বছরশেষের ক্রিসমাসের সঙ্গে সান্টা ক্লজ় বলে যে মানুষটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, তাঁর আসল নাম সেন্ট নিকোলাস। অনেক জায়গায় তাঁর নাম আবার ফাদার ক্রিসমাসও। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি ক্রিসমাস ইভ বা ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এবং মাঝরাতে ভাল ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের উপহার দিয়ে যান। আবার ফিস্ট ডে বা ৬ ডিসেম্বর, যে তারিখটি আবার সেন্ট নিকোলাস ডে নামেও পরিচিত, সে দিনও এমন ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। যত দূর মনে হয়, সান্টা ক্লজ় মানুষ নন। হলে কি এই বুড়ো বয়সে হাড়-কাঁপানো উত্তর মেরুর শীতের রাতে, বল্গা হরিণে টানা উদোম রথে চড়ে, কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে আবার নিজের ভিটেয় ফিরতে পারে? মানুষের পক্ষে এ কাজ অসম্ভব, যতই বল্গা হরিণদের নাইট ভিশন কিংবা জিপিএস ট্র্যাকার থাকুক না কেন! আজকাল কচিকাঁচাদের জন্য উপহার প্রস্তুতির ঝক্কিও কম নয়। বাচ্চারা চিঠি লিখে উপহার চায়। মাথার উপর লাল টুকটুকে মোজা টাঙিয়ে রেখে ঘুমোতে যায়। আহিঙ্কে তাদের ষোলো আনা! উপহার যাতে অপাত্রস্থ না-হয়, তা দেখার ভার সান্টারই উপর। নিশ্চয়ই চিত্রগুপ্তের মতো বিরাট জাবদা খাতার এন্ট্রি থেকে সান্টাকে খুঁজতে হয়, গত বছরের বড় দিন থেকে এ বছরের ক্রিসমাস ইভ পর্যন্ত— যার নাম সান্টা ক্লজ় বর্ষ— খোকাখুকুরা ঘরে-বাইরে কে কী দুষ্টুমি করেছে! তার পর উপহার নির্বাচন। সেই হিসেব রাখার জন্য কম্পিউটারের ডেটা এন্ট্রিতে এখনও সড়গড় হননি সান্টা। হয়তো তাঁর স্মার্টফোনও নেই। না হলে কত অনলাইন শপিং পোর্টাল হয়েছে, তাদের মাধ্যমে উপহার পাঠালেই তো ঝামেলা মিটে যেত।
সেন্ট নিকোলাসের যে ছবিটি দেখতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে সান্টা ক্লজ়ের যে খুব মিল আছে, তা বলা যায় না। সেন্ট নিকোলাস এক জন খ্রিস্টান সন্ত, তাঁর পরনে বিশপের আলখাল্লা। কিন্তু আজকের সান্টা ক্লজ় ভারী চেহারার, হাস্যময় এবং সাদা-দাড়িগোঁফ বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি পরে থাকেন সাদা কলার ও কাফ দেওয়া লাল কোট, সাদা কাফ দেওয়া লাল ট্রাউজ়ার্স, কালো চামড়ার চওড়া বেল্ট ও বুটজুতো। বিশিষ্ট ক্যারিকেচারিস্ট ও কার্টুনিস্ট টমাস নাস্টের আঁকার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সান্টা ক্লজ়ের এই রূপটি সাধারণ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর গোলার্ধের ছ’মাস টানা রাতের দেশে থেকে, এই বুড়ো বয়সেও মোটাসোটা সান্টা ক্লজ়ের স্বাস্থ্য অটুট। রাতের আকাশপথে আসতে-যেতে তাঁর চোখে পড়ে উত্তর গোলার্ধের উঁচু দেশে বড়দিন ও তুষার এক সঙ্গে হলেও, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্ৰীষ্মের দাপট। অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ডে তখন গ্রীষ্ম হলেও, সেখানে সান্টা ক্লজ়ের পোশাকে ও শুভেচ্ছাপত্রে থাকে শৈত্যের চিহ্ন।
সান্টার দেখে ভাল লাগে, পৃথিবীর সব দেশ বড়দিনকে প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর আলাদা আলাদা আবহে না-দেখে, তুষারের পটভূমিতেই উদ্যাপিত করছে। দেশ-কাল যা-ই হোক, বড়দিন আসে শীতের আবহেই। মানসিকতার এই মিল বড়দিনকে করে তুলেছে সর্বজনীন ও আন্তর্জাতিক। বড়দিন বহিরঙ্গের নয়, আমাদের অন্তরের স্বাভাবিক ও স্বতঃপ্রণোদিত উৎসব, যা আমাদের শৈত্য থেকে উষ্ণতায়, অন্ধকার থেকে আলোয় ও অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চয়তায় উত্তরণের পথ দেখায়।
তবে সান্টা ক্লজ় উত্তর মেরুতেই থাকেন কি না, সে নিয়ে আবার মতান্তরও আছে। সান্টা ক্লজ়-সংক্রান্ত আমেরিকান উপাখ্যান অনুসারে, সান্টার বাড়ি উত্তর মেরুতে। অন্য দিকে আবার ফাদার ক্রিসমাসের বাড়ি হিসেবে অনেকে বলে থাকেন ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড প্রদেশের কোরভাটুনটুরি পার্বত্য অঞ্চলের কথাও। সেখানে থাকেন সান্টা ক্লজ়, তাঁর স্ত্রী মিসেস ক্লজ়, অসংখ্য জাদুক্ষমতাসম্পন্ন খুদে খুদে জীব বা এলফ এবং আট-ন’টি উড়ন্ত বল্গা হরিণ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভালমানুষ হয়ে থাকা কিংবা দস্যিপনার উপর নির্ভর করে তাদের বৎসরান্তের পাওনা। উঁহু! ভালমন্দ নির্বিশেষে সব্বাই খেলনা, লজেন্স, চকলেট পাবে, অতখানি প্রশ্রয় সান্টা দিতেন না বলেই জনশ্রুতি। দুষ্টু ছেলেমেয়েরা সান্টার কাছ থেকে কয়লার টুকরো পেত বলেও বিশ্বাস করে কোনও কোনও লোককথা। কিন্তু এখন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে সেই রেওয়াজ।
বিদেশে সান্টার গিফট সার্ভিসিং ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সোজা। ওখানকার রাস্তাঘাট বড়, চওড়া ও সোজা। কলকাতার রাস্তার উপর চতুর্দিকে তার-এর ঘেরাটোপ। বড় রাস্তায় ট্রামের তার, পাড়ায় লাইটপোস্টের, আরও বেশি বিপজ্জনক লাইটপোস্ট থেকে চরকির মতো চক্রাকারে বেরিয়ে আসা কেবল-লাইনের তারের গোল জট, যেন কাউবয়দের ব্যবহারের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে সারি সারি ল্যাসো! বাগরি-বাজারে কেবল-লাইনের জট দমকলকে কী নাকালটাই না করেছিল, সে কথা মানুষ আজও মনে রেখেছেন। সান্টার অলিখিত ও অনুক্ত অসুবিধেরও কমতি নেই। এখানে বাবা, মা-রা খোকা-খুকুদের সঙ্গে একই ঘরে থাকেন। ফলে উপহার দিতে গিয়ে প্রায়শই সান্টাকে বিড়ম্বনা ও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়।
পাহাড় বা সাগর পেরোবার সময় সান্টার একটু ফুরসত মেলে। তখন তিনি ভাবেন বড়দিন উৎসবের উত্থান, পতন ও পুনরুত্থানের সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাস। হুল্লোড় ও বেলেল্লাপনার জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ১৬৪৪ সালে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিল বড়দিন উৎসব। তখন বড়দিন পালিত হত নিভৃতে ও উপবাসে। রেস্টোরেশনের যুগে ১৬৬০ সালে বড়দিন উৎসবের পুনরুত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সান্টার ব্যক্তিগত ইতিহাসে দুঃখের দিন শেষ হয়েছিল। সান্টা জানেন, ১৯৮৪ সালে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও, ক্রিসমাস ইভ-এর দিন ভারতে লোকসভা নির্বাচন হওয়ায় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিস্তর অসুবিধে হয়েছিল। হয়তো সে কথা মাথায় রেখেই পরের বছর ইলাহাবাদ উপনির্বাচন ‘রোজা’-র জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়।
সান্টা এ কথাও জানেন যে, খ্রিস্টপরবের কলকাতায় গভীর রাতে যাতায়াতের ততটা সুব্যবস্থা এখনও নেই। মিডনাইট মাস-এ অংশ নিতে হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাড়ির বন্দোবস্ত করতে হয়। সবার পক্ষে তা সম্ভবও হয় না। এই উৎসব চলাকালীন নৈশ-পরিবহণ আরও ভাল এবং উপযুক্ত করা গেলে বেশ হত, ভাবেন সান্টা।
পরিবর্তনের কথা ভাবতে ভাবতেই আবার সান্টার মনে হয়, ছোটদের কাছে প্রিয় এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে কতই না পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর বরাবরের সঙ্গী ‘কালো পিটার’-কে ত্যাগ করেছেন, কারণ খোকাখুকুরা নাকি কালো লোক পছন্দ করে না। সান্টা আগে ভাল শিশুদের দিতেন উপহার আর বেয়াড়াদের দিতেন, না শুধু কয়লা নয়, দিতেন বার্চ গাছের চাবুক ও ছাই। দুষ্টুদের বাবা-মায়ের ব্যবহারের জন্য। গুণধরদের পিঠে বা পাতে দেওয়ার জন্য, যথাক্রমে। শাস্তি কেউই পেতে চায় না, দোষী হলেও। গাজর আর লাঠির লড়াইয়ে লাঠির দিন শেষ। সান্টা এখন সবাইকেই ঢালাও উপহার দেন। বিশ্বাসী শিশুরা তখন সংখ্যায় অনেক, তাই শাস্তি বা জুজুর প্রয়োজন ছিল। এখন তারা সংখ্যায় কম। যুগের সঙ্গে বদলেছে মনস্তত্ত্বও। সান্টা জানেন, লাঠির চেয়ে লজেন্স, চাবুকের চেয়ে চকলেটের জোর এখন বেশি।
এ হেন সান্টারও সমালোচক ছিল, বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কাছে সান্টা ক্লজ় ছিল অসহ্য। ৩৪ বছরের শাসনের সময় সব ব্যাপারেই তাদের একটা ভিন্ন ও ভ্রান্ত মন্তব্য থাকত। তাদের অভিযোগ ছিল, মেদওয়ালা বুর্জোয়া-মার্কা এক উটকো বুড়ো উপহারের খয়রাতি করে বেড়াচ্ছে! বাপ-মা-গুলো হয়েছে তেমনই, নিজেদের খাটো করে বুড়োটাকে তোল্লাই দিচ্ছে। বুঝতে পারছে না যে, বাচ্চাদের কাছে নিজেরা লিলিপুট হয়ে যাচ্ছে। তাদের আরও অভিযোগ ছিল, এর ফলে আজকের শিশুরা, যারা ভবিষ্যতের দেশ গড়ার কারিগর, পরিশ্রমের বদলে প্রার্থনা-র ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে, যা সমাজতন্ত্রের স্বার্থবিরোধী!
সেই দল বা শাসন আজ নেই, কিন্তু আছে কর্মসংস্থানের তীব্র অভাব। মনোবাঞ্ছা পূরণকারী সান্টা ক্লজ়ের প্রয়োজন এর চেয়ে বেশি আর কখনও অনুভূত হয়নি। ক্লাবগুলো না-হয় এ বার থেকে বড়দিন পালনে উদ্যোগী হোক। সান্টার সৌজন্যে শিল্পায়নে যদি একটু জোয়ার আসে। কে বলতে পারে, ঘুমন্ত বাংলার মাথার কাছে রাখা মোজায় শিল্পায়ন কিংবা কর্মসংস্থানের উপহারটি রেখে যেতে সান্টাই হয়তো ভরসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy