মানবদরদী: মিউনিখের একটি অনুষ্ঠানে ক্যালিপসো-কিং হ্যারি বেলাফন্টে। ছবি: গেটি ইমেজেস।
সময়টা ১৯২৭। প্রায় একশো বছর আগেকার মার্কিন মুলুক। নিউইয়র্কের হার্লেমে এক কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে ছেলেটির জন্ম। শ্রমিক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা ছিল না এই ছেলেটার ছোটবেলা। একটু বড় হয়ে মার্কিন নৌসেনাতে যোগদান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। এই পর্যন্ত প্রায় অতি সাধারণ ভাবে বয়ে চলা একটা জীবন হঠাৎ এক আশ্চর্য বাঁক নিল। ইতিহাস বলছে, টানা প্রায় একত্রিশ সপ্তাহ তাঁর একটি গানের অ্যালবাম আমেরিকায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছিল। এই মানুষটিরই নাম হ্যারল্ড জর্জ বেলাফন্টে জুনিয়র।
যুদ্ধ শেষে বেলাফন্টের জীবন ঘুরে যায় একটি থিয়েটার হলে গিয়ে। আচমকাই সুযোগ পেয়েছিলেন আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের থিয়েটার দেখার। থিয়েটার দেখতে গিয়ে হঠাৎ কমবয়সি ছেলেটার মাথায় চাপে অভিনয় করার শখ। অভিনয় শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অর্থ, তাই ক্লাব সিঙ্গার হিসেবে ধরলেন নতুন রোজগারের পথ। আর এ ভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত এক যুবক, অভিনয় শিখতে গিয়ে প্রবেশ করল গানের জগতে। এর পর ধীরে ধীরে রূপকথার মতো ঘটে গেল একের পর এক ঘটনা। সেই সময়কার মার্কিন মুলুকে, যেখানে পরিষ্কার ভাগ ছিল শেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের, সেখানে অ-শ্বেতাঙ্গ পরিবারে জন্মেও গানের জগতে ধ্রুবতারা হয়ে উঠল ছেলেটা। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল ‘ক্যালিপসো’। সেই অর্থে প্রথম ব্যক্তিগত অ্যালবাম। তার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই আশ্চর্য গায়ককে।
‘ক্যালিপসো’ এতটাই জনপ্রিয় হল যে, একত্রিশ সপ্তাহ ধরে শ্রেষ্ঠত্বের আসন ধরে রাখল। দশ লক্ষের বেশি বিক্রি হল এই অ্যালবাম। এর পর এল একের পর এক বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক চুক্তি এবং অবাধে জনপ্রিয়তার দুনিয়ায় রাজার মতো প্রবেশ করলেন বেলাফন্টে। হয়ে উঠলেন ‘কিং অব ক্যালিপসো’।
এই অ্যালবামের ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ বেলাফন্টের জীবনে অন্যতম জনপ্রিয় গান, এই সুরেই তৈরি জনপ্রিয় বাংলা গান শুনে বড় হয়েছেন অনেক বাঙালি। বাংলা ভাষাতেও তো ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র রঞ্জনপ্রসাদের হাত বেয়ে আছড়ে পড়েছেন বেলাফন্টে, ‘আহা পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়ে/ যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়ে’। এই অ্যালবামেই ছিল ‘ব্যানানা বোট সং’। লাইভ শো-এ এই গান যত বারই বেলাফন্টে গেয়েছেন, তত বারই উত্তাল হয়েছে জনতা। এই অ্যালবামের পরও একাধিক জনপ্রিয় অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে বেলাফন্টের। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বেলাফন্টে অ্যাট দ্য গ্রিক থিয়েটার’, সত্তর দশকে প্রকাশ পেয়েছে ‘ক্যালিপসো কার্নিভাল’।
হঠাৎ কী মনে হল, ঠিক করলেন অভিনয়েও একটু মন দেওয়া উচিত। বেশ কিছু কাজের ডাকও পাচ্ছিলেন। ষাটের দশকে প্রবেশ করলেন অভিনয়ে। অভিনয় করলেনও বেশ কিছু ছবিতে। তবে মন বসল না। এতে বেশি সময় না দিয়ে আবার ফিরলেন গানে। তবে শুধু অভিনয় আর গানের দিক থেকে দেখলে এই শিল্পীর সম্বন্ধে প্রায় কিছুই বলা হয় না। আমেরিকায় তখন শুরু হয়েছে অ-শ্বেতাঙ্গদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। বেলাফন্টের মেন্টর ছিলেন আর এক বিখ্যাত শিল্পী পল রবসন। গানের সঙ্গে প্রতিবাদ, গানের মধ্য দিয়ে উৎপীড়িত মানুষের কথা বলার নেশা হয়তো এই রকম মানুষের কাছ থেকেই এসেছিল বেলাফন্টের জীবনে। তার সঙ্গে যুক্ত হলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। বেলাফন্টে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের আন্দোলনের সঙ্গে। এমনকি ওয়াশিংটনে ১৯৬৩ সালের ঐতিহাসিক পদযাত্রায়, যেখানে মার্টিন লুথার কিং-এর সেই বিখ্যাত ঘোষণা ছিল ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’, তাতেও সঙ্গী হ্যারি বেলাফন্টে। মাটির লুথার কিং জুনিয়রের জীবদ্দশায় যেমন সঙ্গী ছিলেন বেলাফন্টে, শেষ যাত্রাতেও সঙ্গীকে ছাড়েননি তিনি। মার্টিন লুথার কিং-এর পরিবারকেও সাহায্য করে গিয়েছেন নিয়মিত। মার্টিন লুথারের মেয়েও জানিয়েছেন, আপদে বিপদে বেলাফন্টে কী ভাবে তাঁদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অভিভাবকের মতো।
বিখ্যাত গায়ক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, বিপ্লবীর মতো অনেকগুলো তকমা সফল ভাবে বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। পুরস্কার তালিকায় টোনি অ্যাওয়ার্ড, গ্র্যামি, এমি কিছুই বাদ থাকেনি। এক বার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তিনি আসলে এক জন সমাজকর্মী, যিনি পরে শিল্পী হয়েছেন। তবে শিল্পী হওয়ার রাস্তাটা খুব সহজ হয়নি। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার গানের জগৎ তত দিনে কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন বিখ্যাত গায়ক। ঠিক সেই মুহূর্তে এক জন কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক তাঁর গান দিয়ে পরিচিত হবেন, এটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। যদিও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে লুই আর্মস্ট্রং-এর মতো বিখ্যাত শিল্পীরাও ছিলেন। কিন্তু বেলাফন্টে-র ‘ক্যালিপসো’ অ্যালবাম এমন মাদকতা তৈরি করল, যার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। মূলত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের লোকগীতিকে তিনি তুলে ধরেছিলেন নিজের গানে।
মোটামুটি ষাটের দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত বেলাফন্টের জনপ্রিয়তা ছিল তুমুল পর্যায়ে। ধীরে ধীরে বব ডিলান থেকে শুরু করে সিঙ্গার-সং রাইটার অর্থাৎ একাধারে গায়ক-গীতিকাররা আসতে শুরু করলেন এবং সামগ্রিক ভাবে গানের এক অন্য ধারাও তৈরি হল। ও দিকে ষাটের দশকে এসে গেছে ‘বিটলস’। মজার কথা হচ্ছে, এই বব ডিলানের শুরুর দিকের কাজও হ্যারি বেলাফন্টের সঙ্গেই। ১৯৬২ সালে বেলাফন্টের ‘মিডনাইট স্পেশাল’ অ্যালবামে হারমোনিকা ছিল ডিলানের। গানটা পুরনো, আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলির রেলগাড়িতে কয়েদিদের গান। বব ডিলানের সেটাই প্রথম অফিশিয়াল রেকর্ডিং! অভিজ্ঞতাটা বেলাফন্টের পক্ষে বিশেষ সুখকর ছিল না। সেটা বব ডিলানের দোষ নয়, আসলে বেলাফন্টে নিজের গাওয়া গানের বিষয়ে বরাবর খুব বেশি মাত্রায় খুঁতখুঁতে।
এইটুকু বলে গায়ক বেলাফন্টের কথা হয়তো কিছুটা বোঝানো গেল। কিন্তু ব্যক্তি মানুষটিকে বোঝা এবং বোঝানো বোধহয় আরও বেশি কঠিন। কারণ যে শিল্পী সরাসরি এই কয়েক বছর আগেও এক আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে তীব্র সমালোচনা করতে পারেন, আবার একই সঙ্গে যে মানুষটি ইউনিসেফ-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হন, যে মানুষটি সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের জন্য অর্থসাহায্য করতে উদ্যোগী হন— তাঁকে সাধারণ মাপকাঠিতে মাপা যায় না। আজীবন নিজেকে নাগরিক আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী ও সমর্থক হিসেবে দেখতেই পছন্দ করতেন বেলাফন্টে। এমনকি একদা ‘মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট’ কলিন পাওয়েল-ও বেলাফন্টের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। তখন বেলাফন্টে প্রবেশ করেছেন এমন এক বয়সে, যখন মানুষ বিশ্রাম নিয়ে পছন্দের জগতে থাকতে ভালবাসে।
তবে শেষ কয়েক বছর বেলাফন্টে নিজেকে অনেকটাই সরিয়ে রেখেছিলেন সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে। সম্ভবত অসুস্থতা এর প্রধান কারণ। তাঁর সময়ের অথবা পরবর্তী সময়ের বহু বিখ্যাত গায়কের মধ্যেও প্রতিবাদী গান অথবা প্রতিবাদ করার প্রবণতা ছিল। কিন্তু এঁদের মধ্যে অনেকেই অহং-সমস্যায় জড়িয়েছেন। সে দিক থেকে বেলাফন্টে ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নিজের কাজ, নিজের প্রতিবাদ ছাড়া আর বিশেষ কোনও বিতর্কে এই শিল্পীকে পাওয়া যায়নি। তাঁর লক্ষ্য নিয়ে তিনি বরাবর খুব সচেতন।
দরিদ্র মানুষের পাশে থাকা নিজের কর্তব্য মনে করতেন বেলাফন্টে। আর ঠিক এই ভাবেই হঠাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি প্রতিবাদী এই ব্যক্তিত্ব গানের মাধ্যমে অন্য এক স্তরে নিজেকে উন্নীত করলেন। সেই সময়ে ইথিয়োপিয়া-সহ আফ্রিকার একাধিক জায়গায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, প্রবল অর্থকষ্টে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মার্কিন মুলুকের বেশ কিছু নামী শিল্পী এক ছাতার তলায় এসে তৈরি করলেন ‘উই আর দি ওয়র্ল্ড’। গান তৈরিতে যুক্ত ছিলেন মাইকেল জ্যাকসনের মতো শিল্পী। আমেরিকার মানুষের আফ্রিকার পাশে থাকার নতুন রাস্তাও তৈরি হয়। এই কাজেও উপস্থিত ছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে।
এক জামাইকান অভিবাসী পরিবার থেকে জন্ম নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁর গান আর প্রতিবাদকে ছড়িয়ে দেওয়ার সেই মানুষটি আর নেই। খবরে প্রকাশ, বেলাফন্টের কিছু রোগ ছিল, সঙ্গে বেড়েছিল বয়স। কিন্তু হ্যারি বেলাফন্টেকে বিদায় জানানো এত সহজ নয়। কারণ এই রকম শিল্পীর কাজ থেকে যায়, তাঁদের চিন্তাভাবনা থেকে যায় আর সেগুলো প্রবাহিত হয় এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের শ্রেয়বোধে, মানবিক চেতনায়। ঠিক যে ভাবে তাঁর পরবর্তী সময়ে উঠে আসা জন লেনন-এর কথা এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে। চলে যাওয়ার এত বছর পরও ‘ইম্যাজিন’ করার স্বপ্নজাল তৈরি করে চলেছেন লেনন। ঠিক সে ভাবেই সারা দিনের কাজের শেষে বাড়ি ফেরার রাস্তায় কোনও ক্লান্ত মানুষ হয়তো গুনগুন করবেন ‘কিং অব ক্যালিপসো’র কোনও গান। তাঁর গানের মধ্য দিয়েই মানুষ মনে রাখবে মানুষের পাশে থাকার, মানুষের হাত ধরার চিরন্তন বার্তা। কখনও ভুলতে পারবে না।
তাই যতই ফেয়ারওয়েল চান, বেলাফন্টে থেকে যাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy