Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

নীল পেনটা যদি খুঁজে পেতাম

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েও যে পেন ধরা ছিল তাঁর হাতে, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেটি। খুঁজে পাননি স্ত্রী সন্ধ্যা মাহাতো। শিক্ষক দিবাকর মাহাতো বিশ্বাস করতেন তিনি কখনও কারও ক্ষতি করেননি, তাঁরও কোনও ক্ষতি হবে না। এই সরল বিশ্বাসের মূল্য দেয়নি মাওবাদী সন্ত্রাস। এক শিক্ষক দিবসের আগের দিন থেমে গেছে এই শিক্ষকের পথ চলা।

—প্রতীকী ছবি।

কিংশুক গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪৯
Share: Save:

নিস্পন্দ ডান হাতের মুঠোয় ধরা আছে একটা নীল পেন! আজও!

দোতলার ঘরের দেওয়ালে ফ্রেমবন্দি তিনি— ‘শিক্ষক দিবসের আগের দিনে মাওবাদী সন্ত্রাসের বলি শিক্ষক’। তেরো বছর আগের সংবাদপত্রের প্রথম পাতার অংশ। সঙ্গে নীল পেন ধরা হাতের ছবি।

ঝাড়গ্রাম শহরের সত্যবান পল্লির বাড়িতে তিনি ফিরলেন না ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর! কষ্ট নিছক শব্দ নয় বছর পঁয়ষট্টির সন্ধ্যা মাহাতোর কাছে।

ঝাড়গ্রাম শহরের অদূরে গড়শালবনি গ্রামের নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়। দিনটা শনিবার। সকাল সাড়ে এগারোটা। সবে ক্লাস বসেছে। মাওবাদীরা হানা দিল স্কুলে। প্রধান শিক্ষক দিবাকর মাহাতোকে টেনে নিয়ে গিয়ে স্কুলের একেবারে সামনে দাঁড় করিয়ে কপাল ও বুকে গুলি। লোধাশুলি-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়কের উপর লুটিয়ে পড়েছিল দিবাকরের দেহ। তখনও তাঁর হাতে ধরা ছিল নীল পেন!

সন্ধ্যা বলেন, “ওঁকে সারা জীবনের মতো হারিয়েছি। যদি নীল পেনটা খুঁজে পেতাম! অনেক খুঁজেছি। পাইনি।”

পেশায় শিক্ষক দিবাকর সিপিএম-পরিচালিত ঝাড়গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। ছিলেন সিপিএমের আগুইবনি লোকাল কমিটির সদস্যও।

সময়টা ২০১০ সাল। জঙ্গলমহল তখন মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। খুন, গুম, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ, বন্‌ধ-অবরোধের রোজনামচা। আতঙ্কে এলাকাছাড়া সিপিএমের অনেক নেতা-কর্মী। দিবাকর পালাননি। সন্ধ্যার কথায়, “উনি বলতেন, ‘কোনও অন্যায় করিনি, কারও ক্ষতি করিনি। আমাকে মারবে কেন!’ তাই রোজ স্কুলে যেতেন।”

তার পর কয়েকটা গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল সন্ধ্যার জীবন। কিন্তু তিনি অন্ধকারে ডুবে যাননি। ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন। ছেলে বছর পাঁচেক আগে স্থায়ী সরকারি চাকরি পেয়েছেন। কর্মসূত্রে থাকেন হাওড়ায়। ছেলের বিয়েও দিয়েছেন সন্ধ্যা। বৌমা কলকাতার স্কুলের শিক্ষিকা। নাতি-বৌমা তাই যাদবপুরের বাসিন্দা।

ভাদ্রের পড়ন্ত বেলায় ঘরের ভিতরে সঙ্গী নিঃসঙ্গতা আর ঘরের বাইরে এক রাশ মুখ। দিবাকরের মৃত্যুর পর বাড়ির এক তলায় কলেজ, পলিটেকনিক ও চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া ছাত্রদের মেস করে দিয়েছিলেন সন্ধ্যা। আবাসিকদের থেকে ভাড়া নেন না। আবাসিকরা বিদ্যুতের বিলের কিছুটা খরচ দেন। বেলপাহাড়ির রংপুরের সজল গরাই, তমাল বিশুই, গোপীবল্লভপুরের অমিত মাহাতো দেখাশোনা করেন ‘সন্ধ্যা জেঠিমা’র।

পাঠাগারের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া সন্ধ্যার দিন-রাত তাই ঘোরাফেরা করে স্মৃতি, কষ্ট, আর সংসারের কাজে। স্মৃতি সততই সুখের এবং দুঃখের। মিলেমিশে ঘর ভারী করে তোলে।

সামনে এসে দাঁড়ায় ঝাড়গ্রামের ঢোলকাট গ্রামের তরুণী সন্ধ্যা। যার সঙ্গে এলাকার বনকাটি গ্রামের দিবাকরের প্রায়ই দেখা হত পথে। কলেজে ছাত্র-রাজনীতি করতেন দিবাকর। ফার্স্ট ইয়ারের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পার্টির কাজ। আর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বাম রাজনীতিতে সন্ধ্যা। দু’জনের কাছাকাছি আসা। অতঃপর দুই পরিবারের সম্মতিতে চার হাত এক। ১৯৮৮ সালে পুত্রসন্তানের জন্ম। তত দিনে সন্ধ্যাও ঝাড়গ্রাম শহরের একটি সরকারি পাঠাগারে চাকরি পেয়েছেন। দিবাকর পার্টির হোলটাইমার। ছেলের বয়স যখন চার, তখন দিবাকর মধুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরিতে যোগ দিলেন। পরে আউলিগেড়িয়া প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা কয়েক বছর। তার পর গড়শালবনির শালবনি নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আগে ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন দিবাকর-সন্ধ্যা। ১৯৯৮ সাল থেকে ঝাড়গ্রাম শহরে ভাড়া বাড়িতে। ২০০৫ সালে নিজেদের বাড়ি। একতলা।

২০০৮ সালের নভেম্বর। পুলিশি সন্ত্রাসের অভিযোগে জঙ্গলমহলে শুরু জনসাধারণের কমিটির আন্দোলন। ক্রমে সেই আন্দোলনের রাশ গেল মাওবাদীদের হাতে। তাঁদের নিশানায় তখন সিপিএমের নেতা-কর্মী ও দলের সাধারণ সমর্থকরা। পুলিশ ও সিপিএমের চর দেগে দিয়ে ‘সন্দেহভাজন’ সাধারণ গ্রামবাসীরাও। দিনভর উদ্বেগ, আতঙ্ক। দিবাকর বলতেন, “পার্টি করলেও আমি ছা-পোষা মাস্টার। আমাকে মেরে ওদের (মাওবাদী) বিপ্লব সফল হবে না। আমি স্কুল কামাই করলে বরং ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনার ক্ষতি। স্কুলে না গেলে অন্যরা কোন ভরসায় স্কুল চালাবেন!”

‘ছা-পোষা মাস্টার’ স্কুলে যেতেন রোজ। ছেলে তখন বিষ্ণুপুরে বি-টেক তৃতীয় বর্ষ। ঝাড়গ্রামের বাড়িতে সন্ধ্যা আর দিবাকর। সে দিন সকালে মাছের ঝোল-ভাত বেড়ে দিয়েছিলেন স্বামীকে। খাওয়াদাওয়া সেরে বুকপকেটে নীল পেন আর বাস ভাড়ার কিছু খুচরো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন দিবাকর। সে দিন দুপুরে সন্ধ্যার মন চঞ্চল। শনিবার তো হাফছুটি। এখনও কেন ফিরছে না মানুষটা!

স্মৃিতমেদুর: প্রয়াত শিক্ষক দিবাকর মাহাতোর ছবির সামনে স্ত্রী সন্ধ্যা মাহাতো। ডান দিকে, কাচে বাঁধানো স্বামীর মৃত্যুসংবাদে স্ত্রীর মুখের প্রতিফলন। মূল ছবি, মৃত দিবাকর মাহাতোর সেই নীল কলম ধরা হাত। এই ছবিটিই প্রকাশিত হয়েছিল মৃত্যুর পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

স্মৃিতমেদুর: প্রয়াত শিক্ষক দিবাকর মাহাতোর ছবির সামনে স্ত্রী সন্ধ্যা মাহাতো। ডান দিকে, কাচে বাঁধানো স্বামীর মৃত্যুসংবাদে স্ত্রীর মুখের প্রতিফলন। মূল ছবি, মৃত দিবাকর মাহাতোর সেই নীল কলম ধরা হাত। এই ছবিটিই প্রকাশিত হয়েছিল মৃত্যুর পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

আচমকা মেজ-জা বুলবুল আর ছোট দেওরের ছেলে উদয়নের হঠাৎ ছুটে আসা। আর উদয়নের বুকফাটা আর্তনাদ, “জেম্মা গো, জেঠু আর নেই!” তত ক্ষণে টেলিভিশনে খবর দেখে বাড়ির সামনে ভিড়। তার পর? খবর দেওয়া হল বিষ্ণুপুরে। এসে পৌঁছলেন পিতৃহারা সন্তান। পুলিশ মর্গ। ময়নাতদন্ত। স্বপ্নের বাড়িকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন দিবাকর। সন্ধ্যা ভেবে চলেছেন, এর পর কী হবে ছেলের ভবিষ্যৎ। বি-টেক করার পর বাড়িতে গুমরে থাকত ছেলেটা। মায়ের কোলে মাথা গুঁজে কখনও কান্নায়, কখনও ঝাঁঝিয়ে উঠত, “কেন এ ভাবে অনাথ করে দিল ওরা। বাবা তো কোনও ক্ষতি করেনি ওদের!”

শোনা যায়, দিবাকরের স্কুলের ভবন বাড়ানোর জন্য সর্বশিক্ষা মিশন থেকে চার লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু টাকা তোলেননি দিবাকর। কেন? এত বছর পরও স্পষ্ট সদুত্তর নেই। তবে দিবাকরের ঘনিষ্ঠ মহল বলে, ওই টাকা তুলে ভবনের কাজ করাতে গেলে মাওবাদীদের লেভি দিতে হত। হয়তো সেই কারণে গড়িমসি করেছিলেন দিবাকর। আর তাতেই কি মাওবাদীদের রোষ!

সন্ধ্যার মনে পড়ে, দিবাকরের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে সামনাসামনি মাওবাদীদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। তখন তিনি পাঠাগারের কাজে ফিরেছেন। একাই পাঠাগারে ছিলেন। আচমকা এসে থামল সাদা গাড়ি। চালক গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করেননি। তিন জন যুবক দ্রুত ঢুকে প়ড়লেন ঘরে। কোমরে পিস্তল। গ্রন্থাগারিকের (যিনি সিপিএমের নেতাও) খোঁজ করলেন। সন্ধ্যার কথা বিশ্বাস হল না। পাঠাগারের আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে চলল তল্লাশি। সন্ধ্যা এক বার ভেবেছিলেন, ওই যুবকদের কাছে জানতে চাইবেন, দিবাকর মাস্টারের অপরাধটা কী ছিল! কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। আঁচল দিয়ে কপালের বিন্দু-বিন্দু ঘাম মুছে সন্ধ্যা বলেন, “প্রশ্ন করলে হয়তো আমাকেও গুলি করে মারত। তা হলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যেত।”

সেই ছেলে এখন থিতু। চাকরি এবং সংসারে। আর ছা-পোষা মাস্টারের ছা-পোষা স্ত্রী দিন কাটান বদলে যাওয়া শহরটাকে দেখতে দেখতে। মাওবাদী হানায় ‘শহিদ কমরেড’-এর স্ত্রীকে পথচলতি লোকজন চিনতে পারেন না। দলের পুরনো দিনের কর্মীরা বাড়িতে আসেন। খোঁজখবর নেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের প্রাক্তন খাদ্য-কর্মাধ্যক্ষ দীপক ঘোষ প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার খোঁজখবর নেন।

দিবাকরের মৃত্যুর পর দল সন্ধ্যাকে অর্থসাহায্য করতে চেয়েছিল। সন্ধ্যা দলের সাহায্য নেননি। উল্টে দলীয় কার্যালয় ভবনের সংস্কারের জন্য কিছু টাকা দিয়েছেন। সন্ধ্যার কথায়, “আমি এখনও দলের সদস্য। টাকার জন্য তো দল করিনি কোনও দিন। আদর্শ নিয়ে করেছি।”

২০১৭ সালে পাঠাগারের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বলেন, “ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমার আর কিছু প্রত্যাশা নেই।”

তবে অপেক্ষা আছে। আগামী কাল ৪ সেপ্টেম্বর। সন্ধ্যা বলে চলেন, “অপেক্ষায় আছি, হয়তো কোনও এক ভোরে পরিচিত গলাটা শুনতে পাব। কেউ ডেকে উঠবে, ‘দরজা খোলো সন্ধ্যা। আমি এসেছি’।”

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy