কাঠের বারান্দা থেকে দুটো সিঁড়ি নেমে যাব, তক্ষুনি পিছন থেকে রিনরিনে গলায় কে যেন বলে ওঠে, ‘‘কুথুসি গ্যাসুন?’’ (কোথায় যাচ্ছ?) কিছু বলার আগেই হাততালি দিয়ে সুরে সুরে সেই-ই নিজের প্রশ্নের উত্তর জোগায়, ‘‘কুন্নি গ্যাসুন কুন্নি গ্যাসুন!’’ (কোথাও যাচ্ছি না!) আর বিশেষ কিছু বলার আগেই জুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমার। ওর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ি। দশ-পনেরোটা বাড়ি নিয়ে আমাদের পাড়া। পেরিয়ে গেলে বার্চ ঘেরা একটা ছোট মাঠ। একটা প্রকাণ্ড নালা। তার পর আপেল বাগান। ফলের ভারে নুয়ে পড়ছে অজস্র গাছ, ছোট্ট ছোট্ট আগাছা। ফুল লতপত করছে হাওয়ায়। আমরা ছুটোছুটি করছি।
জুলি প্রায় আমারই বয়সি। ওদের বাড়িতেই ভাড়া থাকতাম আমরা। মা, বাবা আর আমি। সাটন অ্যান্ড সান্স-এর কাশ্মীরি বাগান সামলাতে মাস তিনেক আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাবা। তিনি ছিলেন ফুলের কারিগর। নানা রকম হাইব্রিড ফুল তৈরি করতেন আর সেই সব ফুলের বীজ রপ্তানি হত। এ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় এই ব্রিটিশ কোম্পানি ব্যবসা শুরু করে। তখন মূলত ফুল ও আনাজের বীজ আমদানি করত ওরা। পরে উটি, বেঙ্গালুরু, কাশ্মীর, রাঁচিতে বাগান তৈরি হয়। সত্তরের দশকের শেষের দিকে কাশ্মীরে পোস্টিং হয় বাবার। কলকাতা থেকে কাশ্মীর লম্বা পথ। দু’রাত ট্রেনে থাকার পরে জম্মু। রাতে সেখানে থেকে ভোরবেলা ধরতে হবে শ্রীনগরের বাস। ফোনে সে রকমই বলেছিলেন বাবা।
১৯৭২-এর পর পরই ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে কাশ্মীরকে সংযুক্ত করার তাগিদে টেলিকমিউনিকেশন, ট্রেন ও সড়কপথের উন্নতি হয়। আশ্চর্য উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে বানিহাল পাহাড়ের মধ্যে আধো-অন্ধকার জওহর টানেলের ভিতর দিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম জুলিদের বাড়ি। কিছু দিনের মধ্যে ওটা আমারও বাড়ি হয়ে উঠল।
জুলির দাদুরা কল ব্রাহ্মণ। মার মুখে শুনেছি, তেমন গোঁড়ামি ছিল না ওদের মধ্যে। জুলির মা-বাবার মধ্যে বনিবনা ছিল না বলে ওরা মামার বাড়িতে থাকত। সকালে অফিস চলে যেত জুলির মা, আর ও চলে আসত আমাদের কাছে। ওর একটা লাল টুথব্রাশ ছিল। একটা ঘটনা মনে আছে আমার। কলগিন্নি, মানে জুলির দিদিমা, রান্না করতে করতে সরু গলায় জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির রান্নারত হাসিনাদিদির মায়ের সঙ্গে ঝগড়া চালাতেন। মাঝে মাঝে ঝগড়ার রেশ কেটে গিয়ে তা গিয়ে ঠেকত সাধারণ কথোপকথনে। তখন ওঁরা সংসারের হালহকিকত নিয়ে গল্প করতেন। কেউ সামনে এলেই আবার ঝগড়া চালু! ওঁদের নিয়ে দুই পরিবারের সবাই হাসাহাসি করত। কলগিন্নি গম্ভীর মুখে বলতেন, ‘‘ওরা মুসলমান, জানো না তো কী নোংরা!’’ অথচ কল পরিবারের অনেকেই রোজ স্নান করতেন না। রবিবার হলেই ‘আজ নাহানা হ্যায়’ বলে ঘ্যানঘ্যান শুরু! মায়ের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল হাসিনাদিদির। ওর মা আমাদের মশলাদার ক্যাপসিকামের তরকারি পাঠাতেন। বাসমতি চালেই রান্না হত ভাল। সব কিছুতে একটা পায়েস-পায়েস গন্ধ। হাসিনাদিদির প্রেম ছিল এক হিন্দু ছেলের সঙ্গে। ওরা পালিয়ে বিয়ে করেছিল।
আমি আর মা ঘুরে বেড়াতাম এ দিক-সে দিক। জেহ্লাম, মানে ঝিলম নদীর পাড় ঘেঁষে কাদা-কাদা, ঘোড়ার পটিতে ভরা পাইন-চিনার সরণি ধরে পৌঁছে যেতাম মুসলিম মহল্লায়। দোকানিরা সন্দিহান। জানতে চাইতেন আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি। বারবার যেতে যেতে চিনে গিয়েছিলেন আমাদের। দুম্বার (ভেড়া) মাংস ও মেটে কিনে, বয়ে যাওয়া নদীর গান শুনতে শুনতে কুয়াশাঘেরা দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে ফিরতাম আমরা। এমনই এক দিন বৃষ্টি নামল অঝোরে, দেখতে দেখতে নদীনালা ছাপিয়ে এক হাঁটু জল। সে কী কনকনে ঠান্ডা! আমাকে নিয়ে মা খুব বেকায়দায় পড়লেন। তা দেখে এক ভদ্রলোক তাঁদের বাড়ি নিয়ে গেলেন আমাদের। কম্বলে মুড়ে দিলেন আমাকে। আঙ্গেটিতে হাত-পা সেঁকছি, এলাচ দেওয়া গোলাপি চা এল, আখরোট আর খোবানিও। এ দিকে খুঁজতে খুঁজতে বাবা আর কল আঙ্কেল এসে পড়লেন সেই বাড়িতে। কল আঙ্কেল ভিতরে ঢুকলেন না। বাইরে থেকেই সৌজন্য রক্ষা হল। পরে এক-আধ বার আমি বাবা-মা, তিনজনে চা খেতে গিয়েছি ওই হাকিমচাচার বাড়ি। যদিও উনি কোনও দিন আসেননি আমাদের এ দিকে। মজাই হত আমাদের। শিবরাত্রি হোক, অথবা ইদ-উল-ফিতর বা ইদ-উল-আজহা, মাঝেমধ্যেই নিমন্ত্রণ জুটে যেত। বাবা অত মিশুকে ছিলেন না। কিন্তু তাতে কী! মা আর আমিই যথেষ্ট।
এক দিন বাবার সহকর্মী সুবোধকাকু অমিতাভ বচ্চনের ‘বেনাম’ সিনেমার টিকিট কিনে আনলেন। ছোট বলে উনি আমার টিকিট কাটেননি। কিন্তু তা দেখে বাবা সিনেমায় যেতে চাইলেন না। ঠিক হল, হল-এ গিয়ে আমার টিকিটটা কেনা হবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল হাউসফুল! কী করা! অগত্যা বিনা টিকিটেই প্রবেশ। আমাকে নিয়ে ঢোকার সময় গেট আটকাল চেকার। ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন। আমাকে কম কথা বলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কে কার কথা শোনে! লম্বা দাড়ি, টুপি পরা ম্যানেজারকে দেখে প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে তার সঙ্গেই গল্প জুড়ে দিয়েছিলাম। তার পরে লজেন্স হাতে বীরদর্পে সিনেমা দেখলাম। সেই ‘ব্রডওয়ে’ সিনেমাহল পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।
মাঝে মাঝে চলে যেতাম বাবার বাগানে। পাহাড়ের ধারে রকমারি ফুলের বেড। লিলি, ডেইজ়ি, ল্যাভেন্ডারের সিঙ্গল-ডবল কম্বিনেশন। সেখান থেকে ঝুড়ি ভরে আপেল আসত রোজ। খেয়ে খেয়ে মায়ের গাল দুটো টুকটুকে লাল হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে দেখা যেত দূর পাহাড়ের মাথায় খেলনার মতো শঙ্করাচার্যের মন্দির। সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যেতাম। পরিচিত টুরিস্ট স্পটগুলোতেও ঘুরতে যেতাম। এক বার পহেলগাঁও-এ আমি আর বাবা একটা ঘোড়ায় চড়েছিলাম, তার নাম ছিল এরোপ্লেন! ডাল লেককে সত্যিই ‘ডাল’ লাগলেও, হাউসবোটে থাকার ইচ্ছে হত খুব। কিন্তু সে আর হয়নি। অবশ্য কাঠের
তৈরি একটা খেলনা হাউসবোট কিনে দেওয়া হয়েছিল আমায়।
আবার বদলি হয়ে গেল বাবা। কলকাতায় ফিরলাম। স্বপ্নের মতো সুন্দর কাশ্মীরের দিনগুলো ছিল বড্ড আনন্দের। প্রাত্যহিক নজরদারি, ভেদাভেদ কিছু থাকলেও সে সব নজর করার মতো চোখ তখনও আমার তৈরি হয়নি।
এখন মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ভাবতে বসলে, ভেসে ওঠে হাকিমচাচার আতরের গন্ধ, সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ, উইলো-অ্যাপ্রিকট-প্লাম, লাল টুথব্রাশ হাতে জুলি, মা— আর জেহ্লাম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy