সপরিবার: নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে স্ত্রী মীরা দেবী ও পুত্র নীতীন্দ্রনাথ।
আজ থেকে ঠিক একশো এক বছর আগে, ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কলকাতার শিশির পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ছোটদের একটি গল্পের বই। বইয়ের মুখবন্ধে গল্পকারের নিবেদনে ছিল— “এই বইয়ের একটি গল্প ছাড়া সবগুলো সাঁওতালদের উপকথা থেকে নেওয়া। গল্পগুলো তর্জমা নয়,— শোনা বা পড়া গল্পের ছায়া অবলম্বন করে ছোটো ছেলেমেয়েদের জন্যে লেখা। লেখার ভার আমি নিলেও বলার ভার দিয়েছি এক বুড়ো সাঁওতালের উপর। তার মুখে গল্পগুলো মানাবে ভালো, শোনাবেও ভালো।” বইটির নাম ‘উদোল বুড়োর সাঁওতালি গল্প’। যদিও এই গল্পের ‘সাঁওতালের কথা’ অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হয়েছিল তার আগের বছর, অর্থাৎ ১৩২৭-এর ছোটদের পুজোবার্ষিকী ‘পার্ব্বণী’র দ্বিতীয় সংখ্যায়। গল্পের লেখক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত শিশুসাহিত্যের প্রথম বার্ষিকী পত্রিকা ‘পার্ব্বণী’র সম্পাদক।
১৩২৫ বঙ্গাব্দ। নগেন্দ্রনাথ বালক-বালিকাদের উপযোগী একটি শারদীয় সঙ্কলনগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথমে সঙ্কলনের নাম রাখলেন ‘পূজার ছুটি’। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাহায্যার্থে তিনি দ্বারস্থ হন তাঁর শ্বশুরমশাই রবীন্দ্রনাথের কাছে। সম্ভবত এর মধ্যে অর্থসাহায্যের বিষয়টিও ছিল। কারণ সে বছর ২১ আষাঢ় কবি তাঁর এই ছোট জামাতাকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, বিদ্যালয়ের ছাপাখানা-সহ অন্যান্য বিষয়ে জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে, সেই কারণে ছ’-সাতশো টাকা দেওয়াও তাঁর পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক। কারণ ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘পার্ব্বণী’ ছাপতে আনুমানিক সাড়ে ছ’শো টাকা খরচ পড়বে বলে কবিকে জানিয়েছিলেন।
শ্বশুরমশাইয়ের কথায় দমে যাননি নগেন্দ্রনাথ। অদম্য জেদি এই মানুষটি তখনকার বড় বড় লেখকদের কাছে ‘পার্ব্বণী’র জন্য লেখা চাইতে শুরু করেন। নিজের তিনটি লেখা-সহ রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, জগদানন্দ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শিবনাথ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সীতা দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, ইন্দিরা দেবী এমন আরও অনেকের লেখা সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে বার্ষিকীটি তৈরি করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘পূজার ছুটি’ নাম বদলে রাখলেন ‘পার্ব্বণী’। প্রচ্ছদ আঁকলেন নন্দলাল বসু। প্রথম বছরের ‘পাব্বর্ণী’তে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ করের আঁকা ছবি-সহ রঙিন ও সাদা-কালো অনেক ছবি ছাপা হয়েছিল। ১৩২৫-এর আশ্বিনের প্রথম দিন প্রকাশিত বাংলায় ছোটদের প্রথম পুজোবার্ষিকীটি নগেন্দ্রনাথ উৎসর্গ করলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর নাতনি, সুরেন্দ্রনাথ ও সংজ্ঞা দেবীর কন্যা এগারো বছরের মঞ্জুশ্রীকে। ছাপা হয়েছিল সুকুমার রায়ের তত্ত্বাবধানে তাঁদের বিখ্যাত ছাপাখানায়। ‘পার্ব্বণী’র ‘সম্পাদকের বৈঠক’-এ নগেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সকল দেশেই পূজাপার্ব্বণ প্রভৃতি আনন্দোৎসবে ছেলেমেয়েদের উপভোগ্য নানারকম আয়োজন করা হইয়া থাকে, কেননা ইহাদের তরুণ মুখশ্রীতে হাসি না ফুটিলে উৎসব-দেবতার পূজা সম্পূর্ণ হয় না।” বিদেশে থাকাকালীন তিনি দেখেছিলেন বড়দিনের সময় ছোটদের উপযোগী রংবেরঙের নানা বই প্রকাশিত হতে, যা দেখে ছোটদের আনন্দের সীমা থাকত না। “কিন্তু বাংলা দেশে এই ধরণের কোন বই নাই এবং ইহার অভাব পূর্ণ করিবার উদ্দেশ্যেই এদেশের সর্ব্বজনপরিচিত লেখকলেখিকা ও চিত্রশিল্পীগণের সহযোগীতায় ‘পার্ব্বণী’ নাম দিয়া সর্ব্বপ্রথম এই নূতন ধরণের একখানি বই প্রকাশিত হইল।” আশা ছিল বাংলার ঘরে ঘরে এই বার্ষিকীটি আদৃত হলে প্রতি বছর তিনি ছোটদের হাতে এমন শারদসংখ্যা তুলে দিতে পারবেন।
প্রথম বছর মাত্র দেড় টাকা মূল্যের ১৭২ পৃষ্ঠার বইটি হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়েছিলেন, কারণ কাগজপত্রের দুর্মূল্যের মধ্যে মাত্র দেড় টাকায় এই বই পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “তোমার ‘পার্ব্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভাল লাগিবে। ইহা আমাদের শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যেই রাখা হইবে।... বস্তুত আমি ইহার বৈচিত্র্য, সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি।” এ দিকে গোড়ায় নতুন লেখার সময় করে উঠতে পারবেন না জানিয়েও শেষে ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতাটি ‘পার্ব্বণী’র জন্য লিখে দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও কবির আরও দুটি পুরনো রচনা ‘শরতের গান’ ও ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ‘পার্ব্বণী’তে পুনর্মুদ্রিত হল। কবি আশা করেছিলেন, প্রতি বছর ‘পার্ব্বণী’ এই ভাবেই প্রকাশিত হতে থাকবে। কিন্তু তাঁর সে আশা পূরণ হয়নি।
পরের বছর, ১৩২৬ সনে ছাপাখানার কর্মী বিক্ষোভের দরুন ‘পার্ব্বণী’ বার করা সম্ভব হল না। তার পরের বছর ‘পার্ব্বণী’ মহাসমারোহে প্রকাশিত হয়। এ বার নিজের ন’বছরের পুত্র নীতীন্দ্রনাথকে শারদীয় বার্ষিকীটি উৎসর্গ করে সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ প্রতি বছর বার করার প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারায় দুঃখ করে জানালেন, “আমি আমার কথা রাখিতে পারি নাই, অনেক চেষ্টা করিয়াও ১৩২৬ সালে পার্ব্বণী ছাপাইয়া উঠিতে পারিলাম না। আজ ১৩২৭ সালে দ্বিতীয় খণ্ড পার্ব্বণী লইয়া উপস্থিত হইয়াছি।” এর পর ‘পার্ব্বণী’ আর কখনও প্রকাশিত হয়নি।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলা শিশুসাহিত্যের এই আদি পৃষ্ঠপোষককে বাংলা সাহিত্য একেবারেই মনে রাখেনি। তাঁর লেখা ‘হাতে চাঁদ কপালে সূয্যি’, ‘ব্যাঙের আত্মকথা’, ‘জম্বুশিয়াল’ ও ইংরেজিতে ‘শের শাহ- দ্য বেঙ্গল টাইগার’, ‘দ্য রেড টর্টয়েজ় অ্যান্ড আদার টেল্স’, ‘ইন্ডিয়ান ফোকটেল্স’ গল্প সঙ্কলনগুলি আজ বিস্মৃতপ্রায়। এ ছাড়াও নগেন্দ্রনাথ ১৩১৯ সালে কবির ‘জীবনস্মৃতি’ এবং ‘ছিন্নপত্র’ বইদু’টির প্রকাশক ছিলেন। সুইডিশ অ্যাকাডেমি প্রেরিত নোবেল-প্রাপ্তির টেলিগ্রামটি জোড়াসাঁকোতে নগেন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম হাতে পেয়েছিলেন এবং তা সত্বর বোলপুরে কবিকে তার মারফত জানিয়ে দেন।
অথচ এই মানুষটি অনেকের কাছেই সমালোচিত। তার প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরা দেবীর সঙ্গে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্কে ধারাবাহিক মতবিরোধ এবং অশান্তি। কবির সঙ্গেও বহু ক্ষেত্রেই তাঁর মতান্তর ছিল। যদিও ১৯০৭ সালের মে থেকে ১৯৩২ সালের জুন, দীর্ঘ পঁচিশ বছরে নগেন্দ্রনাথকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এখনও পর্যন্ত পাওয়া ১৬৩টি চিঠিতে দেখা যায়, নগেন্দ্রনাথের প্রতি কবির অকৃত্রিম ‘শ্রদ্ধা ও স্নেহ’ প্রকাশ পেয়েছে। সময়ে-অসময়ে জামাতার উপর তাঁর আশা-ভরসা, স্নেহ, প্রীতি, বিশ্বাস ও নির্ভরতার বহু নিদর্শনও আছে।
নগেন্দ্রনাথ ছিলেন বরিশালনিবাসী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট সভ্য বামনদাস গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যম পুত্র। এই পরিবারের আর্থিক অসঙ্গতির জন্য বামনদাসকে ঋণ দেওয়া-সহ তাঁর জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র উপেন্দ্র ও ধীরেন্দ্রের থাকা-খাওয়ার দায় এক সময় কবিকে বহনও করতে হয়েছে। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতন আশ্রমে পড়েছিলেন এবং পরবর্তী কালে ভারতবিখ্যাত চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব হয়েছিলেন। তাঁর খ্যাতি ‘ডিজি’ নামেই।
নগেন্দ্রনাথের ‘অপ্রকাশিত’ ডায়েরিতে আছে, পারিবারিক উন্নতির আশায় তিনি বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকায় পড়তে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন। এই উপলক্ষে তৎকালীন বঙ্গসমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তির কাছে অর্থসাহায্য চেয়ে কোথাও কোথাও তাঁকে অপমানিত হতে হয়েছিল। এই অসময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন। রবীন্দ্রনাথ এর বছর দুই আগে থেকে কনিষ্ঠ কন্যা মীরার জন্য সুপাত্রের সন্ধানে ছিলেন। ‘রবীন্দ্রজীবনী’ গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, “কবি এই প্রিয়দর্শন তেজস্বী যুবককে দেখিয়া অত্যন্ত প্রীত হন এবং তাঁহাকেই কনিষ্ঠা কন্যাদানের সংকল্প করেন।” কবি তাঁকে বিয়ের পর আমেরিকায় পড়তে পাঠানোর ব্যয় বহনের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর আশা ছিল, বিদেশে কৃষিবিদ্যা শিক্ষান্তে নগেন্দ্রনাথ ফিরে এসে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে পল্লি-উন্নয়ন ও কৃষিসেবার কাজে লাগবে।
তাঁকে পাত্র হিসেবে মেনে নিয়ে শান্তিনিকেতন মন্দিরে ১৩১৪ সালের ২৩ জ্যৈষ্ঠ আদি ব্রাহ্মসমাজের রীতি অনুসারে সাড়ে তেরো বছরের মীরার সঙ্গে সতেরো বছর সাত মাসের নগেন্দ্রর বিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ‘তেজস্বী যুবক’ নগেন্দ্রনাথ সে দিন সামাজিক গোঁড়ামির কারণে বিবাহবাসরের বহু প্রথা ও স্ত্রী-আচারকে অগ্রাহ্য করে উপস্থিত সুধীজনের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই আচরণে অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেয়ে হিন্দু আচার পালনের সপক্ষে সওয়াল করে তাঁকে দীর্ঘ চিঠি দেন। পরবর্তী কালে কবি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের এই জাতীয় গোঁড়ামিকে কটাক্ষ করে ‘নৌকাডুবি’র অক্ষয় এবং ‘গোরা’র পানুবাবুর চরিত্রদু’টি গড়েছিলেন। এ দিকে নিজের বিবাহ উপলক্ষে নগেন্দ্রনাথের ভাবনার কথা জানা যায় তাঁর ডায়েরির পাতায়। তিনি যখন অর্থসাহায্য চেয়ে কোথাও কোথাও অপমানিত হচ্ছিলেন ঠিক তখন এই বিয়ের প্রস্তাব আসে এবং মানসিক বিরোধিতা সত্ত্বেও বিয়েতে স্বীকৃতি দেন। “লাভের হিসাব গণনা করি নাই বরং ক্ষতিই স্বীকার করিয়াছি।” সঙ্গে এও লিখেছেন, “ঐ যে বিবাহপদ্ধতির জন্য আমার মত ও বিশ্বাসকে খাটো করিতে হইয়াছে, যাহা আমি কুসংস্কার ও অনাবশ্যক বলিয়া মনে করি, তাহা করিতে স্বীকৃত হইয়াছি।” তিনি একে নিজের ক্ষতি হিসাবেই দেখেছিলেন।
নগেন্দ্রনাথকে বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক চিঠি লিখেছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই সে সব চিঠিতে শুধুমাত্র কবির কথাই জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু চিঠিতে নগেন্দ্রর কবির জন্য চিন্তা করার বিষয়ে আলোকপাত রয়েছে। বোঝাই যায়, শ্বশুরমশাইয়ের জন্যও নগেন্দ্রর যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। আবার কবি লিখেছেন, “তোমাদের দুঃখ আমার হৃদয়ে খুব গভীর করে আঘাত করেচে। অথচ তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি এমন শক্তি আমার নেই।” সেই চিঠিতেই কবি বলেছেন, “সংসারে থেকে যে বেদনা পাও সংসারে তার সান্ত্বনা নেই।” আরও অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় কবি লিখছেন, “তোমার জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েচ জানি— কিন্তু সমস্ত দুঃখকে যতক্ষণ পর্যন্ত গভীরভাবে অন্তরের মধ্যে না মিলিয়ে নিতে পারবে ততক্ষণ তার থেকে কিছুতে নিষ্কৃতি পাবে না।” এখানে দরকার ছিল নগেন্দ্রনাথের কবিকে লেখা চিঠিগুলোর প্রকাশ। অজ্ঞাত থেকে গিয়েছে নগেন্দ্রনাথের দুঃখ-বেদনার কথা। কবির চিঠিতেই জানা যায়, নানা সময়ে নগেন্দ্রনাথকে তিনি নিজের কর্মের সহযোগী করতে চেয়েছেন। “কিন্তু বারেবারে নানা প্রতিকূল ঘটনায় তার বাধা ঘটায় আমার মনে দুঃখ থেকে গেছে,” ১৯২৫-এর ৮ জুন এই উচ্চারণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের।
আরও স্তম্ভিত হতে হয় ১৩২৬-এর অগ্রহায়ণে কবির লেখা একটি চিঠি। লিখেছেন, “সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করি, আমাকে ক্ষমা কোরো। পরস্পরের প্রতি অবিচার করে নি এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই— বিশেষতঃ আমার মত মানুষ যার হৃদয়াবেগ প্রবল। নিশ্চয়ই তোমার উপর অনেক অন্যায় করেচি। সেইটেকেই বড় করে দেখো না। তোমাকে আমি ভালোবাসি সেটা তার চেয়ে বড় সত্য।”
এ দিকে কবিকন্যা মীরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় এবং চিঠিপত্রে নগেন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি বাক্যও ব্যবহার করেননি। যদিও রবীন্দ্রনাথ নগেন্দ্রর স্বাতন্ত্র্যবোধ, কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ উচ্চাশাও পোষণ করতেন। বিদেশযাত্রার আগে নগেন্দ্রকেই শিলাইদহের জমিদারি, জোড়াসাঁকো বাড়ির তত্ত্বাবধান, এমনকি আদি ব্রাহ্মসমাজের ভারও দিয়েছিলেন। কবি একাই নন, কবিবন্ধু জগদীশচন্দ্রের মতে একমাত্র নগেন্দ্রনাথই আশ্রমবিদ্যালয়ের ভার নেওয়ার যোগ্য ছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই কবুল করেন। এ দিকে কবি নিজে মীরা দেবীকে ১৯১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এক পত্রে পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বামীর প্রতি অনুগত ও ভক্তিপরায়ণ হতে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও জামাতা নগেন্দ্রনাথকে ‘অনাহার থেকে দেশের লোককে যথাসম্ভব বাঁচানোই তোমাদের জীবনের ব্রত হবে’ বলে বার বার আহ্বান করেছেন। কবির আহ্বানে নগেন্দ্রনাথ একাধিক বার পল্লি-উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করবেন আশ্বাস দিয়ে উদ্যোগী হয়েও শেষ পর্যন্ত মন স্থির রেখে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেষে ১৩৩৮ সনে পল্লি-সংস্কার সমস্যার আলোচনা প্রসঙ্গে ‘জাতীয় ভিত্তি’ নামে এক অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন । সেখানেও রবীন্দ্রনাথ ভূমিকা লিখে দিলে লেখকের নিবেদনে নগেন্দ্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে লিখেছিলেন, “পরমপূজনীয় বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইখানির ভূমিকা লিখে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সমবায়ের যে আদর্শ উপস্থিত করেছেন, তা’র মূলে আছে শুভবুদ্ধি, খাঁটি-স্বদেশপ্রীতি ও মনুষ্যত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।”
১৯২৬ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-অর্থনীতির ‘খয়রা অধ্যাপক’ নগেন্দ্রনাথ অবশেষে ১৯৩২ সালে পাকাপাকি ভাবে লন্ডনে চলে যান। অভিমানবশত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কি না জানা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রাবস্থায় অশ্বিনীকুমার দত্তের দীক্ষাপ্রাপ্ত নগেন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা বিশেষ উল্লেখ্য। ১৯৫০ সালে ইউরোপের দেশে দেশে ‘রবীন্দ্রনাথ’ সম্পর্কে বহু বক্তৃতা দিয়েছেন। পরের বছর শেষ বার ভারতে এসেছিলেন। লন্ডনে ‘স্বরাজ হাউস’ ও ‘ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয়দের প্রশংসাও পান। যে মানুষটি সারা জীবন নানা বিষয়ে দোলাচলে দুলে বার বার স্থান পরিবর্তন করেছেন, অবাক হতে হয় জীবনের শেষ বাইশ বছর তাঁকে লন্ডনে থিতু হতে দেখে। ১৯৫৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুকালে অন্তত মেয়ে নন্দিতা কৃপালনীকে কাছে পেয়েছিলেন বিতর্কিত, তেজস্বী এই মানুষটি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy