রাজকুমার হ্যারি আর মেগান মার্ক্ল
ব্রিটেনের হাওয়ায় এখন উৎসবের গন্ধ। ইংল্যান্ডের ছোট রাজপুত্র হ্যারির বিয়ে বলে কথা। এই বিয়েতে শুধু ইংল্যান্ড নয়, উল্লাসের মিছিলে সামিল হয়েছে আমেরিকাও। হ্যারির হবু স্ত্রী মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্ক্ল। এখন ব্রিটেনের প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে মেগান-হ্যারির ছবিওয়ালা মগ, প্লেট, টি-টাওয়েল, আরও বহু স্মারক। আগামী শনিবার, ১৯ মে উইন্ডসর কাসল-এর সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে হ্যারি ও মেগান বিয়ের শপথ নেবেন। মস্ত পার্টিতে নিমন্ত্রিত হাজারেরও বেশি অতিথি। নাচে-গানে, সুরার ফোয়ারায় মাতিয়ে রাখা হবে আমন্ত্রিতদের।
ব্রিটিশ রাজপরিবারে মার্কিন বধূ! না, মেগান মার্ক্ল ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রথম মার্কিন বৌ নন। অনেকেরই মনে পড়বে আরও এক রাজকীয় বিয়ের কথা। প্রায় ৮০ বছর আগে এক মার্কিন কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ড— রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরির বড় ছেলে। সব রূপকথার শেষে রাজপুত্র-কন্যের বিয়ের মতো এই বিয়েটা সুখের হয়নি, এই মার্কিন বধূটিকে ইংল্যান্ডের রাজপরিবার আপন করে নেয়নি।
উইন্ডসর কাসল-এর ফ্রগমোর হাউসের ভিতরে সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন সেই দম্পতি— ডিউক এবং ডাচেস অব উইন্ডসর— অষ্টম এডওয়ার্ড আর তাঁর স্ত্রী ওয়ালিস। তাঁদের বিয়ে রাজপরিবারের সিলমোহর পেলে পঞ্চম জর্জের পর অষ্টম এডওয়ার্ডই হতেন ইংল্যান্ডের রাজা, ওয়ালিস হতেন ‘রানি ওয়ালিস’। তার পরিবর্তে ইতিহাস জানল, এই রাজা শাসনক্ষমতা, মুকুট, সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন— বিবাহবিচ্ছিন্না এক মার্কিন মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে। সে মেয়েকে সবাই জানে-চেনে শুধু ‘মিসেস সিম্পসন’ নামে। ডিউক আর ডাচেস, এই উপাধিটুকুর বেশি আর কিছুই জোটেনি তাঁদের। ইতিহাসের ঠাট্টা, এই ফ্রগমোর হাউসেই হ্যারি আর মেগানের বাগদানের ফোটোশুট হয়েছে। বিয়ের রাতে এখানেই হবে নাচগান, পানভোজন।
আশি বছরে রাজপরিবারে অনেক কিছুই পাল্টেছে। দু’বারের বিবাহবিচ্ছিন্না মিসেস সিম্পসন যেমন প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, আর এক বিবাহবিচ্ছিন্না, মিশ্র বংশোদ্ভূত মেগান মার্ক্লকে স্বাগত জানানোর প্রতীক্ষায় বাকিংহাম প্যালেস। রাজপরিবারের কারও সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেই, এরই মধ্যে একটি মেয়ে আমন্ত্রিত হয়েছে সান্ড্রিংহামে রানির বার্ষিক ক্রিসমাস মিলনোৎসবে— ইতিহাসে যে ঘটনা প্রথম ঘটল। ক্রিসমাস সার্ভিসে প্রোটোকল মেনে হ্যারির সঙ্গে হেঁটেছেন মেগান— সামনে ছিলেন উইলিয়াম-কেট, পিছনে প্রিন্স অ্যান্ড্রু, এডওয়ার্ড ও প্রিন্সেস অ্যান। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে মেগান খুব উৎসাহী। হবু দম্পতিকে প্রায়ই নানা অনুষ্ঠানেও দেখা যায়। মেগান বোঝাতে চান, রাজকুমারী ডায়ানার মতোই, তিনিও আলাদা, তিনিও মানুষের মন জয় করতে চান। আর পাশাপাশি খুব অবাক লাগে, যখন পড়ি অষ্টম এডওয়ার্ডের মা, রানি মেরি মিসেস সিম্পসনকে বলেছিলেন ছেলেকে বিপথে নিয়ে যাওয়া ‘ডাইনি’। মার্কিন রীতিনীতিতে অভ্যস্ত ওয়ালিস কোনও দিনই তাঁর ইংরেজ শ্বশুরবাড়িকে বুঝে উঠতে পারেননি। রাজপরিবারের সবার তাঁর প্রতি আচরণ কেমন ছিল, প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘বিষ, বিষ, বিষ!’’
দম্পতি: ওয়ালিস ও এডওয়ার্ড। আজীবন যাঁদের সম্বল ছিল কেবল ডাচেস অ্যান্ড ডিউক অব উইন্ডসর উপাধিটুকুই
বেসি ওয়ালিস ওয়ারফিল্ড জন্মেছিলেন আমেরিকার বাল্টিমোরের মেরিল্যান্ড শহরে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে দাস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অর্থবান হয়ে উঠেছিল ওয়ারফিল্ড পরিবার। ওয়ালিস যখন ছোট, তাঁর বাবা যক্ষ্মায় মারা যান। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তাঁর মা চলে আসেন ওয়ালিসের এক কাকার আশ্রয়ে। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারিকা, ম্যানেজার ও কর্মচারীদের সঙ্গেই ওয়ালিসের বড় হয়ে ওঠা। তাঁর তুতো ভাই এডউইন ওয়ারফিল্ড পরে ১৯০৩ সালে মেরিল্যান্ডের ৪৫তম গর্ভনরও হয়েছিলেন। কাকতালীয় হলেও সত্যি, মেগানের কৃষ্ণাঙ্গ-মার্কিন মা’ও ছিলেন আফ্রিকার দাস পরিবারের বংশধর। কে জানে, ওয়ালিস বেঁচে থাকলে এ কথা শুনে ভুরু কুঁচকোতেন কি না!
আমেরিকা থেকে ওয়ালিস প্রথম লন্ডন আসেন ১৯২৮ সালে, তাঁর স্বামী আর্নেস্ট সিম্পসনের সঙ্গে। অ্যাংলো-আমেরিকান আর্নেস্ট ছিলেন ওয়ালিসের দ্বিতীয় স্বামী, চাকরি করতেন জাহাজে। আগের স্বামী, নেভি পাইলট আর্ল উইনফিল্ড স্পেনসারের সঙ্গে ওয়ালিসের প্রথম বিয়ে টিকেছিল এগারো বছর। ১৯২৭-এ সেই বিয়ে ভেঙে যায়। লন্ডনের মেফেয়ারে বড় একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন আর্নেস্ট ও ওয়ালিস। সেখানে অতিথিদের আসা-যাওয়া, হইহুল্লোড় লেগেই থাকত। ককটেল পরিবেশনে, অতিথিদের মনোরঞ্জনে ওয়ালিসের জুড়ি মেলা ভার। ওয়ালিস হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়ের লন্ডনের এক জনপ্রিয় সোশ্যালাইট। ১৯৩১ সালে এক কান্ট্রিহাউসের নৈশভোজে এডওয়ার্ডের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এডওয়ার্ড তখন প্রিন্স অব ওয়েলস। ওয়ালিসের প্রেমে পড়ে যান এডওয়ার্ড। তিনি যে ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী, কেউকেটা এক জন, ওয়ালিসের কাছে এ সবের কোনও মূল্যই ছিল না। এই ব্যাপারটাই এডওয়ার্ডকে আরও বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
ওয়ালিসকে অভিবাদন জানাচ্ছেন হিটলার, দেখছেন এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড নাৎসিপন্থী, এই অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে
১৯৩৬ সালটা ব্রিটেনের ইতিহাসে খুব অন্য রকম একটা বছর। এই বছরে ব্রিটিশ সিংহাসন তিন জন রাজাকে পেয়েছিল। রাজা পঞ্চম জর্জ মারা গেলে ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন তাঁর বড় ছেলে অষ্টম এডওয়ার্ড। মাত্র দশ মাসের মাথায় দেশ মুখোমুখি হল এক অদ্ভুত সাংবিধানিক সঙ্কটের। নভেম্বর মাসের এক দিন বাকিংহাম প্যালেসে প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বল্ডউইনকে ডেকে এডওয়ার্ড বলেন, তিনি ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করতে চান, শুধু আর্নেস্টের সঙ্গে ওঁর বিবাহবিচ্ছেদের অপেক্ষা করছেন। স্ট্যানলি তৎক্ষণাৎ জানালেন, এই বিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি পাবে না। ইংল্যান্ডের রাজা শুধু দেশের প্রধান নন, গির্জারও প্রধান। আর সেই সুবাদে তিনি এমন কোনও নারীকে বিয়ে করতে পারেন না যাঁর দু’বার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, এমনকী যাঁর প্রাক্তন স্বামীরা জীবিত। স্ট্যানলি এডওয়ার্ডকে সতর্ক করেছিলেন, ওয়ালিসকে বিয়ে করা নিয়ে এডওয়ার্ড বেশি বাড়াবাড়ি করলে স্ট্যানলি বাধ্য হবেন পদত্যাগ করতে, তাতে আর একটা নির্বাচন করতে হবে দেশে। অবশ্য এডওয়ার্ডের সময় ব্রিটেন ক্রমশ সাংবিধানিক সমস্যায় নিমজ্জিত হচ্ছিল। ‘দ্য উইন্ডসর ফাইল’ নামের এক প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ পল সুইট দাবি করেছেন, ১৯৩৬ সালে পঞ্চম জর্জ মারা যাওয়ার পর থেকেই সরকারি নিয়মে নাক গলাতে শুরু করেন এডওয়ার্ড। সাংবিধানিক প্রোটোকল লঙ্ঘন করে তিনি নিজে জার্মান রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিলেন।
ওয়ালিসকে বিয়ে করলে পরিণতি কী হতে পারে জেনেও এডওয়ার্ড মনস্থির করেছিলেন, তিনি সিংহাসন ছাড়বেন তবু ওয়ালিসকে ছাড়বেন না। এডওয়ার্ডের এই সিদ্ধান্ত জানার পর ওয়ালিস তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি একটা মাথামোটা!’’ এডওয়ার্ড কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন।
১১ ডিসেম্বর ১৯৩৬। রাতে এডওয়ার্ড সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল সেই বার্তা। ‘‘রাজা হিসেবে আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব, যদি না আমি সেই নারীর সমর্থন ও সাহায্য পাই, যাঁকে আমি ভালবেসেছি।’’ গোটা দেশ চমকে উঠেছিল এডওয়ার্ডের এই ঘোষণায়। বাবা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর ১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি রাজা হয়েছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। তার পর এক বছরও কাটল না, ১১ ডিসেম্বর সিংহাসন ত্যাগের ঘোষণা। ব্রিটিশ রাজপরিবারে তিনিই সবচেয়ে কম দিন, মাত্র ৩২৬ দিনের রাজা। ছোট ভাই, ডিউক অব ইর্য়ক আলবার্টের উপস্থিতিতে এডওয়ার্ড তাঁর পদত্যাগপত্রে সই করেছিলেন। রাজা হলেন আলবার্ট— অভিষেকের পর তাঁর নাম হয় ষষ্ঠ জর্জ। আর এডওয়ার্ড রাজা থেকে হয়ে যান ‘ডিউক অব উইন্ডসর’।
পদত্যাগের পরের দিনই ইংল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রিয়ায় চলে যান এডওয়ার্ড। ১৯৩৭ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের এক দুর্গে এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের কোনও সদস্যকে দেখা যায়নি। রাজা ষষ্ঠ জর্জের কড়া নির্দেশ ছিল, এডওয়ার্ডের বিয়েতে যেন রাজপরিবারের কেউ উপস্থিত না থাকেন। সেই আদেশ অমান্য করার সাহস কারও ছিল না। তা ছাড়া ওয়ালিসকে কেউ পছন্দও করতেন না। ওয়ালিসের চেহারায় কোমলতার অভাব, বরং প্রকট কাঠিন্যই। তাঁর মার্কিন উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধা হত ব্রিটিশদের। উপরন্তু ওয়ালিসের উপর বেজায় চটে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি, রানি মেরি। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই মেয়ে এডওয়ার্ডের উপর জাদু করেছে, তাঁকে সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে সরিয়ে এনেছে। ওয়ালিস আবার একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না আলবার্টের স্ত্রী, ডাচেস অব ইয়র্ককে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় ওয়ালিসের আত্মচরিত ‘দ্য হার্ট হ্যাজ ইটস রিজনস’। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ডাচেস অব ইয়র্ক তাঁকে ঘৃণা করতেন, কারণ আলবার্ট ও তাঁর নিশ্চিন্ত জীবন ওয়ালিসের জন্যই তছনছ হয়ে গিয়েছিল বলেই ডাচেসের বিশ্বাস ছিল। আলবার্টেরও নাকি রাজা হওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না, ওয়ালিসের জন্যই তাঁকে বাধ্য হয়ে রাজা হতে হয়েছিল!
এখন জানা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ওয়ালিসের সঙ্গে প্রেমের জন্যই যে এডওয়ার্ডকে সিংহাসন ছাড়তে হয়েছিল, ব্যাপার আদৌ তা নয়। এর পিছনে আর একটি কারণ ছিল। এডওয়ার্ড এবং ওয়ালিস নাকি প্রবল নাৎসিপন্থী ছিলেন! ব্রিটিশ সরকার সে জন্যই প্রশাসনের পথ থেকে এডওয়ার্ড নামের কাঁটাটিকে সরাতে চেয়েছিল। এও শোনা যায়, এডওয়ার্ডের সঙ্গে বিয়ের আগে নাৎসি বিদেশমন্ত্রী জোয়াখিম ভন রিবেনট্রপের প্রেমিকা ছিলেন ওয়ালিস! কিন্তু এটা সত্যি কথা, বিয়ের চার মাস পরে এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন জার্মানিতে তাঁর হলিডে হোমে। ফ্রান্সেস ডোনাল্ডসন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ডিউক হিটলারকে পুরোদস্তুর নাৎসি স্যালুট ঠুকেছিলেন!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন কূটনীতিবিদরা জার্মানির মারবুর্গ কাসল থেকে প্রায় ৪০০ টন নাৎসি নথিপত্র উদ্ধার করেন। নথিপত্রের ভিড়ে পাওয়া যায় ‘উইন্ডসর ফাইলস’ নামের এক তাড়া কাগজ। চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, অন্যান্য কাগজপত্র মিলিয়ে প্রায় ৬০টি নথি মিলেছে, যুদ্ধের সময় ডিউকের কাছের লোকেদের লেখা। এমনকী তার মধ্যে কয়েক জন জার্মান এজেন্টও! এই সব কাগজের তথ্য থেকে জার্মানদের করা একটা পরিকল্পনার কথাও জানা যায়। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন উইলি’। জার্মানরা চেয়েছিল ষষ্ঠ জর্জকে সিংহাসনচ্যুত করে এডওয়ার্ডকে আবার রাজসিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া। তাতে ব্রিটেনের উপর জার্মানি ছড়ি ঘোরাতে পারবে। রাজা ষষ্ঠ জর্জের চেয়ে হিটলার-অনুরাগী এডওয়ার্ড নাৎসিদের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই প্রিয় ছিলেন। জার্মান অফিসাররা এডওয়ার্ডকে এও বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ষষ্ঠ জর্জ তাঁকে খুন করার ফন্দি আঁটছেন!
টেলিগ্রামগুলো থেকে জানা যায়, ডিউক এডওয়ার্ডকে আবার রাজা করার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস দুজনেই। একটা টেলিগ্রামে লেখা, ওয়ালিস এ নিয়ে খুবই ভাবিত। আর একটা টেলিগ্রামের ইঙ্গিত, ওয়ালিস রানি হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন: ‘জার্মানরা উইন্ডসরের ডিউক ও ডাচেসের সাহায্য কামনা করছে, ডাচেস যে কোনও মূল্যে রানি হওয়ার জন্য মরিয়া।’ অনেকগুলো টেলিগ্রামে বলা হয়েছে এডওয়ার্ডের নানান বিবৃতিও। একটাতে বলা, ‘এডওয়ার্ড নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি সিংহাসনে থাকলে বরং জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানো যেত’, আর একটাতে: ‘জার্মানির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়ার তিনি দৃঢ় সমর্থক।’
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ-এর গবেষক, ‘গো-বিটুইনস ফর হিটলার’ গ্রন্থের লেখক কারিনা আরবাক এই সব নথিপত্র দেখেশুনে জানাচ্ছেন, নাৎসিদের সঙ্গে এডওয়ার্ডের মজবুত আঁতাত ছিল। ২৫ জুন ১৯৪০ তারিখে স্প্যানিশ কূটনীতিক দন জেভিয়ার বারমেজিলোর সঙ্গে এডওয়ার্ডের কথোপকথনের একটা রিপোর্ট উদ্ধৃত করে তিনি জানাচ্ছেন এডওয়ার্ডের মন্তব্য— ইংল্যান্ডের উপরে বোমা ফেললেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। এই রিপোর্ট নাকি প্রথমে স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে, পরে জার্মানিকে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ১০ জুলাই জার্মানরা ব্রিটেনে প্রথম বোমা ফেলে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল, তখন এডওয়ার্ডকে ফ্রান্সে মেজর জেনারেল পদ দেওয়া হয়। তাতে কী, তিনি নাকি পাশাপাশি শত্রুপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন!
১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে হেগ শহরে এক জার্মান মন্ত্রীর লেখা থেকে পাওয়া যায়, তাঁর সঙ্গে এডওয়ার্ডের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে। তাঁর কাছ থেকেই জার্মানরা জানতে পারে, তাঁদের ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনার কথা মিত্রশক্তি জেনে গিয়েছে। হিটলার ব্যাপারটা জেনে তাঁর পরিকল্পনা বদলে ফেলেন। ফ্রান্সের পতন ঠেকানো যায়নি।
সাক্ষাৎ: ওয়ালিস ও এডওয়ার্ডের সঙ্গে হিটলার।
ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বুঝতে পেরেছিলেন, এডওয়ার্ড দেশের বাইরে থাকা মানে ইংল্যান্ডের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন এডওয়ার্ডকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। এমনকী এক পর্যায়ে এই ভয়ও দেখিয়েছিলেন, সুবোধ বালকের মতো দেশে না ফিরলে তাঁর কোর্ট মার্শাল করা হবে। শেষমেশ এডওয়ার্ডকে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের গর্ভনর করা হয়, যা এডওয়ার্ড বা ওয়ালিস দুজনের কারও মোটেই পছন্দ ছিল না। এডওয়ার্ডের ভাষায় বাহামা ‘থার্ড ক্লাস ব্রিটিশ কলোনি’। কিন্তু তাঁদের অপছন্দকে আমল দেওয়া হয়নি। বাহামা যাওয়ার আগে এডওয়ার্ড সস্ত্রীক স্পেন ও পর্তুগালে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের প্রায়শই জার্মান এজেন্টদের সঙ্গে দেখা যেত। লিসবনে এডওয়ার্ড থাকতেন এক ব্যাঙ্ককর্মীর বাড়িতে, যার সঙ্গে জার্মান দূতাবাসের ভাল যোগাযোগ ছিল।
বেচারা ডিউক আর ডাচেস! বিলাসিতা, শৌখিনতায় জীবন কাটানোয় অভ্যস্ত যাঁরা, বাহামায় আসার পর সেই তাঁদেরই উপরে চালু হল গুচ্ছের নিষেধাজ্ঞা। সুইডিশ ধনকুবের অ্যাক্সেল ওয়েনার-গ্রেন— যিনি হিটলারের বিশ্বস্ত সেনাপতি হার্মান গোয়েরিং-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে খবর ছিল— তাঁর প্রমোদতরীতে তাঁরা নৌবিহারে যেতে পারবেন না, এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। ১৯৪১-এর এপ্রিলে যখন এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস আমেরিকার ফ্রোরিডার পাম বিচ-এ যান, এফবিআই কড়া নজর রেখেছিল তাঁদের উপরে। এফবিআই মনে করত, এই দম্পতিকে নাৎসিরা গোপন তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগাচ্ছে, যাতে মিত্রশক্তির যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
বাকিংহাম প্যালেস নিয়ে বানানো একটি তথ্যচিত্র সম্প্রতি আর্কাইভ থেকে পাওয়া গিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এডওয়ার্ডের পাশে দাঁড়িয়ে খুদে রাজকুমারী এলিজ়াবেথ নাৎসি স্যালুট দিচ্ছে! নিশ্চয়ই এডওয়ার্ডই তাঁকে শিখিয়েছিলেন এই স্যালুট, অত ছোট মেয়ের পক্ষে ও জিনিস কী তা জানা সম্ভব নয়।
দেশের মন্ত্রীদের ডিঙিয়ে এডওয়ার্ড চেয়েছিলেন সরাসরি ব্রিটেনের জনগণের কাছে আবেদন করবেন যে তিনি সিংহাসনে রাজা হয়েই থাকবেন, ওয়ালিসকে বিয়ে করবেন। স্ট্যানলি বল্ডউইন সে প্রস্তাব সংবিধানবিরোধী বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তিনি এডওয়ার্ডকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন যে ব্রিটেনবাসী কোনও অবস্থাতেই ওয়ালিসকে মেনে নেবেন না।
যুদ্ধের পরে ফ্রান্স এডওয়ার্ড ও ওয়ালিসকে আমন্ত্রণ জানায় তাঁদের দেশে বসবাসের জন্য। প্রস্তাব গ্রহণ করেন এই দম্পতি। খুব সামান্য ভাড়ায় এডওয়ার্ড ও তাঁর স্ত্রী একটি বিরাট বাড়িতে থাকতেন। কোনও কর দিতে হত না তাঁদের। এই বাড়িতেও অতিথি সমাগমের শেষ ছিল না। তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ ফ্যাসিস্ত লিডার স্যর অসওয়াল্ডের স্ত্রী ডায়ানা মোসলি-র ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের বাড়িতে বসেও এডওয়ার্ড ভুলতে পারেননি তাঁর ফেলে আসা দেশকে। ভুলতে পারেননি তাঁর সিংহাসন হারানোর যন্ত্রণা। বিশেষ করে রাজপরিবারের খবরের দিকে চোখ থাকত তাঁর। ভাই আলবার্ট মারা গেলে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন এডওয়ার্ড। সাক্ষী ছিলেন আলবার্টের মেয়ে রাজকুমারী এলিজ়াবেথের রাজ্যাভিষেকের।
অনেক পরে তাঁর স্মৃতিকথায় এডওয়ার্ড স্বীকার করেছিলেন যে তিনি জার্মানদের অনুরক্ত ছিলেন। তবে তিনি নাৎসিপন্থী ছিলেন, সে কথা অস্বীকার করেছেন। ১৯৬০-এর দশকে নাকি তাঁর বন্ধু প্যাট্রিক বালফোরকে একান্তে বলেছিলেন ‘‘আমি ভাবতেই পারিনি যে হিটলার এত খারাপ একটা লোক।’’ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭২ সালে প্যারিসে মারা যান এডওয়ার্ড। তাঁর দেহ উইন্ডসরে নিয়ে আসা হয়। ওয়ালিসও সেই সময় লন্ডনে এসেছিলেন, ছিলেন বাকিংহাম প্যালেসেই। জীবনের শেষ দিকে ওয়ালিস ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ তাঁকে ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের ২৪ এপ্রিল প্যারিসে নিজের বাড়িতে মারা যান ডাচেস অব উইন্ডসর ওয়ালিস। উইন্ডসর কাসল-এর সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় তাঁর স্বামী এডওয়ার্ডের পাশেই। উপস্থিত ছিলেন রানি এলিজ়াবেথ, ডিউক অফ এডিনবরা, প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানা। রাজপরিবার জীবনে তাঁকে গ্রহণ করেনি, শেষযাত্রাটুকুতে সঙ্গী ছিল কেবল।
সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলেই হবে হ্যারি আর মেগানের বিয়ে। এখানেই যে এডওয়ার্ড আর ওয়ালিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও হয়েছিল, তা মনে রাখেনি কেউ। আনন্দ, উৎসবই তো মনে রাখে মানুষ। দুটো বিয়েই ইতিহাসে থেকে যাবে। একটা বিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। আর একটা হয়তো রাজপরিবারের ইতিহাসকে নিয়ে যাবে নতুনের পথে, আধুনিকতার দিকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy