Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কবির অভিমানী মেয়ে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় সন্তান রেণুকা। যেমন দুরন্ত, তেমনই কোমল ও সংবেদনশীল। আচমকা দশ বছর বয়সে তাকে বসতে হল বিয়ের পিঁড়িতে। বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সে দিন রেণুকা একটি কথাও বলেনি। মাত্র বারো বছর বয়সে মারা গিয়েছিল সে। আকস্মিক বিয়ের প্রস্তুতি রানীর হৃদয় থেকে যেন প্রাণবায়ু শুষে নিয়েছিল। দুরন্ত ছোট্ট মেয়েটা একেবারে কুঁকড়ে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল।

সন্ততি: সামনে বাঁ দিক থেকে শমীন্দ্রনাথ, বেলা ও মীরা। পিছনে দাঁড়িয়ে রানী

সন্ততি: সামনে বাঁ দিক থেকে শমীন্দ্রনাথ, বেলা ও মীরা। পিছনে দাঁড়িয়ে রানী

অতনুকুমার বসু
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২০ ০২:০২
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত কবির তৃতীয় সন্তান রেণুকা বা রানী। রানীর জন্ম ১৮৯১-এর ২৩ জানুয়ারি। বিবাহ ১৯০১-এর ৯ অগস্ট, তখন রানী ১০ বছর ৬ মাস ১৭ দিন। অকালমৃত্যু— ১৯০৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর। এই বারো বছর সাত মাস আয়ুষ্কালে রানী আলোচিত শুধু তার জীবনের অন্তিম লগ্নটুকুর জন্য। যখন কবি তাকে নিয়ে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন শান্তিনিকেতন-আলমোড়া-জোড়াসাঁকো। কবির তখন সদ্য পত্নীবিয়োগ হয়েছে। তার পর আবার একটি বিয়োগব্যথার আশঙ্কায় তিনি আকুল। শমীর বেঁচে থাকা রানীর তুলনায় কম হলেও রবিজীবনে শমী বহু ভাবে উল্লিখিত। তাই অল্প আয়ুকে রানীর উপেক্ষিত হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় না।

রানী ছোটবেলা থেকে ছিল অত্যন্ত দুরন্ত, জেদি অথচ তার মন ছিল অদ্ভুত সংবেদনশীল। তার সম্বন্ধে বলা হত, সে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আবহাওয়ার সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়। যেমন, দাদা রথীন্দ্রনাথের প্রতি তার একমাত্র অধিকারকে রানী মাত্রাতিরিক্ত ভাবে প্রকাশ করত। রথীকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখলেই রানী প্রবল ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার উপর— ‘যদি দেখলে খোকা কোথাও চুপচাপ শুয়ে আছে অমনি তার ঘাড়ের উপর পড়ে তার মুখের উপর মুখ রেখে তাকে চুমো খেয়ে তার চুল টেনে তাকে মেরে তার প্রতি ভয়ানক সোহাগের উৎপীড়ন আরম্ভ করে দেয়।’ রথীর ঘুমনোর উপায় ছিল না। রানী দেখতে পেলেই ঠেলাঠেলি, টানাটানি করে তুলে দিয়ে মারপিট জুড়ে দিত। তবে বোনের প্রতি দাদার আদরের তাতে এতটুকু খামতি হত না। খোকার অনুনয়— ‘রানী, আমাকে একটু ঘুমোতে দে’— রানীর দস্যিপনায় বিন্দুমাত্র ছাপ ফেলতে পারত না। আবার কোনও রকমে ছাদে উঠতে পারলে তেজি ঘোড়ার মতো রানী ছাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে বেড়াত।

রানীর এই দুরন্তপনা কবির লেখাতেও নিজস্ব স্থান আদায় করে নিয়েছে। সেই সময়ে ইন্দিরা দেবীকে লেখা কবির এক চিঠি থেকে জানা যায়,

‘...রেণুকা কোনোপ্রকার ব্যক্তশব্দে আপন মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না। দিবানিশি নানা প্রকার অব্যক্ত ধ্বনি উচ্চারণ করছে, এবং তাকে সামলে রাখা দায় হয়েছে।’ কবি আবার অন্যত্র বলেছেন, ‘নবদ‌ন্তোদ্গতা রেণুকা সমস্ত বিশ্বসংসার তিনি গালে দিতে পারেন।’ পত্নী মৃণালিনী দেবীর প্রসঙ্গ টেনে এনেও কবি একই অনুযোগ করেছেন, ‘... তার সমস্ত উপদ্রব এমন সহিষ্ণুভাবে সহ্য করে যায় যে, অনেক মা-ও তেমন পারে না।’ এহেন মৃণালিনী দেবীও শেষ পর্যন্ত তাঁর অসন্তোষ গোপন করেননি— ‘কি ছিষ্টিছাড়া মেয়ে জন্মেছে, আর পারি নে বাপু।’ লেখাপড়ার সময়ও রানীর আচরণে কোনও রকম পরিবর্তন লক্ষ করা যেত না। দিদি মাধুরীলতা লিখেছেন, ‘রাণীকে পড়াতে আমার খুবই ইচ্ছে করে, কিন্তু আমরা দু’জনেই অধৈর্য্য, একটুতে বিরক্ত হয়ে পড়ি। অনেক চেষ্টা করে ওকে আমি ৬/৭ দিন পড়িয়েছি কিন্তু আর পেরে উঠলাম না। ও গড়াতে ২ হাঁই তুলতে ২ পড়বে, আমার তা ভালো লাগে না। আর ওরও সে পড়াটা মনে থাকে না।’

তবে রানীর প্রতি বিশেষ স্নেহ ও ভালবাসা ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দেবীর। সবাই যখন ওর দস্যিপনা নিয়ে অভিযোগ করত, তখন অমলা দেবী সবার সামনেই বলতেন, ‘কাকিমা আপনারা কেউ ওকে বোঝেন না— ওর মধ্যে একটা মহাপ্রাণ আছে আপনারা কেউ তা দেখেন না।’

তবে এই একরত্তি দস্যি মেয়েটির মধ্যে ব্যতিক্রমী লক্ষণ তার শৈশবের কয়েকটি আচরণেও আমরা লক্ষ করি। যেমন, রান্নাঘরে দু’টো বড় জ্যান্ত কাতলা মাছ দেখে যখন সবাই উৎফুল্ল, তখন রানীর আর্ত চিৎকারে সকলেই ভীষণ অবাক হয়ে যেতেন।

‘ও মা মাগো, ওই মাছ তোমরা খাবে? ওরা যে এখনও বেঁচে আছে’— দু’হাত মুখে দিয়ে রানীর সে কী কান্না! থামানোই মুশকিল হত। আর এক বার ঠাকুরবাড়ির এক পোষা পাখি মারা যাওয়াতেও রানীর প্রবল অস্থিরতা ও গুমরে গুমরে কান্না সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল।

রানীর মন ছিল খুব কোমল ও গভীর অনুভূতিপূর্ণ। রানী তখন মৃত্যুশয্যায়, কবি আলমোড়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন। জীবনের এই অন্তিম লগ্নেও লখনউ স্টেশনে এক জন খেলনাওয়ালাকে দেখে হঠাৎ রানীর ছোট বোনের কথা মনে পড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ছোট বোন মীরার জন্য সেই বিক্রেতার কাছ থেকে এক বাক্স খেলনা সংগ্রহ করে যত্ন করে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে আসে। তার পর বোনের হাতে সেই খেলনা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। মীরা দেবী স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘রানীদি কলকাতায় এসেছেন শুনে দেখতে গিয়েছিলুম। সে কী জীর্ণ শীর্ণ চেহারা ও ম্লান হাসি, আজও তা ভুলতে পারিনি। তাঁর ঠান্ডা হাতখানি বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডেকে এক বাক্স খেলনা দিলেন— কলকাতায় আসবার সময় লক্ষনৌ স্টেশনে কিনেছিলেন আমার কথা মনে করে।’

সাজগোজ, পোশাকের ব্যাপারেও রানীর কোনও আগ্রহ ছিল না। খুব ছিমছাম, সাদাসিধে থাকতে পছন্দ করত। মাছ-মাংস ভালবাসত না। চুল বাঁধতেও ভীষণ আপত্তি ছিল। দাদা রথী আর অমলা দেবী ছাড়া রানীর বিশেষ সখ্য ছিল জেঠতুতো দাদা নীতীন্দ্রনাথের সঙ্গে। সেই ‘নীদ্দা’ রানীর এক জন্মদিনে নামকরা দোকান ‘হোয়াইটওয়ে লেডল’ থেকে প্রিয় বোনের জন্মদিনে নিয়ে এসেছিলেন লেস ফ্রিল দিয়ে সাজানো সিল্কের দামি ফ্রক। রানী সেই ফ্রক পরে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর পর— ‘পটপট করে লেসগুলো ফ্রিলগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ফ্রকটা টেনে গা থেকে খুলে ফেলে ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।’ রানীর প্রতিক্রিয়ায় উপস্থিত সকলেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। রানীর অভিযোগ ছিল, ‘আমি এসব ভালোবাসিনে, আমার কষ্ট হয় এসব পরতে, তবু কেন আমাকে জোর করে পরানো হয়?’

এমনই ছটফটে, প্রতিবাদী, অন্য রকম মেয়েটি একেবারে নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তার বিয়ে নিয়ে কবির আকস্মিক সিদ্ধান্তে। বড় মেয়ে মাধুরীলতা অর্থাৎ বেলার বিয়ের দেড় মাসের মাথাতেই মাত্র দু’-তিন দিনে কবির এই তড়িঘড়ি আয়োজনে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কবির লেখা একটি চিঠি থেকেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘আজ আমার মধ্যমা কন্যা শ্রীমতী রেণুকার বিবাহ। পাত্রটি মনের মত হওয়ায় দুই তিন দিনের মধ্যেই বিবাহ স্থির করিয়াছি।’ খুবই অবাক হয়েছিলেন কবিপত্নীও। কবিকে বলেছিলেন, ‘তুমি বল কি গো? এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ে তুমি দেবে?’ মীরা দেবীও পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সব মেয়ে ঘরসংসার করবার মন নিয়ে জন্মায় না। রানীদি হলেন সেই ধরনের মেয়ে।

বাবা যদি রানীদিকে অল্প বয়সে বিয়ে না দিয়ে লেখা-পড়া করাতেন তা হলে বোধ হয় ভালো করতেন।’ অথচ কবির যুক্তি ছিল, ‘রানীর যেরকম প্রকৃতি— বাপের বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই ও শুধরে যাবে...’

আকস্মিক বিয়ের প্রস্তুতি রানীর হৃদয় থেকে যেন প্রাণবায়ু শুষে নিয়েছিল। দুরন্ত ছোট্ট মেয়েটা একেবারে কুঁকড়ে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবাদী স্বভাব ছিল তার, তবু এই বিষয়ে একটি শব্দও কখনও উচ্চারণ করেনি সে। বাবার প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ করেনি কখনও। আসলে এই বিপরীতধর্মী আচরণই যেন ছিল তার প্রতিবাদের নীরব গর্জন।

এই আকস্মিক আঘাত সামলে নেওয়ার আগেই আর একটি কষ্ট রানীকে তোলপাড় করে দেয়। তার একমাত্র আশ্রয়স্থল, মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যু। উপর্যুপরি দু’টো চরম আঘাত সামলানোর মতো প্রাণশক্তি রানীর ছিল না। মা ছাড়া যিনি সবচেয়ে স্নেহের চোখে দেখতেন সেই অমলা দেবী বলেছেন, ‘এই শোকটা সবচেয়ে ওরই (রানীর) বেশী লাগবে। ও মেয়ে ভারি সহজে কাতর হয়ে পড়ে। বেলার ঘর-সংসার হয়েছে, স্বামীর ও তার আত্মীয়দের জন্য একটা টান হয়েছে, শাশুড়ি আছে মায়ের অভাব কিছু পূরণ করবে। মীরা ও শমী ছোট, অভাব অনুভব করবার ক্ষমতা তাদের এখনও ভাল করে হয়নি। রথী হাজার হলেও ছেলে— লেখাপড়া নিয়ে নানা কাজে কথায় ভুলে থাকবার অবসর আছে। আমার বোধ হয় রানীর সবচেয়ে কষ্ট হবে।’

কবি তখন অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ছুটেছেন আলমোড়ায়। পাইন গাছের শান্ত, নিবিড় ছায়ায় যক্ষ্মাক্রান্ত রানীকে সুস্থ করার চেষ্টায়। সেখানেই লিখে ফেলেন ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা। তার পর রানীকে সেই কবিতা শোনাতেন, চেষ্টা করতেন যাতে রানী অল্প সময়ের জন্য হলেও রোগযন্ত্রণা ভুলে থাকে। বাবার এ রকম সান্নিধ্যে রানী আনন্দ পেত। একটু সুস্থ বোধ করত। তবে ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের ১৪টি কবিতা আলমোড়াতে লেখা হলেও রানী সেখানে আশ্চর্য রকম ভাবে অনুপস্থিত। এমনকি বাকি ৩৬টি কবিতাতেও রানীর কোনও উল্লেখ নেই। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতা জুড়ে বরং আছে সদ্য মাতৃহারা সন্তানের মর্মবেদনা। কিন্তু মাতৃহারা রুগ্ণ মেয়েটির মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর মুখটি কোথাও ভেসে ওঠেনি। ভেসে ওঠেনি এক দুরন্ত, অবুঝ হৃদয়ের অসহায় আত্মসমর্পণের কথা। কবিও কি কিছু আড়াল করতে চেয়েছিলেন? মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে এই অসহায় মেয়েটির আর্তনাদ কি অসহায় পিতৃহৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল? তাই কি কেবল একটি বার সঙ্গোপনে বলে ফেলেছিলেন নিজের মনের কথা, ‘থামো, থামো, ওর কাছেতে/ কোয়ো না কেউ কঠোর কথা,/ করুণ আঁখির বালাই নিয়ে/ কেউ কারে দিয়ো না ব্যথা।/ সইতে যদি না পারে ও,/ কেঁদে যদি চলে যায়—/ এ ধরণীর পাষাণ-প্রাণে/ ফুলের মতো ঝরে যায়।/ ও যে আমার শিশির কণা,/ ও যে আমার সাঁঝের তারা—/ কবে এল কবে যাবে এই ভয়েতে হই যে সারা।’

রানীর মৃত্যু এই সমস্ত প্রশ্নকে নিস্তব্ধ, নিথর করে দিয়েছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Rani
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy