আমি জানি সারাবছর তোর সল্টলেকে আসার সময় হয় না। বইমেলার সময় তো না এসে পারবি না। মেলায় আসার আগে একটু আমাদের বাড়ি ঘুরে যাস। একটা অনুরোধ আছে।”
কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ঢোকার আগে জেঠুস্থানীয় মানুষটির বাড়ি ঢুঁ মেরেছিলাম। একটা গলির শেষ প্রান্তে তিন তলা বাড়ি। সল্টলেকের অধিকাংশ বাড়িগুলোর মতোই শৌখিন, এবং ভীষণ একা। ভদ্রলোকের স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে বছর দশেক আগে। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পরে থাকেন নিউ জার্সিতে। ‘থাকেন’ শব্দটির গায়ে গয়না পরিয়ে বলা যায়, ‘সেটলড্’। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটি আমাকে দেখে জোছনার মতো হাসলেন। চব্বিশ ঘণ্টার পরিচারিকাকে টাকা ধরিয়ে বললেন, “মিষ্টি নিয়ে আয়।” আর আমার জন্য ডায়েরিটা খুলে তিনটে পাতা ছিঁড়লেন। দেখি, তার মধ্যে লেখা আছে ৬২টি বইয়ের নাম। আমায় পাঁচশো টাকার কুড়িটা নোট দিয়ে বললেন, “বাবা, যদি কিছু মনে না করো, এই ক’টা আমার জন্য একটু মেলা থেকে জোগাড় করে এনে দেবে প্লিজ়?”
প্যানোরামা মোডে ফোটো তোলার সময় আমরা মোবাইল ফোনটা যেমন করে ঘোরাই, ঠিক তেমন ভাবে আমি একতলার অভ্যন্তর দেখে ফেলেছিলাম তত ক্ষণে। জানতাম, জেঠুর পড়ার শখ আছে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এ যে বইয়ের বন্যা! যে দিকে চোখ গিয়েছে, সে দিকেই বইয়ের আলমারি। তাকে বই রাখার জায়গা বাড়ন্ত তাই আলমারির মাথায়, তলায় স্তূপাকারে জমেছে বই। জানি, সিংহভাগই আসে অনলাইনে। ঠিক করলাম, বইমেলার সে দিনটা পড়তে-ভালবাসা বয়স্ক মানুষটির জন্যেই থাক। খুঁজে খুঁজে সব ক’টি বই জোগাড় করে পৌঁছে দিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে। আর স্টল থেকে স্টল ঘুরে বই বিল করার সময় যে প্রশ্নটা আলপিনের মতো আঘাত করছিল মাথায়, সেটা বই পৌঁছে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ভদ্রলোককে না করে পারলাম না। কিছুটা মুখ ফস্কেই বলে দিয়েছিলাম, “এই যে হাজার হাজার বই... এর পর?”
বছর বিরাশির মানুষটি এই প্রশ্নে সামান্য থমকালেন। হোঁচট খেলেন। তার পর বললেন, “জানি না। বাড়ি গাড়ি খাট টিভি, সব বিক্রি হয়ে যাবে জানি। কিন্তু বইগুলো কি কেউ ফেলে দেবে? এ তো আমার বড় আদরের ধন।” কথাগুলো বলার সময় ওঁর চোখে শূন্যতা লেপে ছিল।
নিজের শখের জন্য যাঁরা সারা জীবন সঁপে দেন, তাঁদের এই শখ-সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে মনের মধ্যে হিজিবিজি প্রশ্ন ভর করে। কোনও একটা ধরতাই লাগে, তাই আশি-পেরোনো এই বৃদ্ধের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করলাম। তবে পরিচিত বৃত্তে এমন বহু মানুষকে দেখেছি, যাঁরা তাঁদের আজীবন সংগ্রহ করা বই নিয়ে বেশি ভাবতে পারেন না, হয়তো ভয় পান। এঁদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবনসায়াহ্নে। পুত্রকন্যার প্রবাসজীবন মেনে নিয়ে তাঁরা সম্পূর্ণ একা বাঁচছেন। ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য সর্বক্ষণের লোক আছে হয়তো, কিন্তু মনের পুষ্টির জন্য আজও আঁকড়ে ধরে রয়েছেন আশৈশব লালিত শখ। তবে মনের খোরাক যে আয়োজনে মেটে, তার পাশে যদি ‘ভলিউম’ বলে হিংস্র পরিমাপবোধকে যোগ করা যায়, বুঝতে পারি, তাতে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে থাকে বই। তাঁরা উইল করে সম্পত্তি সন্তানসন্ততির জন্য ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিয়ে যান। কিন্তু এত বছর ধরে জমিয়ে রাখা বইগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীনই থাকেন। এ প্রসঙ্গে একাধিক মানুষকে বলতে শুনেছিলাম, “ছেলেমেয়েরা যার যেটা পছন্দ, নিয়ে নেবে। আমি জানি ওরা এগুলো সের দরে বিক্রি করবে না। আর পছন্দ না হলে লাইব্রেরি তো আছেই।”
এক মনোবিদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল সম্প্রতি। তিনি বার বার বলছিলেন, “আদর লেগে থাকা জিনিসগুলোর আগামী দিন নিয়ে আমরা ভাবতে বসলেই মনের মধ্যে ভর করে কিউমুলোনিম্বাস। কালো মেঘ। নিঃসঙ্গ যে মানুষটি বইয়ের আলমারির দিকে তাকিয়েই বাঁচার স্বাদ খুঁজে পান ইদানীং, আরও কিছু নতুন বই পড়ার জন্য কয়েকটা বছর আরও বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে যাঁদের, তাঁদের কাছে এমন প্রসঙ্গ প্রবল অস্বস্তির।” জানতে পারলাম, অনেকটা একই রকম আশঙ্কা কাজ করে গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রেমে পড়া মানুষদের মধ্যে। গুটিকয় সংগ্রাহক বেঁচে আছেন এখনও। রেকর্ডের যে স্তূপ তাঁদের চোখে, কানে, মনে আজও সুখজাগানিয়া, বছরকয়েক পরে তাঁদের অবর্তমানে সেগুলোর গতি নিয়ে ভাবতে তাঁরা ইতস্তত বোধ করেন। ওই মনোবিদই তাঁর পরিচিত এক রেকর্ড সংগ্রাহকের কথা বলছিলেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় নব্বই ছুঁই-ছুঁই। একেবারে একলা, নিঃসঙ্গ। উনি বিড়বিড় করে বলেছিলেন, “তুতেনখামেনের মতো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে জানো। শেষযাত্রায় কিচ্ছু চাই না আমি। শুধু পছন্দের রেকর্ডগুলো ঘিরে থাকুক।”
শুধুমাত্র বইপ্রেমীদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কয়েকটি গ্রুপ আছে। বেশ কয়েকটি গ্রুপের সদস্যসংখ্যা লক্ষ পেরিয়েছে। কলেজ স্ট্রিট সফর করে সেখানে অনেকে সংগ্রহ করা সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের ছবি দেন। বইয়ের প্রচ্ছদের ছবির পাশাপাশি আপলোড হয়ে যায় সংগ্রহ করা বইটির প্রথম পাতার ছবিও। এমনই এক ছবিতে দেখেছিলাম, ‘আদরের বাবুকে অনেক ভালবাসায়, বাবা।’ কিংবা, ‘জন্মদিনের আশীর্বাদ নিও— মা।’ নীচে সইয়ের সাল ১৯৭৮ যেমন দেখেছি, ঠিক তেমনই দেখেছি ২০০৮-ও। ‘খুব ভাল সংগ্রহ’, ‘জম্পেশ কালেকশন’ জাতীয় মন্তব্যের পাশাপাশি কমেন্ট বক্সে জুড়ে বসেছিল আরও কিছু লেখা। এক জন লিখেছিলেন, “হায় রে। বাবা মা ভালবেসে, আশীর্বাদ করে যে বই দিয়েছিলেন, সেটারও এই দশা হল? ওদের বাবা মায়ের নিজেদের যে বইগুলো ছিল, সেগুলোর কী গতি হয়েছে কে জানে!” ২০০৮-এর সইওয়ালা বইটার প্রসঙ্গে দেখেছিলাম, “তেরো-চোদ্দো বছরও বইটা বাড়িতে রাখা গেল না? জায়গা কম পড়েছিল হয়তো।”
সমাজের অন্দরমহল এবং অন্তরমহল নিয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা অনেকেই মনে করেন, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ছাড়া অন্য কিছুর উত্তরাধিকার কামনা করেন খুব কম জন। পূর্বপুরুষদের শখের ডিজিটাল সংস্করণ করার উপায় না থাকার জন্য তাঁরা জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়া মানুষদেরই কার্যত দায়ী করেন। এ প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুরবাসী এক আত্মীয়ের কথা মনে পড়ছে। একমাত্র সন্তান। মাকে হারিয়েছিলেন স্কুলজীবনেই। পিতৃবিয়োগের পরে, ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রির কাগজপত্র সই হয়ে যাওয়ার পরে, এক ঘর বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “এ আবর্জনা নিয়ে কী করি আমি?” তাঁর স্ত্রী জুড়েছিলেন, “বই না পড়ে যদি ফোটো তুলতেন বাবা, তা হলে একটি বত্রিশ জিবির চিপেই কাজ মিটে যেত। কালকেই কাগজওয়ালা ডেকে বিদায় করো এগুলোকে, প্লিজ়।”
স্কুলজীবন থেকেই বইপত্র জমিয়েছেন যে মানুষেরা, তাঁদের কাছে গুপ্তধনের মতো, ‘টিনটোরেটোর যীশু’র মতো সঞ্চিত আছে এমন বহু বই, যেগুলোর সংস্করণ আজ নিঃশেষিত। আজও বেঁচে আছেন কিছু মানুষ, যাঁদের সংগ্রহে আছে সে কালের নামকরা লিটল ম্যাগাজ়িনের দুর্মূল্য কপি। বইয়ের তাকে কোথাও মুখ লুকিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া প্রকাশনার এমন কিছু বই, দশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে যাওয়ার ভবিতব্য যার উপযুক্ত নয়। এক বই সংগ্রাহককে বলতে শুনেছিলাম, “ছেলেমেয়েরা যদি এর মূল্য না দেয়, তা হলে তো আমাদের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আছেনই। লাইব্রেরিতে নিয়ে নেবেন ঠিক। আমার এত কালের সংগ্রহ বৃথা যাবে না।”
কাউন্সিলর মশাইরা, পৌরপিতা, পৌরমাতারা এমন প্রস্তাব শুনে হয়তো মুচকি হাসেন। গ্রন্থাগার সংস্কৃতি যখন তলানিতে, তখন পাড়ার লাইব্রেরিতে বাড়তি বই ‘আমদানি’র কথা ভাবতেও পারেন না কেউ। একাধিক ব্যক্তির কথা মনে পড়ে, বাবা চলে যাওয়ার পরে তাঁর বইগুলো স্থানীয় গ্রন্থাগারকে দান করার প্রস্তাবে হয় প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, না-হয় কোনও উত্তর পাননি, একাধিক তদবিরের পরেও। শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজওয়ালার কাছে কেজি দরে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। শুনেছিলাম, হলুদ হয়ে যাওয়া অনেক বইয়ের পাতা দেখে কাগজওয়ালাও বলেছিল, “কন্ডিশন বহুত খারাপ আছে। এমন কিতাব দিয়ে ঠোঙা হবে না।”
কলকাতার কয়েকটা জায়গায় নতুন ধরনের গ্রন্থাগার চালু হয়েছিল বছরকয়েক আগে। কোনও ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে শেড দেওয়া সামান্য জায়গা। তার নীচে সাদামাটা বুকশেলফ। লেখা ছিল, “পছন্দের বইটা এখান থেকে নিয়ে যান বিনামূল্যে। পড়ার পরে আবার রেখে যান এখানেই। নিজের সংগ্রহের বইও এখানে রেখে যেতে পারেন সানন্দে। আপনার প্রিয় বই অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।” প্রথম কয়েক মাস সেখানে কিছু বই থাকলেও পরে ওই বুকশেলফের তাকগুলোতে খেলা করত শুধু হাহাকার। এই সাধু উদ্যোগ চলেনি একেবারেই।
বুঝতে পারি, বহু মানুষের জীবনলালিত শখ ফসিল হওয়ার জন্য প্রহর গুনছে। বিশ্ব জুড়ে বইপ্রেমীদের সংখ্যা নিম্নগামী। দেশ-বিদেশের নানা সমীক্ষা গলায় পাথর গুঁজে জানান দিচ্ছে এমনই। পুরনো আখরগুলি যেন হারিয়ে না যায়, তার দায়িত্ব নেওয়া জরুরি সমাজের স্বার্থেই। শরীরের অঙ্গদানে গ্রিন করিডর হয়, তাতে প্রাণ বাঁচে। কেউ যদি সারা জীবনের মন ভাল থাকার অঙ্গগুলো সমাজের জন্য বিলিয়ে দিতে চান, তা হলে আমরা তা দু’হাত পেতে গ্রহণ করব না কেন? একটা সেন্ট্রাল বুক ব্যাঙ্ক হতেই পারে। দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য বইগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি ডিজিটাল আর্কাইভ করা যেতে পারে সেখানে। আর উদ্বৃত্ত বইগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে রাজ্যের গ্রাম গঞ্জ মফস্সলে— যেখানে মানুষের অবসরজীবন ওটিটি-সর্বস্ব হয়ে ওঠেনি এখনও।
অনেকে বলবেন, এখন তো পুনর্ব্যবহারের যুগ। সেলুলোজ় পাতাগুলো রিসাইকলড হলে ক্ষতি কী? এমন প্রশ্ন মনে এলেই উড়তে শুরু করে অসংখ্য অস্বস্তিকর বুদ্বুদ। ইতিহাসের আবার রিসাইক্লিং হয়? স্মৃতির কিংবা শখের?
একটা বই কি শুধু কয়েক অক্ষৌহিণী অক্ষর মাত্র?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy