Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

শিবঠাকুরকে ঘর থেকে বার করতেই পার্বতীর নৃত্য-গীত

না হলে জঙ্গল, নদী, ঢেঁকিশাক-শোলাকচুর বঙ্গ ছেড়ে নড়তেই চাইছিলেন না দেবাদিদেব! বৈশাখ মাসের এই নৃত্য-গীতের নাম ‘মেচেনি’। সংক্রান্তিতে শেফালিপাতা ভাজা দিয়ে পান্তা। ‘তিস্তাবুড়ি’র পুজো মানে নদীর কাছে চাষের জলের প্রার্থনা। চৈত্র-বৈশাখের নানা পার্বণে রঙিন হয় উত্তর বাংলা।

অনুষ্ঠান: উত্তরবঙ্গের বৈশাখী অনুষ্ঠান ‘মেচেনি’। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

অনুষ্ঠান: উত্তরবঙ্গের বৈশাখী অনুষ্ঠান ‘মেচেনি’। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

অনির্বাণ রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:২১
Share: Save:

অনেকে বলেন, উত্তরবঙ্গ নাকি পাণ্ডববর্জিত! এই ‘পাণ্ডববর্জিত’ শব্দটির ভিতরে মস্ত বড় এক হাহাকার ঘাপটি মেরে আছে। থাকবেই তো! মহাভারতের বনপর্বেই তো যুধিষ্ঠিরকে শাস্ত্রবিশারদ শৌনক বলেছিলেন, শারীরিক বা মানসিক কষ্ট হতে পারে চারটি কারণে— রোগ, শ্রম, অপ্রিয় বিষয়ের প্রাপ্তি এবং প্রিয় বিষয়ের বিরহ। এ রকম কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যে স্থানে, তা বর্জন করাই বিধেয়। জানা নেই সেই কারণেই এই ভূখণ্ডকে পাণ্ডবরা বর্জন করেছিলেন কি না। তবে ‘পাণ্ডববর্জিত’ অভিধায় ভূমিপুত্রদের কেউ কেউ অভিমানী হতেই পারেন। তবে পাণ্ডবরা আসুন বা না-ই আসুন, বঙ্গের এই প্রান্তে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের আবির্ভূত হওয়ার কাহিনি রয়েছে। তিনি যে শুধু এসেছিলেন তা-ই নয়, এই সব বনজঙ্গল, নদী-পুকুর, ঢেঁকিশাক-শোলাকচুর বঙ্গ ছেড়ে নড়তেই চাইছিলেন না! শেষে ঘরের মেয়েটা নানা ছলেবলে ছদ্মবেশ ধরে স্বামী মহাদেবকে খুঁজে বার করে কৈলাসে নিয়ে চলে গেলেন। এমন আখ্যান যাঁদের ভান্ডারে, পাণ্ডবদের অনাগমনে তাঁদের মনে খেদ থাকতে পারে, দুঃখ নেই। রোদ-বৃষ্টি, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, পাকা ধান, কুয়াশা এবং কোকিলের ডাকে তাঁদের সারা বছরই নিজস্ব উৎসব। সেই সব উৎসবে জড়িয়ে থাকেন শিব-পার্বতী থেকে রাজর্ষি বিশ্বামিত্র, রামচন্দ্র থেকে প্রতি বছর বন্যা নিয়ে আসা ভূগোলের এক নদীও। তাঁদের বছর ফুরোয় সাদা ভাতে জল ঢেলে পান্তা করে। তাঁদের বছর শুরু হয় সেই পান্তা খেয়ে। চৈত্রের পান্তা খাওয়া হয় বৈশাখে, পুরনোর হাত ধরে নতুনে প্রবেশ— এই প্রথা উত্তরবঙ্গের বহু দিনের।

ধরা যাক, চৈত্রের কোনও এক সকালে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে দেখা হয়ে গেল হাতে দোতারা নিয়ে বসে থাকা গণেশ সরকারের সঙ্গে। শোনা গেল, তাঁকে লোকে ‘খেপা গণেশ’ বলে ডাকে। বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান, নাতনি, জমি, বলদ, পোষা ছাগল সবই রয়েছে, তবু রোদ নেই, মেঘ নেই। তিনি দোতারা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ান। ট্রেনে ঘোরেন, বাসে ঘোরেন। যাত্রাপালায় যান, রাজবংশীদের পালাটিয়া গান শুনতে যান, বিয়ের আসরে যান, গোটা আকাশ নিয়ে যখন সন্ধেতারা একা ফুটে থাকে, তখন কখনও কখনও গ্রামের শ্মশানের পাশে উঁচু জমিটায় বসে দোতারা বাজান।

ধরা যাক, তিনি অপেক্ষা করে আছেন কলকাতা থেকে আসা পদাতিক এক্সপ্রেসের। ট্রেন চলে যাবে আলিপুরদুয়ারে। আজ ট্রেন অনেক লেট। আজ চৈত্রের রোদে কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। গণেশ সরকার স্টেশনে ছায়া খুঁজে বসে দোতারা বাজাচ্ছেন। সেই সুর শিমুল তুলোর মতো ধীরে ধীরে ভেসে চলে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মের এ দিকে-ও দিকে। গণেশ সরকার যাবেন আলিপুরদুয়ারে পরান ভুঁইমালির বাড়িতে। তার পর সেখান থেকে দল বেঁধে যাবেন ‘বিশুয়া’ উৎসবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন এই উৎসব হয়। সে দিনই বর্ষবরণ। পূর্ব বাংলার মানুষদের মধ্যে সংক্রান্তির দিন নিরামিষ খাওয়ার প্রথা আছে। ‘বিশুয়া’ উৎসবে সংক্রান্তিতে মাংস খাওয়া হয়। শিকার করে নিয়ে আসা মাংস।

‘বিশুয়া’ উৎসবের পুরো নাম ‘মহাবিশুয়া’। অনেকের মতে, উৎসবের আসল নাম ‘মহাবিষুব’, সেটিই কালক্রমে লোকমুখে বিশুয়া। এর রীতি একেবারেই নিজস্ব। চৈত্র সংক্রান্তির দিন বাড়ির দেওয়াল, উঠোন মুছে তাতে আঁকা হয় খড়িমাটির আলপনা। সে দিন কেউ মাঠে চাষের কাজে যান না। ঘর থেকে লাঙল, কোদাল বার করে স্নান করাতে নিয়ে যান নদীতে। গরু-মহিষের সঙ্গে লাঙল-কোদালেরও স্নান হয় সংক্রান্তিতে। দুই-ই যে চাষের অন্যতম সরঞ্জাম! স্নান সেরে বাড়ি ফিরিয়ে এনে লাঙল-কোদালের গায়ে সিঁদুর লেপা হয়। সেগুলির পরিচর্যা করা হয়। সারা বছর এই লাঙল, এই কোদালই পতিত জমিকে আবাদি করবে, সোনা ফলাবে। বিশুয়া উৎসব আসলে সেই সব সজীব, নির্জীব বস্তুদের সম্মান দেওয়া, যেগুলি সারা বছর ধরে মানুষকে ভাল রাখবে, তার মুখে ক্ষুধার অন্ন তুলে দেবে।

ধরা যাক, জলপাইগুড়ি স্টেশনে এখনও ট্রেন এসে পৌঁছয়নি। ধরা যাক, আলিপুরদুয়ারে চড়া রোদ মাথায় করে পরান ভুঁইমালি অপেক্ষা করে আছেন গণেশ সরকারের জন্য। আদুল গায়ে বসে থাকা পরানের সামনে রয়েছে বারোটি কচুপাতা। তিনি এক-এক করে কচুপাতাগুলিকে নিচ্ছেন এবং ঘটের মতো আকার দিয়ে আলতো করে মুখ বেঁধে দিচ্ছেন পোয়াল, অর্থাৎ খড় বা বিচালি দিয়ে। সারা রাত সেগুলিকে রাখা হবে উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে। এক-একটি কচু পাতা এক-একটি মাসের জন্য। একটি পাতার নাম রাখা হবে বৈশাখ, একটির জ্যৈষ্ঠ, এ ভাবে কার্তিক, অগ্রহায়ণ হয়ে চৈত্র। সংক্রান্তির সারা রাত ধরে কচুপাতায় শিশির পড়বে। সকালে প্রতিটির মুখ খুলে দেখা যাবে কচুপাতার ভিতরে শিশিরবিন্দু টলটল করছে। যে-যে মাসের নাম রাখা পাতায় শিশিরবিন্দু দেখা যাবে, সেই মাসগুলিতে বৃষ্টি পড়বে ধরে নেওয়া হবে। মনে করা যাক, ফাল্গুন বা কার্তিক নাম রাখা কচুপাতায় শিশিরবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে, তা হলে ধরা যাবে ওই দুই মাসে বৃষ্টি হবে। সেই ভাবে চাষবাসে সাবধানী হবেন সকলে। এখন ‘চালাক মোবাইল’ই কবে বৃষ্টি হবে আর কবে মেঘ এসে শুধু আয়োজন করে ফিরে যাবে, সে সব জানিয়ে দেয়। তবু ‘বিশুয়া’ উৎসবের এই বৃষ্টিগণনার প্রথা আজও চলছে।

ধরা যাক, এখনও ট্রেন আসেনি। প্ল্যাটফর্মে ছড়াচ্ছে গণেশ সরকারের দোতারার সুর, ‘তোমরা গেলে কি আসিবেন ও মোর মাহুত বন্ধু রে...’ তাঁকে ঘিরে জড়ো হচ্ছে ভিড়। কেউ মোবাইল বার করে ভিডিয়ো তুলছেন। কেউ ছবির ফ্রেমে দোতারা-বাদকের সঙ্গে নিজেকে রেখে ছবি তুলছেন। কেউ সঙ্গে সঙ্গেই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দোতারার সুর। মাহুত বন্ধুর সুর ভাসতে ভাসতে কখন যেন কাজল ভ্রমরার সুরে এসে মুখ গুঁজছে। ‘তোমরা গেলে কি আসিবেন’ প্রশ্ন তুলে আকুল সুর মিশে যাচ্ছে ‘ও মোর কাজল ভ্রমরা, কোনদিন আসিবেন কয়া যান কয়া যান রে।’ ট্রেন এলেই দোতারা-বাদক উঠে পড়বেন। তিনি যাবেন বন্ধুর বাড়ি। তাঁর এক পাশে রাখা একটি পুঁটলি। তাতে চালভাজা, মুড়িভাজা, চিঁড়েভাজা, ডালভাজা, কচুভাজা। পেঁয়াজভাজাও নেবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু এতটা পথে মিইয়ে যাবে। বন্ধুর বাড়িতেই পেঁয়াজভাজা হবে। সঙ্গে কচি পাটপাতা এবং শেফালিপাতাও ভাজা হবে। ‘বিশুয়া’ উৎসবে এই সব ভাজা খেতেই হবে। সঙ্গে পান্তা। তবে পান্তা সংক্রান্তির দিন নয়। সংক্রান্তির দিন ভাতে জল ঢেলে রাখা হবে। সারা রাত ধরে পান্তা জমবে। বৈশাখের প্রথম সকালে সকলে গোল হয়ে বসে পান্তা খাওয়া হবে, সঙ্গে শেফালিপাতা ভাজা। দোতারা-বাদক গণেশ সরকার চলেছেন বন্ধুর বাড়ি।

এক গ্রামে যখন ‘বিশুয়া’ উৎসব, তখন উত্তরবঙ্গের অন্য কোনও গ্রামে নদীর পাড়ে পর পর ঘট সাজানো হচ্ছে। সে সব নদীর নাম পাঙ্গা, যমুনা, গদাধর, টুঙ্গি, কনকলতা, সাপটানা, রুকরুকা। চৈত্র সংক্রান্তির তিন দিন আগে থেকে সেই সব নদীকে পুজো করা হয় গঙ্গা ভেবে। যে গঙ্গার সামনে বালক রামচন্দ্রকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। খানিক আগেই বালক রামের পায়ের ছোঁয়ায় শাপমুক্ত হয়ে পাথর থেকে মানবীতে বদলে যান অহল্যা। সেই দৃশ্য দেখে গঙ্গার পাড়ে রাখা ভাঙা নৌকোর মাঝি আত্মহারা, আতঙ্কিত। তিনি কিছুতেই বালক রামকে নৌকোয় তুলবেন না। যে পায়ের ছোঁয়ায় পাথর হয়ে যায় সুন্দরী মেয়ে, সেই পায়ের স্পর্শে মাঝির ভাঙা নৌকো কী না কী হয়ে যাবে! ঋষি বিশ্বামিত্র মাঝিকে অভয় দিলেন। মাঝি বালক রামের পা ধুইয়ে নৌকোয় তুললেন। রামচন্দ্রের পায়ের ছোঁয়ায় নৌকো হয়ে গেল সোনার। রামায়ণের এই গল্পকে মাথায় রেখে উত্তরবঙ্গে কৈবর্তরা প্রচলন করেছিলেন ‘ঘাটুপুজো’। কৃষিকাজ করে, মাছ ধরে তাঁদের ডাল-ভাত-নুন-কাঁচালঙ্কা জোগাড় হয়, তাই গঙ্গাকে পুজো করা হয়। পুজো পেয়ে নদীর জল মাটিকে উর্বর করুক, ঢেউ এনে দিক সোনার মাছ। পর পর ঘট সাজিয়ে পুজো করে ঘট উপুড় করে দেওয়া হয় নদীতে। ফুল, প্রসাদী নকুল দানা, বাতাসা, বেলপাতা নদীর জলে দুলে দুলে ভাসতে থাকে। চৈত্রের হাওয়া ছোট নদীর জলের শরীরে টান দেয়, তরঙ্গ ওঠে। ফুল, বেলপাতা, নকুলদানায় মাখামাখি বিশ্বাস ভেসে ভেসে চলতে থাকে, পাথরে ধাক্কা খায়, চড়ায় আটকায়, আবার ভাসে। শান্ত সময়ে ছোট নদীগুলিকে মমতামাখা হাতছানি দিয়ে ডাকে বড় নদী। সেই টানে নিজের যা কিছু সব ভাসিয়ে বড় নদীকে দিয়ে আসে ছোট নদী। আবার বন্যার সময়ে বড় নদী প্রবল তেজে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোট নদীর উপরে, ভাসিয়ে দেয় আশপাশের গ্রাম। যেন তার একটুও মনে নেই, এই সব গ্রামেই চৈত্রের শেষের তিন দিন পুজো দেওয়া হয়েছিল তাকে। পাড়ের মানুষেরা জানে, নদীর মন নেই। নদী সুন্দর, নদী ভয়ঙ্কর। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় নদীকে তুষ্ট করার চেষ্টা। এক পুজো শেষে আর এক পুজো। ‘তিস্তাবুড়ি’র পুজো। এ পুজোয় বৃষ্টি চাওয়া হয়। বৃষ্টি না এলে বৈশাখের খর রোদে ফসল সব পুড়ে যাবে।

এ দিকে বৃষ্টি হলেও যাতে তিস্তায় বান না ডাকে, সেই প্রার্থনাও জানানো হয় বুড়ির কাছে। নদীর পাড়ে বাস, চিন্তা বারো মাস। সেই চিন্তা দূর করবে তিস্তাবুড়ি। গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে বেরোয় বাড়ি বাড়ি। গান গাইতে গাইতে চালটা, মুলোটা সংগ্রহ করে। তার পর বৈশাখের শেষে এক দিন তিস্তার পাড়ে অথবা কোনও নদীর পাড়ে বসে শুরু হয় পুজো। কোনও বাঁধাধরা মন্ত্র নেই, শুধু গান এবং নাচ। যখন গ্রামে গ্রামে চাঁদা তোলা চলে তখন সবচেয়ে বয়স্কা মহিলার হাতে দেওয়া হয় একটি ডালা। তাতে একটি শিলাখণ্ড। সেই শিলাখণ্ডকে ছায়া দিতে ফুলমালা জড়ানো একটি ছাতা ধরা থাকে। যে বয়স্কা মহিলা ছাতা ধরে থাকেন তাঁকে সাজানো হয় ‘তিস্তাবুড়ি’র সাজে। শিলাখণ্ডটি আসলে মহাদেবের প্রতীক, তা হলে তিস্তাবুড়ি? তিনি পার্বতী।

নদীদের মতোই এক গল্প আর এক গল্পে মিশে এগিয়ে চলে। দু’পাশে তৈরি হয় নানা ঘাট, আঘাটা। সেখানে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয় গল্পেরা। তার পর কিছু গল্প আবার ভেসে যায়, কিছু গল্প থেকে যায় দু’পাড়ে। গল্পের টানে মহাদেব নেমে আসেন উত্তরবঙ্গে, গিয়ে ওঠেন মেচ সম্প্রদায়ের এক বাড়িতে। মেচ পাড়া ভাল লেগে যায় মহাদেবের। মেচ রমণীদের নাচ-গান ছেড়ে তিনি আর ফিরতে চান না কৈলাসে। কোচ, মেচ, রাভা পরিবারের বাস এই খণ্ডে। বনজঙ্গল ঘেরা এই ভূমিতে সকাল হলেই গান গেয়ে সব লাঙল-কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, মাটি চাষ করে গান গেয়ে বিকেলে ফিরে আসে। তার পর বিকেলে দল বেঁধে শুরু হয় গান, কখনও দেশি, কখন হাঁড়িয়া, কখনও বা ফুলের মধু খেয়ে কোমর দুলিয়ে নাচে পুরুষেরা, আর মহিলারা খোঁপায় টগর ফুল গুঁজে, ধামসা মাদলের সুরে কোমর দোলায়। এমন আনন্দ ছেড়ে মহাদেব যাবেন কোথায়?

মহাদেব স্থির করেন, মেচ মহল্লাতেই থাকবেন। কিন্তু সেই যে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন, মহাদেবের কপালে আগুন। তিনি জানতেন, আর কেউ না আসুক এক দিন পার্বতী খোঁজ করে তাঁকে নিয়ে যেতে আসবেনই। তাই তিনি মেচপাড়ায় লুকিয়েই থাকতেন। পার্বতী ভালই জানেন শিবের স্বভাব। তাই তিনিও সাজলেন মেচ রমণী, যাতে কেউই টের না পায়। মেচ রমণীবেশী পার্বতী গান গেয়ে, নেচে ঘুরতে লাগলেন বাড়ি বাড়ি। অবশেষে এক বাড়ির উঠোনে গান গাওয়ার সময়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন মহাদেব। তার পর গল্প এগিয়েছে নদীর মতো, কিছু গল্প ভেসে গিয়েছে, কিছু গল্প রয়ে গিয়েছে। তার পর থেকে শিবকে ঘরের ভিতর থেকে বার করে আনতে উত্তরবঙ্গের নানা সম্প্রদায়ের মেয়েরা পার্বতীর মতো সেজে বৈশাখ মাসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচে, গান গায়। সারা মাসের মাধুকরী দিয়ে এক দিন বড় করে নাচ গানের আসর বসে। বৈশাখ মাস জুড়ে চলতে থাকা এই নাচ গানের নাম হয়েছে ‘মেচেনি’, মতভেদে ‘মেছেনি’। কেউ কেউ বলেন, জেলে পরিবারে এসে লুকিয়ে ছিলেন মহাদেব আর তাঁর অন্বেষণে পার্বতী পরেছিলেন জেলে রমণী তথা, মেছেনির সাজ। তাই ‘মেছেনি’। সে বিশ্বাস যা-ই হোক, ‘তিস্তাবুড়ি’ হোক, ‘মেচেনি’ হোক বা ‘মেছেনি’। বৈশাখ মাস জুড়ে শিব-পার্বতীর লুকোচুরির আখ্যান আর মনের মানুষকে ঘর থেকে টেনে বার করে আনার ব্যাকুল সুরে আহ্বান গাওয়া হতে থাকে। ব্যথা মেশানো সেই মিষ্টি সুরের খাঁজে খাঁজে বসে যায় বঙ্গের উত্তর প্রান্তের প্রার্থনা— বৃষ্টি দাও, ফসল দাও, শান্ত নদী ফিরিয়ে দাও, বুকে সুখ দাও, খোঁপায় ফুল দাও, ভাতে আরও দু’হাতা ডাল দাও...

সকলের জন্য কল্যাণকামনায় নতুন বছর আসে, পুরনো বছর যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy