এ কবিতা লেখার শুরু। কবিতার মাঝে রয়েছে মার্গেট-এর বালুকাবেলার অনুষঙ্গও— যেখানে বসে তিনি ‘নেতি’-কে যোগ করে চলেন ‘নেতি’র সঙ্গে— ‘নাথিং উইদ নাথিং’। মার্গেট-বাসের পর কিছু দিন তাঁকে কাটাতে হয় সুইটজ়ারল্যান্ডের এক স্যানেটোরিয়ামে। সেখানে বসেও এ কবিতার বেশ কিছু অংশ লেখা।
যুগের আয়নায় দেখলে অবশ্য ধরা পড়ে, পাশ্চাত্যের আধুনিক যুগসাহিত্যে এই ‘ব্যক্তিগত’, কাব্যিক বিক্ষোভের প্রভাব কতখানি। বিশ শতকের পরবর্তী দশকগুলিতে প্রকাশিত ফিটজ়েরাল্ড-এর ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’, হেমিংওয়ের ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ বা গিন্সবার্গ-এর ‘দ্য হাউল’-এর মতো যুগন্ধর সাহিত্যকীর্তির উপর ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর প্রভাব স্পষ্ট। এর প্যারডিও হয়েছে একাধিক। অবশ্য বিশ শতকের প্রথম অর্ধে এ কবিতা যে রকম আলোড়ন তুলেছিল পশ্চিমি দুনিয়ার শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজে, ১৯৫০-এর দশক থেকে উত্তর-আধুনিকতার জোয়ারে তার অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। তবে সমকালীন আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে এর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলায় এলিয়টের ভাবশিষ্য বলে পরিচিত বিষ্ণু দে ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ কবিতায় সরাসরি এনেছেন ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর প্রসঙ্গ— “…সাম্রাজ্যের অন্তিমে কি লর্ড এলিয়ট/ ওয়েস্টল্যান্ডে হর্ষে যেন আপন স্বদেশ?” সুধীন্দ্রনাথের কবিতাতেও ‘চোরাবালি’, ‘ফণিমনসা’র চিত্রকল্পে যেন ফিরে আসে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এরই অনুষঙ্গ। জীবনানন্দের “দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙ্গে”-র মতো উচ্চারণ মনে করিয়ে দেয় জেরুজ়ালেম আলেকজ়ান্দ্রিয়া আথেন্স-এর মতো ‘অলীক শহর’ ধ্বসে পড়ার দৃশ্যকল্প। তখন বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে ফিরত ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’। বিশ্বের আধুনিক সাহিত্যে অন্যতম স্মারক হয়ে ওঠা এই কবিতা একশো বছর পার করল এই অক্টোবরে। এই উপলক্ষে ইংল্যান্ড আমেরিকায় চলছে নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, যাতে মিশে যাবে ভাঙা ভাঙা শিল্পের কোলাজ, ওয়াগনার-এর অপেরার সঙ্গে মিলে যাবে জ্যাজ। একুশ শতকে বিশ্বায়িত বাঙালির কি মনে থাকবে ‘পোড়ো জমি’র কথা, কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ইংরেজির পাঠ্য হিসেবে একে দেখার প্রয়োজনীয়তাটুকুর বাইরে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy