নাট্যমুহূর্ত: ‘নয়ে নাটুয়া’-র ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ নাটকে ‘মহুয়া’-র কথা। নির্দেশক গৌতম হালদার। ছবি: লেখক।
ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২৩-এর মার্চ মাসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটার ছাপাখানা থেকে বেরোনো একটি বই বাংলা সাহিত্যের ভোল পাল্টে দিয়েছিল বললে অনেকেই নড়েচড়ে বসবেন। আরও যদি বলি, পুবে-পশ্চিমে ভেঙেচুরে থাকা বাংলাকে জুড়তে চেয়েছিল সেই বই, উদ্যাপন করেছিল প্রাগাধুনিক বাংলার স্বয়ংসিদ্ধাদের, তবে অনেকের কপালে ভাঁজ পড়বে। অথচ এই কাজটাই করেছিল ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’। দুই বাংলার সেতু বাঁধাই ছিল সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেনের মনোবাঞ্ছা।
এর সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল আরও দশ বছর আগে, ময়মনসিংহ শহরের বুকে।
১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে, কেদারনাথ মজুমদারের সম্পাদনায় বেরোতে শুরু করে ‘সৌরভ’। ‘সৌরভ’-এর ১৩২০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ নামে একটি রচনা ছাপা হয়। লেখক চন্দ্রকুমার দে। বয়স ২৩ বৎসর। তিনি লিখছেন গৈগেরামের এক কবিকে নিয়ে। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।
কেদারনাথ খবর নিলেন। জানা গেল, নেত্রকোণার আইথরে চন্দ্রকুমারের বাসা। লেখাপড়া গ্রামের পাঠশালায়। এক মুদির দোকানে এক টাকা বেতনের চাকরি পেয়েও খুইয়েছিলেন। এ দিকে দিন চলে না। যে কারণে রামপ্রসাদ তবিলদারির চাকরি চেয়েছিলেন, কতক সেই কারণেই দু’টাকা মাইনের তহশিলদারির চাকরি জোগাড় করলেন চন্দ্রকুমার। গ্রামীণ কৃষকরা কেউ কেউ গাইতে জানেন। সেই কবেকার সব পালা শ্রুতিবাহিত হয়ে স্মৃতিধার্য হয়ে ওঠে চন্দ্রকুমারের কাছে। এই তন্ময়তার খেই ধরেই আর পাঁচ জনকে চন্দ্রাবতীর কথা শোনানোর মন হয়েছিল চন্দ্রকুমারের। ১৩২০-২১ বঙ্গাব্দ জুড়ে ‘সৌরভ’-এর একের পর এক সংখ্যায় লেখা বেরোতে থাকে সে সব লেখা।
পল্লিগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা নিয়ে ভদ্রলোক বাঙালি যখন ভাবিত, তখন পল্লিসাহিত্যের এমন পেলব পরিচিতি অবাক করেছিল পাঠকমণ্ডলীকে। কেদারনাথ ‘সৌরভ’-এর দফতরে ডেকে পাঠালেন চন্দ্রকুমারকে। শুনলেন কত কায়ক্লেশে দিন চলে তাঁর। অতএব ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কালীপুর এস্টেটের জমিদার বিজয়কান্ত লাহিড়ীকে বলে আট টাকা মাইনের তহশিল আদায়ের চাকরির বন্দোবস্ত করলেন চন্দ্রকুমারের জন্য। তাতে কী? হিসাবের খাতা ভরাট হতে থাকল খেতে খামারে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা গায়েনদের উপাখ্যানমালায়। কর্তব্যে গাফিলতির জেরে এই চাকরিও গেল তাঁর।
এ দিকে চন্দ্রকুমারের লেখা পড়ে ‘অজানা খনির রতনখানি’র হদিস পেলেন দীনেশচন্দ্র সেন।
আঞ্চলিক ইতিহাসের নাও তখনও গাঙে ভাসেনি। ফোকলোর জাতে ওঠেনি। ওরাল ট্র্যাডিশন রিটন ট্র্যাডিশনের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে পারে, এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। তালপাতায় লেখা পুঁথির খেই ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি প্রাগৈতিহাসিক সূত্র আবিষ্কারের তোড়জোড় শুরু হয়েছে মাত্র। আবিষ্কারের নেশা পেয়ে বসেছে কাউকে কাউকে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়ার এক নাম-না-জানা গ্রাম থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর পুঁথি উদ্ধার করে আনলেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ। ক’বছরের মধ্যেই বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের উদ্যোগে সেটা ছেপে বেরোতে সাড়া পড়ে গেল। বৈষ্ণব শাস্ত্র ও রসতত্ত্ব নিয়ে যে আগ্রহ তৈরি হল তার ঢেউ আছড়ে পড়ল কলেজ স্ট্রিট মহল্লায়। নেপালের রাজদরবারের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দহরম মহরমের সৌজন্যে বাংলা গদ্যের হাজার বছরের পুরনো চেহারা পাওয়া গেল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খুঁজে আনলেন ‘চর্যাপদ’-এর পুঁথি। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের কবিতার হেঁয়ালি আমাদের টানছে, কিন্তু ‘নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী’র মানে বার করতে দম ছুটে যাচ্ছে। ও দিকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের হাত ধরে কলকে পাচ্ছিল মুসলমান কবিদের কৃতি। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি সম্প্রসারিত মুখমণ্ডল ফুটে উঠছিল।
কিন্তু এই সবই লিখিত পাঠনির্ভর। এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের সহজাত।
অথচ ১ নং পার্ক স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নাল’-এ মাঝে মাঝে এমন সব লেখা বেরোচ্ছে যে, বাংলা সাহিত্য নিয়ে গতে বাঁধা ধারণার ভিত টলে যাচ্ছে। সিভিলিয়ান তথা লিঙ্গুয়িস্ট জর্জ গ্রিয়ারসন যখন বাংলার উত্তর সীমা রংপুরে কাজ করতেন, তখন স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে জোগাড় করা রসদ নিয়ে ‘মানিক রাজার গান’ নামে একটি গীতিকা ছেপেছিলেন ‘জার্নাল’-এ, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। দেবনাগরী হরফে বেরোনো এই গীতিকা দীনেশচন্দ্রের নজর এড়ায়নি। ১৮৯৬-তে বেরোয় দীনেশচন্দ্রের প্রথম সাড়া-ফেলে-দেওয়া বই ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’। তাতে গ্রিয়ারসনের নাম করে এই হারামণিটির তত্ত্বতালাশ চলে, খানিক উদ্ধৃত হয়, খানিক আলোচিত হয়। বাংলার লিটারারি ক্যাননে ঢুকে পড়ে ‘নাথ গীতিকা’।
‘সৌরভ’-এর পাতায় চন্দ্রকুমারের লেখা পড়ে নড়েচড়ে বসলেন দীনেশচন্দ্র সেন। কেদারনাথের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এই অধ্যাপকের। পূর্ববঙ্গীয় বৈদ্যকুলোদ্ভব এই পণ্ডিত অনেক চেষ্টাচরিত্তির করেও শান্তিপুরি বাংলায় সড়গড় হতে পারেননি বলে কোনও কোনও মহলে রংতামাশার পাত্র হতেন।
দীনেশচন্দ্রের মনে হল চন্দ্রকুমারের নাগালে আরও অনেক হারামণি আছে, যার হিমশৈলের চুড়ো দেখেই অবাক মানছেন তিনি। অথচ উঠতে বসতে তাঁকে গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে— “ছোটলোকেরা, বিশেষতঃ মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুঁথি ঘাঁটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।” অথচ এই শ্রেণি উইলিয়াম ল্যাংল্যান্ডের ‘পিয়ার্স প্লাউম্যান’ পড়েছেন, জেফ্রি চসারের ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’-এর দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিফ। বটতলার লেখাপত্তর যতই নাক-সিঁটকোনো হোক না কেন, রিচার্ড বার্টনের ইংরেজি তরজমায় আরব্য রজনীর কথা ও কাহিনি থেকে মুখ ফেরাননি।
কাজেই দীনেশচন্দ্র ছাড়লেন না। কলকাতায় ডেকে পাঠালেন চন্দ্রকুমারকে। অসুস্থ চন্দ্রকুমারের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করলেন। পরামর্শ দিলেন পালাগান সংগ্রহে মনোযোগী হতে। ক্ষেত্রসমীক্ষা তখনও ভাষা ও সাহিত্যের দেওয়ান-ই-খাসে আমল পায় না। অথচ চন্দ্রকুমার যা করে চলেছেন তা যে ক্ষেত্রসমীক্ষার হদ্দমুদ্দ, বুঝেছিলেন দূরদর্শী দীনেশচন্দ্র। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কলেজ স্ট্রিটের ডোরিক থামওয়ালা বাড়ির তেতলায় দিনকে-দিন কোণঠাসা হয়ে পড়া দীনেশচন্দ্রের পরম সহায়। সোজাসুজি আশুতোষের কাছে দরবার করলেন তিনি। কী আর্জি? ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে চন্দ্রকুমারকে। আর্জি মঞ্জুর হল। মাইনে মাসে ৭০ টাকা। এটি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
এর পরের তিন-চার বছর ধরে যে সব পালা ‘সংগ্রহ’ করে— মানে, কানে শুনে শুনে, হাত লিখে লিখে, বার বার যাচাই করে জোগাড় করে আনলেন চন্দ্রকুমার, তার মধ্যে ছিল দ্বিজ কানাইয়ের ‘মহুয়া’, তখনও অবধি নাম না-জানা কবির ‘মলুয়া’, নয়ানচাঁদ ঘোষের ‘চন্দ্রাবতী’, দ্বিজ ঈশানের ‘কমলা’, চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ ও ‘কেনারাম’, মনসুর বয়াতির ‘দেওয়ান মদিনা’ ও আরও অনেক পালা। তা ছাড়াও অনেক কবিগান, যাত্রাগান। পূর্ব ময়মনসিংহ থেকে সংগৃহীত এই সব পালার গায়ে ‘গীতিকা’ বা ‘ব্যালাড’-এর তকমা জুড়ে দীনেশচন্দ্রের মনে হয়েছিল, “মৈমনসিংহ-গীতিকায় আমরা বাঙ্গালা ভাষার স্বরূপটি পাইতেছি। বহুশতাব্দীকাল পাশাপাশি বাস করার ফলে হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা।”
‘সমস্ত বঙ্গভাষীর ভাষা’ বলায় অতিশয়োক্তি আছে। কারণ ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র আধার বৃহৎ ময়মনসিংহ। এর উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থান নেত্রকোণার। নেত্রকোণা এখন জেলা, ব্রিটিশ আমলে ছিল মহকুমা। এই নেত্রকোণায় বাড়ি চন্দ্রকুমারের। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র যাঁরা গীতিকবি তাঁদের প্রায় সকলেই এই নেত্রকোণা-জাতক। এই সে দিন, হাজং কৃষিবিদ্রোহের উত্তপ্ত সে দিন, রব উঠেছিল— “ধান দিব না ধান দিব না / কবির ভূমি নেতেরকনা।” কিন্তু গল্পগুলোর শেকড়বাকড় চারিয়ে আছে গোটা ময়মনসিংহের মাটিতে। সেই ময়মনসিংহ, যার উত্তরে গারো পাহাড়। পুবে ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র পেরোলে রাঙামাটি, ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা। দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ। কিশোরগঞ্জ ছাড়িয়ে মেঘনা অববাহিকা। পশ্চিমে সিলেট, সুনামগঞ্জ।
আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা থেকে ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ করল ‘Eastern Bengal Ballads – Mymensing (vol. 1, part-1)’, যা আদতে ইংরেজি জবানে দশটি ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র তরজমা। খোদ দীনেশচন্দ্র এই অনুবাদ করেছিলেন। বই হয়ে বেরোনোর সময় জুড়ে দিয়েছিলেন দীর্ঘ একটি ভূমিকা। মার্চে এই বই বেরোতেই সাড়া পড়ে যায়। ওই বছর পুজোর পরই নভেম্বর মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোয় ‘শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন, রায় বাহাদুর, বি এ, ডি লিট কর্ত্তৃক সঙ্কলিত’ ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ (পূর্ব্ববঙ্গগীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)।
কোন কোন পালা ছিল এই সম্পুটে? ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘কমলা’, ‘দেওয়ান ভাবনা’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘রূপবতী’, ‘কঙ্ক ও লীলা’, ‘কাজলরেখা’, ‘দেওয়ান মদিনা’। ১৯২৩-এর নভেম্বরের পর খুব দ্রুত আরও তিনটি খণ্ড বেরিয়েছিল ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’-র। শুধু চন্দ্রকুমার দে নন, পরবর্তী কালে এই প্রকল্পের ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসেবে জুড়ে গিয়েছিলেন আশুতোষ চৌধুরী, জসীমউদ্দীন, নগেন্দ্রনাথ দে, বিহারীলাল রায়, মনসুরউদ্দীন, মনোরঞ্জন চৌধুরী, শিবরতন মিত্র। তাঁদের সবার খুঁজেপেতে আনা পালার সংখ্যা সাকুল্যে দাঁড়িয়েছিল ৫৪। এর মধ্যে চন্দ্রকুমারের অবদান ছিল আট আনা!
ছাপার অক্ষরকে হাতিয়ার করে হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি যখন বাংলা সাহিত্যের আলাদা আলাদা খোপ তৈরি করতে ব্যগ্র, তখন এই ঘেরাটোপকে উড়িয়ে দিয়ে দীনেশচন্দ্র লিখেছিলেন, “এই গীতিসাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়ের, এখানে পণ্ডিতগণের রক্তচক্ষে শাসাইবার কিছু নাই।” আড়েঠারে নয়, ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’-র ভূমিকায় কার্যত নস্যাৎ করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটার প্রথম গ্র্যাজুয়েট তথা নব্য জাতীয়তাবাদের পোস্টারবয় বঙ্কিমচন্দ্রকে। যে বঙ্কিমচন্দ্র এক দিন তাঁর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের বাড়িতে পূর্ববঙ্গ থেকে উজিয়ে আসা দীনেশচন্দ্রকে সীমাহীন উপেক্ষা উপহার দিয়েছিলেন, যে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধে ‘যাত্রাওয়ালা’ আর ‘নীচ ব্যবসায়ীদিগের’ মধ্যে ফারাক রাখেননি, সেই বঙ্কিমচন্দ্র যে ‘ইংরাজী উপাখ্যানের পূর্ব্বরাগ বাঙ্গালা সাহিত্যে আমদানী করিতেই হইবে’ বলে ‘হিন্দুর ঘরে স্বাধীন প্রেম-চর্চ্চার সুযোগের অভাব অনুভব করিয়া’ মুসলমানী আয়েষার হাত ধরেছিলেন এ কথাও সোজাসাপ্টা লিখে দিয়েছিলেন দীনেশচন্দ্র। এর পাল্টা জবাব হিসেবে কোনও কোনও মুসলমান লেখক যে ‘হিন্দু রমণীকে মুসলমান নায়কের অনুরাগিণী করিয়া দেখাইতেছেন’, সেই আড়াআড়ির কথা তুলে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-য় হিন্দু-মুসলমানের অনাবিল অকুণ্ঠ অনর্গল প্রেমের দিকে আমাদের নজর ঘুরিয়েছিলেন।
একশো বছর আগেকার বাঙালি পাঠকবর্গ কী ভাবে নিয়েছিলেন ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’-কে? এক কথায় বলতে গেলে— মহাসমারোহে। শুধুই কাগুজে পরিসরে নয়, এর প্রভাব ছড়াল সমগ্র সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। পাঠক বুঝলেন যে, কয়েকশো বছর আগে সুলতানশাহির জমানায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জুড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজশাস্ত্রীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যে খোলা হাওয়া বইত, ইসলামের প্রসারের পাশাপাশি যা সমন্বয়ী সংস্কৃতির বীজ বুনেছিল, যেখানে ঋতুমতী হয়েই ভেলুয়া মহুয়া কমলা সোনাইয়ের মতো গাঁয়ের মেয়ে মনের মতো পুরুষসঙ্গী বেছে নেওয়ার উদার আকাশ পেয়েছিল, সেই দেশটাও আসলে বাংলা।
দীনেশচন্দ্রের উদ্দেশে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, “বাংলার প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু মৈমনসিংহ-গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বতঃ উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্মবিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি। এই আবিষ্কৃতির জন্য আপনি ধন্য।”
ইতিপূর্বে বেরোনো ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ইত্যাদি ফোকলোরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দরদের কথা মাথায় রেখেও বলতে হয় যে, দীনেশচন্দ্রের জন্য এমন উৎসাহ বড় দরকারি ছিল।
তা বলে দীনেশচন্দ্রের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হল এমন নয়। ১৯২৪-এ চলে গেলেন আশুতোষ। স্থলাভিষিক্ত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। এই আমলে দীনেশচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন জসীমউদ্দীন। সহমর্মীও বটে। অনেক পরে, ১৯৭৬-এ বেরোনো স্মৃতিকথায় জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন, “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বৎসরগুলিতে দীনেশবাবুর জীবন বড়ই অসহায় ছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দল তাঁহাকে বড়ই কোণঠাসা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। শনিবারের চিঠি ‘শ্রীদীনেশ’ নাম দিয়া ধারাবাহিকভাবে তাঁকে গালাগালি দিতেছিল।” পাশে দাঁড়াতে পারতেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু “স্যার আশুতোষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করিতেছেন। পিতার অনুরক্ত এই মহামনীষীকে তিনি অগণ্য শত্রুসেনার ব্যূহ হইতে রক্ষা করিতে সাহস করিলেন না। আজীবনের সাহিত্যসাধনার পীঠভূমি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে দীনেশবাবুকে বিদায় গ্রহণ করিতে হইল। কেহ তাঁহাকে কোন ফুলের মালা দিল না। কোন বিদায় অভিনন্দনের ব্যবস্থা হইল না। অকৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি এইভাবে সেই বাংলা সাহিত্যের অক্লান্তসেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইল।”
১৯৩৯ অবধি বেঁচেছিলেন দীনেশচন্দ্র। আরও গভীরতর জ্ঞানসাধনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সে আলোচনা অন্যত্র হবে। আমরা ফিরে আসি ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’-য়।
আগেই বলেছি, বাংলার আগে ইংরেজিতে বেরিয়েছিল এই মহাগ্রন্থ। সাহেব-মেমদের খাতির কিছু কম জোটেনি সম্পাদকের বরাতে। ‘মহুয়া’ নিয়ে মুগ্ধতা জাহির করেছিলেন অনেক কৃতবিদ্য মানুষ। সিলভ্যাঁ লেভির মনে হয়েছিল, “আমাদের শীতার্ত প্রকৃতির ক্রোড়ে বসে মহুয়া পাঠ করে মনে হলো, ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ায় শীত ও বসন্ত ঋতুর দৃশ্য উপভোগ করছি।” স্টেলা ক্র্যামরিশ সে আমলের নামী শিল্পরসিক, নন্দনতাত্ত্বিক। তিনি বলেছিলেন, “সারাদিন জ্বরের ঘোরে আমি মহুয়া, নদের চাঁদ ও হোমরাকে যেন স্বপ্নের মত দেখেছি। আমি ভারতীয় সাহিত্য যত পড়েছি, তার মধ্যে এমন মর্মস্পর্শী, এমন সহজ সুন্দর কোনও আখ্যান পড়িনি।”
‘মহুয়া’ যে “এই গাথাসাহিত্যে অতীব অভিনব সামগ্রী— ইহা ঘরেরও নহে, বাহিরেরও নহে”— বইয়ের ভূমিকায় এ কথা হলফ করে বলেছিলেন দীনেশচন্দ্র। “এই গীতিকায় জাতিবিচার, কুলশীল, পরমর্য্যাদা সমস্তই প্রেমরত্নাকরের অতল জলে ডুবিয়া গিয়াছে,” মন্তব্য করেছিলেন। কেন ‘ঘরেরও নহে, বাহিরেরও নহে’ বললেন তিনি? গারো পাহাড়ের অরণ্যদুহিতা মহুয়ার মধ্যে একাধারে কালিদাসের শকুন্তলা ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসির আদল পেলেন বলে? না কি এত উত্থানপতনমুখর আখ্যান আর দু’টি পাননি বলে?
শকুন্তলাকে যেমন জন্মলগ্নে ছেড়ে গিয়েছিলেন অপ্সরা মেনকা, কতক সে ভাবেই ছ’মাসের দুধের বাছনি মহুয়াকে চুরি করে পাহাড়ে নিয়ে গেছিল হুমরা বেদে। শকুন্তলার সই অনসূয়া-প্রিয়ংবদার মতো মহুয়ার প্রাণসখা ছিল পালঙ। নদের চাঁদ ওরফে নদের ঠাকুরের সঙ্গে মহুয়ার প্রণয়ের মধ্যে সমাপতনের যে ঘনঘটা তাতে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার খরস্রোতা সম্বন্ধের আলগা আভাস কেউ পেতেই পারেন। আমাদের মন কাড়ে এর সহজিয়া চলন। পয়ারের ছাঁদে গড়া কাব্যভাষায় নদের চাঁদ অকপটে প্রেম নিবেদন করতে পারে— “কঠিন আমার মাতাপিতা কঠিন আমার হিয়া/ তোমার মত নারী পাইলে করি আমি বিয়া।” কপট কোপের তূণ ধরে মহুয়া বলতে পারে— “লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর/ গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুইব্যা মর।” নদের চাঁদ জবাব দেয়— “কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ী/ তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি।” সহজ সরল আবিলতা। আবার যৌনতা নিয়েও অযথা রাখঢাক নেই।
তবু এই নিষিদ্ধ প্রণয়, এই অসবর্ণ প্রেমের মধ্যে নানা দেশের নানা ভাষার বিয়োগান্ত আখ্যানের গড়ন মিলে যায়। আখ্যান যত এগোয় তত গাঢ় হয় অচরিতার্থতার বয়ান— “তোমায় যদি না পাই কন্যা আরনা যাইবাম বাড়ী/ এই হাতে মার লো কন্যা আমার গলায় ছুরি।”
তা বলে ‘মহুয়া’ পালার নিবিড় পাঠে ব্রাহ্মণ্য শ্রেষ্ঠত্ব ও শূদ্রসেবাধর্মের অন্তর্বাহিনী স্রোত মিলবে না, এমন নয়। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে জাঁকিয়ে বসা কোমলস্বভাব নায়ক আর দাপুটে নায়িকার বিরোধাভাসও মিলবে। অথচ আদতে বামুনের মেয়ে মহুয়ার ওপর মনুবাদী নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই। সে একাধারে স্বাধিকারপ্রমত্তা ও স্বয়ংসিদ্ধা। এ সবের বলে রাতারাতি শিক্ষিত বাঙালির নয়নের মণি হয়ে উঠল ‘মহুয়া’। ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ বেরোনোর পর পরই কলকাতার ৪০ নং গ্রে স্ট্রিটে (আজকের অরবিন্দ সরণি) গড়ে ওঠে কল্পতরু সাহিত্য পরিষদ ও সাধারণ পাঠাগার। ‘সুশিক্ষিত ও উচ্চবংশজাত যুবকবৃন্দের মধ্যে সাহিত্য চর্চ্চার বিস্তার ও সৌহার্দ্দ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে’ তৈরি এই সংস্থার সভাপতি ছিলেন মহামহোপাধ্যায় কবিরাজ শ্রীযুক্ত গণনাথ সেন সরস্বতী, সহ-সভাপতি দীনেশচন্দ্র। এঁদের দাক্ষিণ্যে বেরোয় ‘মহুয়া’র প্রথম নাট্যরূপ, সুশীলকুমার সেনের হাতযশে। এই নাটকটি কবে কোথায় বা আদপে মঞ্চস্থ হয়েছিল কি না, আমাদের জানা নেই। কিন্তু তথাকথিত কুলীনকুলে লোকায়ত প্রতিমার এমন সমাদর আমাদের সচকিত করে বইকি!
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। মন্মথ রায়, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে ব্রজেন্দ্রকুমার দে— একের পর এক নাট্যরূপ হয়েছে ‘মহুয়া’র, সেই ১৯২৯ থেকে। বহু গীতিনাট্য হয়েছে। আজও হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে নয়, অসমে, ত্রিপুরায়। ছ’বছর আগে গৌতম হালদারের নির্দেশনায় ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র নামে যে জনপ্রিয় প্রযোজনা করেছে ‘নয়ে নাটুয়া’, তারও আকর সেই ‘মহুয়া’। শুধু থিয়েটারে নয়, ‘মহুয়া’ এসেছে সিনেমাতেও, মন্মথ রায়ের হাত ধরে, ১৯৩৪ সালে। ব্রজেন্দ্রকুমারের লেখা থেকে যাত্রা হয়েছে অসংখ্য। একদা মহুয়া সেজেছেন জ্যোৎস্না দত্ত। আশির দশক অবধি ‘মহুয়া’ পালায় নায়িকা সেজেছেন ‘টিনের তলোয়ার’-এর ময়না ওরফে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
শুধু ‘মহুয়া’ নয়, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র হেন আখ্যান নেই যা নিয়ে যাত্রা হয়নি। এমনকি ১৯৬০-৭০’এর দশকে হইহই করে চলা যাত্রা ‘সোনাইদীঘি’-র আড়ালে আছে ‘দেওয়ান ভাবনা’। একই সূত্র ধরে আড়াই দশক ধরে ‘সোনাই মাধব’ নাটক করছে ঢাকার লোক নাট্যদল। ১৯৮০-র দশকে কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ভাটার মরসুমে মোহাম্মদ সাইদুরের জোগাড় করা উপকরণ থেকেই ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ বেঁধেছিলেন বিভাস চক্রবর্তী। ভাসিয়ে দিয়েছিলেন দুই বাংলার অনাবাদী প্লাবনভূমি। আড়ালে রয়ে গিয়েছিল ১৯৭১-এ ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে বেরোনো বদিউজ্জামান সম্পাদিত ‘মোমেনশাহী গীতিকা’। যেমন আড়ালে চলে গেছে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিকের অবিশ্বাস্য ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্যে ফার্মা কে এল এম থেকে সাত খণ্ডে বেরোনো ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’।
এদের কেউ ১৯২৩-এর আদি প্রকাশনাটির কাছে ঋণ অস্বীকার করেননি।
আজকাল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মিইয়ে-যাওয়া দ্বৈরথে আটকে পড়ে ঘটি-বাঙালের রেষারেষির দফারফা হওয়ার জোগাড়! অথচ এই ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্বসমাসের আবর্ত কী ভাবে ঘিরেছিল ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’-কে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হবে। ১৯৬০-এর দশক অবধি এই আবর্ত সক্রিয় ছিল। এক দিকে ছিলেন আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতো খাস ময়মনসিংহ-জাতক, যাঁর আদরে ফোকলোর বিচার-বিশ্লেষণের সারস্বত কাঠামো মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছিল। তাঁরই হাত থেকে বেরিয়েছিল ‘ইহার জীবন বাস্তব, জগৎ সত্য ও ভাষা জীবন্ত’র মতো শংসাপত্র, আর অপাঙ্ক্তেয় হতে হয়নি ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’-কে। অন্য দিকে ছিলেন সুকুমার সেনের মতো সাহিত্যের ইতিহাসকার, যিনি ‘মুদ্রিত গাথাগুলিকে লোকসাহিত্যের ভেজালহীন নিদর্শন বলিয়া নেওয়া চলে না’ বলে প্রামাণিকতার কূট প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। সংগৃহীত গাথার ভাষায় ও ছন্দে কলম চালানোর দায়ে চাঁদমারি বানিয়েছিলেন চন্দ্রকুমার দে-কে।
এ কথা সত্যি যে চন্দ্রকুমার ঠিক যেমনটি শুনেছিলেন তেমনটি লেখেননি। শহুরে রুচির খাপসই হতে অল্পবিস্তর কলম চালিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় স্বীকারও করেছিলেন যে ‘বাদিয়ানীর পালা’র ‘মহুয়া’ নামকরণ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ‘উনরা বাইদ্যা’কে তিনিই ‘হুমরা বেদে’ করেছেন। ‘আলাল-দুলাল’-এর পালার নাম ‘দেওয়ান মদিনা’ দিয়েছিলেন তিনিই। পূর্ববঙ্গের কাদামাটিতে গড়ে ওঠা কিচ্ছা-পালা-গীতরঙ্গের গায়ে ‘গীতিকা’ বা ব্যালাডের একমেটে সাজ পরানোর মধ্যে বিচক্ষণতার পরিচয় ছিল, এমন কৃতিত্ব আর দেওয়া যাবে না দীনেশচন্দ্রকে। শাহমান মৈশানের মতো কেউ একে ‘ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদী খপ্পরে’ পড়ার শামিল বললে পাল্টা যুক্তি মিলবে না।
এর বাইরে অন্যবিধ খোদকারির অভিযোগ যে নেহাতই ছেঁদো কথা ছিল তা ১৯৬০-এর দশকেই ফাঁস হয়ে গেছে। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে দুশান জভাতিয়েল যে বিশদ বিবরণ লিখেছিলেন, তাতে সুকুমারদের ওজর-আপত্তি ফুৎকারে মিলিয়ে গেছে। বছর পাঁচেক আগে শামসুজ্জামান খানের সম্পাদনায় ‘মহুয়া’-র তিনটি আলাদা পাঠ দু’মলাটের মধ্যে এসেছে ঢাকার বাংলা একাডেমির সৌজন্যে। এতেও খাটো হয়নি চন্দ্রকুমার-দীনেশচন্দ্রের প্রয়াস।
একটু তলিয়ে দেখলে আমাদের পপুলার কালচারের নানা পরিসরে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র অবিশ্বাস্য প্রভাব পড়েছে। আর গত একশো বছরে কত বঙ্গতনয়ার নামকরণ হয়েছে ‘মহুয়া’র নামে, তা কি গুনে শেষ করা যাবে? এ নামের আড়ালে একটি রবীন্দ্রকাব্যগ্রন্থ থাকতে পারে, থাকতে পারে সাঁওতাল পরগনার কুহক টান। তার চেয়ে ঢের বেশি আছে দ্বিজ কানাইয়ের নামে কথিত ওই অপূর্ব আখ্যান, যা আমাদের ‘কালেকটিভ আনকনশাস’-এ ঘা দিয়েছিল। শরণার্থীর জ্বালাযন্ত্রণার উপশম করেছিল। এ মহুয়া একান্তই বৃহত্তর ময়মনসিংহের স্বপ্নসুরভিজাতক।
‘অ্যানাস মিরাবিলিস’ বলে ল্যাটিন ভাষায় একটি কথা আছে। বাংলায় এর মর্মার্থ হতে পারে অত্যাশ্চর্য বর্ষ। ইংরেজি সাহিত্যের বেলায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ ছিল তাই। একই বছরে এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ বেরোচ্ছে, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ বেরোচ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের নাও কোন খাতে বইবে তা ছকে দিচ্ছে এই দুই কীর্তিস্তম্ভ। স্রেফ ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র জোরে বাংলা সাহিত্যের অ্যানাস মিরাবিলিস-এর দাবিদার হতে পারে ১৯২৩।
সমকাল তাকে প্রসিদ্ধি দিয়েছিল বটে, কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত ছিল সারস্বত স্বীকৃতি দিতে। অথচ এই একটি বই কেবল জনসমাদরের খাতিরে নয়, যে ভাবে বাংলা সাহিত্যের রূপরেখাকে বদলে দিয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ছোট নদীকে বড় গাঙে চলার হিম্মত জুগিয়েছে, গ্রেট ট্র্যাডিশন আর লিটল ট্র্যাডিশন-এর বাঁধ ভেঙে জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুককে একুশ শতকের প্রার্থিনী করে তুলেছে, তার অতুল বৈভবকে নাকচ করে কোন আহাম্মক? শ্রুতি ও স্মৃতিবাহিত এই প্রাগাধুনিক সাহিত্য কোনও একক মালিকানার তোয়াক্কা করে না বলে কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিদ্রোহ নির্মাণপ্রবণতার ছাঁকনিতে আটকে যাবে?
আমাদের মনে থাকবে না দীনেশচন্দ্র সেনের কথা? বছর ছয়েক আগে ঢাকায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দীনেশচন্দ্রের জন্মের সার্ধশতবর্ষকে মনে রেখে আয়োজিত একটি স্মারক বক্তৃতা শেষ করতে গিয়ে সলিমুল্লাহ খান বলছিলেন, “দীনেশচন্দ্র সেনকে বাদ রাখিয়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হইবে কি করিয়া! এ কালের বাংলা সংস্কৃতির জনক জ্ঞান করিয়াই মাত্র আমরা তাঁহার কীর্তির যথোপযুক্ত মূল্য নিরূপণ করিতে পারি। আমেন।”
দীনেশচন্দ্র আক্ষরিক ভাবেই আমাদের মাথায় থাকুন। আর পূর্ব-পশ্চিমের রাজনৈতিক বিভাজনরেখাকে একেবারে আবছা করে দিয়ে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র স্বীকৃতির পালে হাওয়া দিক অখণ্ড বাংলার সাংস্কৃতিক অস্মিতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy