—প্রতীকী ছবি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অল সোলস কলেজ। পরে শেক্সপিয়র-চর্চায় দুনিয়া জুড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া এ এল রাউস তখন সদ্য ‘ফেলো’ হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানে। বয়স বাইশ বছর মাত্র। এক রাতে কলেজের কেতাদুরস্ত নৈশভোজের টেবিলে শেষ পাতে মিষ্টি এল— পুডিং। তার উপরে একটি টুকটুকে লাল চেরি ফল। চেরি তো না-হয় খেলেন, কিন্তু তার বীজটিকে নিয়ে কী করণীয়, আদৌ তা মুখ থেকে বার করে ফেলতে যাওয়া সেখানকার আদবকায়দার সঙ্গে মানানসই হবে কি না, সে বিষয়ে চিন্তা করলেন বেশ খানিক ক্ষণ। এক সময়ে আর মনস্থির করতে না পেরে কোঁৎ করে গিলেই ফেললেন সেটিকে! এর অনেক-অনেক দিন পরে, বয়স যখন ঢুকে পড়েছে নব্বইয়ের কোঠায়, তখন এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকারে রাউস বলেছিলেন, সেই রাতে চেরির বীজটি নিয়ে ঠিক কী করা উচিত ছিল, আজ এত দিনেও তা ঠাহর করে উঠতে পারেননি তিনি!
রাউসের এই মজার কীর্তি উঠে এসেছে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধনের স্মৃতি রোমন্থনের পাতায়। তাঁর বই ‘স্মৃতিকণ্ডূয়ন’-এ। যত বার পড়ি, তত বার খুব একচোট হাসি বটে, তবে একই সঙ্গে মনে হয়, মুখের মধ্যে ঘুরতে থাকা চেরির ওই বীজই আসলে আমাদের জীবন!
আমরা বলতে, যারা গাঁ-গঞ্জ-গ্রাম-মফস্সল থেকে পড়তে কিংবা চাকরির খোঁজে বাড়ি ছেড়ে, ঘর ‘ভুলে’, তল্পিতল্পা গুছিয়ে বড় শহরে আসি। আসি এবং থেকে যাই। পিছনে পড়ে থাকে নিজের বাড়ি, আপন ঘর, রক্তের টান, চেনা চৌহদ্দি, ভরদুপুরে ক্রিকেট-খেলা গলি, মায়ের হাতের রান্না, ভোররাতে মহালয়া শোনার রেডিয়ো, নারকেলের নাড়ু, আচারের বয়াম, পরিচিত মহল্লা, স্কুলের বন্ধুত্ব, প্রথম প্রেম... আরও কত কিছু।
ট্রেন কিংবা বাস ধরতে রওনা দেওয়ার মুখে যেন ‘কু ডাকে’ মন। কানের কাছে এসে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে যায়, ‘এর পরেও মাঝেমধ্যে ছুটিছাটায় বাড়ি তুমি আসবে বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে অনেক কিছুই পাল্টে যাবে অনেকখানি!’ এক-এক করে ছিঁড়ে যাবে সম্পর্কের বহু তার। প্রায় গায়ে-গায়ে লেপ্টে থাকা ছোটবেলার বন্ধুর ‘কী রে কেমন আছিস’ ফোনও কমে আসবে ক্রমে ক্রমে। বহু ক্ষেত্রে বদলে যাবে পড়শির চাউনি। পরিচিতের মিষ্টি কথা বদলে যাবে কটাক্ষে। আলো-আঁধারি সন্ধ্যায় দু’দিনের বহু কষ্টে পাওয়া ছুটিতে ব্যস্ত পায়ে বাড়ি ঢোকার ঠিক মুখে পিছন থেকে কে যেন আলতো করে বলে যাবে, “এত দিনে আসার সময় পেলি? তা তোদের তো আবার বড় চাকরি!” মুহূর্তে তেতো হয়ে যাবে ছুটি। বিস্বাদ ঠেকবে বাড়ি ফেরার আনন্দও। যেন এক লহমায় পাল্টে যাবে জীবনের আঙ্গিকই।
এমন নয় যে, সকলের সঙ্গে অবিকল এমনটাই ঘটবে। কিংবা সকলকেই খানিকটা ‘পর করে দেবে’ তার পরিবার-পরিজন। অনেকেরই বাড়ি আর পরিচিতের বৃত্ত স্নেহের আঁচল বিছিয়ে আজীবন থাকবে অপেক্ষায়। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, সে সুখ গ্রাম-মফস্সল ছেড়ে আসা সব ছেলের নয়।
নিখাদ পড়ার তাগিদে, কাজের খোঁজে কিংবা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যে বড় শহরে আসা, সে-ও তার হিসাব বুঝে নিতে থাকে নিজের মতো করে। তার গদ্য বড় কর্কশ, বড় কঠিন সেই অঙ্কের নামতা। শুধু পায়ের নীচে জমি পেতেই কত জনের কেটে যায় অর্ধেক জীবন। ‘আর একটু গুছিয়ে নেওয়া’ আর হয়ে ওঠে না কখনও। ফিরে গেলে ব্যর্থের তকমা, আর সামনে ধূ-ধূ তেপান্তরের মাঠ। ওই দূরে, মাঠ পেরিয়ে সাফল্যের আলো দেখা যায় মিটিমিটি। কত দূরে কে জানে? এ তো রূপকথা নয় যে, চকিতে হাজির হবে পক্ষীরাজ ঘোড়া, হা-ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে গল্প শোনাবে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী। এখানে বরং গল্প শুধু একবগ্গা লড়াইয়ের। জীবনের ময়দানে যুঝে নেওয়ার। যে যতটুকু পারে।
প্রেসিডেন্সি কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য পড়তে এসেছেন অমর্ত্য সেন। নিজের স্মৃতিকথা ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ লিখছেন, প্রায়রি রোডে মিসেস হ্যাঙ্গার নামে যাঁর বাড়িতে তিনি তখন ভাড়া থাকেন, সেই ভদ্রমহিলা যথেষ্ট মিষ্টভাষী, দিলখোলা মানুষ। কিন্তু গোড়ায় অশ্বেতাঙ্গ কাউকে বাড়ি ভাড়া দিতে তাঁর আপত্তি ছিল যথেষ্ট। কেন? মজার ছলে অধ্যাপক সেন লিখছেন, “প্রথম দিনই আমাকে তাঁর সটান জিজ্ঞাসা, আচ্ছা, স্নানের সময়ে, বিশেষত গরম জলে স্নানের সময়ে তোমার চামড়ার (বাদামি) রং বেরিয়ে আসবে না তো?” অর্থাৎ তাঁর ভয়, যদি সেই রঙে নোংরা হয় বাথটব!
হয়তো এতখানি নয়, তবু কত শত অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন যে তাড়া করে গ্রাম-মফস্সল থেকে দলে-দলে আসা ছেলেদের! ‘হ্যাঁ রে, তোরা নাকি কুমড়োকে ডিংলে বলিস?’ ‘তোর অমুক সার্কাসমার্কা উচ্চারণটা আর এক বার করে দেখা দেখি!’ ‘ও চাঁদু, তোমার মুখে তো দেখি কথা ফোটে না... পটাপট এই খানকয়েক খিস্তি মুখস্থ করো দেখি!’ কোথাও হস্টেলে ‘দাদা’কে খুশি রাখার ফরমায়েশ, কোথাও অফিসে জড়সড় ইংরেজির গ্লানিতে কুঁকড়ে থাকা মন। কত সময় আর এই বোঝা বইতে না পেরে কত স্বপ্নের লাশ পড়ে থাকে হস্টেলের চাতালে! আবার কোনওক্রমে বেঁচে গিয়েও মরমে মরে থাকে কেউ। আজীবন! তার মানে অবশ্য এই নয় যে, এই ভীরু, লাজুক, মুখে কথা না-ফোটা ছেলেই ‘ট্রেডমার্ক মফস্সল’। সদ্য র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে প্রাণ খোয়াল যে ছেলে, সত্যিই সে এসেছিল জেলার অতি সাধারণ পরিবার থেকে। কিন্তু তেমনই এ কাজে যাদের দিকে অভিযোগের আঙুল, তাদের অনেকের শিকড়ও কিন্তু সেই গ্রাম-মফস্সলে। গ্রাম-মফস্সল থেকে শুরু করেই কেউ ‘রাজনীতির দাদা’র হাত ধরে ‘এলাকার ডন’, কেউ চাঁদের পিঠে দেশের পতাকা ওড়ানোর নেপথ্য কুশীলব। অঙ্কের একটি সূত্রে সব ধাঁধার চাবি খোলে কি কখনও?
গ্রাম-মফস্সল থেকে আসা আমরা যারা নিতান্ত সাধারণ, সকাল থেকে রাত খেটে খাওয়াই যাদের জীবনসংগ্রামে একমাত্র অস্ত্র, চাকরিতে-ব্যবসায় ঘাড় গুঁজেই তাদের পার হয়ে যায় কত-কত বছর। কখন যে সন্ধ্যা নামে, কখন জ্যোৎস্নায় থইথই করে ছাদ, কখন বসন্ত টোকা দিয়ে যায় জীবনের দরজায়, আর কখনই বা কথা শুনতে বেঁকে বসে হুশ করে বড় হয়ে যাওয়া সন্তান— সে সব ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই জীবন চলে যায় কয়েক দশকের পার। চুলে পাক ধরে। বুকের মধ্যে ঘূর্ণির মতো পাক খায় হাজারো আক্ষেপ। এত দৌড়েও জীবন-খাতার হিসাব আর মেলে না! মাথার উপরে ছাদ জোগাড়ের তাগিদ, ছাদ হলে তার কিস্তি গোনার টেনশন, ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন, সপ্তাহান্তে জমানো টাকায় শপিং মল আর অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষে পুরী— এই রুটিন ভেঙে যখন ঘোর কাটে, তখন শরীরে বয়সের থাবা। তত দিনে তারার দেশে চলে গিয়েছে কত প্রিয়জন। ডাকনামে ডাকার লোকও আর খুঁজে পাওয়া ভার। চোখের জলে আবছা হয় স্মৃতি। মনে হয়, শহরের ‘লড়ে জেতা’ মাটিতে শুধু থিতু হতে গিয়ে কত কিছু খুইয়ে ফেললাম আমরা! পাসপোর্টে ফ্ল্যাটের ঠিকানা, ভোটার-কার্ডে মফস্সলের বাড়ির। কোনটা যে আসল বাড়ি, কে জানে! ছুটির অলস কোনও দুপুরে হেমন্ত-কণ্ঠ মনে করায়, ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে যে জন আছে মাঝখানে...’ ভেজা চোখে ভারী হয় মন। ঝাপসা হয় চশমার কাচ। বুকের ভিতরে কে যেন হাতুড়ি পেটে। শিকড়ে ফেরার শিস দিয়ে গেল কোন পাখি?
আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসতেই মন আনচান। স্মৃতির সিন্দুক থেকে আচমকা বেরিয়ে আসে ঠাকুরদালানের হুল্লোড়, ক্যাপ ফাটানোর বন্দুক, ভাই-বোনেদের মিঠে খুনসুটি, গুড় জ্বাল দেওয়ার গন্ধ। নিজেকেই চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছা করে, কবে কোন জাদুতে পিঠেপুলির জায়গা নিল পিৎজ়া? কী করেই বা জন্মদিনে পায়েসের বাটিতে কামড় বসাল কেক-পেস্ট্রি-বার্গার?
পেপসি-র এক সময়ের কর্ণধার ইন্দ্রা নুয়ি-ও আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ ইন ফুল’-এ লিখছেন, “অবসরের পরে রাস্তায় গাড়ি চালাতে-চালাতে এক-এক সময় থমকে যেতাম আমি। দেখতাম, হাতে কত অঢেল সময় নিয়ে স্কুল থেকে সন্তানকে নিতে এসেছেন মা। গল্পগাছা করছেন। অফুরান অপেক্ষায় বিরক্তি নেই। কারণ, হাতে সময় অনন্ত। মনে হত, এই সময় কি কোনও দিন আমি দিতে পেরেছি নিজের মেয়েদের?” এই নাছোড় দোটানা, এই লাগাতার দোলাচলেই ভাসতে থাকে আমাদের জীবন। হয়তো সেই কারণেই কর্পোরেট-কেরিয়ারে কার্যত এভারেস্টজয়ী ইন্দ্রা মধ্য-পঞ্চাশ পেরিয়েও ভুলতে পারেন না ভারতে তাঁদের ছোট্ট বাড়িতে লন্ঠনের আলো! এমনকি দাঁত মাজতে ব্যবহারের সেই কাঠকয়লার স্বাদও তাঁর মনে থেকে গিয়েছে চিরকাল! ভুলতে পারেননি ঘরের আধছেঁড়া মাদুর বা রান্নার মৌতাতও।
তার পরে এক দিন সেই ফোন আসে। যা আস্ত জীবনটাকেই কার্যত দাঁড় করিয়ে দেয় এক মস্ত প্রশ্নচিহ্নের মুখে। যেন কড়া চোখে প্রশ্ন করেন ছোটবেলার অঙ্কের সেই রাগী মাস্টারমশাই— ‘তা হলে হিসাবটা কী দাঁড়াল?’ আমি, আমরা তো কোন ছার, হাজার হাতড়েও এর উত্তর খুঁজে পাননি আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা!
‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’ বইয়ে ওবামা লিখছেন, “ফোনের ও পাশ থেকে এক মহিলাকণ্ঠ বলে চলেছেন, ব্যারি... ব্যারি, শুনতে পাচ্ছ?... তোমার বাবা আর নেই!”
ফোনের এ পাশে তখন পড়ুয়া বারাকের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিলকুল। মনে হচ্ছে, যে মানুষটা এখনই চলে গেল, তার সঙ্গে ভাল করে দেখাই তো হল না কখনও। হল না দু’দণ্ড বসে কথা বলাও।
ওবামার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। কিন্তু কাজের চাপে বাড়ি থেকে আসা ফোন কেটে দেওয়ার গ্লানি, সময় থাকতে আরও দু’বার যেতে না পারার অপরাধবোধ অজান্তেই ঘিরে ধরে আমাদের। মনে হয়, বাড়ি থেকে গুছিয়ে আনা ব্যাগের মধ্যেই যেন চিরকাল ছিল এ সব। যে দিন মা চলে যান চিরদিনের মতো, বাবা চোখ বোজেন, আর কখনও না-ফেরার দেশে রওনা দেন বুকে আগলে মানুষ করা পিসি, সে দিন এক সর্বগ্রাসী অসহায়তা যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাদের। বার বার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘কী করে এমন হল? কী ভাবে এমন অসেতুসম্ভব দূরত্ব তৈরি হল নিজের বাড়ির সঙ্গে? ঘণ্টা কয়েকের রেলপথের দূরত্ব কেন ঠেকল অতলান্তিকের মতো?’
উত্তর নেই। তখন উত্তর খুঁজে আর কোনও লাভও নেই অবশ্য। কী খুইয়ে কী পেলাম, সেই হিসাব আর মফস্সলের ছেলেটির মেলে না। কোনও দিন, আজীবন।
এক-এক সময় সব ফেলে বাড়ি ফিরে যেতে মন চায়। ঠিক যেমন ভাবে মাকে সঙ্গে করে এনে নিজের পুরনো মহল্লায় বহু দিন আগে ছেড়ে যাওয়া বাড়ির তালা খুলেছিলেন ‘চক দে ইন্ডিয়া’-র শাহরুখ খান। কিন্তু পথ রুখে দাঁড়ায় রুখা বাস্তব। হিসেবি বুদ্ধি বলে, টুকটুকে লাল চেরির সেই বীজের মতোই এই ‘নতুন করে আঁকড়ে ধরা’ শহুরে জীবনকেও আর ফেলে দেওয়ার জো নেই। তার থেকে বরং কোঁৎ করে গিলে ফেলাই ভাল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy